প্রিয় বেলা
৩০.
আদ্র গোসল সেরে বের হয়েছে মাত্র। একহাতে চুল মুছতে মুছতে পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো সে। ভ্রু কুঁচিত হলো। তিক্ত হলো মন, মস্তিষ্ক, মেজাজ। চুলের ডগা থেকে জলরাশির সূক্ষ্ণ রেখা কপাল ঘেঁষে গড়াতেই তা তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেললো সে। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। একরাশ হতাশা নিয়ে। বেলা রুমে নেই। চলে গেছে হয়তো। মেয়েটা একটা কথাও শোনে না তার। থেকে যেতে বলার পরও অবাধ্যতা করে চলে গেছে সুড়সুড় করে। বিছানার একপাশে গিয়ে বসলো আদ্র। কণ্ঠে ক্রোধের ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে উঁচুস্বরে ডাকলো,
—“বেলা।”
বেলা বারান্দায় ছিল। বিস্তর নভস্থলের দাগযুক্ত চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। আজকে চাঁদটা বেশ বড় করে উঠেছে। জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে আশপাশের কালো আঁধারি জায়গাগুলো। দৈবাৎ আদ্রর রাশভারি কণ্ঠের ডাক শুনে থমকালো সে। পিছু ফিরে তাকালো। আদ্র একমনে মাথা মুছতে মুছতে ঘাড় কাত করে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখশ্রী অসম্ভব বিকৃত। অসন্তোষ ভাব। বেলা সময় নিলো না। দ্রুত পায়ে রুমের ভেতর ঢুকলো। চোখ বড় বড় করে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হয়েছে? এভাবে ডাকছেন কেন?”
আদ্র একটু বিস্মিত হলেও তা চেহারায় বিন্দু মাত্র প্রকাশ পেল না। স্বাভাবিক ভাবে সে প্রশ্ন করলো,
—“তুমি এতক্ষণ বারান্দায় ছিলে?”
—“হ্যাঁ।”
—“তোমাকে আমি বিছানায় বসে থাকতে বলেছিলাম। বারান্দায় গেলে কেন?”
আদ্রর গম্ভীর প্রশ্নের পিঠে অবুজ চোখে চেয়ে রইলো বেলা। উত্তর দিতে পারলো না। ভেঁজা তোয়ালে বিছানায় ছুঁড়ে মেরে হঠাৎ-ই মাথা নিচু করে ঝুঁকলো আদ্র। ঘাড়ের পেছনে হাত বুলালো ব্যগ্র ভাবে। অধৈর্য কণ্ঠে ভীষণ অতৃপ্তি নিয়ে বললো,
—“তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছো বেলা। অধৈর্য করে ফেলছো।”
বেলার অবুঝ নেত্রজোড়ার পরিবর্তন ঘটলো। লাজুক গালগুলো ভারী হলো। নেত্রপল্লব লেগে আসতে চাইলো যেন। বার দুয়েক পলক ঝাপটে সে দৃষ্টি নুয়ালো। মৃদু স্বরে বললো, “আপনি দুপুর থেকে কিছু খাননি। খাবেন না? আমি নিয়ে আসবো?”
—“উহু! তোমার সঙ্গে থাকতে চাইছি এখন।” নিঃসঙ্কোচ, সুপ্ত বাসনা। বেলাকে আরও লজ্জায় মিইয়ে দিলো। আড়ষ্টতা জেঁকে ধরলো।
আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রগাঢ় গলায় শুধালো,
—“তুমি এত লজ্জা পাও কেন বেলা? আমার মতো লজ্জাহীনের মুখে সামান্য থেকে সামান্য কথাও আটকায় না। সহ্য করতে পারবে তুমি?”
