প্রিয় বেলা – পর্ব ২৯

0
387

প্রিয় বেলা

২৯.
নিকষকৃষ্ণ আঁধার ডিঙ্গিয়ে সূর্যের তপ্তহীন কিরণ চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ প্রবল কোলাহল সৃষ্টি করছে। এয়ারকন্ডিশনের তীব্র শীতল স্পর্শে প্রিয়তমের বুকের উষ্ণতায় জড়োসড়ো হয়ে লেপ্টে আছে বেলা। টেলিভিশন চলছে অনেকটা শব্দ বাড়িয়েই। সময় সংবাদে একজন ভদ্র মহিলা খবর পড়ছেন,
—“কুমিল্লায় কাল রাত্রিবেলা তিনজন টেক্সিচালক গুরুতর ভাবে আহত হয়ে পরে ছিলেন মাঝরাস্তায়। এলাকার কিছু ভদ্র লোকের সাহায্যে এখন আপাতত সিটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, বেঁচে ফিরবার সম্ভাবনা থাকলেও হাত, পা অকেজো হয়ে যেতে পারে তাদের। এছাড়া টেক্সিগুলোও বাজেভাবে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। শুনলেন শিরনাম। এবার বিস্তারিত।”

বেলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তবে নেত্রপল্লব উন্মুক্ত হলো না। চোখ-মুখ কুঁচকে গেল তীব্র আলোর ছটায়। আদ্রর বক্ষস্থলে নিবিড়ভাবে মুখ লুকাতেই বিস্তর হাসলো সে। লহু কণ্ঠে ডাকলো,
—“বেলা? উঠবে না? ন’টা বেজে গেছে কিন্তু!”
বেলা ক্ষীণ নড়েচড়ে মাথা নাড়ালো। উঠবে না সে। তন্দ্রা ঘোর এখনো চোখের পাতায় দৃঢ় ভাবে এঁটে রয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠবার জো নেই। আদ্র আরও কয়েকবার ডাকলো। সারাশব্দ না পেয়ে পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল সে। টিভির ভলিউম একটু কমিয়ে দিলো। সেকেন্ড গড়ালো, এরপর মিনিট। তন্দ্রা ভাবটা যেন হঠাৎ-ই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো বেলার। চোখ মেললো সে। নিজের অবস্থান আদ্রর অতি নিকটে আবিষ্কার করতেই চমকিত হলো। ভড়কালো প্রচন্ড লজ্জায়। আদ্রর কোমড়ে থাকা তার দৃঢ় হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসলো। সরে যেতে চাইলেই পুরুষালি শক্ত হাতটি গিয়ে ঠেকলো পিঠের একদম মধ্যিখানে। টেনে এনে বুকের মাঝে আবারও মাথা চেপে ধরলো। খুব সাবধানী গলায় সর্তক করলো,
—“খবরদার, উঠবে না। এভাবেই থাকো। আমার সঙ্গে খবর দেখবে।”

বেলার আমতা আমতা কন্ঠস্বর,
—“খবর দেখে আমি কি করবো?”
—“তোমাকে লেডি রাজনীতিবিদ বানাবো আমি। তাই দেশের খুটিনাটি খবরাখবর রাখতে হলে তোমাকে খবর দেখতে হবে। একটু পর বাহিরে বের হবো। তখন রাজনৈতিক বইও নিয়ে আসবো কিছু। তুমি না বই পড়তে পছন্দ করো?”

বেলা পলক ঝাপটালো। সরে আসতে চাইলো। আদ্র এবারও অনড়ভাবে ধরে রইলো তাকে। চোখ, মুখ কুঁচকে অসম্ভব বিকৃতি করে প্রবল প্রতিবাদ জানালো বেলা, “ছাড়ুন আমাকে। এসব বই পড়বো না আমি। খবরও দেখবো না। আপনার রাজনীতি নিয়ে আপনিই থাকুন।”

প্রতিউত্তরে নিঃশব্দে হেসে দিলো আদ্র। বিরতিহীন, নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে। হাসতে হাসতে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“রাজনীতি পছন্দ না তোমার?”
—“একদম না।”
—“এই রাজনীতিবিদকেও পছন্দ না?”

প্রশ্ন শুনে একটু থতমত খেয়ে গেল বেলা। নজর তুলে তাকালো। আদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নির্মলভাবে। বেলা বুঝে উঠতে পারলো না। লোকটা কি রাগ করলো এভাবে বলায়? বলা উচিত হয়নি বোধহয়। নত হয়ে সে আদ্রর শার্টের এককোণা খুব আলতো করে ধরলো। না ধরার সমান। স্নিগ্ধ গলায় মিনমিন করে বললো, “পছন্দ।”

আদ্রর তূখর দৃষ্টি তখন ভীষণ গভীর। আলাদা মাদকতার পরশ সুস্পষ্ট। ঘোর লাগা, অন্যরকম। হাত উঁচিয়ে বেলার গাল ছুঁলো নিষ্প্রভ ভাবে। ধীরস্থির কণ্ঠে শুধালো,
—“অথচ আমার মতো পছন্দ তুমি কখনোই করতে পারবে না বেলা।”

থেকে থেকে নিশ্বাস নিচ্ছে বেলা। আদ্রর দিকে তাকানোর সাহস নেই। লোকটার চাহনি মারাত্বক। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। জাদুকরের মতো সম্মোহন করে ফেলে নিমিষেই। আড়নজরে একবার টিভির দিকে তাকালো সে। বিজ্ঞানপন শেষ হয়ে এখন আবারও ওই টেক্সিচালকগুলোর সংবাদ দেখাচ্ছে। কি বিভৎস ভাবে মেরেছে তাদেরকে! চেহারা চেনার উপায় নেই। ব্যান্ডেজে আবৃত পুরো মুখশ্রী।

ক্লাবের দরজা, জানালা বন্ধ। বড়োসড়ো রুমটায় এখন শুধু আদ্র, আকিব আর ইখতিয়ার। ইখতিয়ার বেশ অসন্তোষ চোখে আকিবকে দেখছে বারবার। যেন আকিবের উপস্থিতি ঠিক পছন্দ হয়নি তার। ইশারা-ইঙ্গিতে বারবার চলে যেতে চলছে তাকে। আকিব বুঝতে একটু সময় নিলো। পরক্ষণেই নিজ থেকে বললো,
—“আমি তাহলে আসছি ভাই? আপনারা কথা বলুন।”

খরখর শব্দে দরজা খুলে তা আবার বাহির থেকে আটকে চলে গেল আকিব। ইখতিয়ার এবার সরাসরি মুচকি হেসে তাকালো আদ্রর মুখপানে। অথচ তার ভেতরটা আদ্রর জন্য কালো বিষে ভরে আছে। নিজ স্বার্থ না থাকলে কবেই এই নেতার দাপট বের করে জঙ্গলে লাশ ফেলে আসতো, তার ইয়ত্তা নেই।
ক্ষীণ চাটুকারিতার রেশ ধরে ইখতিয়ার তার কর্কশ কণ্ঠটা মোলায়েম করার চেষ্টা করলো,
—“কেমন আছো আদ্র সাহেব? টাকা পেয়ে তো ভুলেই গেলে। কল ধরছো না, না মেসেজ। পাশের এলাকার কলেজটাতে তো কাল থেকে ড্রাগস বেচার কথা। ভেবেছ কিছু এ বিষয়ে? তোমার ছেলেদের আসতে বলেছিলাম। ওরা তো এলো না।”

আদ্রর নির্লিপ্ত সুর, “আসবে। কাল ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দেব আমি।”
ইখতিয়ার টেবিলে জোড়ে থাবা মারলো। হো হো করে হাসলো বিশ্রী কণ্ঠে। বললো,
—“এই না হলে নেতা।”

ইখতিয়ার থামলো। চারিদিকে তার কটু দৃষ্টি ফেলে দেখলো সবটা। ধীর গলায় বললো,
—“তা, কাল রাতে আমার ছেলেদের মারলে কেন? মারলে তো মারলে, একেবারে মেরেই ফেললে না কেন? এমনিতেও ওরা আর আমার কোনো কাজে লাগবে না। উটকো ঝামেলা কতগুলো!”

