প্রিয় বেলা
২৬.
হাতের চিকন আঙুলগুলো অবিশ্রান্ত ঝাঁকড়া চুলগুলোর ভাঁজে ভাঁজে ঘুরিয়ে চলছে বেলা। লোকটা ঘুমিয়ে গেছে প্রায় অনেক্ষণ হলো। ঘন ঘন নিশ্বাসে বিস্তর বক্ষস্থল ওঠানামা করছে। বেলার একহাত খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। খুব যতনে। চুল থেকে হাত নামিয়ে আদ্রর গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো বেলা। সেভ করা গালটায় সদ্য নতুন চাপদাঁড়ি গজিয়েছে। লোকটাকে আরও সুন্দর লাগছে এতে। বেশ কিছুপলক এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আদ্রর মাথা কোল থেকে নিচে নামিয়ে রাখতে চাইলো বেলা। ছাদের দরজা খোলা। সময় গড়াচ্ছে। মা, বাবা যদি হুট করে চলে আসেন? কিন্তু তার পূর্বেই হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে প্রবল শব্দে। বেলা উসখুস করলো। আওয়াজের উৎস খুঁজলো। পরে যখন বুঝলো আদ্রর কল এসেছে, উপায়ন্তর হয়ে মৃদু গলায় ডাকলো তাকে,
—“আদ্র। আদ্র শুনছেন? আপনার কল এসেছে। আদ্র?”
আদ্রর সাড়া শব্দ নেই। নড়চড়ও করছে না। বেলা আরও বেশ কয়েকবার ডাকতেই বিরক্তিতে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললো সে। নেত্রপল্লব বোজা অবস্থাতেই রোষপূর্ণ গলায় প্রশ্ন করলো,
—“কি হয়েছে? ডাকছো কেন?”
ততক্ষণে নতুন উদ্যমে ফোন আবারও বাজতে শুরু করেছে। বেলা মিনমিন করে বললো,
—“আপনার ফোন বাজছে। অনেকবার কল করেছে।”
আদ্র বিনাবাক্যে ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। বেলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অলস কণ্ঠে বললো,
—“ফোন রিসিভ করে কানে ধরো। এসব করতে এখন একদম ভালো লাগে না আমার।”
বেলা অবাক হয়ে পলক ঝাপটালো। আদ্র তখনো ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না। তিক্ততায় বিকৃত করে রেখেছে সারা মুখশ্রী। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই কেমন থমথমে, গম্ভীর স্বরে বললো, “আদ্র ইয়ানিদ বলছি।”
ওপাশ থেকে কি যেন বললো। আদ্রর ভ্রুযুগল অস্বাভাবিক ভাবে কুঁচকে গেল। ঘুম উবে গেল পুরোপুরি। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে ফোনটা বেলার কাছ থেকে টেনে নিলো সে। বড়োসড়ো ধমক লাগালো,
—“আমাকে আগে জানানো হয়নি কেন?”
আবারও পিনপতন নীরবতা। আধো আধো কোনো পুরুষ কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল বেলা। চকিতে তাকালো। আদ্র আগের মতোই বললো, “আসছি আমি। যেভাবে আছিস সেভাবেই থাক।”
কান থেকে ফোন নামালো আদ্র। কপালে দু’টো আঙুল জোড়ালো ভাবে ঘঁষে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। যথেষ্ট শান্ত থাকার চেষ্টা করে বেলার দিকে তাকালো। বললো,
—“আমার এখন যেতে হবে বেলা। আমি তোমাকে পরে কল করবো।”
বলে মাথা ঝুঁকিয়ে কাছাকাছি হলো সে। উষ্ণ নিশ্বাসের অস্থির ছোঁয়া ললাট রাঙিয়ে দিলো। বেলা বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হয়েছে?”
—“বিপক্ষদল আক্রমণ করেছিল বেলা। আমার যেতে হবে।”
আদ্র চলে গেল। বেলা নিশ্চুপ হয়ে দেখল তার যাওয়া। পিছু ডাকলো না আর। কানে এলো, মা ডাকাডাকি করছেন।
–
আদ্র রাতে ফেরেনি বাসায়। দলবল নিয়ে ক্লাবেই ছিল। কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তন্ময়ের হাত গুরুতর ভাবে কেটে গেছে। বাহুর একদলা মাংস ছুড়ির আঘাতে কেটে ক্ষতবিক্ষত। মাথা ফেটে এলাহি কান্ড। বাকিদের অবস্থাও সমীচীন নয়। ক্লাব তচনচ করা। প্রয়োজনীয় ফাইল, বুকসেল্ফ, চেয়ার ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
আদ্রর মাথা ঝিমঝিম করছে। ফুলে টনটন করছে কপালের মোটা রগগুলো। স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে আছে। মাথার দু’ধারে হাত চেপে ঘাড় ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলো সে। দরজা ঠেলে আকিব এলো তখন। যথেষ্ট নম্র গলায় ডাকলো,
—“ভাই?”
আদ্র শুনলো। চোখ তুলে তাকালো অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“পার্টি অফিসে যেতে হবে আমার। কাজ সব হয়েছে? বাসায় যাবো আমি।”
আকিব ইতস্তত করলো। ভীতু মনে এদিক-ওদিক তাকালো। আস্তে করে বললো,
—“বিরোধী দলের ইখতিয়ার এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি কি পাঠাবো ভাই?”
আদ্রর চোখ ছোট ছোট হলো। খুবই সূক্ষ্ণ, দৃঢ়। তীক্ষ্ণতা প্রবাহমান। ওভাবেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো সে। বললো, “পাঠাও।”
আকিব মাথা দুলিয়ে চলে গেল। ইখতিয়ার এলো তার একটু পরেই। পরনে মুজিব কোর্ট, ধূসর রঙের জিন্সের জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। হাতে, গলায় বিভিন্ন ব্রেসলেট। মুখে বয়সের ছাপ পরতে শুরু করেছে এখন থেকেই। আদ্র থেকে বড়জোর সাত-আট বছরের বড় হবে। অনুমতি ছাড়াই সোজা আদ্রর সামনের চেয়ারে বসে পরলো সে। নোংরা দাঁত বের করে বিশ্রী হাসলো। হাত বাড়িয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,
—“কেমন আছেন আদ্র সাহেব। নতুন পদ, ক্ষমতা পেয়ে কেমন লাগছে?”
আদ্রর চেহারায় কাঠিন্যতা। চোয়াল শক্ত। হাত মেলালো না সে। রাশভারি কণ্ঠে উত্তর দিলো, “রাতের আঁধারে চোরের মতো কাজ করে এখন আবার কি জন্যে এসেছেন? নিশ্চই পদ, ক্ষমতা পেয়ে কেমন আছি তা জানার জন্য না। কাজের কথা বলুন।”
হাত না বাড়ানোয় অপমানে শরীরে জ্বলুনি অনুভব করলো ইখতিয়ার। তবে পরক্ষণেই তা গা ঝাড়া দিয়ে ফেললো। এমন একটু আধটু অপমান সহ্য করতেই হয়। নইলে রাজনীতিতে টেকা যায় না। পরে নাহয় হিসাব সমান সমান করবে। পা ছড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো সে। বিচ্ছিরি কণ্ঠটা আরেকটু বিচ্ছিরি করে বললো,
—“তোমার বুদ্ধীর প্রসংশা করতে হয় কিন্তু। এইজন্যই তোমাকে আমার ভালো লেগেছে অনেক। কিন্তু চোর তো রাতের বেলাই চুরি করে আদ্র সাহেব।”
হাতের পিঠে থুতনি ঠেকিয়ে বসলো আদ্র। ঠাট্টার সুরে বললো,
—“তাহলে আপনি মানছেন, আপনি চোর। একজন নিম্নমানের চোর।”
শুনে সশব্দে হেসে উঠলো ইখতিয়ার। কি বাজে শোনালো হাসিটা! মুহুর্তেই আবার হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠলো সে। টেবিলের উপর দু’হাত রেখে বললো,
—“ঠাট্টা মজা করা শেষ। এবার কাজের কথায় আসছি। দেখ আদ্র, তুমি না থাকলে এমপি পদটা আমারই হতো। তুমি মরলেও পদটা আমারই হবে। কিন্তু আমি তোমাকে মারবো না। আমার দলের একজন প্রধান সদস্য বানাতে চাচ্ছি। আমার ড্রাগসের ব্যবসা আছে। মানে কলেজ, ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের ড্রাগ এডিক্টেড করা আরকি। এতে ব্যবসা ভালো চলে। কিন্তু ইদানিং তোমার ছেলেপেলেরা ভীষণ সমস্যা করছে। ওদের সামলাও। মোটা অংকের টাকা পাবে।”
আদ্রর অভিব্যক্তি আগের মতোই কঠিন। শূণ্যের কোঠায়। কপালে গাঢ় ভাঁজের বলিরেখা। টেবিল থেকে কলম নিয়ে সে কিছু একটা ভাবলো। হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলো, “কত টাকা?”
