প্রিয় বেলা – পর্ব ২২

0
361

প্রিয় বেলা

২২.
সময় গড়াচ্ছে। রাত্রি গভীর। নিস্তব্ধ পরিবেশে মানুষের হাঁটার ধপধপ শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। থমথমে হয়ে আছে আশপাশ। বিছানার একপাশে বিহানকে আগলে রেখাও দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। প্রভা বেগম খুব করে আগলে রাখছেন মেয়েকে। পরম স্নেহে, মমতায় বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছেন। বেলাও চুপ করে লেপ্টে আছে মায়ের বক্ষস্থলে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। মায়েদের শরীরে কেমন একটা ‘মা’ ‘মা’ গন্ধ থাকে। সে কাছে থাকলে ব্যথা, বেদনা, চিন্তা সব কোথায় যে উবে যায়!
আদ্র দীর্ঘক্ষণ একমনে চেয়ে রইলো বেলার শুকনো, মলিন মুখশ্রীর পানে। সন্ধ্যায় সে কিছু না বলেই ক্লাব থেকে চলে এসেছিল। পরে আর সেখানকার খবর নেওয়া হয়নি। পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো সে। পাওয়ার বাটন চাপতেই ইতিমধ্যে তন্ময়ের বেশ কয়েকটা মিসডকল দেখতে পেল। লাস্টে একটা মেসেজও ছিল। আদ্র আর দেড়ি করতে চাইলো না। বেলার সঙ্গে তো সবাই আছেই। ফোন ঢুকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য টুল ছেড়ে ওঠার পূর্বেই সায়েদ সাহেদ ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। আদ্রর সামমাসামনি দাঁড়ালেন। খুব শান্ত ভাবে স্নেহের সঙ্গে বললেন,
—“তোমাকে আমি কিভাবে যে ধন্যবাদ জানাই বাবা। পরপর দু’টো বড় বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছ আমাদের। আজকে যদি তুমি আসার পথে আমার মেয়েটাকে না দেখতে, ও বোধহয় এখনো ওভাবেই রাস্তায় পরে থাকতো। তুমি আমাদের ঋণী করে তুললে বাবা।”

আদ্র একটু হাসার চেষ্টা করলো। নির্দ্বিধায় বললো,
—“এভাবে বলতে হবে না আঙ্কেল। এটা আমার দায়িত্বের মাঝেই পরে।”
তিনিও প্রতিউত্তরে প্রফুল্ল হাসলেন। কিছু একটা ভেবে আবারও বলে উঠলেন,
—“তুমি তো মনে হয় কিছু খাওনি এখনো। খাবে না? দাঁড়াও, আমি কিছু নিয়ে আসছি তোমার জন্য।”
আদ্র সঙ্গে সঙ্গে দিরুক্তি করলো, “তার প্রয়োজন নেই আঙ্কেল। আমি একটু বের হবো এখন। তখন খাওয়া যাবে। আপনাদের কিছু লাগলে আয়াজকে বলবেন। ও আর মা আজকের রাতটা এখানেই থাকবে।”

সায়েদ সাহেব কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বলতে পারলেন না। আদ্র একপলক বেলার দিকে দৃষ্টি ফেলে বেরিয়ে পরলো কেবিন থেকে।

বিকাল ৪টা বাজছে। বিছানায় বসে বসে বিশাল জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে বেলা। কাল থেকে এখন অব্দি একাধারে শুয়ে বসে থাকতে বিতৃষ্ণা চলে এসেছে খুব। আজকেই বাসায় চলে যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে নাকি ডিসচার্জ দেবে না। কালকে ছাড়া বাসায় যেতে পারবে না সে।
কেবিনের ভেতর এখন শুধু বেলাই একা। সায়েদ সাহেব এখান থেকেই অফিসে চলে গেছেন। বিহান স্কুলে। আরু বাসায় একা থাকায় রেখাকে সকালেই দিয়ে এসেছে আয়াজ। এখন আবার প্রভা বেগমকে কোথায় যেন নিয়ে চলে গেছে। অনেকটা জোড় করেই। বেলা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে শুধু। মানা করেনি। কিন্তু এখন বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। ক্ষীণ চিনচিন করছে ক্ষতস্থান। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলো চুলকাতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু তা করার সাহস নেই। পাছে আবার ব্যথা পেলে? রক্ত বের হলে? হঠাৎ খট শব্দে কেবিনের দরজা খুলে গেল। বেলা তাকালো না সেদিকে। একটু অভিমানী সুরে বললো,
—“এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমার মা?”

ওপাশ থেকে সারাশব্দ এলো না। বেলা দৃষ্টি ঘোরালো। সামনে তাকাতেই আদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ ভাবে চমকালো সে। হকচকিয়ে, অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখানে?”
আদ্র মুচকি হাসলো। উত্তর দিলো না। ধীরস্থির পায়ে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো। কোনো কথা ছাড়াই কপালে, গালে হাত ছোঁয়ালো। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “জ্বর সেড়েছে কখন?”
বেলা মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলো, “সকালে।”

আদ্র সরে এলো। হাতে থাকা বড়সড় প্যাকেট থেকে অনেকগুলো লাল চুড়ি বের করলো। বেলার কাছে অনুমতি চাইলো,
—“তোমার হাতটা একটু দাও তো বেলা।”

বেলা শুনলো না যেন। হাত বাড়ালো না। চোখে বিস্ময় নিয়ে পলক ঝাপটালো পরপর দু,তিনবার। জিজ্ঞেস করলো,
—“এতগুলো চুড়ি এনেছেন কেন?”
আদ্র ততক্ষণে বেলার হাত টেনে নিয়েছে। খুব সাবধানে, স্বযত্নে একটা একটা করে চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছে তাকে। অকপটে, নিঃসঙ্কোচ ভাবেই বললো,
—“তোমার চুড়িগুলো ভেঙ্গে গিয়েছিল না? তাই নতুন এনেছি।”
বেলা রোষপূর্ণ হয়ে বললো,
—“আমার কাছে তো আরও অনেকগুলো চুড়ি ছিল। আপনি শুধু শুধু এখন আবার আনতে গেলেন কেন? তাছাড়া মা যদি এখন আমার হাতে চুড়ি দেখে তখন কি বলবো আমি?”

আদ্রর মাঝে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল না। ভ্রুক্ষেপহীন সে। চুড়ি পড়ানো শেষ হতেই বেলা হাত টেনে নিলো। হাত নাড়াতে এখন অত অসুবিধে হচ্ছে না। চুড়িগুলো খুলে ফেলতে চাইলেই কঠিন গলায় ধমকে উঠলো আদ্র,
—“খবরদার বেলা! আমি চলে না যাওয়া অব্দি চুড়িগুলো তোমার হাত থেকে খুলবে না।”

বেলা আর খুলতে পারলো না। জড়োসড়ো হয়ে মাথা নুয়ালো। মিনমিন করে অভিযোগ করলো,
—“আমি অসুস্থ না? বকছেন কেন?”
আদ্র শুনলো। কিছুক্ষণ চুপ করে নিঃশব্দে তার অবুজ প্রেমিকাকে দেখল। তারপর হঠাৎ-ই হেসে দিলো সশব্দে। এগিয়ে এসে অধর ছোঁয়ালো প্রিয়তমার স্নিগ্ধ ললাটে। বেশ ক্ষণ লাগিয়ে, খুব সময় নিয়ে ওভাবেই রইলো। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ণ হাসির অস্তিত্ব বজার রেখে কোমলস্বরে বললো,
—“আচ্ছা। এখন বকবো না। তুমি সুস্থ হলে তারপর বকবো। ঠিকাছে?”

বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিলো আদ্র। এসির পাওয়ার বাড়ালো। চোখ বুজে উঁচু গলায় ডাকলো,
—“মা? ঠান্ডা পানি আনো।”

ডাকার দু’মিনিটের মাথায় পানি নিয়ে এলেন রেখা। ছেলের পাশে বসলেন। গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নেয়।”
আদ্র নিলো। এক নিশ্বাসে পুরো পানি পান করে গ্লাস রেখে দিলো টেবিলে। রিমোটে আঙুলের একেকটা চাপ প্রয়োগে খবরের চ্যানেলগুলো পাল্টাতে লাগলো সে। রেখা হাঁসফাঁস করছেন। প্রবল জড়তা কাজ করছে মনে। একবার টিভির দিকে তাকিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন আবার। জিজ্ঞেস করলেন,
—“বেলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি আদ্র?”
আদ্রর কপালে ভাঁজ পরলো। ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। সন্দিহান কণ্ঠে বললো, “হ্যাঁ। তুমি জানলে কিভাবে?”

রেখা একটু থেমে থেমে বললেন,
—“আয়াজ বললো।”
বলে ক্ষীণ থামলেন তিনি। জড়তায় কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। এরপর হঠাৎই এক উদ্ভট প্রশ্ন করে বসলেন,
—“তুই কি বেলাকে পছন্দ করিস আদ্র?”

আদ্রর সময় লাগলো কথা বুঝতে। তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারলো না। রেখা আবারও বলে উঠলেন,
—“দেখ, মিথ্যা বলবি না। আমার কেন যেন মনে হয়, তুই বেলাকে পছন্দ করিস। অনতত তোর আচরণে আমি সেটাই বুঝেছি। তুই কি সত্যিই পছন্দ করিস ওকে?”

বিমূঢ়তা কাটিয়ে নির্বিকার স্বরে আদ্র উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, করি।”
রেখার ভেতরটা হাজার হাজার পাথরে ডেবে গেল যেন। বুক ভারী হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব কঠিন স্বরে তিনি বলতে লাগলেন,
—“পছন্দ করিস ঠিকাছে। আর বেশি এগোবি না। এখানেই থেমে যা।”
এতক্ষণে টিভি থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো আদ্র। চোখ-মুখ বিকৃত হলো। বিরক্তিতে তিক্ত হলো মেজাজ।
—“তুমি কি বলছো বুঝেশুনে বলছো মা?”
রেখা আগের মতোই বললেন,
—“আমি বুঝেশুনেই বলছি। তোর মতো একটা ছেলের সঙ্গে জড়ালে মেয়েটা কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না। যেমনটা তোর বাবার বেলায় আমি পেয়েছি। মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ আদ্র। আমি ইচ্ছে করে তো মেয়েটাকে কষ্টের পথে ঠেলে দিতে পারিনা।”

আদ্র শক্ত চোয়ালে তাকিয়ে রয়। কিচ্ছুটি বলে না। চোখে ভীর জমায় লাল লাল শিরাগুলো। রেখা এবার খুব করে অনুরোধের সুরে বলেন,
—“বেলা থেকে সরে আয় আদ্র। মেয়েটাকে একলা ছেড়ে দেয়।”

আদ্র প্রথমেই উত্তর দেয় না। সময় নেয়। রাগী সত্ত্বাটি স্বাভাবিক হতেই ভীষণ শান্ত স্বরে বলে, “এমন আবদার করো না মা, যা পূরণ করার সাধ্যি আমার নেই।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

[এলোমেলো হয়েছে কি? আমি পর্বটা একদমই গুছাতে পারছিলাম না। ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here