বলতে বলতে উৎসুক চোখে তাকালো সে। আদ্র সময় নিলো। টেবিল থেকে কফির মগ নিয়ে একটু করে চুমুক দিলো। কপালে ভাঁজ ফেলে সূক্ষ্ণ গলায় বললো,
—“স্বার্থ ছাড়া আমি কিছু করিনা মিস্টার ইখতিয়ার। নয়তো মেরেই ফেলতাম।”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইখতিয়ার। জিজ্ঞেস করলো, “ওদেরকে মারার পেছনে তোমার কি স্বার্থ থাকতে পারে?”
—“আমার সঙ্গে একটা মেয়েকে প্রায়ই দেখতেন আপনি। আমার ক্ষতি করতে মেয়েটাকে মারার চেষ্টাও করেছিলেন। মারতে পারেন নি অবশ্য। সিনএনজির থাক্কায় মাঝরাস্তায় ফেলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। আমি শুধু তার থেকে একটু বেশি করেছি। হাত, পা ভেঙ্গে জন্মের গুন্ডামি করার সখ মিটিয়ে দিয়েছি মাত্র।”

কৌশলে স্বার্থের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল আদ্র। ইখতিয়ার খেয়াল করলো না। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ সে। চোখ অত্যাধিক বড় বড়। থুতনি ঝুলিয়ে বিমূঢ় কণ্ঠে সে বললো,
—“তুমি জানতে?”
আদ্র হাসলো। দূর্বোধ্য হাসি। উত্তর দিলো না।

আদ্র এলো সন্ধ্যার দিকটায়। রুমে এসে বেলাকে দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হলো সে। তৎক্ষণাৎ জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলো তাকে। বেলা তখন রেখার রুমে ছিল। আদ্রর ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনা বলছিলেন তিনি। বেলা মন দিয়ে শুনছিল। হঠাৎ আদ্রর উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ডাকার শব্দে হকচকালো সে। অপ্রস্তুত ভাবে তাকালো রেখার দিকে। রেখা মুচকি হাসলেন। ক্ষীণ লজ্জায় মিইয়ে গেল বেলা। তিনি বললেন, “যাও, ডাকছে তোমাকে। পরে রেগে যাবে নয়তো।”

এসির তাপমাত্রা কমিয়ে শার্টের বোতাম খুলছিল আদ্র। পিপাসায় কাতর তার গলদেশ, চক্ষুদ্বয়। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকানো। ঘামে লেপ্টে বাজে অবস্থা। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আদ্র আবারও ডেকে উঠলো বেলাকে। পরমুহুর্তেই দেখলো, ইতস্তত পায়ে রুমের ভেতর ঢুকছে বেলা। তার থেকে ভীষণ দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—“ডেকেছিলেন?”
আদ্র উত্তর দিলো না। পালটা প্রশ্ন করলো, “কোথায় ছিলে?”
—“মায়ের রুমে।”
—“আমি বাসায় আসলে একটু আশেপাশে থাকবে। ঠিকাছে?”

এবারও মাথা দুলায় বেলা। আদ্র চেয়ে রয়, নিষ্পলক। মেয়েটা অতিরিক্ত লজ্জা পায়। তার লজ্জাবউ। কথা ঠিক ভাবে বলতে পারে না। জড়তা কাজ করে। তার দিকে ঠিকভাবে তাকাতেও পারেনা। সর্বদা দৃষ্টি নামিয়ে রাখে। এই সাধারণ মেয়েটার মাঝে আছে কি আসলে? ক্ষণে ক্ষণে আদ্র খুব বাজেভাবে আটকে যাচ্ছে। বের হওয়ার সাধ্যি নেই। একবার তাকালে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। শক্ত করে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ।
আদ্র সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। বললো,
—“গোসল করতে যাচ্ছি। এসে যেন তোমাকে রুমে পাই।”
বেলা ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “আচ্ছা”

বলে উঠে যেতে চাইলো সে। আদ্র যেতে দিলো না। হাত ধরলো জড়ালো ভাবে। কিছুক্ষণ আগের মতোই চেয়ে থেকে গাঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না বেলা?”

বেলা কি বলবে ভেবে পায় না। হাসফাস করে। একরাশ ক্লেশে সিক্ত হয় গৌড় বর্ণের গালদু’টি। খুব করে বলতে চায়, “করবে না কেন? অবশ্যই করে।”
কিন্তু অকপটে সে বরাবরের মতোই নিশ্চুপ। আদ্র হাত ছেড়ে দেয়। উঠে দাঁড়ায়। বাথরুমে যেতে যেতে একরোখা কণ্ঠে বলে,
—“সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দেব।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here