যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৩৭

0
906

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৩৭
.
সময়ের বেগে চলে গেল অনেকটা দিন। এর মাঝে ফুফিরা এবং ছোট চাচ্চুরা একবার এখানে এসে ঘুরে গেছেন। উনাদের সাথেই চলে গেছেন ইয়াসিন ভাইয়া। আমার পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে অনেকদিন হলো। কাল শেষ পরীক্ষা। সে নিয়েই রাতের অন্ধকারে লাইট জ্বালিয়ে পড়াশোনা করছি রুমে। পড়াশোনা তো করছি না, বরং হাজারো ভাবনায় ডুবে আছি। এর মাঝে ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। বাজতে বাজতে কেটেও গেল। পরেরবার ফোনের রিং আবার বাজতেই দ্রুত ধরে ফেললাম কল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ঝাড়ি দেওয়ার সুরে বলে উঠলেন রেয়ান,
— “সমস্যা কি? কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি। কোথায় ছিলে তুমি?”

আমতা আমতা করে আমার জবাব,
— “পড়ছিলাম।”

এবার যেন একটু নরম হলেন উনি। ঝাঁঝালো কণ্ঠটাকে শিথিল করে শান্ত গলায় বললেন,
— “যে ম্যথটা পারছিলে না সেটার উত্তর করে দিয়েছি আমি। ওয়াটস আপে দিয়েছি। দেখে নিয়ো।”

আস্তে করে বললাম,
— “ঠিকাছে।”
উনি আবারো বললেন,
— “শুনো, যত রাত জাগার জাগবে কিন্তু পড়া যেন কমপ্লিট হয়। পরীক্ষায় যদি একটুও ভুল হয় তাহলে কিন্তু একবছর ফুচকা খাওয়া বন্ধ তোমার। রেস্টুরেন্ট থেকেও খেতে পারবে না।”

অবাক, বিস্ময় আর রাগে জ্বলে যাচ্ছি আমি। পৃথিবীর কোন ব্যক্তি তার বউকে বলেছে, রাত জেগে পড়ালেখা করতে? তাছাড়া আমার প্রিয় খাবার নিয়েই উনার এতশত শত্রুতামি কেন? ভাবতেই রাগ যেন বেড়েই যাচ্ছে আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— “আপনার একটা কথাও শুনবো না আমি। ইচ্ছে করে পরীক্ষায় ফেল করবো।”

ভেবেছিলাম রেগে যাবেন উনি। কিন্তু না! অত্যন্ত শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
— “চড়, থাপ্পড়গুলো আমিও ইচ্ছে করেই দেবো। আবদ্ধের রিসেপশনের সময় একটা ব্রীজে গিয়েছিলে মনে আছে? সেখানের পানিতে ফেলে দেবো একদম। বেয়াদপ!”

আস্তে আস্তে তার শান্ত কণ্ঠ গম্ভীর কণ্ঠে পরিণত হলো। এবং সাথে সাথে কলটা কেটে দিলাম আমি। নাহলে যে কতগুলো বকা খেতে হবে তার হিসেব আমিও জানি না। কলটা কেটে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলবো তারো সময় পেলাম না আমি। আবারো রেয়ানের কলে ফোনের ‘টুংটাং’ শব্দ বেজে উঠল। বাধ্য হয়ে এবার ফোনটাই বন্ধ করে দিলাম আমি। পরক্ষণেই আবার ভয়ে চুপসে গেলাম। আল্লাহ্ জানে কাল এই ফোন বন্ধ করার জন্য কি শাস্তি দেবেন রেয়ান।

_______________

অদ্ভুদ ভাবে সকালে পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় রেয়ানকে দেখতে পেলাম না আমি। অথচ আমাকে নিয়ে যেতে এবং আসতে সর্বদা উনিই হাজির হয়েছেন। আজ আসেন নি কেন? তবে ভালোই হয়েছে। তার বকা শুনতে হবে না আর। অনেকটা খুশি মনেই পরীক্ষা দিলাম আমি। কিন্তু পরীক্ষার হল থেকে বের হতেই আমার সব খুশিতে পানি ঢেলে চলে এলেন রেয়ান। তার মুখে রহস্যময় হাসি। আমি তার সামনে যেতেই বললেন,
— “পরীক্ষা কেমন হলো?”
— “ভালো।”

কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে তার প্রশ্ন,
— “ইচ্ছে করে ফেল করো নি?”

বুঝতে পারলাম খোঁচা দিয়ে বলেছেন কথাটা। চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম তার দিকে। সে হাসলেন। হাত ধরে সামনের ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
— “আজ গাড়ি নেবো না। হাঁটবো। সমস্যা হবে?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না জানালাম। উনি আমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলেন। হঠাৎ-ই বিড়বিড় করে উঠলেন,
— “আমার মরুভূমি।”

কথাটা শুনতে পেলাম স্পষ্ট। লজ্জায় নুইয়ে গেলাম। চোখ তুলে তার দিকে তাকানোর সাহস হলো না আর।

১৫.

আজ কোথাও যায় নি আবদ্ধ। সারাদিন বাসায়ই সময় কাটিয়েছে। কেন যায় নি তার সঠিক উত্তর আবদ্ধেরও জানা নেই। তবে বলা যায়, তার যেতে ইচ্ছে করে নি। দীঘিও আবদ্ধের সাথে সাথেই ছিল সারাক্ষণ। এই যে এখন! বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকালের স্নিগ্ধ বাতাস উপভোগ করছে আবদ্ধ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে দীঘি। হঠাৎ হঠাৎ কি যেন বলে উঠছে দীঘি। সেদিকে আবদ্ধের পাত্তা নেই বললেই চলে। দীঘিও কম কিসের? ইচ্ছে করেই আবদ্ধের কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলছে। এবার বেশ বিরক্ত হলো আবদ্ধ। বিরক্ত সহিত বলল,
— “বিরক্ত করছো কেন দীঘি? শান্ত থাকতে পারো না?”

দীঘির ত্যাড়া জবাব,
— “থাকতে পারি না তো। শিখিয়ে দিন।”
— “দীঘি! ফাজলামি বন্ধ করো। দিনদিন বেশি দুষ্টুমি করছো তুমি।”

সাথে সাথে মুখ ফুলিয়ে নিলো দীঘি। রাগ দেখিয়ে রুমে চলে গেলো। ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। এদিকে আবদ্ধ বুঝতে পারছে না সে এমন কি বললো? দীঘি চলে গেলো ই-বা কেন? এমন তুচ্ছ কথায় রাগ করেছে কি দীঘি? এত তুচ্ছ কথায়? ছোট একটা নিশ্বাস ফেললো সে। এত ছোট মেয়ে যেহেতু বিয়ে করেছে, সেহেতু মেয়েটার রাগ ভাঙ্গানোর সব দায়িত্বও তার। সুতরাং, দেড়ি না করে দীঘির কাছে চলে গেল আবদ্ধ। আস্তে করে বসল দীঘির পাশে। সাথে সাথে দীঘি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবদ্ধ হাসলো একটু। আহ্লাদী গলায় বললো,
— “আমার বউয়ের রাগ কি করলে ভাঙ্গবে?”

দীঘি জবাব দিলো না প্রথমে। আবদ্ধ আবারো জিজ্ঞেস করতেই কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
— “আপনার সাথে কথা নেই। আপনি অনেক বাজে। সবসময় বকেন আমাকে।”

আবদ্ধের মনে হলো, কোনো পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে অভিমান করেছে তার সাথে। আগের কঠিন দীঘি ভালোবাসা পেয়ে এখন যেন ছোট্ট শিশু হয়ে গেছে। প্রতিদিন দীঘির এমন আহ্লাদী রূপ দেখে বড্ড হাসি পায় আবদ্ধের। আজও হেসে দিলো সে। দম ফাটানো হাসি যাকে বলে, ঠিক তাই। আবদ্ধের হাসি দেখে দীঘির মুখ আরো ফুলে গেলো। দীঘিকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো আবদ্ধ। ম্লান কণ্ঠে বলল,
— “বেশি রাগ করেছো কি?”

দীঘির জবাব নেই। আবদ্ধ আবার বলল,
— “সরি দীঘুপাখি। আর বকবো না। এবার একটু হাসো।”

দীঘি তবুও নিরুত্তর। একটু রেগে গেলো আবদ্ধ। দীঘির বাহুধরে তাকে নিজের মুখোমুখি বসালো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,
— “কথা বলবে না আমার সাথে? হাসবে না?”

দীঘি মাথা ঝাঁকিয়ে না জানালো। সঙ্গে সঙ্গে দীঘিকে কাতুকুতু দিতে শুরু করলো আবদ্ধ। খিলখিল করে হেসে উঠল দীঘি। বারবার আবদ্ধকে থামানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু আবদ্ধ থামছে না। মুখে শুধু এতটুকুই উচ্চারণ করেছে,
— “আমার সাথে রাগ করার শাস্তি এবার বুঝো। হাসাতে হাসাতেই কাঁদাবো তোমায়।

______________

রাত ১০টা বাজে। টেবিলে বসে আব্বু, আম্মু আর আমি রাতের খাবার খাচ্ছি। এমন সময় আব্বু বলে উঠলেন,
— “তোমার তো পরীক্ষা আজই শেষ হলো তাই না?”

আমি ছোট্ট করে বললাম,
— “জ্বী আব্বু।”

আব্বু এবার একটু কেশে উঠলেন। নরম গলায় বললেন,
— “তোমার পরীক্ষা যেহেতু শেষ তাই ভাবছি কালই রাঙামাটি চলে যাবো। ভাইয়ের সাথেও কথা হয়েছে আমার। আব্রাহাম, আবদ্ধ, সবাইসহ আমরা কাল দুপুরের ট্রেনে রাঙামাটি যাচ্ছি। তোমার সব গুঁছগাছ করে রেখো।”

আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। তাছাড়া কি-ই বা বলার আছে আমার? আমি শুধু খেয়ে-দেয়ে রুমে যেতে চাই। পরীক্ষার জন্য ঠিক মতো ঘুমানো হয় নি। এখন একটু শান্তি মতো ঘুমাতে পারলেই বাঁচি।

পূর্ব পরিকল্পনা মতে রুমে গিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ি আমি। সাথে সাথে দু’চোখের পাতায় আকাশসম ঘুম এসে হাজির হয়। ঘুমিয়েই যাচ্ছিলাম এমন সময় অসহ্যকর ফোনটা বেজে উঠল। পরপর তিনবার। শেষে একটা মেসেজ এলো। তীব্র আলসেমি নিয়ে ফোনের স্ক্রীনে তাকালাম। স্পষ্ট লেখায় বুঝতে পারলাম, রেয়ান আপাতত বিল্ডিংয়ের বাহিরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। অফিস থেকে সোজাসুজি এখানে এসেছেন উনি। তাই আসতে বলেছেন আমাকে।

বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই। গায়ে চাদর জড়িয়ে দ্রুত পায়ে বের হলাম। ড্রইংরুমের পাশ দিয়ে যেতেই মনে হলো উনার জন্য কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত। কিছু যদি না খেয়ে থাকেন উনি? ভাবনা মতে মায়ের রান্না করা খিচুড়ি আর গরুর মাংস গরম করে নিয়ে নিলাম একটা থালায়। সেটা নিয়েই চলে এলাম বিল্ডিং এর বাহিরে। বিল্ডিংয়ের গেটের কাছে আসতেই দেখলাম দারোয়ান চাচা ঘুমিয়ে আছেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসেই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে রেয়ানকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। পেয়েও গেলাম। ডান দিকে একটু দূরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে উনি। এক হাতে পানির বোতল ধরে অন্য হাত প্যান্টের পকেটে। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে আছেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। তার কাছে আসতেই চোখ মেলে তাকালেন উনি। আমার দিকে তার অশান্ত চোখ জোড়া নিক্ষেপ করলেন। তবে কিছু বললেন না।

