প্রিয় বেলা – পর্ব ২৫

0
367

প্রিয় বেলা

২৫.
বাতাসে কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। আদ্র একদমই সহ্য করতে পারে না এই গন্ধ। হাঁচি হয়, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রুমাল নাকে চেপে ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারাজে রেখে আসতে বললো সে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশপাশটা একবার দেখে নিলো। না! কাউকে তো কিছু পোড়াতে দেখা যাচ্ছে না। তবে ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারিদিক। বিরক্ত হয়ে আদ্র দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো,
—“রাহেলা আন্টি। কোথায় আপনারা? পোড়া গন্ধ কোথা থেকে আসছে? স্প্রে করেননি কেন এখনো?”

রাহেলা দিলদার দৌঁড়ে এলেন। মোটা শরীর নিয়ে দৌঁড়ঝাপ করা একটু বেশিই কষ্টকর। এসে ক্ষীণ সময় হাঁপিয়েই কুল পেলেন না। তাড়াতাড়ি মুখ চালিয়ে বললেন,
—“আপা পুরান জিনিস পুরাইছিলো ইকটু আগে। ওইটারই পুড়া গন্দ আইতেছে।”

তিক্ত মেজাজটা চড়া দিয়ে উঠলেও আদ্র কথা বাড়ালো না। কণ্ঠে কঠিনতা এনে বললো,
—“একটু আগে হলে এখনো রুমস্প্রে করেন নি কেন? এসিও বন্ধ। আমি যে পোড়া গন্ধ সহ্য করতে পারি না, তা জানেন না আপনি?”
রাহেলা মাথা নুয়ালো। মলিন কণ্ঠে বললো,
—“ছোরি, ছোরি। ভুইলা গেছিলাম। এহনই দিতাছি।”

রাহেলা আবারও ছুটলো। আদ্র সেদিকে একবার চেয়ে সোজা ঘরে চলে গেল। এসির তাপমাত্রা কমিয়ে শীতলতা বাড়িয়ে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এসেই ল্যাপটপ নিয়ে বসলো সে। ই-মেল চেক করতে লাগলো একে একে।
রেখা ছেলের দরজার সামনে জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক্ষণ যাবত। ছেলে তার অনেকদিন হলো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। হুটহাট পাশে বসে বলে না, “আজকের দিনটা অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে মা। হাত ধুঁয়ে-টুয়ে ভাত খেতে পারবো না এখন। খাইয়ে দাও তো।”
কোলটা কেমন খালি খালি লাগছে। রেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেড়ানো দরজায় আলতো ধাক্কা দিলেন। নিমিষেই খুলে গেল তা। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। আদ্র মাত্র একবার তাকালো। দৃষ্টি ফেরাতে ফেরাতে বললো,
—“কোনো প্রয়োজন মা?”

রেখা আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিঃশব্দে ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন। হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
—“আর কত আদ্র? আর কত শাস্তি দিবি?”

কি-বোর্ডে অনবরত টাইপ করতে থাকা আঙুলগুলো ক্ষণিকের জন্য থমকালো। পলক পরলো দু’বার। ফের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে নিষ্প্রাণ স্বরে বললো,
—“শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো মা। আমি না।”
—“আমি কি শাস্তি দিচ্ছি তোকে? আমি শুধু মেয়েটার ভালো চাচ্ছি আদ্র। আমি চাই না আমার মতো কষ্ট কেউ করুক। তোর বাবা যখন মারা গেল তোরা তখন মাত্র পনেরো বছরের ছিলি। তোর দাদার ব্যবসা না থাকলে পথে নামতে হতো আমাদের। আব্বা কতবার তোদের রেখে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাকে, জানিস? কতটা মানসিক যন্ত্রণা আমি সহ্য করেছি তার অনুমান কখনো করেছিস? কখনো বুঝতে চেয়েছিস আমার কষ্ট?”

আদ্র ল্যাপটপ পাশে রেখে দিলো। পূর্ণ দৃষ্টে শান্ত ভাবে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বললো,
—“তুমি কি তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলে মা? দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম তোমাকে। তোমার কান্না দেখে আমরাও কাঁদতাম। তুমিও তো খেয়াল করো নি কখনো।”

রেখার ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসতে চাইলো। তবে কাঁদলেন না তিনি। ঝাপসা চোখে স্বামীর হাসোজ্জল মুখশ্রী মানস্পটে ভেসে উঠলো। দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল কিছুক্ষণ। কঠোর হয়ে রেখা বললেন,
—“তুই রাজনীতি ছেড়ে দেয়। আমি বেলার সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব।”
—“যা সম্ভব না, তা কেন বলছো?”
—“আমি চাই না তোর বাবার মতো তোরও সেই অবস্থা হোক। কথাটা বুঝতে চাচ্ছিস না কেন?”

আদ্র রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে উত্তর দিলো, “যদি বাবার মতো আমার অবস্থা না হয়? আমি যদি মারা না যাই? তখন তো আফসোস রয়ে যাবে মা। বেলাকে না পাওয়ার আফসোস।”
রেখা হাল ছাড়লেন না। আবারও বোঝাতে লাগলেন, “ভালোর দাম নেই আদ্র। দূর্নীতি ছাড়া রাজনীতিতে টেকা যায় না।”
—“জানি। দরকার পরলে আমিও দূর্নীতি করবো।”

রেখা চমকালেন খুব। অবাক চোখে ছেলের মুখপানে তাকালেন। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন,
—“তুই দূর্নীতি করবি আদ্র?”
—“যারা দূর্নীতির ভাষা বুঝে তাদের সেই ভাষাতেই বোঝাতে হয় মা। আমি বাবার মতো নই। খুব সম্ভবত সেই পরিণতি চাই না বলে দূর্নীতি করতেও পিছপা হবো না। বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। সেই দাম ওরা দেই নি। চোখের সামনে এখনো ভাসে মা। এই এলাকার ডাস্টবিনে আমার বাবার লাশ পরে ছিল। পুরো একটা বছর আমাদের কাছ থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। অত্যাচার সহ্য করেছেন, মৃত্যুর জন্য ছটপট করেছেন। আমরা টের পাইনি। ঘুণাক্ষরেও তার ভেতরের অবস্থা জানতে পারিনি।”

আদ্র থামলো। কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে এলো যেন। রোধ হলো। তবে কান্নার ছিঁটেফোঁটাও এলো না। চোখ রোষাক্ত হলো। ওভাবেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল সে। রেখা বসে রইলেন। নিশ্চুপ ভাবে। চোখ থেকে পাষান জলরাশিগুলো বইতে থাকলো একাধারে।

বিহানকে পড়তে বসিয়ে বেলাও পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ভাইব্রেশনে আটক ফোনটা ঝিরঝির আওয়াজ করতেই হাতে নিলো তা। নেতা সাহেব থেকে কল এসেছে। সে ধরলো কলটা। ওপাশ থেকে আদ্রর থমথমে কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
—“তোমার কাছে পাঁচ মিনিট আছে বেলা। ছাদে আসো।”

পরক্ষণেই কল কেটে গেল। দাম্ভিক নেতার কথার পিঠে পালটা কিছু বলতে পারলো না বেলা। কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার স্ক্রিনে তাকালো। ঝটপট ফোনটা টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে পরলো। বিহানকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে ধমকালো,
—“আমি একটু ছাদে যাচ্ছি। একদম পড়া বাদ দিয়ে অন্যকিছু করবি না। এসে পড়া ধরবো। না পারলে দেখিস, বাবাকে দিয়ে মার খাওয়াবো।”
বিহান বেজার মুখে বইয়ে মুখ গুঁজলো। তাকালোই না। যেন বইয়ের ভেতর আজ ঢুকেই উদ্ধার করবে সে।

আদ্রকে বেশি অপেক্ষা করালো না বেলা। সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ছাদে প্রবেশ করতেই আদ্রকে দেখতে পেল সে। ছাদ টপকে তাদের ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে আছে সে। সিগারেট ফুঁকছে। বেলা এগিয়ে এসে কাছাকাছি হলো। নাক, মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
—“আপনার না পোড়া গন্ধে, ধোঁয়ায় এলার্জি? তবুও সিগারেট খাওয়া বাদ দেন না কেন? এতে সমস্যা হয় না?”

আদ্র পাশ ফিরে তাকালো। গম্ভীর, প্রাণহীন চোখে। হাতের সিগারেটে আরও একবার টান দিয়ে ফেলে দিলো সূদুরে। কোথায় যে গিয়ে পরলো সেটা। দৃষ্টি গোচর হলো না। আদ্র বললো,
—“আমি যেটা খাই, সেটায় পোড়া গন্ধ নেই। আর এটুকু ধোঁয়ায় কিচ্ছু হয় না আমার। অভ্যাস আছে।”
বেলা শুনলো না। জোড় গলায় বললো,
—“তাও। আর খাবেন না।”
—“আচ্ছা।”

আদ্রর দৃষ্টি বিস্তর আকাশে অনড় হয়ে আছে। তারাগুলো টিপটিপ করছে। আদ্র আগে বিশ্বাস করতো, ওই তারাগুলোর একটি আদ্রর বাবা। সম্মানিত এমপি। যাকে আটক করে রাখা হয়েছি পুরো এক বছর। তিল তিল করে প্রতিটা দিন মৃত্যু যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল তিনি বুঝি আত্মগোপন করেছেন! কিংবা বেঁচে নেই আর। তারপর একদিন বড় ডাস্টবিনটার ওখানে, গন্ধ, পঁচা মায়লার স্তুপে বাবার লাশটা পরে থাকতে দেখেছিল সে। বুঝতে পারেনি ওটা তারই বাবা। চেহারা ঝলসানো ছিল তো! বাবার সেই একবছর পুরোনো ছেঁড়া শার্টটা না দেখলে সে তো বিশ্বাসই করতো না, এটা তার প্রাণপ্রিয় বাবা।
যন্ত্রণাদায়ক এক গাঢ় নিশ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। খুব কষ্টে। বেলার হাত আলতো করে ধরলো সে। বললো,
—“বেলা, আমি কিন্তু রাজনীতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য করছি না। আমি শুধু জানতে চাই কারা আমার বাবাকে মেরেছিল, কেন মেরেছিল। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই আমি। ওদের দেখাতে চাই, ওরা সবসময় আমাদের নিচে ছিল। নিচেই থাকবে।”

বেলা কিছুই বুঝলো না। অবাক নয়নে চেয়ে রইলো শুধু। ওই সুদর্শন মলিন মুখটার দিকে। তার প্রেমিক পুরুষের দিকে। আদ্র হঠাৎ নিচে বসে পরলো। বেলার হাত টেনে তাকেও বসিয়ে দিলো। সময় ব্যয় না করে মাথাটা বেলার কোলে রেখে শুয়ে পরলো সাবধানে। বেলা হকচকিয়ে উঠলো। ভড়কালো খুব। মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
—“পাগল হয়েছেন নাকি? ময়লার মধ্যে শুয়েছেন কেন? দরজা খোলা তো। আদ্র? উঠুন।”

আদ্র উঠলো না। একটা অক্ষরও শুনলো না যেন। চুপ করে চোখ বুজে রইলো। আদ্রর ক্লান্ত, মায়াময় মুখ দেখে বেলাও আর কিছু বলতে পারলো না। নিয়ন্ত্রণহীন হাত আপনা-আপনি ঝাঁকড়া চুলগুলোর ভাঁজে ভাঁজে চলে গেল। আদ্র তখন ডাকলো, “বেলা।”
বেলা ঘোরলাগা কণ্ঠে মৃদু জবাব দিলো, “হু।”

আদ্র তখন ঘুমিয়ে যেতে যেতে প্রবল দৃঢ়তার সঙ্গে বললো,
—“আমি তোমাকে খুব জলদি বিয়ে করে ফেলবো বেলা।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here