প্রিয় বেলা
২৪.
দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ-ই হোঁচট খেয়ে পরে যেতে নিলো বেলা। বাম পায়ের বুড়ো আঙুল কেমন বেঁকে যাচ্ছিল। কোনোমতে নিজেকে সামলালো সে। বেখেয়ালি শরীরটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো। তড়িৎ গতিতে রুপাও অতি ভীতু মনে বেলার বাহু টেনে ধরলো। কটমটে গলায় ধমকের সুরে বললো,
—“এত হুলস্থুল কান্ড ঘটাচ্ছিস কেন বেলা? কোথাকার কোন ট্রেন ছুটে যাচ্ছে? আস্তে হাঁট!”
কাঁধের ব্যাগটা ঢিলে হয়ে পরে যাচ্ছিল। তা ঠিক করে এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজলো বেলা। অনভ্যস্ত কণ্ঠে মিথ্যা বললো,
—“বাড়িতে মেহমান আসবে। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।”
রুপা বড় বড় চোখে তাকালো,
—“মেহমান বলতে? তোকে আবার দেখতে আসবে নাকি?”
—“নাহ্। এমনিই আসবে।” ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো বেলা।
রুপা শুনলো। সামান্য ‘ওহ্।’ বলে চুপ হয়ে গেল। হাতে থাকা ফোন চালু করলো। ইউটিউবে ঢুকে কি যেন টাইপ করলো সে। উৎফুল্ল মনে একটা ভিডিও ছেড়ে বেলাকে দেখাতে দেখাতে বললো,
—“দেখ বেলা, আমাদের কুমিল্লার নতুন এমপি। আদ্র ইয়ানিদ। সুন্দর না দেখতে?”
বেলা শান্ত নেত্রে তাকালো। ফোনের স্ক্রীনে ঘর্মাক্ত আদ্রকে দেখা যাচ্ছে। চোখ-মুখ কুঁচকে ভাষণ দিচ্ছে সে। রোদে জ্বলজ্বল করছে মুখশ্রী। বরাবরের মতোই কঠিন তার কণ্ঠের তেজ, গা শিরশির করে কাঁপিয়ে তোলার মতো। বেলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। রুপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলতেই রইলো,
—“উনাকে যে আমার কি ভালো লাগে! উনার একটা ভাইও আছে জানিস? আয়াজ মেহেরাব। একদম ওনার মতো দেখতে। টুইনস ওরা।”
বেলা আড়চোখে আরও একবার ভিডিওটির দিকে তাকালো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
—“জানি। উনারা আমাদের এলাকাতেই থাকেন।”
কথাটা রুপার কানে প্রবল ঝংকার তুললেও তা বিশেষ আমলে নিতে পারলো না সে। বিশ্বাস করলো না। মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো, “ধুর! মিথ্যা বলছিস কেন?”
মনে মনে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো বেলা। মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছিল সে। ভাগ্যিস রুপা বিশ্বাস করেনি। নয়তো এ খবর পুরো ভার্সিটিতে রটিয়ে ছাড়তো সে।
–
ভার্সিটির পেছনের পিচঢালা রাস্তায় কালো গাড়িটি দাঁড় করানো। নির্জন জায়গা। ড্রাইভার আর আকিবকে ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছে না বেলা। আকিব বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল সে। বেলাকে দেখতে পেয়ে অল্প মুচকি হাসলো। নম্র স্বরে বললো,
—“কেমন আছেন ভাবী?”
প্রতিউত্তরে বেলাও লাজুক হেসে বললো, “ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”
—“আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনার জন্যই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাই ভেতরে অপেক্ষা করছেন।”
বলে গাড়ির পেছনের সীটের দরজা খুলে দিলো আকিব। বেলা নিঃশব্দে ভেতরর গিয়ে বসতেই একদফা চমকালো। বড় মাপের ব্যস্ত নেতা তার সঙ্গে দেখা করতে এসে আরাম করে সীটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার নিশ্বাসের থেকে থেকে চলাচল বেলা তীব্র ভাবে শুনতে পারছে। এসির পাওয়ার অতিরিক্ত করে রাখা। কালো রঙের জানালার কাঁচগুলো উঠানো। বাহিরের কেউ ভেতরটা দেখার জো নেই। একহাত কপালে রেখে ঘুমাচ্ছে লোকটা। গায়ে ভিডিওর সেই সাদা পাঞ্চাবী। বুকের প্রথম তিনটে বোতাম খোলা। লোমশ বক্ষস্থল ক্ষীণ দৃশ্যমান। ঘাড় বেয়ে ঘামের সূক্ষ্ণ রেখা স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে।
বেলা হাঁসফাঁস করলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। লোকটা কি উঠবে না? বাহিরে তাকিয়ে সবাইকে একবার পরখ করে নিলো সে। আকিব আর ড্রাইভার দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বেলা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ইতস্তত হাতে আদ্রর চওড়া কাঁধে আলতো ধাক্কা দিলো। মৃদু স্বরে ডাকলো,
—“আদ্র। শুনছেন? আদ্র?”