আমিও চেয়ে রইলাম তার দিকে। বলা যায়, পর্যবেক্ষণ করছি তাকে। এলোমেলো চুলে কপাল ঢেকে গেছে উনার। সাদা শার্টের এক পাশ ‘ইন’ করা তো অন্য পাশ ‘ইন’ করা নেই। কুনুই এর একটু নিচ পর্যন্ত হাতা ফোল্ড করা। শার্টের প্রথম দু’টো বোতাম খোলা। টাইয়ের নাটটাও ঢিলে করে রেখেছেন। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে উনার মুখ। আমাকে এভাবে তাকিয়ে তাকতে দেখে অসাধারণ একটা মুচকি হাসি দিলেন রেয়ান। নিমিষেই মনটা ভালো হয়ে গেল যেন। আচ্ছা, এই অগোছালো অবস্থায়ও মানুষটাকে এত হ্যান্ডসাম লাগছে কেন? উত্তরটা ভাবার সময় পেলাম না আমি। তার আগেই আমাকে কোলে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন রেয়ান। তারপর নিজে বসে পড়লেন আমার পাশে। হতভম্ব আমি তখনো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে। কি হলো একটু আগে? বিস্ময় নিয়ে রেয়ানের দিকে তাকালাম। উনি এখনো মুচকি হাসছেন। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এ ছেলে এত অসভ্য তা অজানা ছিল না আমার। আজ সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন উনি। একরাশ রাগ এসে হানা দিলো আমার মাঝে। নিজেকে কোনো রকম সামলে হাতের প্লেট দেখিয়ে বললাম,
— “খেয়েছেন কিছু? নিশ্চয়ই না। আমি আপনার জন্য খিচুড়ি এনেছি। খাবেন?”

রেয়ান ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “তুমি দেখছি আমার জন্য চিন্তাও করো। ব্যাপার কি? প্রেমে পড়ে গেছো নাকি আমার? শোনো মেয়ে, এসব বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হও। আমার কাছে এসব করে পাত্তা পাবে না।”

রাগে, দুঃখে কান্না চলে আসছে আমার। প্রবল রেগে তাকালাম তার দিকে। গাড়ির দরজা খুলে চলে যেতে নিলেই বাহু ধরে ফেললেন আমার। শান্ত গলায় বললেন,
— “ক্ষুধা লেগেছে তো।”

রাগী কণ্ঠে বললাম,
— “তো আমি কি করবো?”
— “খাইয়ে দিবে।”

নির্লিপ্ত ভাবে কথাটা বলতেই চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম আমি। বললাম,
— “আপনি কি ছোট বাচ্চা নাকি? হাত নেই?”
— “উহু!”
— “একদম উহু শব্দটা উচ্চারণ করবেন না।”
— “উহু! করবো।”

অতিরিক্ত রাগে আর কিছু বললাম না। চুপচাপ বসে রইলাম সীটে। উনিও সীটে হেলান দিয়ে বসলেন। প্রায় অনেক্ষণ এভাবেই নিরবতা কাটলো আমাদের মাঝে। এদিকে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য আমি খাবার খাইয়ে দিতে শুরু করলাম উনাকে। উনিও শান্ত ছেলের মতো খেয়ে নিলেন পুরোটা খাবার। শেষে আমি চলে যেতে নিলে তড়িৎ গতিতে শুয়ে পড়লেন আমার কোলে। আমি অবাক হলাম। তাকে কোল থেকে উঠাতে চাইলেই উনার জবাব,
— “আমি অনেক ক্লান্ত মরুভূমি। একটু ঘুমাতে চাই।”

মায়া হলো আমার। আর কিছু বললাম না। তার চুলে হাত বুলাতে শুরু করলাম মাত্র।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here