প্রিয় বেলা – পর্ব ২০

0
546

প্রিয় বেলা

২০.
সরকারি হাসপাতালগুলোর মতোই অতি সাধারণ এই হাসপাতালটিও। নিয়ম-কানুন বাঁধা নেই। বৃষ্টির দরুণ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। মস্তবড় রুমগুলোয় শত শত রোগীর অবস্থান। সেই রুমগুলোর একটিতে বেলাকে দেখতে পেল আদ্র। এককোণের এক বিছানায় ঘুমিয়ে আছে সে। পরনের ভেঁজা শাড়িটি পালটে হাসপাতালের সাদা পোষাক গায়ে জড়ানো। দৃশ্যমান কপাল, থুতনি, হাত, পায়ের গোড়ালি সবটাই যেন পাষাণ ব্যান্ডেজের দখলে। ডান গালটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ব্যান্ডেজ না থাকলেও নাজুক চামড়া ছিঁলে কি করুণ দেখাচ্ছে! রক্তিম হয়ে আছে পুরো মুখশ্রী। আদ্রর নিশ্বাস আটকে আসলো যেন। স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়ালো। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়েই রইলো সে। কঠিন্যতার আবরণ উবে গেল। বিকালের সময়টাতেও তো মেয়েটা তাকে দেখে কিভাবে লজ্জা পাচ্ছিল। সুশ্রী শাড়িতে কি চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছিল তাকে। তবে এখন কি হলো মেয়েটার? এমন নির্জীব হয়ে পরে আছে কেন?
পেছনে থেকে করিম চাচা একটু রয়েসয়ে কাঁদো গলায় বললেন,
—“এতক্কন অজ্ঞান ছিল। জাগন হওয়ার ফর থেইকা ব্যতায় কানছে। যহন কইলাম তুমি আইবা, তথন এট্টু শান্ত হইছে। এট্টু আগেই ঘুমাইলো মাইয়াডা।”

আদ্র প্রতিত্তরে কিছুই বললো না। তার কঠিন দৃষ্টি বেলাতেই স্থির। চোয়াল শক্ত। হাসপাতালে আসতে গিয়ে শার্টের কাঁধের অংশটুকু বাজেভাবে ভিঁজে গেছে। এলোমেলো চুলগুলো পানিতে আরও চুপসে আছে যেন। চোখের কোণ ঘেঁষে বিন্দু বিন্দু পানি গড়াচ্ছে। করিম চাচা আবারও বলতে চাইলেন,
—“তোমার লাইগা টুল আনমু? বসবা?”

আদ্র গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,
—“লাগবে না। আপনার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আপনি বাসায় চলে যান। রিকশার যা ক্ষতি হয়েছে সব আমি কালকে দেখব।”

কৃতজ্ঞতায় নেত্রজোড়া জলে ভরে গেল উনার। আবারও কেঁদে ফেলে বললেন,
—“তুমি অনেক ভালা বাজান। বেলা মায় তাত্তাড়ি ঠিক হইয়া যাইবো। তুমি চিন্তা কইরো না।”
করিম চাচা চলে গেলেন। আদ্র আস্তে ধীরে বেলার পাশে বসলো। ব্যান্ডেজ করা হাতটা আলতো করে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। এতক্ষণের আটকে রাখা দূর্বলতা নিমিষেই বেরিয়ে এলো যেন। বক্ষস্থল নিদারুণ সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় শিরশির করে উঠলো। চোখ ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসলো। ঢিমে যাওয়া গলায় সে খুব আস্তে করে বললো,
—“আমায় ক্ষমা করবে বেলা। আমি ঠিকমতো তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি।”

আদ্র মাথা ঝুঁকালো। হাতের পিঠে কপাল ঠেকিয়ে অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। বেলার বিছানা থেকে মাঝারি জানালাটা কিঞ্চিত দূরে অবস্থিত। বৃষ্টির ছিঁটে না আসলেও তেজি অনলের হিম শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে দিচ্ছে ওদের।
আদ্রর ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো আরও এলোমেলো হলো। ঠান্ডায় অল্প কেঁপে উঠলো বেলা। বন্ধ চোখজোড়া পিটপিট করলো। আস্তে আস্তে চোখ মেললো সে। মাথাটা ভারী লাগছে। টনটন করছে কপালের রগ। শরীরের ক্ষতগুলো যেন নতুন উদম্যে গা জ্বালানো ব্যথায় মেতে উঠেছে। চোখে কিছু দেখতে পারছে না। সব ঝাঁপসা। আধো, আধো। কয়েক সেকেন্ড গড়ালো। ঝাপসা জিনিসগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো হঠাৎ। নিজের সামনে আদ্রকে দেখে কয়েকদফা চমকালো বেলা। কিছুপলক চেয়ে থেকে দূর্বল গলায় কোনোমতে ডাকলো, “আদ্র।”

আদ্র শুনলো না যেন। কিছুক্ষণ ওভাবেই রইলো। তারপর ছট করে মাথা তুলে তাকালো তার পানে। বেলার চোখে তখন জলরাশিরা এসে ভীর জমাচ্ছিল। কিন্তু তা গাল অব্দি পৌঁছানো দুঃসাহস করতে পারেনি। খুব কঠিন হয়ে বেলা বললো,
—“কেন এসেছেন আপনি? চলে যান।”
আদ্র আহত নয়নে তাকালো। রদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বললো, “আমি সরি বেলা। তোমার কাছে পৌঁছাতে খুব দেড়ি করে ফেলেছি।”

ওমনি দুঃসাহসি হয়ে জলগুলো গাল ছুঁয়ে দিলো। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ফেললো বেলা। আটকে আসা কণ্ঠে প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে অভিযোগ করে উঠলো,
—“আপনি খুব খারাপ আদ্র। সত্যিই দেড়ি করে ফেলেছেন আসতে। আরও আগে আসেননি কেন? রাস্তায় পরেছিলাম আমি। কেউ এগিয়ে আসেনি সাহায্য করতে। আমার ভেঁজা শরীরটার দিকে বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছিল। যন্ত্রণায় আমি কাতরাচ্ছিল। মনে মনে আপনাকে খুব করে চাইছিলাম। কিন্তু আপনি আসেননি। হাসপাতালের ব্যাডে যখন ঔষধ লাগাচ্ছিল, তখন খুব জ্বলছিল ব্যথাগুলো। আমি তখনো আপনাকে নিজের পাশে চাচ্ছিলাম। আপনি তবুও আসেননি। এখন কেন এসেছেন? আপনার সহানুভূতি চাই না আমার। চলে যান। যাচ্ছেন না কেন? চলে যান এখান থেকে।”

বেদনাদায়ক করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো খুব সন্তপর্ণে। বুকটা খুব ভারী ভারী লাগছে। ছেলেরা কাঁদতে পারেনা কেন? আদ্রর খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। চেষ্টা করেও পারছেনা। অসহ্য লাগছে সব। গলায় যেন কাঁটা বিঁধে আছে। আদ্র ঝুঁকে বেলার কপালে কপাল ঠেকালো। ব্যথার কারণে তাকে সরাতে পারলো না বেলা। প্রবল প্রতিবাদী হয়ে বললো,
—“সরুন আমার কাছ থেকে। ছোঁবেন না আমায়। চলে যান। আর আসবেন না। কখনো আসবেন না।”
আদ্রর ধীর গলা, “হুশশ! কথা বলবে না বেলা।”

বেলা সত্যি সত্যি চুপ হয়ে গেল। আর একটা কথাও বললো না। চোখ বুজে নিলো। আদ্রর উষ্ণ নিশ্বাস তার পুরো মুখশ্রী জুড়ে ঘুরছে। প্রচন্ড হাহাকার করছে দু’জনের ভেতরটা।
আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো, “আমার ভেতরের তোলপাড় কি তুমি শুনতে পারছো বেলা? বিশ্বাস করো, আমি আগে জানলে কখনোই তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতাম না। নিরুপায় ছিলাম। তোমার কাছে তাড়াতাড়ি আসতে পারছিলাম না। জ্যামের কারণে রাস্তা পালটে এসেছি কতবার! আমার নিশ্বাসের গতি বুঝতে পারছো? কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আমার নিজেকে অসহায় লাগছে বেলা। এতটা অসহায় আমি কখনোই হয়নি। বিশ্বাস করো, কখনো না।”

আদ্র থামলো। নিশ্বাসের গতি আরও বেড়ে গেল। বেলা তার ক্ষতবিক্ষত হাতটা আদ্রর পিঠে বহুকষ্টে রাখলো। ক্রন্দনরত হয়ে কম্পয়মান গলায় বললো,
—“আপনার জন্য আমি ঘড়ি কিনেছিলাম আদ্র। ওটা আর দিতে পারলাম না।”
আদ্র মনে মনে তখন বললো, “আমিও তো একবুক ভালোবাসা এনেছিলাম বেলা। ওটাও আর দেওয়া হলো না।”

আদ্র সরে এসেছে। বেলা উঠে বসতে চাইলো। কিন্তু হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার ক্ষমতা নেই। তা দেখে আদ্র সচকিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
—“কি হয়েছে? ব্যথা পাচ্ছো? ডাক্তার ডাকবো?”
বেলা মাথা নাড়ালো। অর্থ্যাৎ না।
—“তাহলে কি হয়েছে?” ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে শুধালো আদ্র।
—“উঠে বসতে পারছি না।”

মুহুর্তেই বেলার অতি নিকটে এসে কাঁধে তার মাথাটা আলতো করে রাখলো আদ্র। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। বালিশগুলো ঠিক করে বেলাকে হেলান দিয়ে বসালো। কিন্তু নিজে সরলো না। বেলার গালে বৃদ্ধাঙ্গুল বোলালো বেশ কয়েকবার। আশেপাশের রোগী, তাদের স্বজন সবাই বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার ভীষণ অপ্রতিভ হলো বেলা। আদ্রকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে মিনমিনিয়ে বললো,
—“সরুন।”
আদ্রর পছন্দ হলো না কথাটি। চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো সে, “মানে?”
—“সবাই আমাদের দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে। আমার অস্বস্থি হচ্ছে। সরুন।”

আদ্র দৃষ্টি ঘোরালো। সবার নজর তাদের দিকেই স্থির। কেউ অবাক হচ্ছে, কেউ মিটিমিটি হাসছে। আদ্রর ভালো লাগলো না। রাগ হলো প্রচন্ড। এভাবে তাকিয়ে দেখার কি আছে? ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে। কেবিন নিতে হবে। এই খোলামেলা রুমটিতে বেশিক্ষণ থাকাও যাবে না। বিপক্ষদলের কেউ দেখলে সমস্যায় পরতে হবে।
রুম থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যোগী হতেই হঠাৎ হাতে টান পরলো আদ্রর। অবিন্যস্ত ভাবে তার হাতের তিনটে আঙুল ধরে রেখেছে বেলা। আদ্র তাকাতেই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনি কি চলে যাচ্ছেন?”
আদ্র উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই বেলা আবার আগের মতোই বলে উঠলো, “যাবেন না দয়া করে। এখানে একটু বসুন না। আমার একা একা থাকতে ভালো লাগে না।”

প্রেমিকার সিক্ত অনুরোধের পিঠে কথা বাড়াবার সাহস পেল না প্রেমিক। বাধ্যের ন্যায় বসে পরলো। কোমলস্বরে বললো,
—“আচ্ছা, যাচ্ছি না। এইযে হাত ধরলাম। এখানেই থাকবো।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here