কথাটা যেন ঝংকার তুললো পুরো রুমে। নিস্তব্ধতা ডিঙ্গিয়ে ইখতিয়ার হো হো করে হেসে উঠলো। জবাব দিলো, “তুমি যত চাও।”
—“আমি এমাউন্ট আপনাকে মেসেজ করে দিব। এখন যেতে পারেন।”
মনে মনে আদ্রকে গালমন্দ করলো ইখতিয়ার। এত সহজে রাজী হওয়ায় খুশিও হলো সে। সাচ্ছন্দ্যে চলে গেল সেখান থেকে।
আকিব অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে তখনো। আদ্রকে চিনতে পারছে না যেন। কণ্ঠস্বর থেকে কথা বেরোতে চাইছে না। ক্ষত মনে ক্ষীণ গলায় সে ডাকতে চাইলো,
—“ভাই।”
–
পশ্চিম দিকে সূর্য ডুবেছে। আকাশে ঘোর সন্ধ্যার সমাপ্তি। মেদুর কালো রঙে আচ্ছাদিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীর বাসা থেকে বেরিয়ে বেলা করিম চাচার রিকশার দিকে এগোলো। রিকশায় উঠে বসতে নিলেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে দিরুক্তি করে উঠলেন,
—“তুমি আমার রিকশায় আইজকে উঠতে পারবা না মা। আদ্র সার মানা কইরছে।”
বেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে হাসলেন করিম চাচা। লাজুক কণ্ঠে বললেন,
—“ওই সামনে, গাছের পিছে আদ্র সারের গাড়ি খাড়াইয়া আছে। তোমারে যাইতে কইছে। যাও।”
বেলা তৎক্ষণাৎ সূদুর গাছের ওখানটায় দৃষ্টি ফেললো। কালো রঙের গাড়িটা ঠিক নজরে এলো তার। করিম চাচার দিকে তাকিয়ে বিনয়ী হাসি ফিরিয়ে সে গাড়ির দিকে এগোলো। কাছাকাছি আসতেই পেছনের দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল। ঠোঁট কামড়ে একবার চারপাশটা দেখল বেলা। নিঃশব্দে আদ্রর পাশে গিয়ে বসলো।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আদ্র নিশ্চুপ। একমনে, অনিমেষ দেখছে বেলাকে। চোখের পলক খুব কমই ফেলছে। বেলার দিকে একদম ফিরে বসে আছে সে। অথচ চেহারায় স্পষ্ট চিন্তা, ক্লান্তি। নত মস্তকে বেলা আড়নয়নে একবার তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হয়েছে?”
—“দেখছি তোমাকে।”
অকপটে বলা কথার পিঠে কিছু বলার সাহস হলো না বেলার। মিইয়ে গেল। লজ্জা পেল। কেঁপে উঠলো নেত্রপল্লব। ভারী হলো গাল। আদ্র দূর্বোধ্য হাসলো। হুট করে শুধালো, “আমাকে তোমার কেমন লাগে বেলা?”
বেলা হকচকালো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ক্ষীণ সময় লাগিয়ে মৃদু কণ্ঠে খুব ছোট্ট করে বললো, “ভালো।”
—“শুধুই ভালো?”
বেলা জবাব দিলো না। লোকটা যে তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে, তা ঢের বুঝতে পেরে গেছে সে।
আদ্র আবারও হাসলো। উঁচু গলায় ড্রাইভারকে বললো, “লাইট বন্ধ করে দাও ইমরান।”
বাতি নিভে যায়। অন্ধকার হয় আশপাশ। সেই অন্ধকার কাজে লাগিয়ে বেলার কাঁধে মাথা রেখে হেলে পরে আদ্র। বেলা চমকিত হয়ে কিছু বলার পূর্বেই বলে,
—“তোমার বাসায় কাল পরিবার নিয়ে আসছি আমি। তৈরি থেকো।”
—“কেন?”
বেলার কণ্ঠে বিস্ময়। আদ্র নিষ্প্রভ স্বরে বললো,
—“বিয়ে করতে।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা