প্রিয় বেলা – পর্ব ১৪

0
369

প্রিয় বেলা

১৪.
আদ্রর বক্ষস্থলে নিবিড়ভাবে লেপ্টে আছে বেলা। কান্না থেমেছে ক্ষীণ। ডুকরে ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গাঢ় নিশ্বাসগুলো আদ্রর শার্ট ভেদ করে শরীরে উষ্ণতা ছুঁয়ে দিচ্ছে যেন। আদ্রর পুরুষালী শক্ত ডান হাতটি মোলায়েম ভাবে বেলার চুলের ভাঁজে রাখা। আলতো করে হাত বোলাচ্ছে সে। লহু স্বরে বলে,
—“শান্ত হন বেলা। শার্ট ভিঁজিয়ে দিয়েছেন আমার। চোখের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে না?”

বেলা সরে এলো তৎক্ষণাৎ। সময় নিলো না। ভীষণ অভিমানী হয়ে অন্যদিকে তাকালো। আদ্র হাসলো। নিঃশব্দে, প্রাণ ভরে, দীর্ঘক্ষণ। ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমি আপনার কে হই বেলা? এই পাষাণ নেতার জন্য কাঁদছেন কেন?”

ক্রদনের দরুণ নাকের ডগা রক্তিম হয়ে আছে তার। ফুলে আছে অল্প। নেত্রে পানির অস্তিত্ব না থাকলেও পাঁপড়িগুচ্ছ এখনো ভেঁজা। গালে দাগ বসে গেছে নিষ্ঠুর পানির রেখায়। বেলা অন্যদিকেই চেয়ে রইলো। অভিমান ভুলে বেশ কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো,
—“কেউ হন না।”
আদ্র তার রেশ ধরেই বললো,
—“কেউই হই না?”
বেলা জবাব দিতে পারে না। তার আবারও কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে যদি কান্না করা যেত, খুব শান্তি পেত সে। আদ্রর কপালের ব্যান্ডেজটা অস্পষ্ট হয়ে বারবার ভাসছে চোখে। কি করুণ সেই দৃশ্য! কি ভরাবহ! বেলা চোখ বুজে ফেলে। নিশ্বাস নিতে থাকে ধীরস্থির ভাবে।

তার জন্য চিন্তিত, আতঙ্কিত মুখটির দিকে তাকিয়ে এক আলাদা প্রশান্তি অনুভব করলো আদ্র। অধরে হাসি এসে হানা দিলো আরও একবার। মেয়েটা কিভাবে যেন তার সর্বত্র দখল করে নিয়েছে৷ যার কারণ অবশ্য আদ্রর জানা নেই। জানার ইচ্ছেও হয়নি কখনো। কিছু জিনিস না জানাই শ্রেয়। সংগোপনে থাকা কারণটা বুড়ো বয়সে বেলাকে নিয়েই ভাববে সে। পুরোনো দিনের কথা ভেবে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে হাসবে, উল্লাস করবে। ভাবতেই তো সুখময় আনন্দে মৌ মৌ করছে পরিবেশটা।
বেলার কব্জি জোড় করে টেনে নিজের বুকে আবারও মিশিয়ে নিলো আদ্র। বেলা সরতে চাইলো। বাঁধন শক্ত হলো, গভীরতা বাড়লো। আদ্র থমথমে আওয়াজে সাবধান করলো,
—“নড়বেন না বেলা। হাতে ব্যথা পাচ্ছি কিন্তু।”

বেলা থেমে যায়। ভুলেও আর নড়চড় করে না। লোকটা পাশে থাকলে নিজেকে দূর্বল লাগে তার। শরীরের সব শক্তি রোধ হয়ে কেমন নেতিয়ে পরে। আদ্রর বুকের বা’দিকটায় মাথা রেখে হেলে পরলো বেলা। শার্ট ভেদ করে গলার কাছে নজর যেতেই সাদা রঙের আরও একটি ব্যান্ডেজ দেখতে পেল। বেশ দীর্ঘ ব্যান্ডেজ। দেখা মাত্র সরে আসতে চাইলো বেলা। আদ্র দিলো না। বাধ্য হয়ে ওভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনার বুকে ওটা কিসের ব্যান্ডেজ?” ক্ষীণ ব্যগ্র শোনালো তার কণ্ঠ। আদ্র নির্বিকার স্বরে উত্তর দিলো,
—“আঁচড় লেগেছে বোধহয়।”
—“সামান্য আঁচড়ে কেউ এত বড় ব্যান্ডেজ করে? আপনার আমাকে বোকা মনে হয়?”

আদ্রর কপালে দৃঢ় ভাঁজের দেখা দিলো, “একদম না।”
বেলা সেকথা কানেই তুললো না। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—“মিথ্যে বলছেন কেন আদ্র? এসব কিভাবে হয়েছে? হাত, বুক, কপাল এগুলো ছাড়াও কি আরো ক্ষত আছে?”
—“আছে।”

যতটা শান্ত আর নির্লিপ্ত ভাবে আদ্র কথাটা বললো, তার থেকেও দ্বিগুণ অশান্ত হলো বেলার মন। চোখে দারুণ জ্বালা হচ্ছে। তবে না কাঁদার অসহ্য প্র‍য়ার চালিয়ে যাচ্ছে সে। ধারালো নখ গিয়ে খামচে ধরলো আদ্রর বুকের শার্ট। আদ্র ব্যথা পেলেও কিছু বললো না। বেলা শুকনো গলায় আওড়ালো,
—“আপনি আমাকে এখনো বলছেন না, কিভাবে হয়েছে এসব?”

বেলার কেশবহুল মাথায় নিজের গাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আদ্র। ওয়ানওয়ে রোড দিয়ে মাঝে মাঝে ট্রাক, গাড়ি সাঁ সাঁ করে চলে যাচ্ছে। বাতাসের গতি একটুর জন্যে বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। সেসময় একটা ট্রাক আদ্রদের গাড়ি অতিক্রম করতেই অনলের ভীষণ তেজি ঝাপটা এসে ছুঁয়ে দিলো তাদের। বেলার চুল আবারও এলোমেলো হলো। আদ্র হাত বাড়িয়ে তা সযত্নে গুঁজে দিলো কানের পেছনে। গম্ভীর গলায় খুব কঠিন করে বললো,
—“এভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না বেলা। রাজনীতিবিদদের প্রাণের নিশ্চয়তা থাকে না। আমি তো তাও বেঁচে ফিরেছি। ইনশাল্লাহ এই নির্বাচনে আমারই জয় হবে।”

নখের সাহায্যে খামচে ধরা হাতটা দৃঢ় করলো বেলা। বলতে চাইলো, “রাজনীতি ভীষণ খারাপ আদ্র। ছেড়ে দিননা এসব। নিজের প্রিয়জন থেকেও কি এই পেশা আপনার কাছে বেশি প্রিয়?”

তবে বলা হয় না তা। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে শুধু। হৃৎপিণ্ডে হাহাকার তৈরি হয়।

বেলাকে এলাকার মূখ্য গেটে নামিয়ে গাড়ি ঘোরায় আদ্র। বাসায় এখন যাওয়া যাবে না। নির্বাচনের কিছু কাজও বাকি আছে। আপাতত দলের ক্লাবের উদ্দেশ্যে গাড়ি চালাচ্ছে সে। জানালার কাছে স্থির থাকা ফোনটায় আয়াজের কল আসছে বারবার। আদ্র ধরেনি একবারও। উলটো ফোন সাইলেন্ট করে দিয়েছে। কিন্তু যখন দেখল অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে, তখন সপ্তমবারের কলটি রিসিভ করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে আয়াজ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
—“এই তোর ফোন কোথায় থাকে? কতবার কল দিয়েছি খেয়াল আছে? কই তুই?”

আদ্র জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকালো একবার। আয়াজের চিৎকার পরোয়া না করে স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলো,
—“রাস্তায়। ক্লাবে যাচ্ছি।”
—“তুই অসুস্থ ভাই। এখন অনতত এসব কাজ বাদ দেয়। তোর চিন্তায় কান্না করছে মা। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।”

আদ্র ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
—“কয়েকদিন পরই নির্বাচন আয়াজ। এখন কোনোভাবেই কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।”
আদ্রর নাছোড়বান্দা ব্যবহারে বেশ বিরক্ত আয়াজ। অনেকটা রাগ নিয়েই বললো,
—“আমার তোকে নিয়ে সবসময় ভয় হয় ভাই। বাবার মতো তোকেও হারানোর ইচ্ছে নেই আমার। তবুও আমি তোর স্বপ্নকে সম্মান করি। প্রাধান্য দেই। কখনো তোকে বাঁধা দেই না। আজ যখন বাঁধা দিচ্ছি তখন তার পেছনে নিশ্চই কারণ আছে। আর কারণটা তুই ভালোভাবেই জানিস। আমি একা মায়ের কান্না থামাতে পারছি না। মা তোকে খুঁজছে বারবার। তুই কি আসবি?”

শুনে আদ্র অনেক্ষণ চুপ রইলো। হাতে ব্যথা পাচ্ছে সে। অবশ হয়ে আসছে যেন। আয়াজ আবারও ডাকতেই গাড়ি বাড়ির পথে ঘোরালো সে। মুখে বললো, “আসছি।”

এরপর বাড়ি আসার পর রেখা এক মুহুর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করলেন না আদ্রকে। জড়িয়ে ধরে রইলেন। কাতর কণ্ঠে আহাজারি করে উঠছিলেন,
—“তুই রাজনীতি ছেড়ে দেয় বাবা। আমরা এমনিতেই তো ভালো আছি। ছেড়ে দে না বাবা। রাজনীতিতে কি আছে?”
আদ্র তখন শুধু এটুকুই বলেছিল, “রাজনীতি আমার স্বপ্ন মা।”

গভীর রাত। বিছানার এপাশ ওপাশ করছে বেলা। ঘুম আসছে না। কতক্ষণ যে সে এমনিই চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল তার ইয়ত্তা নেই। তবুও চোখে ঘুম ধরছে না। তন্দ্রা যেন তুখর শত্রুতা করেছে তার সঙ্গে। সূদুর হতে এক নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘুম না আসার কারণ হিসেবে বেলা সেই পাখিটিকেই দোষারোপ করলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তায় মানুষজন নেই। দোকানপাট বন্ধ। যতদূর চোখ যায় সবার বাড়ির বাতি নেভানো। শুধু বাহিরের ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। ঘুমের অতলে ভাসমান সবাই। একা কি তবে সে-ই শুধু জেগে আছে? প্রশ্নের চাক্ষুষ উত্তর হিসেবে হঠাৎ আদ্রকে ছাদে দেখতে পেল বেলা। আদ্রর বারান্দা দিয়ে যেমন তাদের ছাদ দেখা যায়, তেমনি বেলার বারান্দা দিয়েও আদ্রদের ছাদ দৃশ্যমান।
রেলিংয়ের ওপর স্থির হয়ে বসে আছে আদ্র। হাতাকাটা গেঞ্জি পড়ায় শরীরের ক্ষত গুলো সুস্পষ্ট। বিশেষ করে হাতের ক্ষতটি। রেলিংয়ের ওপাশে পা দু’টো ঝুলিয়ে রেখেছে সে। বেলা আঁতকে উঠলো। লোকটার কি সাহস! ওখানে বসে থাকতে ভয় করছে না? কি নিশ্চিন্তে সিগারেট ফুঁকছে! বেলা না চাইতেই চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ওখানে বসে আছেন কেন? পরে যাবেন তো। নামুন!”

আদ্র অল্প চমকালেও তা নজরে এলো না। ঘাড় বেঁকিয়ে বেলার দিকে তাকালো সে। বেলাকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
—“এখনো ঘুমাননি কেন? বারান্দায় কি?”

বেলা জবাব দেয় না। উলটো আবারও চেঁচিয়ে বলে, “নামছেন না কেন? এমনিতেই আপনি অসুস্থ। এখান থেকে পরলে কি হবে জানেন?”
কথাটা বলে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় বেলা। খুব জোড়েই কথা বলে ফেলেছে সে। বিহান বিরক্ত হয়ে ওদিক ফিরে শুয়েছে। বলছে, “এভাবে চিল্লাচ্ছো কেন বুবু? ঘুমাচ্ছি তো!”
বেলা দমে গেল। ছাদের দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখল, আদ্র হাসতে হাসতে রেলিং থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। সিগারেট নেই হাতে। নত বেলার দিকে চক্ষুদ্বয়ের বেহায়া চাহনি স্থির করে প্রশ্ন করলো,
—“আপনাকে কখন বেশি সুন্দর লাগে তা জানেন?”

বেলার জানতে ইচ্ছে করলো খুব। লজ্জায়, জড়তায় মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলো না। চুপ রইলো। আদ্রর দিকে তাকালোও না। আদ্র বেলার দিকে চেয়েই রইলো। ঘোর লেগে গেছে যেন। আবিষ্ট কণ্ঠে বললো,
—“আপনার কান্না দেখার জন্য হলেও আপনাকে আমার লাগবে বেলা।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here