আদ্র অল্প নড়েচড়ে উঠলো। তন্দ্রা কেটে গেল নিমিষেই। কপাল থেকে হাত সরালো। চোখ মেলল ধীরস্থির ভাবে। প্রচন্ড বাঁকানো ভ্রুযুগল নিয়ে কিছুক্ষণ গাঢ় নেত্রে চেয়ে রইলো অবুজ প্রেয়সীর দিকে। মুখশ্রী জুড়ে একরাশ ঘুমু ঘুমু ভাব তার। ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে সে খুব গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
—“কখন এসেছো?”
বেলা আড়চোখে সুদর্শন পুরুষটির দিকে একপলক তাকালো। জবাবে ছোট্ট করে বললো, “কিছুক্ষণ আগে।”
দু’হাতে চোখ কচলে ঠিক হয়ে বসলো আদ্র। বাহিরে দৃষ্টি ফেলে কি যেন দেখল। অনুমতি ছাড়াই বেলার ওড়নার একাংশ টেনে ঘর্মাক্ত ঘাড় মুছলো। গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লো,
—“ইমরান! এদিকে আসো।”
সঙ্গে সঙ্গে আকিব আর ড্রাইভার এগিয়ে এলো। আদ্রর দিকে উৎসুক চোখে চাইতেই সে বললো,
—“বাসায় যাবো। গাড়ি ছাড়ো।”
ড্রাইভার মাথা ঝাঁকালো। গাড়িতে বসে পরলো বিনা বাক্য ব্যয়ে। আকিব তখন জানালায় ক্ষীণ উঁকি মেরে বললো,
—“আমি তবে চলে যাচ্ছি ভাই? দরকার হলে ফোন করবেন। আমি আবার আসবো।”
আদ্র মুখে কিছু বললো না। হালকা মাথা কাত করলো মাত্র।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নিরবতার প্রখরতা খুব। আদ্র চুপচাপ, শব্দহীন ভাবে বেলার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি স্থির, অনড়। তীক্ষ্ণতায়, দৃঢ়তায় ভরপুর। বেলার গাল ভারী হয়ে আসছে। লজ্জায়, অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আছে সে। এভাবে তাকানোর কি আছে? লোকটা কি বুঝতে পারছে না, তার যে খুব লজ্জা লাগছে। প্রেমিকের দৃষ্টির পিঠে সিক্ত বেলা আড়ষ্ট হচ্ছে বারবার।
জোড়ালো গলায় বেলা বললো,
—“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার অস্বস্তি হচ্ছে। অন্যদিকে তাকান।”
আদ্র নিমগ্ন স্বরে উত্তর দিলো, “তুমি মিথ্যে বলছো বেলা। তোমার অস্বস্থি হচ্ছে না। একদমই হচ্ছে না।”
—“আপনার ধারণা ভুল। অন্যদিকে তাকান।”
আদ্র শুনলো না। দূর্বোধ্য হাসলো। বেলার লজ্জা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে শুধালো,
—“তোমাকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে বেলা।”
লজ্জায় সে আর কথাই বলতে পারলো না। তাকালোও না। আদ্র আবারও সীটে হেলান দিয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বুজলো। হতাশ কণ্ঠে বললো,
—“তোমাকে শাড়ি পরিয়ে আমার রুমে বসিয়ে রাখার ইচ্ছেটা মাথা চড়া দিয়ে উঠছে বেলা। তোমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা বাজেভাবে আহত করছে। তুমি একটু বাজে হতে পারলে না? এত সুন্দর হতে কে বলেছিল তোমায়?”
প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো বেলা। পরক্ষণেই ড্রাইভারের কথা মস্তিষ্কে হানা দিতেই রেগে তাকালো সে। ঝাঁঝালো কণ্ঠের রেশ ধরে বিশাল নেত্রে পলক ঝাপটালো। বললো,
—“সমস্যা কি আপনার? ড্রাইভার সামনে না?”
আদ্র ঠাট্টার সুরে ড্রাইভারকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো,
—“আমার কথা কি তুমি কিছু শুনেছো ইমরান?”
সে মিটিমিটি হেসে মাথা দুলালো, “না ভাই।”
আদ্র জয়ের হাসি এঁটে বেলাকে বললো, “দেখেছো? শুনেনি।”
–
সময় গড়ালো। গাড়ি থামলো এলাকা থেকে বেশ অনেকটা দূরে। গাছের আড়াল করে। বেলা ধীর পায়ে নেমে পরলো। আদ্রর দিকে একবার চেয়ে চলে যেতে নিলেই তার হাত শক্ত করে ধরে ফেললো আদ্র। কোত্থেকে গোলাপের একটা তোড়া বের করে ধরিয়ে দিলো তার হাতে। বেলা অবাক চোখে তাকালো। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র কেমন অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠলো,
—“কথা দিচ্ছি বেলা, গোলাপগুলোর পাঁপড়ি পরে যাওয়ার আগেই তোমাকে আমার ঘরে তুলবো।”
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা