হৈমন্তিকা পর্ব – ১৫

0
390

হৈমন্তীকা

১৫.
গোধুলির আগমন ঘটছে পৃথিবীতে। পূব দিকের নীল রঙা আকাশটা কি দারুণ হলদে, কমলা হয়ে উঠেছে! মাত্র রান্নাঘর থেকে নিজের রুমে এসেছে হৈমন্তী। সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবে আজ চনাবুট, পিঁয়াজু আর আলুর চপ রেঁধেছে সে। গরমে ঘর্মাক্ত তার পুরো মুখশ্রী। মুখ না ধুলে এবার হচ্ছেই না! চট জলদি হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় বসতে না বসতেই হেমন্ত চলে এলো বাহির থেকে। ব্যস্ত হয়ে ব্যগ্র গলায় বললো,
— “আব্বু তো নতুন বাসা খুঁজতে উঠে পরে লেগেছে আপু। এবার কি হবে?”
হৈমন্তী ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে,
— “কি হবে আর। অন্য বাসায় উঠবো।”
— “তাহলে তুষার ভাইয়া?”

হেমন্তের কণ্ঠ উত্তেজনায় ভরপুর। কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। হৈমন্তী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
— “মানে?”
— “মানে, তুমি তুষার ভাইয়াকে ভালোবাসো না?”

হৈমন্তীর আঁখিজোড়া বড় হয়ে এলো। চোখ রাঙিয়ে তাকালো সে। রোষপূর্ণ গলায় ধমক দিয়ে উঠলো,
— “মুখ সামলে হেমন্ত! মাত্র নাইনে পড়িস তুই। নিজের চেয়ে বড় ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করে মাথা বিগড়ে গেছে পুরোপুরি। বড় বোনের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস? নাকি আদব-কায়দার অভাব হয়েছে তোর?”

হেমন্ত চুপসে গেল। কি যেন বলতে গিয়ে আবারো থেমে গেল সে। মুখ কালো করে চলে গেল অন্যদিকে।

_____

আফতাব সাহেবের সঙ্গে তুষারের দেখা হয় না প্রায় দু’দিন। আজ শুক্রবার। জুম্মার নামায পড়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছে তুষার। মুখভঙ্গী অস্বাভাবিক শান্ত, শীতল, নির্বিকার। টেলিভিশনের চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে উঁচু গলায় ডেকে উঠলো সে,
— “মা? ঠান্ডা পানি দাও।”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো, “অপেক্ষা কর। আনছি।”

ততক্ষণে আফতাব সাহেব এসে পরেছেন বাসায়। ড্রইংরুমের টেবিলের ওপর মাথার টুপি খুলে রেখে, সোফায় বসতে বসতে বললেন,
— “আজ সূর্য কোথায় উঠেছে তুষার? সকাল সকাল বাহিরে না গিয়ে বাসায় বসে আছো যে?”

আফতাব সাহেবের মন মেজাজ আনন্দে স্বতঃস্ফূর্ত। কণ্ঠে রসিকতা বিদ্যমান। হবেই না কেন? পথের কাঁটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে যে!
তুষার জবাব দিলো না। চ্যানেল পাল্টানোতে সম্পূর্ণ মনোযোগ তার। আফতাব সাহেব আবার বললেন,
— “বেকার না ঘুরে এবার একটু ব্যবসায়ও তো হাত লাগাতে পারো তুষার। ম্যানেজারকে বলে দেব আমি। টুকিটাকি কাজ করবে। এরপর মাস্টার্স শেষ হতেই ভালো দেখে একটা মেয়ে বিয়ে করিয়ে দেব তোমার।”

আফতাব সাহেব যত আগ্রহ নিয়ে কথাটা বললেন, ততই আগ্রহহীন তুষার। সে আগের ন্যায়ই নিশ্চুপ। আফতাব সাহেব এবার বিরক্ত হলেন। বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি সমস্যা তুষার? কথা বলছো না কেন?”

তুষার তার শীতল দৃষ্টি মেলে ধরল। ক্ষীণ আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “হৈমন্তীকার পরিবারকে ফ্ল্যাট ছেড়ে যেতে বলেছ কেন বাবা?”

আফতাব সাহেবের মুখের রঙ পালটে গেল নিমিষেই। মলিন হয়ে এলো তা। থমথমে গলায় বললেন,
— “কোনো থার্ডক্লাস পরিবার আমার ফ্ল্যাটে থাকার অধিকার রাখে না।”
— “ওদের মাঝে কি থার্ডক্লাস দেখেছো তুমি? শুধু একটা কারণ দেখাও।”
— “দেখার আর কি বাকি আছে? ওই মেয়ে যেভাবে তোমার ব্রেনওয়াশ করেছে, আমি কিছু বললে সেটা বিশ্বাস করবে তুমি?”
— “অবশ্যই না। কারণ তুমি ভুল বুঝছো এবং করছো। উনি আমার ব্রেনওয়াশ করেন নি বাবা। বরং আমিই উনাকে বিরক্ত করছি।”

আফতাব সাহেব বিস্মিত স্বরে বললেন,
— “এসব বলতে লজ্জা করছে না তোমার তুষার?”
— “একদম না। বিয়ে করলে আমি হৈমন্তীকাকেই করবো বাবা। সেটা তুমি চাও বা না চাও।”
— “খবরদার তুষার! আমার সন্তান হয়ে আমার মতামতের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না তুমি।”

ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন তিনি। তুষার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো।
— “তোমার ছেলে? সিরিয়াসলি! হঠাৎ করে এত অধিকার দেখাচ্ছ কেন তুমি? আমি যখন নিঃস্ব ছিলাম তখন কোথায় ছিল তোমার এই অধিকার বোধ? সবার বাবা যখন তাদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যেত, তখন কোথায় ছিলে তুমি? যে বয়সে বাবার সঙ্গে অন্যরা খেলাধুলা করতো, সে বয়সে আমি কেন ব্যতিক্রম ছিলাম? তুমি কখনোই আমার ভালো চাও নি বাবা। আমার বন্ধুবান্ধব, জামা কাপড়, স্কুল, কলেজ সব তোমার কথা অনুযায়ী হবে না। হৈমন্তীকাকে আমি ছাড়বো না বাবা। কক্ষনো না।”

আফতাব সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “আমি ওই মেয়েকে কখনোই নিজের ছেলের বউ হিসেবে মানবো না তুষার! তুমি কেন বারবার ভুলে যাচ্ছো মেয়েটা তোমার বয়সে তিন বছরের বড়!”

তুষার চলে যাচ্ছিল। এহেন কথায় সিঁড়ির কাছে এসে থামলো। নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিলো,
— “ভুলিনি বাবা। আর এটাও ভুলিনি আমি উনাকে ভালোবাসি।”

হেনা মুরগির মাংস রাঁধছিলেন। আফতাব সাহেবকে চেঁচাতে দেখে দ্রুত চুলা বন্ধ করে দিলেন। তুষারের জন্য পানি নিয়ে ড্রইংরুমে ছুটলেন। ততক্ষণে তুষার চলে গেছে। আফতাব সাহেব প্রচন্ড রেগে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। ড্রইংরুমে তুষারকে না দেখে হেনা আফতাব সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি হয়েছে তুষারের আব্বু? আপনার চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? আর তুষার কোথায়?”

তীব্র ঝংকার তুলে তিনি ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “তুষারের নাম মুখেও নিবে না তুমি। তোমার কারণে ছেলেটা এত বিগড়ে গেছে।”

_____

রাকিব আহসান। রংপুর শহরে আসরাফ সাহেবের একমাত্র চেনা পরিচিত লোক। প্রাণপ্রিয় বন্ধু। তারই ছেলে নাওয়াজ আহসান। রংপুরের এই ফ্ল্যাটটাও নাওয়াজই খুঁজে দিয়েছিল আসরাফ সাহেবকে। তিনি যেহেতু রংপুর শহর এতটাও চেনেন না, সেহেতু আবারও নাওয়াজকে ডেকে আনেন বাসায়। নতুন বাসা খুঁজতে সাহায্য করার জন্য।

তখন সকাল সাড়ে ন’টার কাছাকাছি। অনেকদিন ভার্সিটি না যাওয়ায় আজ পারু বেশ তাড়া দিচ্ছে হৈমন্তীকে। তৈরি হতেও খানিক দেড়ি হয়ে গেছে তার। দ্রুত তৈরি হয়ে ড্রইংরুমে আসতেই নাওয়াজের চোখে পরে গেল সে। মুখভরে হেসে সে জিজ্ঞেস করলো,
— “কেমন আছো হৈমন্তী?”

হৈমন্তী অল্প হাসলো। নম্র আওয়াজে উত্তর দিলো,
— “ভালো ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”
— “ভীষণ ভালো আছি। ভার্সিটি যাচ্ছ নিশ্চই? আমিও এখন বের হবো। চলো তোমাকে পৌঁছে দেই।”

হৈমন্তী দিরুক্তি করতে চাইলো। তার আগে আগেই আসরাফ সাহেব সায় দিয়ে উঠলেন,
— “ভালো বলেছ নাওয়াজ। হৈমন্তী? দ্রুত যা। একটু পরেই দশটা বাজবে। দেড়ি হচ্ছে না তোর?”

হৈমন্তী হাসফাস করতে লাগলো। অস্বস্তিতে মুখ পাংশুটে হয়ে গেছে তার।

__________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here