প্রিয় বেলা – পর্ব ২১

0
366

প্রিয় বেলা

২১.
বেলা ঘুমাচ্ছে। অবাধ্য চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো হচ্ছে বারবার। হাত বাড়িয়ে তা কানের পেছনে গুঁজে দিলো আদ্র। আলতো করে বেলার মাথা বুকের মধ্যিখানে টেনে নিলো। শীতল আবহাওয়ায় একটুখানি উষ্ণ আলিঙ্গন পেয়ে নড়েচড়ে উঠলো বেলা। ঘনিষ্ট হলো। দূর্বল হাতে আদ্রর কোমড় জড়িয়ে বুকে গুটিয়ে গেল। তা দেখে দূর্বোধ্য হাসলো সে। কপালের সাদা ব্যান্ডেজের একপাশে দীর্ঘক্ষণ অধর ছুঁইয়ে রইলো। মোটা লম্বা করে একজন মহিলা ডাক্তার এগিয়ে এলেন তখন। ওদের দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
—“উনি কি আপনার ওয়াইফ হন মিস্টার আদ্র?”

অধিক পাওয়ারি ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে বেলাকে। জোড়েসোড়ে হট্টগোল হলেও সে সহজে আর ঘুম থেকে উঠবে না। তবুও প্রেমিক পুরুষের এ নিয়ে বড্ড আশঙ্কা। ক্ষণে ক্ষণে আশপাশের কোলাহলে বিরক্ত হচ্ছে সে। প্রিয়তমার ঘুমে যদি ব্যাঘাত ঘটে? ঘুম থেকে উঠলেই তো ব্যথায় কাঁদবে মেয়েটা। ঘুমানোর আগেও কাঁদছিল। ঔষধ খেতে চাইছিল না। তিতা লাগে বলে। আদ্রর বুক ভারী হয়ে আসে। মেয়েটার এইটুকু কষ্ট তার সহ্য হয় না। বুকের চিনচিনে ব্যথায় নিজেরই অসহ্য লাগে।
মহিলা ডাক্তারটির দিকে না তাকিয়েই আদ্র রোষপূর্ণ গলায় বললো,
—“আস্তে কথা বলুন। ও উঠে যাবে।”

উনার ঠোঁট থেকে যেন হাসি সরছেই না। আগের থেকে এবার একটু ধীর গলায় বললেন,
—“ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে উনাকে। এত সহজে উঠবেন না।”
তারপর একটু থেমে আবার বললেন, “আপনি কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।”

ডাক্তারের দিকে একপলক তাকালো আদ্র। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো তৎক্ষণাৎ। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
—“না, হবে। আপনি কি আমাকে চেনেন?”
—“আপনাকে কে চেনে না আদ্র ইয়ানিদ? টিভিতে অনেকবার দেখেছি। ইভেন আমার পরিবারও আপনাকেই ভোট দেবে বলে ভেবে রেখেছে। ভীষণ পছন্দ করে সবাই আপনাকে।”

আদ্র উত্তর দিলো না সেকথার। বেলা শীতে কাঁপছে। গা গরম লাগছে। জ্বর এলো নাকি? উদ্বিগ্ন হয়ে সে বললো,
—“ওর জ্বর আসছে কেন? দেখুন তো।”
ডাক্তার বেলার কপালের তাপমাত্রা চেক করলেন। বললেন,
—“ব্যথার কারণে জ্বর এসেছে। চলে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।”

আদ্রর ভেতরটায় তবুও স্বস্তি এসে হানা দিলো না। নেতিয়ে পরা বেলাকে একহাতে সামলে প্রশ্ন করলো, “আমি কেবিন রেডি করতে বলেছিলাম আপনাদের। করেছেন?”
—“হ্যাঁ। আমি নার্সদের ডাকছি। ওরা হুইলচেয়ার নিয়ে আসবে।”

আদ্র কথা বাড়ালো না। চট করে কোলে তুলে নিলো বেলাকে। আদুরে ভাবে। খুব সাবধানে। সুপ্ত অধিকারবোধ নিয়ে। গম্ভীর স্বরে বললো,
—“তার প্রয়োজন নেই। আমি ওকে নিয়ে যেতে পারবো। কেবিনটা কোন দিকে?”

মহিলা ডাক্তারটি ক্ষীণ সময়ের জন্য হকচকালেন, ভড়কে গেলেন। পরক্ষণেই হেসে দিলেন তিনি। এমন বিশুদ্ধ, অকৃত্রিম ভালোবাসা নিজের ছত্রিশ বসন্তে খুব কমই দেখেছেন।

বাহিরে বৃষ্টি আর নেই। রাস্তা, গাছপালা সব পানির সংস্পর্শে এসে স্নিগ্ধ হয়ে আছে। নভস্থলে গাঢ় নিকষকৃষ্ণ। কেবিনের জানালা বন্ধ। তবুও যানবাহনের কড়া হর্ণের শব্দ কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে। বেলার তন্দ্রা কেটে গেল। চোখ মেলতেই তীব্র আলোর ঝলকে আবারও চোখ বুজলো সে। মাথাটা ভারী, ভারী লাগছে। শরীরে ক্ষীণ চিনচিনে ব্যথা বিরাজমান। হাতের ওপর ভারী কিছুর অস্তিত্ব টের পেল সে। ধীরস্থির ভাবে, সময় লাগিয়ে চোখ মেললো আবার। আদ্রর শার্ট শুকিয়ে গেছে। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো আধভেঁজা। শুষ্ক ঠোঁটযুগল। বেলার ক্ষতহীন হাতটা ধরে কপাল ঠেকিয়ে আছে। নেত্রজোড়ার পাতা লাগানো। বেলার হঠাৎই পিপাসা পেল খুব। আধো আধো কণ্ঠস্বরে আদ্রকে ডাকলো,
—“আদ্র? আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ডের মাথায় মাথা তুলে তাকালো আদ্র। শরীর যেন অল্প দুলে উঠলো তার। ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব। চোখের শিরা-উপশিরা রক্তিম হয়ে আছে। মুদে আসতে চাইছে শুধু। আদ্র দু’হাতে চোখ কঁচলালো। জোড় করে তাকালো। থেমে থেমে ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে বেলা? মাথা ব্যথা করছে? কষ্ট হচ্ছে কোথাও? পানি খাবে?”

উত্তর দিতে বেশ সময় নিলো বেলা। তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের প্রেমিক পুরুষটাকে দেখল দীর্ঘক্ষণ। লোকটা ভীষণ অধৈর্য। একটুতেই ব্যস্ত হয়ে পরে। অথচ ঠিকভাবে তাকাতেও পারছে না ঘুমে। বেলার মায়া হলো। ক্লান্ত আদ্রকে দেখে খারাপ লাগলো প্রচন্ড। ঠোঁট কামড়ে কয়েকবার পলক ঝাপটালো বেলা। মৃদু স্বরে বললো,
—“আমি ঠিক আছি। আপনি শান্ত হন।”

আদ্র শুনলো। তবে শান্ত হলো কি-না বোঝা গেল না। তার দৃঢ় নিশ্বাসের শব্দ বেলা অতদূর থেকেও শুনতে পারছে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এলো আদ্রর মুখশ্রী।
বেলা আগের মতোই বললো,
—“আমাকে উঠে বসান। পানি খাবো।”

সে দেড়ি করলো না। বেলাকে আলতো হাতে বুকে চেপে বালিশ ঠিক করলো। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে দিলো খুব সতর্কতার সঙ্গে। ভরা পানির গ্লাসটা বেলার অধরের নিকট ধরলো। অন্যহাত মেলে রাখলো তার থুতনির কাছে। বেলা বেশি পানি পান করতে পারলো না। চুকচুক করে অর্ধেক পানি পান করার চেয়ে ফেলেই দিলো বেশি। আদ্র বিরক্তহীন ভাবে গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো। তার পুরুষালি শকপোক্ত হাতটা নমনীয় ভাবে বেলার ঠোঁটের আশপাশে থাকা পানি মুছে দিলো। কোমলস্বরে শুধাল, “আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? খাবে?”

বেলা মাথা দুলালো। অর্থ্যাৎ, খাবে না। আদ্র আবার কিছু বলবে, তার পূর্বেই বড়সড় থাক্কায় কেবিনের দরজা ঠেলে কে যেন ভেতরে প্রবেশ করলো। বেলা কেঁপে উঠলো। ভীতু চোখে তাকালো। হন্তদন্ত, এলোমেলো চুলে উদ্ভট পোশাক পরে আয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। টি-শার্টের একটা হাতা ছেঁড়া। আদ্র ভ্রু কুঞ্চিত করে সরু চোখে তাকালো। দৃষ্টিতে প্রখর তীক্ষতা, দৃঢ়তা। আশ্চর্য ভাব কাটিয়ে থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো,
—“তোর এমন পাগলের মতো অবস্থা কেন? আমি তো সবাইকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম তোকে। বাকি সবাই কই?”

আয়াজ তখন দ্রুত পদে বেলার পায়ের কাছটায় বসলো। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো। হড়বড় করে বললো,
—“ওরা নিচে। আমি আগেভাগে মিলখা হয়ে আসছি। তুই যে কেমন নির্লজ্জ, তা তো আমার জানা। ভাবীকে ছেঁড়ে এবার একটু দূরে গিয়ে বস তো। তোদের এই স্বাধীন প্রেম দেখে আমার মনে বিরহ সৃষ্টি হচ্ছে। শান্তি মতো প্রেমও করতে পারছি না চৈতির সঙ্গে।”

আদ্রর কোনোরুপ হেলদোল দেখা গেল না। সে তার মতোই বেলার এলোমেলো চুলগুলো প্রথমে ঠিক করে দিলো। কাঁথা ভালোভাবে টেনে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে একটু দূরত্বে গিয়ে বসলো।
আয়াজ বেলার দিকে তাকিয়ে হাসলো এবার। ক্ষীণ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো,
—“এখন কেমন আছো ভাবী?”

আয়াজ আজ হঠাৎ করেই বেলাকে ভাবী বলে সম্মোধন করছে। ব্যাপারটায় ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে বেলা। মাথা নুইয়ে সে মৃদু স্বরে উত্তর দিলো, “আগের চেয়ে অনেকটা ভালো আছি ভাইয়া।”

আয়াজ মিটিমিটি হাসলো শুধু। আদ্রকে বললো, “ভাই আমাকে কিন্তু নতুন টি-শার্ট কিনে দিবি তুই। তোর কথায় তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে দরজার সঙ্গে লেগে আমার নতুন টি-শার্ট ছিঁড়ে গেছে। আমার প্রিয় টি-শার্ট! চৈতি দিয়েছিল।”

আদ্র প্রতিউত্তরে তেমন কিছুই বললো না। একটু পরই বাকি সবাই চলে এলেন। প্রভা বেগম এসেই ঝাপটে ধরলে মেয়েকে। কপালে স্বস্নেহে চুমু খেলেন বিরতিহীন ভাবে। মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। কেঁদে ফেললেন তরতর করে। প্রবল শাসনের কণ্ঠে বললেন,
—“তোকে আর বাসা থেকে বের হতে দেব না আমি। কোনো টিউশন, ফিউশন করতে হবে না।”

__________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here