ভুলোনা আমায় – পর্ব ১৪

0
227

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-১৪
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মালয়েশিয়ায় ব্যবসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা বেশ এগিয়ে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী এখানে বেশ শক্ত অবস্থানে আছেন।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি বস্ত্রশিল্পের চাহিদা অনেক বেশি।

ইউনিক্লো, এইচ অ্যান্ড এম, জারা, লিভাইস, সুপার ড্রাই ইত্যাদি ব্র্যান্ড এর পোশাক আসে বাংলাদেশ থেকেই। এছাড়াও বাংলাদেশি গার্মেন্টস এর স্টক লট এর বিশাল চাহিদা এই মালয়েশিয়ায়।

সেরকম ই ব্র্যান্ডের পোশাক ব্যবসায় সোহানের। তবে সেটা যৌথ মালিকানায় গঠিত। সোহান সহ আরো তিন জন মালয়েশিয়ায় এসেছে, এখানকার কোম্পানি দেখা শোনার দায়িত্ব পালন করবে তারা।
.
সোহান রাতের খাবার খেয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে লোকজনের ঘরের জানালা দিয়ে একটু একটু করে লাইটের আলো গুলো বাহিরে আলোকিত করে আছে। এমন লক্ষাধিক ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে বের হ‌ওয়া আলো গুলো বেশ চমৎকার লাগছে তার কাছে।এই মুহূর্তে পাশে যদি টুসি থাকতো তাহলে মন্দ হতো না। মূহূর্তটা আরো মোহনীয় হয়ে উঠতো।
সোহান আর কালবিলম্ব না করে ফোন অন করে।অন করতেই টুসি’র মেসেজের নোটিফিকেশন দেখতে পায়।তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলে যায়। তারপর দেখে টুসি’র হোয়াটসঅ্যাপ এ অনলাইন সো করছে তাই কল করে, সাথে সাথে ওপাশ থেকে রিসিভ করা হয়। খুব বিচলিত কন্ঠে বলে,
— আপনি এখন কল করবেন আমি ভাবতেই পারিনি জানেন!

সোহান হাসি দিয়ে বললো,
— আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়াবারাহ কাতু।
— ওহ্ সরি, ওয়ালাইকুমুস সালাম।
আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়াবারাহ কাতু
— আসলে আপনার কল দেখে খুব এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম তাই সালাম দিতে ভুলে গিয়েছি।
— আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই, আমি বুঝতে পেরেছি। কেমন আছো তুমি?আর কি করছিলে তুমি?
— আপনি যেমন রেখে গেছেন তেমনি আছি।আর পড়ার টেবিলে বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছিলাম। আপনি কেমন আছেন বলেন?
— আমি যেমন রেখে গেছি মানে কি? এভাবে বলতে হয় না।বলবে আল্লাহ তা’আলার রহমতে ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।
— আপনি তো আমাকে ভুলেই গিয়েছেন, তাই এভাবে বলেছি।
— কাজের খুব চাপ ছিল তাই কল করতে পারিনি,তাই বলে কি ভুলে গিয়েছি? আমার পিচ্চি ব‌উটা কে কখনো কি ভুলিতে পারি আমি? কখনো ভুলবো না ইনশা আল্লাহ।
আচ্ছা বাসায় সবাই ঘুমিয়ে আছে তাই না?
— হুম সবাই ঘুমিয়ে আছে। রাতের খাবার খেয়েছেন আপনি?
— আলহামদুলিল্লাহ খেয়েছি তুমি?
— আমিও খেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
— আম্মা,মেহের, আরমান ওর স্ত্রী সবাই কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছেন।
— তো এখনো অবধি ঘুমাও নি কেন?
— ঘুম আসে না সে জন্য।
— আমি নেই বলে সব কিছুর অনিয়ম শুরু করে দিয়েছো? দেশে তো এখন বারোটা বেজে সামথিং ম্যাবি। প্রতিদিন এতো লেইট করে ঘুমাও নিশ্চ‌ই?তাই তো দেখছি ডার্ক সার্কেল পরে গেছে চোখের নিচে।

টুসি ঠোঁট কামড়ে ধরে, তার পর বলে,
— আপনাকে ছাড়া সব কিছু অসহ্য লাগে আমার। আমাকে আসক্ত করে দিয়ে আপনি কেন চলে গেলেন?চলে আসুন ন?
— সময় হলে ঠিক চলে আসবো ইনশা আল্লাহ। সেদিন তোমাকে চমকে দিব।
আচ্ছা পড়াশোনা কেমন করছো? ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু! তোমাদের টেষ্ট এক্সামের বেশি দিন নেই হয়তো।

টুসি ঠোঁট উল্টে বলে আর একমাস আছে।বড় ভাইয়া এসে নিয়ে যাবে বলেছে।
— আচ্ছা খুব ভালো, এটা তো তোমার স্কুলে দিতে হবে।
— হুম।
— আচ্ছা ঘুমাও এখন রাত বেড়ে যাচ্ছে।ফজর নামায পড়ে মেসেজ দিও আমাকে কেমন?
— ইনশা আল্লাহ।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকে সোহান।টুসি লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে। সোহান হাসি মুখে বিদায় নেয়।
.
.
সকাল বেলা মেহুল আর টুসি স্কুলে যাবে বলে তৈরি হয়ে এসে খেতে বসে। তখন আরমান এর ব‌উ মিরা বলে,
— ভাবী ভোর বেলায় উঠে আমাদের তো একটু সাহায্য করে তারপর স্কুলে যাইতে পারেন?

মেহুল তখন বলে,
— ছোট ভাবী আমাদের সামনে পরীক্ষা জানোই তো? দু’জনেই নামায পড়ে পড়াশোনা করেছি। কিছুদিন একটু ম্যানেজ করে নাও প্লিজ?

মিরা দারাজ গলায় বললো,
— আমি ও তো পরীক্ষা দিয়েছি তাই বলে কি মায়ের সাথে কাজকর্ম করিনি? তাছাড়া ভাবী এ বাড়ির বড় বউ, তার দায়িত্ব আমার থেকে বেশি অথচ তিনি কিছুই করেন না।

মিরা এ বাসায় আসার কিছুদিন পর থেকেই তার এমন চেটাং চেটাং কথা শুরু হয়। বয়সে টুসি’র থেকে বড় বলে কখনোই সম্মান করে কথা বলে না। অথচ সম্পর্কে সে টুসি’র ছোট, সবটা হয়েছে রোকেয়া বেগম এর প্রশ্রয়ে। মিরা এমন ধারা কথা বললে তিনি যেন খুশি হন। কারণ লোকলজ্জার ভয়ে নিজে কিছু বলতে পারেন না তো তাই।
টুসি’র বাড়ি থেকে এখনো অবধি কোন টাকা পয়সা বা ফার্নিচার দিচ্ছে না বলে চাপা ক্ষোভ টুসি’র উপর। ছোট ব‌উয়ের বাড়ি থেকে কিছু দিতে না পারলেও ছোট ব‌উ ভালো কেননা ছোট ব‌উ তার কাজের পার্ফোমেন্স দিয়ে মন জয় করে নিয়েছে। কিন্তু টুসি বয়সে ছোট তার উপর নিজের বাড়িতে কোনো কাজ করেনি। রোজিনা বেগম শত বলেও একটা কাজ করাতে পারেনি।তাই কখন কি করতে হবে কিছুই জানে না টুসি।এর জন্য দিনকে দিন টুসি’র প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে রোকেয়া বেগম এর।

যাই হোক একজন টুসি’র পাশে ছায়া হয়ে থাকে। সে হল মেহুল, মায়ের মুখে মুখে তর্ক না করলেও ছোট ভাবীকে ছেড়ে কথা বলে না মেহুল।
.
টুসি আর মেহুল স্কুল গেইট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে খেয়াল করলো সাবা’কে মাহফুজ আনাম স্যার ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন!
এতেই তারা দুজন বুঝে গেল আসলে এই দু’জনের দুজনার সাথে বিয়ে হয়েছে।

আসলে টুসি আর সোহানের ডিবোর্সের ঘটনার পর সাবা খুব ভেঙ্গে পরে।এর কিছুদিন পর মাহফুজ আনাম এর বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় সাবা’র মায়ের কাছে।সাবা নাকুচ করে বসে, কিন্তু তার মা হতে দেয়নি। এতো ভালো ছেলে সচরাচর পাওয়া মুশকিল তাই অনেক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সাবা কে রাজি করায় বিয়েতে।
বিয়ের পর একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে মাহফুজ আনাম কে দেখতে পায় সাবা।যে কিনা দুইটা পরিবারের সমান ভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছে আলহামদুলিল্লাহ। এমন একজনের সংস্পর্শে থেকে তাকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না সে। ধীরে ধীরে সব কিছু ভুলে সুন্দর সংসার করতে শুরু করে। বর্তমানে স্কুলে আসার পথে সাবা পায়ে হুচট খেয়ে মচকে যায়।তাই ব্যাথায় হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে বলে মাহফুজ আনাম ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

আলহামদুলিল্লাহ সাবা ও তার যোগ্য জীবন সঙ্গিনী পেয়েছে।সে জন্যই বলে একটা ভালো দিন পাওয়ার জন্য তোমাকে অনেকগুলো খারাপ দিনের সাথে লড়াই করতে হবে!

[ অবশ্যই তুমি পাবে, যা তোমার থেকে চলে গেছে তার চেয়েও উত্তম কিছু। ] [১]
.
.
হুজুর স্যার ক্লাসে বললেন, তোমাদের পরীক্ষা তো অতি নিকটে পৌঁছে গেছে।আশা করি ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয় নিয়ে তোমাদের সমস্যা থাকার কথা নয়। তবুও তোমাদের কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারো, ইনশা আল্লাহ আমি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করবো।

একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে বললো,
— শুনেছি নামায নামাযীকে বদ দু’আ দেয়,এটা কতটুকু সত্যি? এবং নামায কখন নামাযীকে বদ দু’আ দেয় এবং ধ্বংস কামনা করে?

হুজুর স্যার খুশি হয়ে বললেন,
— মা শা আল্লাহ অতি উত্তম প্রশ্ন। মনোযোগ দিয়ে শুনো,
যে ব্যক্তি মন্দভাবে নামায আদায় করে, সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখে না, ওযুও ভালরূপে করে না, রুকু সিজদাও ঠিকমত করে না, তার নামায বিশ্রী ও কালো হয়ে বদ দু’আ দিতে দিতে চলে যায় এবং বলে, আল্লাহ তা’আলা তোমাকেও এরূপ ধ্বংস করুক, যেমন তুমি আমাকে ধ্বংস করেছ। অতঃপর নামাযকে পুরানো কাপড়ের মত পেঁচিয়ে নামাযীর মুখে মেরে দেয়া হয়।[২]

উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা গেল, নামায যথাযথভাবে মাসআলাসহ আদায় করা অপরিহার্য। নামাযের মাসআলা বলতে অযু, রুকু, সিজদা, নামাযের আরাকান, আহকাম যথাযথভাবে অর্থাৎ উত্তমরূপে সম্পাদন করতে হবে। আওয়াল ওয়াক্তে নামায আদায় করতে হবে। নামাযের মধ্যে মনোযোগ আনতে হবে। এককথায় বলা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত উত্তম সালাত নিশ্চিত করতে হবে। মাসআলা ছাড়া নামায পড়লে সে নামায মহান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।

এমন আরও কিছু প্রশ্ন করলো ছাত্র ছাত্রী’রা।টুসি মনোযোগ দিয়ে শুনছে।আর ভাবছে তাকে ও তার স্বামীর মতো নামাযে মনোযোগী হতে হবে। সোহান সব সময় বলে সব কিছুর উর্ধ্বে যেন নামায থাকে। কোন কিছুর বিনিময়ে নামায আদায় থেকে বিরত যেন না থাকে টুসি।টুসি তার স্বামীর কথা মেনে চলার চেষ্টা করে।
.
.
এস এস সি পরীক্ষার পর টুসি কে আর কোন কিছুতে ছাড় দিবেন না বলে ঠিক করেন রোকেয়া বেগম।যদিও বাসায় একজন হেল্পিং হ্যান্ড আছে তবুও বাসার সমস্ত কাজ টুসি করবে বলে জানিয়েছেন। কেননা তার আদরের ছোট ব‌উমা অন্তঃসত্ত্বা!এই অবস্থায় তার কাজ করা বারন…..
___________
রেফারেন্স:-
[১]সূরা, আনফাল – ৭০
[২](হাদীসঃ তাবারানী ২ঃ ২২৭)
____________

#চলবে ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here