বেলা আর বসে থাকতে চাইলো না। লোকটা পাগল হয়ে গেছে নিশ্চিত। কিসব বুলি আওড়াচ্ছে। ইতস্তত পায়ে বিছানা থেকে তোয়ালে নিয়ে আবারও বারান্দায় চলে গেল সে। কাঠের চেয়ারটাতে বিছিয়ে দিলো সুন্দর করে। আদ্রর বারান্দায় তার মতো রশি বা তাড় ঝুলানো নেই। একদম পরিষ্কার। তবে ফাঁকা পুরোটা। বেলা মনে মনে ভাবলো, বারান্দাটা সে ফুলগাছে ভরিয়ে দেবে।
ভাবনার অকূল পাথারেই আদ্রর শক্ত, শীতল পুরুষালি হাতটি আচমকা কোমড় জড়িয়ে ধরলো তার। হাতজোড়া শাড়ির ওপরে থাকা সত্ত্বেও তীব্র ঠান্ডার স্বতঃস্ফূর্ত আভাসে শিহরিত হলো সর্বাঙ্গ। বেলা চমকিত হলো। খুব ভড়কালো, ভয় পেল। ছোট্ট পিঠটা গিয়ে ঠেকলো প্রশস্ত বুকে। অস্থির নয়নে বাগানের দিকটায় চোখ ঘোরালো সে। দেহরক্ষীগুলো সব এখনো পাহারা দিচ্ছে বাড়িটা। চারিদিকে তাদের বিচক্ষণ দৃষ্টি অনবরত ঘুরছে। স্থির হচ্ছে না। আতঙ্কিত হয়ে হালকা চেঁচালো বেলা,
—“কি করছেন? ছাড়ুন! আপনার হাত অনেক ঠান্ডা।”
আদ্র শুনলো না যেন। হাতও সরালো না। হাসফাস করে বেলা অনুরোধের সুরে বললো,
—“নিচে গার্ডসরা আছেন। আমাদের এভাবে দেখলে কি ভাববে? ছাড়ুন না।”
—“উপরে তাকাবে না ওরা।”
বেলার সন্দিহান কণ্ঠ, “যদি তাকায়?”
প্রতিউত্তরে আদ্র কিছুই বললো না। নিজ গতিতে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো বেলাকে। আদুরে ভাবে। কাঁধে থুতনি ঠেকালো। আকাশের ওই বিশাল চাঁদটির দিকে একবার চেয়ে বেলার দিকে তাকালো আবার। আনমনে বললো,
—“তোমার এই জনপ্রিয় চাঁদটা থেকে আমার আকাশের অপরিচিত চাঁদটাই বেশি সুন্দর বেলা।”
–
হাসপাতালের কক্ষগুলোয় ফিনাইলের কড়া গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। রুমালটা নাকে চেপে আকিব বেশ চোখ-মুখ কুঁচকে আছে। বিরক্তও সে। কেবিনে লম্বালম্বিভাবে আহত টেক্সিচালক গুলোকে আলাদা, আলাদা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। নিষ্ঠুর, খারাপ লোকগুলোকে দেখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই আসছে না আকিবের। মূলত এজন্যই সে ভীষণ বিরক্ত। নাক কুঁচকে প্রচন্ড রোষপূর্ণ গলায় আদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমরা এখানে কেন এসেছি ভাই? চলুন, চলে যাই। এসব অমানুষদের সাথে কথা বললেও পাপ।”
আদ্র কিছু বলছে না। নিশ্চুপ ভাবে দেখছে টেক্সিচালকগুলোকে। ব্যথায় যখন তারা কাতরাচ্ছে, তখন অভ্যন্তরে সিক্ত আনন্দ দোলা দিয়ে উঠছে বারবার। প্রশান্তি কাজ করছে মনে, মস্তিষ্কে। এদের মাঝের জনকে আদ্র বেশ ভালো ভাবেই চেনে। পাঁচজন মেয়েকে ধর্ষণ করার মামলা আছে এর ওপর। শুধু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে স্বাধীন ভাবে ঘুরছে এই মানুষ রুপি হায়নাগুলো।
আদ্র থমথমে গলায় আকিবকে বললো, “তোমাকে কিছু রেকর্ডিং পাঠিয়েছিলাম আমি। বের করো।”
আকিব দেড়ি করলো না। একহাতে নাক চেপে অন্যহাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। রেকর্ডিং-এর ফাইলটি বের করে বললো,
—“বের করেছি ভাই।”
—“প্রথমটা চালু করো।”
আকিব চালু করলো। সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করলো রেকর্ডারটি। যেখানে স্পষ্ট ইখতিয়ারের কণ্ঠ ভেসে উঠছে। সে বলছে,
—“ওদের না মেরে আমাকে একটা উটকো ঝামেলায় সত্যিই ফেলে দিয়েছো আদ্র সাহেব। এখন ওদের রিলিজের অপেক্ষা করতে হবে। তারপরই খেলা শেষ।”
