প্রিয় বেলা – পর্ব ২৩

0
519

প্রিয় বেলা

২৩.
সকালটা যতটা কাঠফাটা রোদে মুখরিত ছিল, রাত্রির ক্ষণটা ঠিক ততটাই বরফ শীতল লাগলো বেলার। বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়ে গলা অব্দি ব্ল্যাংকেট টেনে রেখেছে সে। ফ্যান বন্ধ। জানালা গলিয়ে সুরসুর করে ঠান্ডা বাতাস আসা যাওয়া করছে। শীত লাগছে খুব। দাঁতে দাঁত লেগে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আলসেমি ছুটিয়ে বেলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠান্ডার দরুণ ক্ষতস্থানগুলো আরও বেশি টনটন করছে। ডান পায়ের গোড়ালি বাজেভাবে কেটে গিয়েছিল। ক্ষীণ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। জানালা লাগানোর পূর্বে একবার বারান্দার ওপাশটায় দৃষ্টি বুলালো বেলা। অবুজ মন আদ্রকে দেখবার জন্য তৃষ্ণাতুর হয়েছিল বোধহয়। তবে আদ্র নেই সেখানে। আশাহত হয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো সে। পর্দা টেনে দিলো। বিছানায় শুলেও এবার আর তন্দ্রা এসে ধরা দিচ্ছে না। লোকটা তার সঙ্গে সেই কাল বিকালে দেখা করতে এসেছিল। তারপর আর বিন্দুমাত্র খোঁজখবর নেয়নি। হাসপাতাল থেকে চলে আসার পরও না। ওই যে, ড্রেসিংটেবিলের ওপর আদ্রর দেওয়া কালকের চুড়িগুলো পরে আছে। অন্ধকারেও স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারছে বেলা।
বেলার মন নিমিষেই বিষণ্ণতায় তিক্ত হয়ে উঠলো। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না। কিছুক্ষণ এমনিই গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো সে। চেনা ঘরটা দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। উঠে দাঁড়িয়ে এবার সোজা বারান্দায় চলে গেল বেলা। হিম করা দমকা হাওয়া ছুঁতেই গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। শিরশির করে উঠলো গালযুগল। চাদরখানা শরীরের সঙ্গে ভালো ভাবে আষ্টেপৃষ্টে নিলো। আদ্রর বারান্দার দিকে তাকালো আরও একবার। লোকটার দেখা এখনো পেল না। আদ্র কি তবে বাসায় আসেনি? বিষণ্ণতা বাড়লো। কাঠের চেয়ারটাতে নিঃশব্দে বসে পরলো বেলা। বিস্তৃত নভস্থলে অন্যমনস্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই পাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত ডাকটা শুনতে পেল সে,
—“বেলা।”

বেলা চমকিত হলো। কালবিলম্ব না করে চমকানো দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকালো। আদ্র থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় চাহনি বেলার মুখপানে স্থির। একদিনেই লোকটাকে কেমন মলিন দেখাচ্ছে। উজ্জ্বল গৌর বর্ণের ত্বক প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে যেন। নেত্রকোণের কাটা দাগটা সুস্পষ্ট। পরনে টি-শার্ট, ট্রাউজার।
আদ্র এগিয়ে এলো। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। কঠোর গলায় প্রশ্ন করলো,
—“তুমি না অসুস্থ? না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?”

বেলা এলোমেলো ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকালো। মৃদু স্বরে বললো,
—“ঘুম আসছিল না।”
—“কেন আসছিল না?”
বেলার আমতা আমতা কণ্ঠস্বর, “জানি না।”

আদ্র আর কিছু বললো না। নিভৃতে চেয়ে রইলো প্রেয়সীর পানে। দীর্ঘক্ষণ, অনিমেষ, পলকহীন। কালো কুচকুচে মণিজোড়ায় কেমন অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো তখন। নিষ্প্রাণ স্বরে সে দৃঢ়তা নিয়ে বললো, “তুমি কাছে থাকলে তোমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে বেলা। বুকের ভেতর চেপে ধরতে ইচ্ছে করে। তুমি আমার সামনে এসো না তো। নিষিদ্ধ জিনিসে ঝোঁক বাড়ছে আমার। যাও, ঘুমাতে যাও। আমি এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো।”

বেলা গেল না। হতবিহ্বল হলো। অবাক চোখে এই অচেনা আদ্রকে দেখতে লাগলো। চোখ-মুখে দারুণ মেজাজ নিয়ে রেখেছে লোকটা। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। তাকাচ্ছে না। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো বেলা। অবিন্যস্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
—“কিছু কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছেন কেন?”

আদ্র প্রথমেই জবান দিলো না। স্বাভাবিক হওয়ার প্রয়াস চালালো। ল্যাম্পপোস্টের বাতিটি ঝিরঝির করছে। একবার বন্ধ হচ্ছে, একবার জ্বলছে। রাস্তায় গাঢ় আঁধার স্থির হতে পারছে না। সেদিকে চেয়েই শান্ত গলায় আদ্র উত্তর দিলো,
—“কিছু হয়নি।”
তারপর একটু থেমে আবারও ঢিমে যাওয়া স্বরে প্রশ্ন করলো, “তোমার কি মনে হয় বেলা, আমি কি সত্যিই তোমার অযোগ্য? তোমাকে কি শুধুই কষ্ট দেই?”

বেলার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পরলো। আশ্চর্য কণ্ঠে বললো, “হঠাৎ এসব কথা কেন বলছেন?”
আদ্র থেমে নেই। শাহাদাত আঙুল উঁচিয়ে বাড়ির উঠানে তাক করলো। আগের মতোই বলতে লাগলো,
—“কয়েকদিন পর এখানটা গার্ডে ভরে থাকবে। আমার আপনজন কেউই পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ছাড়া বের হতে পারবে না। স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না। আমার প্রাণের নিশ্চয়তা থাকবে না। যেকোনো সময় মরে যাবো–।”

কড়া গলায় আদ্রকে থামিয়ে দিলো বেলা। আশপাশের খেয়াল করলো না। অনেকটা জোড়েই চেঁচিয়ে উঠলো,
—“চুপ করুন আদ্র। এসব কথা কেন বলছেন আমাকে? আমি শুনতে চেয়েছি আপনার কাছে?”
আদ্র হাসলো, দূর্বোধ্য ভাবে। ভাষাহীন নেত্রে তাকালো। নড়বড়ে দৃষ্টি বেলার মুখশ্রীতে একটু একটু করে ঘুরছে। তার আতঙ্কিত ভাবটা নজরে এতেই আদ্র আরেকদফা হাসলো। শুধালো,
—“আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বেলা। এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতে কি তুমি জড়াতে চাও?”

নিষ্ঠুর জলরাশিগুলো ভীর জমালো। বক্ষস্থলের ধুকধুক ধ্বনির গতি প্রচন্ডভাবে বেড়ে গেল। মাথা হঠাৎ করেই যন্ত্রণা করছে। থেকে থেকে, অকপটে বেলা স্বীকারোক্তি করলো,
—“চাই।”

আদ্র নিগূঢ়ভাবে চাইলো। শান্ত হলো সবার্ঙ্গ। প্রতিউত্তরে সে স্বাভাবিক স্বরে বললো, “রুমে যাও। ঠান্ডায় কাঁপছো তুমি। ঘুমাও, যাও।”
বেলা একদমই গেল না। গলার জোড় বাড়িয়ে দিলো, “আমি আপনারই প্রিয় বেলা হবো আদ্র।”

আদ্র মুচকি হাসলো। সুদীর্ঘ, বিস্তর হাসি। উত্তর দিলো, “জানি।”

টিভির সব খবরে নেতা আদ্র ইয়ানিদকে দেখাচ্ছে। একশতরও অধিক ভোটে বিজয়ী হয়েছে সে। আনন্দে মেতে উঠেছে পুরো দল। বাদ্যযন্ত্র বাজছে। গান চলছে সর্বোচ্চ আওয়াজে। আদ্র বেশিক্ষণ সেখানে থাকলো না। মন টিকলো না তার। আকিবকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। আকিব মন খারাপ করে বললো তখন,
—“এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন কেন ভাই? আপনার এত বড় জয় হলো, একটু আনন্দ করতেন।”

আদ্র ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে সীটে হেলান দিয়ে বসলো। পকেট থেকে ফোন বের করলো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“আমার সব আনন্দ তো তোমার ভাবীর মাঝেই আটকে আছে আকিব।”
আকিব হাসলো,
—“তা ঠিক বলেছেন ভাই। গাড়ি কি এখন ভাবীর ভার্সিটির ওখানে নিয়ে যেতে বলবো?”
—“না। ফুলের দোকানে চলো আগে। কিছু গোলাপ কিনবো।”

কি ভেবে মিটিমিটি হেসে ফেললো আকিব। একটু শব্দ করেই। আদ্র ভ্রু কুঁঞ্চিত করে তাকাতেই বহুকষ্টে থামালো তা। ড্রাইভারকে ফুলের দোকানে নিয়ে যেতে বললো।
আদ্র ফোনের কী-বোর্ডে অনবরত চাপ দিয়ে বেলাকে বার্তা পাঠালো তখন, “বড় মাপের একজন নেতা আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছে বেলা। তৈরি থাকুন।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here