প্রিয় বেলা – পর্ব ২৮

0
496

প্রিয় বেলা

২৮.
আদ্রর রুমে কখনো আসেনি বেলা। সুযোগই হয়নি। বিছানায় বসে পুরো রুমটা একবার পরখ করে নিলো সে। বড়োসড়ো একটা আয়তাকার রুম। একপাশে বিশাল বুকসেল্ফ, পড়ার টেবিল। বিভিন্ন রঙবেরঙের ফাইলের স্তুপে গোজামিল সেখানটা। দেওয়ালের একপাশে মাঝারি আকারের একটা পুরাতন কাঠের ফ্রেম টাঙ্গানো। পরিবারের সবার হাসোজ্জল মুখশ্রী ভেসে উঠছে ফ্রেমটিতে। আদ্রর বাবাও আছেন সাথে। তবে অনেকটা দূরে হওয়ায় ক্ষীণ অস্পষ্ট সবটা। কৌতূহলী বেলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দেওয়ালের কাছাকাছি এসে আলতো করে ছুঁলো ফ্রেমটা। মুজিব কোর্ট গায়ে সম্মানের সহিত বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রর বাবা। চেহারা অনেকটা আরুর সঙ্গে মেলে। তিন ছেলেমেয়েকে কি ভীষণ আদুরে ভাবে আগলে ধরে রেখেছেন। প্রাণবন্ত হাসিগুলো বাস্তবিকই যেন তার সামনে জ্বলজ্বল করে হাসছে।

—“আদ্রর যখন বারো বছর, তখন বেশ সখ করে ছবিটা তুলেছিলেন ওদের বাবা। সেই থেকে ছবিটা আদ্রর রুমেই টাঙানো। ফ্রেম নষ্ট হওয়ার পরও ফ্রেমটা ও পাল্টাতে চায় না। ওখানে নাকি ওর বাবার ছোঁয়া লেগে আছে।”

বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেখা। বেলা চমকে তাকালো। রেখার মুখশ্রী মলিন। কণ্ঠে হতাশ ভাব। একরাশ আফসোস, কষ্ট, যন্ত্রণা। বেলার কাছে এসে হাতের বাসন্তী রঙের শাড়িটা এগিয়ে দিলেন তিনি। কৃত্রিম হেসে বললেন,
—“তুমি নিশ্চই অনেক ক্লান্ত? এক শাড়ি পড়ে আর কতক্ষণ থাকবে? এটা পড়ে নিও। নাও।”
বেলা হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে নিলো। রেখা আবার বললেন,
—“মুখটা শুকনো লাগছে তোমার। ক্ষুধা লেগেছে? কিছু খাবে? নিয়ে আসবো?”
সে দ্রুত দিরুক্তি করলো, “না, না আন্টি। মা খাইয়েই দিয়েছিল। ক্ষুধা নেই এখন।”

রেখা শুনলেন। মুখের মলিন ভাব যেন আরও দ্বিগুণ বাড়লো। ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে ম্লান কণ্ঠে বললেন,
—“আমার তিন ছেলেমেয়ের মাঝে আদ্রই সবচেয়ে বেশি তার বাবাকে ভালোবাসত। ছেলেটা আমার বাবার মৃত্যু সহজে মেনে নিতে পারেনি। মনে মনে কষ্ট পুষে রেখেছে।”

রেখার দৃষ্টি অনুসরণ করে বেলাও তাকালো। বারো বছর বয়সী আদ্রকে চিনতে তেমন অসুবিধে হয়নি তার। নেত্রকোণের সূক্ষ্ণ দাগটা সহজেই চোখে পরছে।
রেখা আচমকা বেলার হাত ধরলেন। তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও বসলেন পাশে। অত্যন্ত সর্তক কণ্ঠে কেমন কাতরতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাকে কি আদ্র কোনো রকম জোড় করেছে বিয়ের জন্য? সত্যি করে বলবে বেলা। তুমি কি আদ্রকে পছন্দ করো? নাকি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ?”

বেলা ভড়কে তাকায়। হতভম্ব হয়। চোখে বিস্ময়, বিমূঢ়তা। উত্তর দিতে পারে না। কণ্ঠনালিতে বিশ্রী শব্দজোট সৃষ্টি হয়। রেখার গভীর মুখপানে মায়া খুঁজে পায় সে। ছেলের চিন্তায় অস্থির হওয়া মায়ের কষ্ট দেখতে পায়। রেখা উত্তেজিত কণ্ঠে আবারও জিজ্ঞেস করেন,
—“উত্তর দিচ্ছো না কেন বেলা? ও কি সত্যিই জোড় করেছে তোমাকে?”
দমবন্ধকর অনুভূতি হলো বেলার। অস্বস্থি হলো ভেতরটা। মৃদু গলায় সে কোনোমতে উত্তর দিলো, “জোড় করেনি।”
—“তবে একা আদ্রই পাগলামি করতো না, তুমিও আগে থেকেই আমার ছেলেকে পছন্দ করতে?” বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রেখা।
বেলা প্রতিউত্তর করতে পারলো না। চুপচাপ রইলো। তিনি আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ ভেঙ্গে এলো যন্ত্রণায়। মেয়েটা সেধে সেধে কেন কষ্টের পেছনে ছুটছে? রাজনীতির বিশ্বে ভালো মানুষেরা আদৌ ঠিকেছে কখনো? তবুও থামলেন না তিনি। শেষ চেষ্টা করে গেলেন। খুব অনুরোধের সুরে বললেন,
—“আদ্র তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি কি ওকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে আনতে পারবে বেলা? ও তোমার কথা শুনবে। ওকে একবার বলবে?”

বেলা পলক ঝাপটালো। নেত্রের অদৃশ্য ফ্রেমবন্ধী আদ্রর কৃত্রিম ছবিগুলো ভেসে উঠলো সামনে। টেলিভিশনে দেখানো গর্বে ফুলে ওঠা দাম্ভিক নেতার উচ্ছ্বাসিত মুখশ্রী হানা দিলো মস্তিষ্কে। সে দেখল, আদ্রর ভাষণ দেওয়ার সময়কার আনন্দ। চোখের সেই গভীর প্রশান্তি। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বেলা নমনীয় কণ্ঠে বোঝালো,
—“আমি বললে উনি হয়তো রাজনীতি ছেড়ে দেবেন আন্টি। কিন্তু এতে কি উনি শান্তি পাবেন? বরং মনের কষ্ট আরও বাড়বে। রাজনীতি করে উনি আনন্দ পান। সেই আনন্দ ছিনিয়ে নিতে চাইলে হয়তো উনি আমার ওপরও বিরক্ত হতে পারেন। কি দরকার আন্টি? উনি যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকনা। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তো আমরা কেউ জানিনা। উনার বাবার মতো উনার পরিণতি নাও তো হতে পারে, তাই না?”

বেলা তাকালো রেখার দিকে। রেখার ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না। তিনি কিছু বলবেন তার পূর্বেই আদ্র ঢুকলো রুমে। অনেকটা শব্দ করেই। পায়ের ধুপাধাপ আওয়াজ কানে লাগছে খুব। রেখা দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ছটপট কণ্ঠে বললেন,
—“এসেছিস? আয়াজ কোথায়? ক্ষুধা লাগলে নিচে চলে যাস। ফ্রিজে কেক আছে।”

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আদ্র হাত ঘড়ি খুলে রাখলো। সেসবের উত্তর না দিয়ে অতি শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি প্রেশারের ঔষধ খেয়েছ?”
—“হ্যাঁ।”

চলে যাওয়ার আগে বেলার মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন রেখা। দূর্বল হেসে বললেন,
—“পরের বার থেকে মা বলে ডাকবে, কেমন?”

প্রতিউত্তরে হালকা মাথা দুলালো বেলা। রেখা হন্তদন্ত পায়ে চলে গেলেন। মুখের মলিন ভাব ঢাকার ঢের চেষ্টা করলেন। অথচ বেলা ঠিকই বুঝতে পারলো উনার মনের অবস্থা।

ক্লান্তিতে বেলা একেবারে গোসল করেই বেরুলো। আদ্র বিছানায় আধ শুয়ে ফোন চাপছিল। পরনের লাল শার্টটি পালটে সাধারণ একটা টি-শার্ট পড়ে আছে সে। পেশিবহুল ফোলা বাহুগুলো যেন ইচ্ছে করেই দেখিয়ে রেখেছে। আকর্ষিত করতে চাইছে খুব। বেলা চোখ সরিয়ে নিলো। দক্ষিণের বড় জানালা গলিয়ে প্রবাহমান তেজি বাতাস আনাগোনা করছে। কি ভীষণ শীতল, ঠান্ডা। শরীর ছুঁতেই জায়গাটা শিরশির করে উঠলো যেন। দাঁতে দাঁত চেপে আসলো। আদ্র একপলক তাকালো সেদিকে। বললো,
—“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো।”

লজ্জায়, অস্বস্থিতে পা নড়ছে না তার। খুব ধীরস্থির ভাবে সে বিছানার এক কোণে পা উঠিয়ে বসলো। আদ্রর দিকে তাকাতেই দেখলো, লোকটা ভ্রু বাঁকিয়ে কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। বিরক্তির স্পষ্ট ভাঁজ কপালে। বেলা দ্রুত অন্যদিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
—“কি করেছি আমি। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

আদ্র উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ অসন্তোষ চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎই চোখের দৃষ্টি গাঢ় হয়ে উঠলো। দৃঢ়ভাবে প্রেয়সীর মাথা থেকে পা অব্দি খুব সময় দিয়ে দেখলো সে। কোমড়ের আশপাশটায় স্থির হতেই সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা তৈরি হলো বক্ষে। অসহনীয়। স্নিগ্ধ বেলাকে ভীষণ পবিত্র মনে হলো তার। হাত টেনে নিজের পাশ ঘেঁষে বসালো। ব্যাঙ্কেট পুরো শরীরে সুন্দর করে ছড়িয়ে দিয়ে নির্বিকার সুরে বললো,
—“বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখনো তোমার দূরত্ব, দূরত্ব খেলা শেষ হয়নি? হলে বলবে, তোমাকে ছুঁয়ে দিব।”

বেসালাম অদ্ভুদ কথার পিঠে ভয়ংকর লজ্জায় জড়োসড়ো বেলা। কম্পয়মান সর্বাঙ্গ। মিনমিন করে সে বললো, “আপনি এত খারাপ কেন?”
—“তুমি খারাপ বানালে কেন?”

পালটা প্রশ্নে হকচকালো বেলা। ইতস্তত করলো। আড়নজরে দেখলো লোকটাকে। পকেট হাতড়ে কি যেন বের করছে সে। অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে বেলার হাত টেনে নিয়েছে। আঙুলের ভাঁজে খুব যতনে একটা আংটি পরিয়ে দিয়ে বললো,
—“এই রাতে নাকি স্ত্রীদের কিছু দিতে হয়। আয়াজ বলেছে। আমি জানতাম না। কিছু আনিও নি। ও-ই আংটিটা দিয়ে বলেছে তোমাকে যেন পরিয়ে দেই। এটা ওর পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার।”

বেলা একপলক তাকালো আংটিটির দিকে। কারুকাজের নিপুণতা খুব সূক্ষ্ণ ভাবেই মন কেড়ে নিচ্ছে। অথচ বেলার অনুভূতি শূণ্য। আদ্র দেয়নি বলেই হয়তো।
চোখ বুজে ছোট্ট হামি দিয়ে উঠলো বেলা। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে। চোখের পাতা মিলিত হতে চাচ্ছে তীব্র ভাবে। একহাতে তার বাহু টেনে নিজের বুকের মধ্যিখানে মাথা চেপে ধরলো আদ্র। আলতো করে, আদুরে ভঙ্গিতে। শুধালো,
—“তোমার কি ঘুম আসছে? তাহলে ঘুমিয়ে যাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

বেলা যেন আরও লেপ্টে গেল প্রেমিক পুরুষটির মাঝে। বিনাবাক্যে চোখ বুজলো। নীরবতা রইলো প্রায় অনেক্ষণ। বাহিরে কোলাহল নেই। সূদুর কোত্থেকে যেন নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। নভস্থলে তারাদের প্রখর মেলা।
বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,
—“তোমার কাছে আমার একটা উপহার পাওনা রইলো বেলা।”

___________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here