বলে হো, হো করে হাসতে লাগলো সে। কর্কশ কণ্ঠের হাসিতে ভয়ে তটস্থ হলো সবার মুখ। চোখের দৃষ্টি ভীতু। হঠাৎ-ই শরীর গরম হতে শুরু করেছে যেন। কপাল ঘামছে। গলা শুকিয়ে পিপাসা পাচ্ছে প্রচন্ড। মাঝখানে পাতলা, কৃষ্ণবর্ণের লোকটি অনেকটা তোতলিয়ে বললো,
—“এখন আমগো কি করতে হইবো ভাই?”
আদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। অদৃশ্য হাসি। কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,
—“বেশি কিছু না। ইখতিয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে স্বাক্ষী দিতে হবে।”
লোকগুলো একে অপরের মুখপানে একে একে চাইলো। পরক্ষণেই একসাথে হইহই করে উঠলো,
—“আমরা দিমু ভাই। সবাই স্বাক্ষী দিমু। শুধু আমগো ওই ইখতিয়ার থেইকা বাঁচাইয়েন।”
আদ্র কেবিন থেকে বেরিয়ে পরলো। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আকিবও এলো পিছু পিছু। ধীরস্থির ভাবে অপরাধীর ন্যায় বললো,
—“আমাকে ক্ষমা করবেন ভাই। আমি শুধু শুধুই আপনাকে ভুল ভেবেছিলাম।”
আদ্র শুনলো। হাঁটতে হাঁটতে পালটা প্রশ্ন করলো,
—“মাক্স পরো মুখে। রুমাল চেপে আছো কেন?”
—“আনতে মনে নাই ভাই।”
লজ্জিত হেসে উত্তর দিলো আকিব।
–
সময় গড়াচ্ছে। সকাল পেরিয়ে পৃথিবীর আকাশে দুপুর নেমে এসেছে। মেঘেরা প্রবল ঝগড়া করে একে অপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দীর্ঘক্ষণ আগে। শুভ্রতা হারিয়ে কালো রূপ ধারণ করেছে মেদুরগুলো। তাদের রেশারেশির তীব্রতা বেড়ে গেল হুট করেই। কালো বিস্তর নভস্থলে সূর্যের দেখা মিললোই না আর। বৃষ্টি শুরু হলো। মুষলধারে বৃষ্টি। বেলার বেকুলতা বড্ড বেড়ে গেল। আদ্র দুপুরে খেতে আসবে বলেছিল। এখনো আসছে না কেন? ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ৩টা বেজে এক মিনিট। অশান্ত মনে সে বিছানায় গিয়ে বসলো। এবাড়িতে কেউ কাজ করতে দেয় না তাকে। টুকটাক রেখা আর আরুর সঙ্গে কথা বলেই কেটে যায় কিছুটা সময়। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বেলার ভালোলাগে না। আদ্রকে মনে পরে। ভীষণভাবে মনে পরে।
রাস্তা থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ এখান অব্দি শোনা যাচ্ছে। বেলার সম্বিৎ ফিরলো। বসে থাকতে থাকতে প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল সে। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। বাহিরে উঁকি দিতেই দেখতে পেল আদ্রর কালো গাড়িটা। বেলা কালবিলম্ব করলো না। ব্যস্ত পায়ে দ্রুত ছুটে গেল নিচে। কলিংবেল বাজার পূর্বেই দরজা খুলে দিলো। আদ্র মাত্রই কলিংবেল চাপতে যাচ্ছিল। হঠাৎ দরজা খুলে যাওয়ায় অবাক হলো। প্রিয়তমার স্নিগ্ধ মুখশ্রী চোখে ভাসতেই ক্লান্তি উবে গেল যেন। সতেজ হয়ে উঠলো ভেতরটা। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা দেখা দিলো।
বেলা কিছুপলক তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো। আলতো স্বরে বললো,
—“ভেতরে আসুন।”
আদ্র ঢুকলো। ড্রইংরুমে বসে থাকা আয়াজের দিকে তাকালো একবার। খুব আস্তে করে বললো,
—“রুমে আসো।”
—“আসছি।”
আয়াজ ফোন চাপছিল। আদ্রকে দেখে সরাসরি তাকালো। তাড়াতাড়ি ডাকলো,
—“ভাই শুন। কথা আছে তোর সঙ্গে।”
আদ্র তখন সিঁড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছিল প্রায়। আয়াজের কথায় দাঁড়ালো। ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি?”
—“ব্যবসায় ইদানিং সমস্যা করছে একলোক। কোন ইখতিয়ার নাকি কি! অবৈধ কাজ করতে চাইছে। তোর বিপক্ষদলের মনে হয়। ওরে আউট কর তো!”
আদ্রর ছোট্ট উত্তর,
—“পারবো না।”
সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভট কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালো আয়াজ,
—“কেন? কেন পারবি না? তোকে কি মাগনা মাগনা রাজনীতিতে ঢোকার জন্য সাপোর্ট করেছিলাম আমি? সময় এসেছে, আমি আমার সাপোর্টের মূল্য চাই।”
—“পরে দেখা যাবে।”
চলে যাওয়ার আগে আদ্র আবারও বেলাকে ইশারা করলো রুমে আসার জন্যে। তা দেখে আয়াজ পেছন থেকে খুব চেঁচালো, “ইশারায় কথা বলছিস কেন? আমি দেখব না মনে করেছিস? নিজে তো বিয়ে করেনিলি। আমার মতো নিরীহ মানুষটাকে এখন লোভ দেখাচ্ছিস। শুধু চৈতির সঙ্গে আমার বিয়েটা হতে দেয়। অসভ্য আমিও হতে জানি।”
আয়াজের কথা থামলো না। লাজুক বেলা কোনোমতে চলে এলো সেখান থেকে। রুমে পা রাখতেই আদ্রকে ক্ষীণ ভেঁজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎকণ্ঠা হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এগিয়ে এসে তাগাদা দিয়ে বললো,
—“আপনি এখনো ভেঁজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ফ্রেস হয়ে আসুন। যান।”
আদ্র গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে কি যেন বের করলো। পরক্ষণেই অনেকটা কাছে টেনে নিলো বেলাকে। গলায় কিছু একটা পরিয়ে দিলো। বেলা তাকালো। পাথরের গলার চেইন। জ্বলজ্বল করছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর। বেলা মৃদু হাসলো। হাত বারিয়ে চেইনটা ছোঁয়ার আগেই তাকে নিজের বক্ষের মধ্যিখানে টেনে আনলো আদ্র। কানের পেছনে এলোমেলো চুলগুলো গুঁজে দিলো খুব যতনে। জিজ্ঞেস করলো,
—“আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”
বেলা মাথা দুলালো আস্তে আস্তে। সে অপেক্ষা করছিল। আদ্র বিস্তর হাসলো। আরেকটু ঘনিষ্ট হলো। নিবিড় হলো সবটা। প্রগাঢ় হলো স্পর্শ। বেলা মিনমিন কণ্ঠে বললো,
—“আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। শার্ট পালটে আসুন। শার্ট বের করে দেব আমি?”
কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি, সন্তুষ্টি ভাব নিয়ে আদ্র উত্তর দিলো,
—“শার্ট-টার্ট পাল্টাতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে আসো। চুল মুছে দেবে।”
___________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা