প্রিয় বেলা – পর্ব ১৭

0
351

প্রিয় বেলা

১৭.
কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুতে পৌঁছাতে বেশ সময় নিলো। আদ্র স্থির ভঙ্গিতে তখনো সোফায় মাথা হেলিয়ে রেখেছে। সে কি শুনেনি তার কথা? নাকি বুঝতে পারে নি? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো আয়াজ। আদ্রর ক্লান্ত, কঠিন মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সাহস জুগিয়ে আবার বললো,
—“ভাই শুনছিস আমার কথা? বেলাকে পাত্র দেখতে এসেছিল আজকে।”

আদ্র শুনলো এবার। চোখ মেললো। সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসা রক্তিম নেত্রজোড়া দৃশ্যমান হলো। কি ভয়ংকর সেই লাল শিরাগুলো। চোখের মণি ঘিরে রেখেছে। আদ্র আয়াজের মুখোমুখি বসল। খুব শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় সাবধান করলো,
—“ক্লান্ত লাগছে আমার। মাথাও ঠিক নেই। চটে আছি। তুই কি চাচ্ছিস আমার মেজাজটা আমি তোর ওপর দেখাই?”

আয়াজ চোখ বড়সড় করে তাকালো। দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না করলো। তারপর সর্তক কণ্ঠে বললো,
—“সত্যি বলছি ভাই। সন্ধ্যায় এসেছিল ওরা। মাও গিয়েছিল। পাত্রর নাকি বেলাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সায়েদ আঙ্কেল এখনো কিছু জানান নি। তোর বিশ্বাস না হলে সকালে মাকে জিজ্ঞেস করিস। আমি মিথ্যা বলছি না।”

আদ্রর চোয়াল শক্ত। নিদারুণ কঠিন্যতায় ভরপুর মুখশ্রী। কোনোরকম রাগ আটকে রেখেছে সে। আয়াজের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পরলো আদ্র। আয়াজ তাড়াতাড়ি করে বললো, “মা তো এখন ঘুমাচ্ছে ভাই। সকালে জিজ্ঞেস করিস। তোর কি আমার কথায় বিশ্বাস নেই?”
আদ্র উঁচু গলায় সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, “নেই।”
আয়াজের চোয়াল যেন হা হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, “একেই বলে মীরজাফর। নিজের প্রাণপ্রিয় ঘুম ধ্বংস করে তার কলিজা, ফুসফুসের সব খবরাখবর রাখছি আমি! অথচ আমারই দাম নেই। এইজন্যই ভালো মানুষগুলো দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত আজ। কি একটা অবস্থা!”
আপন মনে কথাগুলো বলে সটান হয়ে সোফায় শুয়ে পরলো আয়াজ। রুমে যাওয়ার শক্তি নেই। ঘুমে শরীর ভেঙ্গে আসছে তার।

রুমে যেতে যেতে দুইতিনবার বেলাকে কলও করে ফেললো আদ্র। অস্থির হয়ে শরীর থেকে শার্ট খুলে নিলো। উষ্কখুষ্ক চুলগুলোয় হাত চালালো বারংবার। হাতের ব্যান্ডেজ, বুকের ব্যান্ডেজ অসহ্য লাগছে খুব। ঠিকমতো হাত নাড়ানো যাচ্ছে না। একটানে তা খুলে ফেলতেই ক্ষীণ রক্ত বেড়িয়ে এলো বুকের ক্ষত হতে। ক্ষত স্থানটা তখনো শুকায়নি। বিরক্ত হয়ে টিস্যু দিয়ে রক্তগুলো মুছে নিলো আদ্র। বিছানায় বসে আবারও কল লাগালো বেলাকে। একবার, দু’বার, তিনবার, অনেকবার। মেয়েটা তবুও ফোন ধরলো না। অসহ্য অবহেলায় তন্দ্রা কাটিয়ে দিলো তার। চাপা রাগে মাথার যন্ত্রণা দ্বিগুণ বেড়ে গেল যেন। হাতের ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরলো আদ্র। হাতে ব্যথা পেল। তবে তা হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হতে খুব কমই বটে।

টিউশন শেষে ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে এদিক-ওদিক একবার তাকালো বেলা। ওইযে, একটু দূরে করিম চাচার রিকশা। রিকশায় বসে আরাম করে লাল চা খাচ্ছেন তিনি। বেলা কাছাকাছি হতেই বিস্তর হাসলেন। মিটমিটে কণ্ঠে আগেভাগেই বললেন, “তোমারে আইজকা নিয়া যাউতে পারুম না মা। স্যারে মানা কইরছে।”
বেলা যারপর নাই অবাক হলো। জানতে চাইলো, “কেন? কেন মানা করেছে?”
—“তা জানি না মা। তোমারে কইছে এইহানে দাঁড়াইতে। স্যারই তোমারে নিয়া যাইবো কইছে। আইতাছে।”

বেলা আর প্রশ্ন করলো না। বিশাল বিস্ময় নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। করিম চাচা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলেন তাকে, চা খাবে কিনা। সে মানা করে দিয়েছে।
আদ্র এলো মিনিট খানেক পর। সাঁ করে কালো রঙের গাড়িটা থামলো বেলার ঠিক সামনে। আকস্মিক হওয়ায় বেলা ভয় পেয়ে দুকদম পিছু হটে দাঁড়ালো। কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই গাড়ির দরজা খুলে আদ্র গম্ভীর আওয়াজে বললো, “উঠো।”

আদ্র আজকে ড্রাইভার আনেনি। নিজেই ড্রাইভ করছে। তার পাশের সীটের দরজা খুলে দিলো এইমাত্র। বেলা ধীরস্থির ভাবে বসতেই তৎক্ষণাৎ গাড়ি চলতে শুরু করলো। নিষ্ঠুর চোখেজোড়া মেলে বেলার পানে একবার তাকাচ্ছেও না আদ্র। শুধু গম্ভীর, ক্রোধপূর্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“আজকাল দেখছি বিয়ের খুব সখ জেগেছে। পাত্রদের সামনে সেজেগুজে বসে যাচ্ছে। নিজের রুপ দেখাচ্ছে। এত সাহস কোথায় পাচ্ছে এরা? ভয় লাগে না? বুক কাঁপে না একটুও?”

বেলা ভয়ে ঢোক গিললো। কি বলবে বুঝে পেল না। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো ক্রমশই। লোকটাকে তো সে ভয় পায় না৷ আজকে পাচ্ছে কেন? কাঁপা স্বরে কিছু বলতে নিলেই আদ্র আবার প্রশ্ন করলো,
—“ফোন কোথায় থাকে আপনার? কাল রাত থেকে কতবার কল করেছি। দেখেন নি?”
বেলা ঠোঁট কামড়ে চারপাশটায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ক্ষীণ স্বরে বললো, “দেখেছি।”

আকস্মিক জোড়ে ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র, “তাহলে কলব্যাক পাইনি কেন আমি? আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয়না? বলুন! হয়না?”
বেলা কেঁপে উঠলো। ভীতু চোখে তাকালো। লোকটাকে সে চিনতে পারছে না। এমনটা তো করেনি কখনো। আজকে এভাবে রাগ দেখাচ্ছে কেন? ধমকাচ্ছে কেন? বেলা মাথা নুয়ালো। কাঁপা গলায় থেমে থেমে বললো,
—“সকালে দেখেছিলাম। পরে কলব্যাকও করতাম। কিন্তু মনে ছিল না আর। সরি।”

আদ্র সশব্দে স্টেয়ারিংয়ে ধাক্কা মারলো। হকচকিয়ে তাকালো বেলা। আড়চোখে আদ্রকে দেখল। সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। নিশ্বাসের গাঢ় শব্দ শোনা যাচ্ছে খুব প্রখর ভাবে। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে। কপালের রগগুলো ফুলে ভয়ংকর অবস্থা। গৌর বর্ণের মুখশ্রী কি রুঢ়, দাম্ভিক! সাহস নিয়ে কম্পয়মান হাতটা আদ্রর হাতের পিঠে রাখলো বেলা। কোমল স্বরে বললো, “এত রেগে যাচ্ছেন কেন? শান্ত হন। আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”
আদ্র প্রবল ক্রোধ নিয়ে আবারও ধমকের রেশ নিয়ে বললো,
—“আপনার এই হয়ে যাচ্ছে না নিয়ে বসে থাকবো আমি? যদি হয়ে যেত? তখন আমি কি করতাম?”
থামাথামি ছাড়া আদ্র আবারও বললো, “তোমাকে আমি আর আপনি করে বলবো না। সাহস বেড়ে গেছে তোমার। আপনি, আপনি বলে ডাকি বলে দাম দিচ্ছো না। অধিকার নেই নাকি আমার? দেখেছো কি এখনো?”

বেলা চুপ হয়ে গেল। এ কথার পিঠে কি বলা উচিত? জোড় গলায় কি বলবে, ‘আপনার কোনো অধিকার নেই। আমাকে তুমি করে বলতে পারবেন না। আপনি করে বলুন।’
কিন্তু লোকটার মুখে তাকে তুমি সম্বোধন করাটা তো তার খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগায় সিক্ত করে তুলছে ভেতরটা। কি প্রাণনাশক ডাকটা। কি গম্ভীর সুন্দর! বেলা আর মানা করলো না। কিচ্ছুটি বললো না এনিয়ে।
আদ্র ড্রাইভ করছে। নিজ থেকে বেলার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। বেলা একবার বাহিরে তাকালো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সূর্য ডুবে গেছে সেই কবে। বেলা মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো, “বাসায় ফিরবেন না?”

আদ্রর উত্তর নেই। কপাল খানিক কুঁচকে গেছে। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ ভাব। বেলা ইতস্তত করলো। আধো গলায় বললো,
—“আমি তো বিয়ে করতাম না।”
—“কেন করতে না?” তৎক্ষণাৎ উত্তর এলো ওপাশ থেকে।
বেলা আদ্রর দিকে তাকালো। লোকটা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে। কপালের ভাঁজগুলো মিলিয়ে গেছে। তবে গম্ভীর ভাব এখনো বিরাজমান। বেলা সময় নিয়ে, আমতা স্বরে আগের মতোই বললো,
—“আপনাকে রেখে কিভাবে করবো?”

শুনে ক্ষীণ থমকালো আদ্র। এরপরই নিঃশব্দে হেসে ফেললো সে। বেলা দেখতে পেল না। গাড়ি থেমে গেল কড়া ব্রেকে। উজ্জ্বল চোখে তাকালো। নিষ্প্রভ স্বরে বললো, “দেখি, বুকে আসো। অনেক জ্বালিয়েছ।”

বেলা পিটপিট করে তাকালো। মানা করার জন্য উদ্যোগী হলেও সুযোগ দিলো না আদ্র। টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। খুব প্রগাঢ় ভাবে, ঘনিষ্ট হয়ে। বেলা লজ্জিত ভঙ্গিতে একটু জড়োসড়ো হলো। আদ্র কি ভেবে হঠাৎ বললো, “ছেলেটার নাম কি?”

বেলা বুঝলো না যেন। জিজ্ঞেস করলো,
—“কোন ছেলে?”
—“তোমাকে যে দেখতে এসেছিল।”
—“কেন?”
—“লাগবে আমার।”

বেলা আতঙ্কিত হয়ে তাকালো। উৎকণ্ঠ হয়ে বললো, “আপনি কি মারপিট করতে চাইছেন?”
আদ্র ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। উত্তর দিলো,
—“হ্যাঁ।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here