ভুলোনা আমায় – পর্ব ১৩

0
184

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-১৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সকালের মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। অন্ধকারের রেশটুকু নেই আর। পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে একটুকরো রোদের সোনালী আলো বার বার টুসি’র মুখশ্রী জোরে খেলে যাচ্ছে।টুসি হাত দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বাধা মানছে না।তাই বিরক্ত হয়ে চোখ খুললো। দেয়াল ঘড়িতে সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট, শ্বাশুড়ি মাকে নাস্তা তৈরি করায় সাহায্য করবে বলে উঠতে নিলে সোহান কে লক্ষ্য করে সে।সোহান ঘুমিয়ে আছে তার যেন ঘুম ভেঙ্গে না যায় তাই। খুব সন্তর্পণে উঠে গেল টুসি।টুসি উঠতেই সূর্যের আলো সোহানের উপর পরলো।তাই পর্দা টেনে দেয় টুসি।
তারপর বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কিচেনে যায়।
রোকেয়া বেগম টুসি কে দেখে কটুক্তি করে বললেন, “ঘুম তাহলে ভাঙ্গলো মহারানীর”?

টুসি পাল্টা জবাব না দিয়ে বললো,
— আম্মা আমাকে বলুন কি করতে হবে?
(সোহান টুসি’কে বলেছে তার আম্মা কে টুসিও যেন আম্মা বলে ডাকে)

রোকেয়া বেগম মনে মনে খানিক খুশি হলেন, কেননা তিনি পাল্টা জবাব পছন্দ করেন না। তিনি সারাদিন বকাঝকা নানান ধরনের কথা বলবেন কিন্তু এর পাল্টা জবাব দিলেই মুশকিল।তার ছেলে মেয়েরাও এ ব্যাপারে অবগত আছেন।যাই হোক টুসি’কে বললেন রুটি বেলার জন্য।টুসি পারুক আর না পারুক বসেছে রুটি বেলার জন্য। খুব কষ্ট করে বেলে চলেছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। একেকটা রুটি মানচিত্রের আঁকার ধারণ করছে। রোকেয়া বেগম ডিম,আলু একসাথে মাখো মাখো করে ভাজি করছেন আর টুসি’র দিকে আড়চোখে দেখছেন। মনে মনে ঠিক করলেন এই রুটিই আজকে সবাইকে খাওয়াবেন। তাহলে যদি টুসি’র কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

রুটি বেলা অর্ধেক শেষ হয়ে এলে মেহুল আসে। এসে বলে,ভাবী আমাকে দাও আমি তৈরি করে দিচ্ছি?
টুসি কিছু বলার আগেই রোকেয়া বেগম বললেন,
— ও করছে করুক। তুই অন্য কাজ কর।
— কি করবো বলো?
— ডাইনিং টেবিলে নাস্তার প্লেট গুলো সাজিয়ে রাখ।আর খাবার পানি আছে কিনা দেখ, না থাকলে পানি নিয়ে রাখ।
.
খাবার তৈরি হয়ে এলে রোকেয়া বেগম বললেন,
— টুসি যা গিয়ে সোহান কে আসতে বলে আয়।আর মেহুল তুই গিয়ে আরমান কে ডেকে আন।

দু’জনেই আচ্ছা বলে চলে গেল।

টুসি সোহানের পাশে বসে আলতো হাতে বাহুতে ছুঁয়ে বললো,
— এই যে শুনছেন? আম্মা খাবার খাওয়ার জন্য যেতে বলছে। উঠুন তারাতাড়ি আম্মা আবার রাগ করবেন।

সোহান ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
— তুমি উঠে চলে গেলে কেন? আজকের দিনটা তো আমার সাথে সারাক্ষন থাকতে পারো?
— আম্মা যে রাগ করবেন তাই গিয়েছি।
— আজকে আমি চলে যাব তাই আম্মা কখনোই রাগ করতেন না।

টুসি’কে পাশে শুয়ে দিয়ে মুখ গুঁজে রাখে সোহান। এদিকে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয় টুসি! কিচেনে যেতেই রোকেয়া বেগম বললেন, “ঘুম তাহলে ভাঙ্গলো মহারানীর”!
তাহলে এমন ধারা কথা কেন বললেন তার শ্বাশুড়ি আম্মা?টুসি’র ছোট্ট মাথায় ঢুকছে না মা ছেলের কথা।

টুসি’কে নিঃশব্দ থাকতে দেখে সোহান বললো,
— চুপ করে আছো যে?কি এমন ভাবনায় মগ্ন তুমি?
— তেমন কিছু না, উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে চলুন। আম্মা নিশ্চ‌ই অপেক্ষা করছে।

সোহান আর বিলম্ব না করে ফ্রেশ হতে চলে গেল।টুসি উঠে বিছানা গুছিয়ে রেখে বড় করে ঘুমটা টেনে ডাইনিং রুমে গেলো।তার দেবর বাসায় এসেছে খুব সন্তর্পণে চলাফেরা করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মহিলাদের নিকট একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসার জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! দেবরদের ব্যাপারে কি নির্দেশ? তিনি উত্তর দিলেন, দেবর তো মৃত্যুতুল্য।[১]

আরমান টুসি’কে দেখতে পেয়ে বললো,
— আসসালামু আলাইকুম।ভাবী কেমন আছেন?

টুসি নিচু কন্ঠে বললো,
— ওয়ালাইকুমুস সালাম।জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ভাইয়া আপনি কেমন আছেন?
— আল্লাহ রাখছে ভালোই। ভাইয়া কোথায় আসে না খেতে?
— জ্বি এক্ষুনি আসবে।

তারপর সোহান আসলে সবাই এক সাথে খেতে বসে। খাবার খাওয়া শেষে সবাই মিলে আরমানের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করে। সোহান তার ভাইকে বলে দেয় স্ত্রীর সাথে যেন সদা ভালো ব্যাবহার করে। মায়ের এবং কি পরিবারের খেয়াল রাখতে। আরমান বলে, ইনশা আল্লাহ সর্বদা চেষ্টা করবো।আর রোকেয়া বেগম কে ও বললো,
— ব‌উদের সাথে রাগারাগী না করে স্নেহের মায়ায় বুঝিয়ে যেকোনো বিষয়ে কথাবার্তা বা কাজ করানো।যাই করার করতে, রাগারাগী করলে হিতে বিপরীত হয় ভালো কিছু হয় না।

তারপর শেষ মুহূর্ত গুলো টুসি’র সাথে কাটাতে রুমে চলে আসে।টুসি মলিন মুখে বসে আছে, সোহান পাশে বসে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে বললো,
— তোমার এমন মলিন মুখশ্রী দেখে গেলে আমার ভালো লাগবে বলো?
— আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন প্লিজ?
— তা তো এখন সম্ভব নয়। তবে দেশে ফিরে তোমাকে নিয়ে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেশে ঘুরতে যাবো ইনশা আল্লাহ।

টুসি নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে।তার এখন থেকেই বড্ড একা একা মনে হচ্ছে। এতো গুলো কিভাবে কাটাবে জানে না সে।
সোহান টুসি’র থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে, দেখতে পায় টলমলে আঁখিপল্লব দুটো। দুই হাত দিয়ে গাল দুটো আঁকড়ে ধরে নিজের অধরপল্লব ছুঁয়ে দেয় টুসি’র আঁখিপল্লবে।
পুনরায় টুসি’কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,
— খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো আমি ইনশা আল্লাহ। ততদিনে তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো কেমন? নিজেকে পূর্ণ পর্দায় ঢেকে রেখো তোমার স্বামীর জন্য। মনে রাখবে তুমি শুধুমাত্র তোমার স্বামীর জন্য। কোন লোভাতুর দৃষ্টি পরতে দিও না নিজের উপর।
আম্মার সাথে কখনো খারাপ আচরণ করো না, তাহলে আমি সহ্য করতে পারবো না। কখনো আম্মার অবাধ্য হ‌ইয়ো না। আম্মা তার মুখে মুখে তর্ক পছন্দ করেন না।কিছু বললে শুধু শুনে থাকবে প্রতিউত্তর করবে না।আম্মা কোন অন্যায় করলে আমাকে বলবে আমি আম্মাকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি কিছু বললে হিতে বিপরীত হবে।

মন খারাপ হলে বাবার বাড়ি ঘুরে আসবে গিয়ে। তাছাড়া ফোনে কল করে কথা বলবে।রাতে একা ঘুমাতে ভয় পেলে মেহুল কে নিয়ে ঘুমাবে। রাস্তা ঘাটে গাড়ি দেখে শুনে রাস্তা পার হবে। আগের মত বৃষ্টিতে ভিজবে না।
ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করবে, খাবার ঠিক মত খেলে জ্ঞান বাড়বে বুদ্ধি বাড়বে, সুস্থ থাকবে।যখনি আমার কথা মনে পরবে তখন আমাকে মেসেজ দিবে। আমি ফ্রি থাকলে কল করবো।
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে, সোহানের র‌ওনা হ‌ওয়ার সময় হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা সাতটায় ফ্লাইট। টুসি মলিন মুখে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দিচ্ছে। রোকেয়া বেগম এসে তারা দিয়ে বললেন,বাপ আগে আগে পৌঁছে যাওয়া ভালো। বৃষ্টিবাদলের দিন তার উপর ঢাকা শহরে কতো যাটযট লেগে থাকে।

সোহান বললো,
— এই আম্মা হয়ে গেছে,বের হবো এক্ষুনি।

তারপর মায়ের হাতে টুসি’কে তুলে দিয়ে বললো,
— তোমরা একে অপরকে দেখে রাখবে। মনে রেখ তোমাদের একজন কে ছাড়া আমি অপূর্ণ।

দু’জনেই সোহানের কথায় সায় দেয়। রোকেয়া বেগম রুম থেকে বেরিয়ে গেলে শেষ বারের মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে টুসি’কে। তারপর টুসি’র মুখশ্রী’র বরাবর নিজের মুখশ্রী রেখে বললো,
— আদর করে দিবে না আমাকে?

টুসি দুই হাত দিয়ে সোহানের গাল দুটো আঁকড়ে ধরে সারা মুখে নিজের অধরপল্লব ছুঁয়ে দেয়। এরপর সোহান পাগলের মত চুমু এঁকে দেয় টুসি’র মুখশ্রী’তে। এতে টুসি শব্দ করে কেঁদে দিয়ে জড়িয়ে ধরে সোহান কে।
সোহানের চোখ দুটো লাল রঙা ধারন করেছে। ভিশন কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু যেতে হবে তাকে তাই চলে গেল। রোকেয়া বেগম,মেহুল বাড়ির গেইট অবধি পৌঁছে দিতে এলেন। তাদের চোখেও পানি স্পষ্ট। আরমান সাথে গেল পৌঁছে দিতে।
.
.
সোহান চলে গেলে টুসি ফ্লুরে বসে বিছানায় মাথা রেখে কাঁদে। খুব করে বিয়ের প্রথমের দিন গুলো মনে পরছে। মানুষটা তার এতো কাছে থেকেও কতোই না অবহেলা করেছে সে।আজ যখন ভালোবাসা বুঝতে শিখেছি তখন মানুষটা চলে গেল দূর দেশে। ফিরবে কবে তার কোন ঠিক ঠিকানা আজো জানে না টুসি।

কয়েকদিন যাবত অতি কষ্টে শূন্যতায় ডুবে আছে টুসি। পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছে না।বার বার সোহানের বচন ভঙ্গি গুলো মনে পরছে।
এদিকে সোহান পৌঁছে কল করে জানিয়েছে ঠিকই কিন্তু কাজে নতুন জয়েন করার জন্য আর কল করার সুযোগ পায়নি। নতুন অবস্থায় কোম্পানিতে জয়েন করে সমস্ত কাজ বুঝে নিচ্ছে যার ফলে ভিশন ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে।
টুসি মেসেজ দিলে খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা মেসেজের রিপ্লাই দেয় এটুকুই। তবে খুব শীঘ্রই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে বলেছে ইনশা আল্লাহ।

বাসায় চলছে ছোট ছেলের বিয়ের তোরজোর। রোকেয়া বেগম ঘরদোর মানুষ নিয়ে সাজাতে ব্যস্ত। আত্মীয়-স্বজন আসবে বলে কথা। সোহান বলেছিল বেশি তোরজোর না করতে যেন মেয়ের বাবার খরচ কম হয়। কিন্তু রোকেয়া বেগম তার বড় ছেলের বিয়ে ছোট করে দিলেও ছোট ছেলের বিয়ে দুমদাম করে দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

টুসি সারাক্ষণ নিজের রুমে থাকে বলে, মনে মনে টুসি’র প্রতি খুব বিরক্ত রোকেয়া বেগম।যদিও কাজ কর্ম সব মানুষজন দিয়ে করাচ্ছে তাও।
.
.
বিয়ের কিছুদিন হতেই ছোট ব‌উয়ের কাজ কর্মে বেশ সন্তুষ্ট রোকেয়া বেগম। কথায় কথায় ছোট ব‌উয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি। এদিকে একটা বিশেষ কারণে টুসি’র প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে তার….
_________
রেফারেন্স:-
[১] (বুখারী পর্ব ৬৭ অধ্যায় ১১২ হাদীস নং ৫২৩২; মুসলিম ৩৯/৮, হাঃ ২১৭২)
__________

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here