প্রিয় বেলা
১৩.
পরিবেশ থমথমে। সেই থমথমে ভাবটা নিমিষেই কাটিয়ে আয়াজ মিটিমিটি হেসে উঠলো। তবুও রেখার তীক্ষ্ণতা কমলো না। তিনি জহুরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
—“এমন মেয়ে কোথায় খুঁজবো আমি, যার সবকিছুতে তুই মুগ্ধ হবি। পছন্দ কি আগে থেকেই করে রেখেছিস নাকি? কে মেয়েটা?”
আদ্র ফোনের স্ক্রীনে মনোযোগ দিলো। গম্ভীর স্বরে বললো, “পরে সময় হলে বলবো। আপাতত জেনে রাখো, তুমি তাকে চেনো।”
ভ্রু কুঞ্চিত হলো রেখার। তিনি মেয়েটাকে চেনেন? তার জানামতে বেশ কিছু মেয়েই আদ্রকে পছন্দ করে। কিন্তু আদ্র কখনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি সেখানে। তাদের সঙ্গে কথা বলতেও কখনো দেখেনি রেখা। তবে কে হতে পারে? মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলেন তিনি। কৌতূহলী মন উতলা হয়ে উঠলো ভীষণ। মায়ের হাবভাব বুঝে আদ্র আগেই জানিয়ে রাখলো,
—“আমি কিন্তু এখন কিছুই বলতে পারবো না তোমাকে। সময় আসুক। এমনিতেই জেনে যাবে।”
রেখা দমলেন না। চিন্তিত মুখে রাজ্যের ভাবনা জুড়ে দিলেন। আয়াজ তখন বেলাকে জিজ্ঞেস করলো,
—“তুমি বলো তো বেলা, তুমি আদ্র ভাইয়ের পছন্দের মানুষকে চেন?”
আয়াজের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি খেলা করছে। বেলা হকচকিয়ে যায়। মিনমিন করে উত্তর দেয়,
—“আমি কিভাবে জানবো?”
রেখাও সায় দিলেন। বিরক্ত কণ্ঠে আয়াজকে বললেন,
—“আরে ও জানবে কিভাবে? হাঁদার মতো কথা বলিস কেন?”
আয়াজ নাক কুঁচকে বিড়বিড়ালো, “ও-ই তো জানবে মা। ভাই তো ওকেই জান, প্রাণ সব দিয়ে দিয়েছে।”
__________
রোদ্দুরে বেজায় বিরক্ত নিকষকৃষ্ণ কাকগুলি। কা, কা শব্দে বিশাল তোড়জোড় করছে তারা। অনেকে পাশের ঝিল থেকে স্নান করে কারেন্টের তারে এসে বসেছে। শরীর ঝাকিয়ে গায়ের পানিগুলো ঝেড়ে ফেলছে বারবার। চোখ,মুখ কুঁচকে একবার সেদিকে তাকালো বেলা। কাঁধের ব্যাগটা আরেকটু চেপে নিলো। কলেজ শেষ হয়েছে আরও আধঘণ্টা আগে। কিন্তু রিকশা চালক করিম এখনো আসছেন না। ঘেমে পরনের কামিজ শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে যেন। সরব ফোনে কল এলো তার। ফোন হাতেই ছিল। স্ক্রীনে আদ্রর নামটা ইংরেজী গুটিগুটি অক্ষরে ভেসে উঠছে। বেলা একটু অবাকই হলো। তিনদিন ধরে আদ্রর সঙ্গে দেখা নেই তার। আজ হঠাৎ কল দিলো কেন? পরক্ষণেই বিস্ময় ভাব কাটিয়ে কল রিসিভ করলো সে। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র ওপাশ থেকে ডাকলো,
—“বেলা।”
বেলা ক্ষীণ থমকালো। আদ্রর কণ্ঠস্বরে ভাঙ্গা, ভাঙ্গা ভাব। দূর্বলতার স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। বেলা নিঃশব্দে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। ছোট্ট করে জবাব দিলো, “হু।”
—“আপনার ডান দিকে তাকান বেলা।”
বেলা কালবিলম্ব করলো না। তৎক্ষণাৎ তাকালো ডান পাশটায়। কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড় করানো। জানালা দিয়ে অস্পষ্ট আদ্রর মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে। বেলা যেন আরও একদফা থমকালো। ভড়কালো, চমকালো, বিমূঢ় হলো ভীষণ। আদ্রর শুভ্র কপাল জুড়ে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ বিরাজমান। নিষ্পলক দৃষ্টি বেলার দিকেই। সে চেয়েই রইলো। ওপাশ থেকে আদ্র দূর্বল কণ্ঠে আবার বললো,
—“আমি অপেক্ষা করছি বেলা। এদিকে আসুন।”
ফোন কেটে গেল। আড়ষ্ট, জোড়োসড়ো বেলা ধীরে ধীরে এগোলো গাড়িটির দিকে। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই দরজা খুলে দিলো আদ্র। বেলা উঠে বসলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো ক্ষতবিক্ষত আদ্রর মুখপানে। আদ্র হাসলো ক্ষীণ। ঢিমে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কেমন আছেন?”
বেলা সেকথার উত্তর দিলো না। তার নিশ্বাস আটকে আটকে আসছে। কণ্ঠনালিতে শব্দজোট। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে অধরযুগল। হাত এগিয়ে আলতো করে কপালের ব্যান্ডেজ ছুঁলো সে। ছোট্ট করে শুধু বললো,
—“এসব– এসব কিভাবে হয়েছে?”
প্রতিউত্তরে আদ্র মুচকি হাসলো। উত্তর দিলো না। গাড়ি স্টার্ট করে ধীর গতিতে চালাতে লাগলো। বেলার অস্থিরতা বেড়ে দ্বিগুণ। চোখে পানি টলমল। আদ্রর হাত ঝাঁকিয়ে বেলা আবার জিজ্ঞেস করলো,
—“বলছেন না কেন? কিভাবে হয়েছে এসব?”
—“আমি এহাতে ইঞ্জুর্ড বেলা। ঝাঁকাবেন না। ব্যথা পাচ্ছি।”
বেলা সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিলো। কিছু বলতে নিলেই তাকে থামিয়ে আদ্র বললো,
—“এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না বেলা। আমি সব বলব। একটু অপেক্ষা করুন। ড্রাইভ করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। একটু নিরিবিলি জায়গায় যেতে চাচ্ছি।”
বেলা নিশ্চুপ হয়ে যায়। নত হলো তার মস্তক। আঁখিজোড়া বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তার। প্রচন্ড যন্ত্রণা। গাড়ির সামনের কাঁচে ফোন ফিট করে রাখা। যান্ত্রিক শহর পেরিয়ে নিরিবিলি রাস্তায় ঢুকতেই বেজে উঠলো তা। স্ক্রীনে মা নামটা ভাসমান। আদ্র সেদিকে একপলক তাকালো। বেলাকে বললো কল রিসিভ করতে। বেলাও তাই করলো। তৎক্ষণাৎ গমগমে গলায় রেখা বলে উঠলেন,
—“কোথায় তুই?”
আদ্র স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো,
—“ক্লাবে আছি।”
মুহুর্তেই তেঁতে উঠলেন তিনি,
—“এই তোর লজ্জা করে না? আবারও ওখানে গিয়েছিস কেন? তুই কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস আদ্র? প্রথমে তোর বাবা রাজনীতির কারণে মারা গেল। এখন তুইও মরার জন্য এসব করছিস? আমার সুখ কি তোদের সহ্য হচ্ছে না?”
এটুকু বলে থামলেন রেখা। উগ্র মেজাজটা অল্প শান্ত হলো। নমনীয় কণ্ঠে অনুরোধ করলেন,
—“রাজনীতি ছেড়ে দেয় বাবা। কি লাভ এসব করে? তুইও কষ্ট পাচ্ছিস, আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। আমাদের কথা অনতত ভাব। ছেড়ে দেয় বাবা।”
আদ্রর জবাব না পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন রেখা। কাতর স্বরে ডাকতে লাগলেন, “আদ্র শুনছিস বাবা? আদ্র?”
আদ্র জোড়ালো নিশ্বাস ফেললো। প্রতুত্তরে শুধু বললো, “আমার আসতে রাত হবে মা। রাখছি।”
ওপাশ থেকে রেখার কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না।
গাড়ি থামলো তার একটু দূরেই। নির্জন স্থান। রাশি রাশি গাছপালা আর কিছু ট্রাকের আনাগোনা মাত্র।
গাড়ির সব জানালা খুলে দিলো আদ্র। বাঁধা না পেয়ে বাতাসগুলি মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পরলো গাড়ির ভেতর। এলোমেলো হলো বেলার ললাটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেশ, মাথার ঘোমটা। ক্লান্ত শরীর সীটে এলিয়ে দিলো আদ্র। নির্নিমেষ চোখে তাকালো বেলার নত মুখে। দু’হাত বাড়িয়ে দিলো। নিষ্প্রভ স্বরে আবদার করলো,
—“একটু বুকে আসবেন বেলা?”
বেলা সময় নিলো না। দূরত্ব কমালো। মিশে গেল আদ্রর বক্ষস্থলে।
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
[আজ পর্ব অনেক ছোট হয়েছে। দু’দিন পর দেওয়ায় বড় করে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাসায় মেহমান। কোনোভাবেই গল্প লিখার সময় হয়ে উঠছিল না। যেমন-তেমন করে লিখেছি। আজ একটু মানিয়ে নেওয়ার অনুরোধ। এবং আজ একটু বেশি বেশি মন্তব্য করবেন প্লিজ? পড়তে ইচ্ছে করছে।]