প্রিয় বেলা – পর্ব ৮

0
372

প্রিয় বেলা

৮.
বেলার কান্না থেমেছে। নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে ক্ষীণ। আঁখিপল্লব বড্ড ভারী, মুখশ্রী রক্তিম আভায় সিক্ত। অগোছালো চুলগুলো দু’হাতে ঠিক করে দিলো আদ্র। কানের পেছনে চুল গুঁজে দিলো। বেঠিক ওড়নাটা সুন্দর করে গায়ে জড়িয়ে মাথায় ঘোমটা পরিয়ে দিলো সে। মোলায়েম স্বরে ডাকলো,
—“বেলা, এদিকে তাকান।”

বেলা তাকালো। চোখাচোখি হলো দু’জন। লাল হয়ে যাওয়া নাক, গাল, ঠোঁট আর ফোলা ফোলা চোখ দেখে বেলাকে ভীষণ আদুরে মনে হলো আদ্রর। মনের খুব গোপনে তাকে আদর করার অদম্য ইচ্ছে জেগে উঠলো মস্তিষ্কে। হৃদযন্ত্রের ধ্বনি হলো দৃঢ়। আদ্র শুকনো ঢোক গিললো। ওড়নার ওপরেই বেলার চুলে হাত চালালো বেশ করেকবার। গাঢ় অধিকারবোধ নিয়ে আদেশের সুরে বললো,
—” বাহিরের লোকেদের নিজের কান্না দেখাবেন না বেলা। তাদেরকে আপনার ওপর মিছে মায়া দেখানোর সুযোগ দেবেন না। তবে যদি খুব বেশি কান্না পায়, আমি আছি। একান্তই আমার বুকে মিশে গিয়ে কাঁদবেন। আমি বাঁধা দেব না।”

বেলার চোখ অল্প কেঁপে কেঁপে উঠলো। পরক্ষণেই নেত্রপল্লব পিটপিট করে তাকালো সে। দৃষ্টি নত করলো দ্রুত। বলতে চাইলো,
—“আমি কাঁদবো না আপনার সামনে।”
আদ্র অবাক হলো খুব। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলো, “কেন?”
—“কারণ আপনি খারাপ।”
আদ্র হাসলো। বললো,
—“কিভাবে?”

সেকথার উত্তর দিলো না বেলা। মিনমিন করে বললো,
—“বাবার কাছে যাবো।”
আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেলার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় প্রগাঢ় ভাবে নিয়ে বলে,
—“চলুন।”

__________

সায়েদ সাহেব আর আদ্র মুখোমুখি বসে আছে। উনার গায়ে অন্য একটি শার্ট জড়ানো। আগের শার্টটি পুলিশের ধস্তাধস্তিতে কাঁধের অংশটুকু বাজেভাবে ছিঁড়ে গেছে। চোখে মুখে একরাশ ক্লান্তি উনার। মলিন মুখখানা যন্ত্রণায় জর্জরিত। সোফায় হেলান দিয়ে বসে ভাঙ্গা গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
—“কি বলবে বাবা? বলো।”

আদ্র একটু কেঁশে নিলো। নম্র স্বরে বললো,
—“আমি আসলে সকালের ব্যাপারেই কথা বলতে চাইছি আঙ্কেল। লোকটা যেহেতু থানায় মামলা করেছে, সে হয়তো আরো অনেক কিছুই করতে পারে। তাই এ নিয়ে সব কিছু জানা প্রয়োজন আমার। নয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না।”

বলে একটু থামলো আদ্র। সায়েদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
—“ওই লোক আপনার কি হয়? আর কত টাকা পায় আপনার কাছ থেকে?”

সায়েদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন,
—“আমার বোনের স্বামী হয়। বাড়ি বানানোর জন্য দেড় বছর আগে তিন লাখ টাকা নিয়েছিলাম আমি। এখন পর্যন্ত এক লাখ নব্বই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা কয়েকদিন পরই দিতাম আমি। কিন্তু ও এখনই চাচ্ছে। এতটাকা এখনই দেওয়া আমার জন্য কষ্টের। জমি বেঁচেকেনার কথা শুরু হয়েছে মাত্র। টাকা পেলেই ওকে দিয়ে দিব। এই অপেক্ষাটাই ও করতে চাইছে না।”

আদ্র শুনলো। একপলক দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা বেলার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সায়েদ সাহেবকে আশ্বস্ত করে বললো,
—“আপনি চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আপনার সময় মতোই টাকা দেবেন আপনি। আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

সায়েদ সাহেবেও ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কণ্ঠে একরাশ স্নেহ নিয়ে বললেন,
—“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে বাবা। আবার এসো বাসায়।”
আদ্র মাথা দুলালো। গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেল সেখান থেকে।

__________

দু’দিন ধরে ভার্সিটি, টিউশনি কোথাও যাওয়া হয় নি বেলার। আজকেও যাবে না বলেই ভেবে রেখেছিল সে। কিন্তু বিকাল হতে না হতেই শিক্ষার্থীর মায়ের কল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, আজকে না আসলে আর আসার প্রয়োজন নেই।
বাধ্য হয়ে বেলাও বিরসমনে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আদ্রদের বাসার সামনা-সামনি আসতেই সরব ফোন বেজে উঠলো তার। বেলা দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই স্ক্রীনে ভেসে উঠলো এক অচেনা নম্বর। কল রিসিভ করে কানে ফোন রাখলো বেলা। ‘হ্যালো’ বলার সময়টুকু না দিয়ে ওপাশ হতে ভরাট পুরুষালী কণ্ঠ বলে উঠলো,
—“দাঁড়ান ওখানে। আমি আসছি।”
বেলা ভ্রু কুঁচকালো। জিজ্ঞেস করলো,
—“কে? আদ্র ভাইয়া?”
ওপাশ থেকে গমগমে উত্তর, “হ্যাঁ।”

বেলা প্রায় তৎক্ষণাৎ পালটা জবাব দিলো,
—“আপনি আমার নাম্বার কই পেলেন?”
—“আমি একজন রাজনীতিবিদ। ভুলে গেছেন?”

বেলা হকচকালো। কিছু বলতে নিলেই তাকে থামিয়ে দিয়ে আদ্র আবার বললো,
—“দাঁড়ান। আসছি।”

বেলা দাঁড়িয়ে রইলো। আদ্র এলো তার কয়েক মিনিট পরই। কোনোরুপ অনুমতি ছাড়া বেলার হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো অতি সন্তপর্ণে। ছোট্ট করে বললো, “আসুন।”

বেলা মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো। যাওয়ার পথে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও হাত ছাড়েনি আদ্র। বরং হাতের বাঁধন শক্ত করেছে আরও।
মেনরোডে আসতেই রিকশা চালককে ডাক দিলো আদ্র,
—“এই মামা, এদিকে।”
রিকশা চালক সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকালো আদ্রর দিকে। রিকশা ঘুরিয়ে আসতে লাগলো। তাদের সামনে রিকশা থামতেই আদ্র বললো,
—“উঠুন।”

বেলা নিঃশব্দে উঠে বসলো রিকশায়। আদ্রও তার পাশে বসতেই অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনিও কি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন?”
আদ্র প্রথমেই উত্তর দিলো না। রিকশা চালক হুট তুলে দিচ্ছিলেন। তাকে থামিয়ে আদ্র বললো,
—“হুট তুলতে হবে না। থাকুক।”
তারপর বেলার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ। পৌঁছে দিব আপনাকে।”

বেলা আর কিছু বলে নি। আড়চোখে দাম্ভিক নেতা আদ্র ইয়ানিদকে দেখেছে কয়েকবার। আদ্র একবারের জন্যও তার মুখপানে তাকায় নি। তার স্থির দৃষ্টি সামনের রাস্তায়।
গন্তব্য আসতেই রিকশা থেমে গেল। নিজেকে গুছিয়ে নেমে পরলো বেলা। আদ্রও নামলো সেই সঙ্গে। বেলা এদিক-ওদিক তাকালো। হাসফাস করে বললো,
—“আসি তাহলে?”

আদ্র নিশ্চুপ রয়। প্রতিউত্তর করে না। চোখের গম্ভীরতা বাড়ে শুধু। নির্নিমেষ হয় দৃষ্টি। বেলা না যাওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে তার প্রস্থান।

__________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here