হৈমন্তিকা পর্ব – শেষ

0
461

হৈমন্তীকা

শেষ পর্ব.
রুমের বাতি জ্বালানো নেই। বারান্দা আর জানালা গলিয়ে আলো উপচে পরছে রুমের আনাচে-কানাচে। এসির পাওয়ার বাড়ানো। চারপাশের শীতলতায় তীব্র কাঁপুনি অনুভব করছে হৈমন্তী। তুষার চুপচাপ, স্বাভাবিক ভাবে সোফার ওপর বসে আছে। মাথা হেলিয়ে হালকা নিচু হয়ে আছে। মুখশ্রী গম্ভীর, থমথমে। সে বারণ করার পরও হৈমন্তী কেন রান্নাঘরে গিয়েছে, তা নিয়ে মনে মনে ভীষণ রেগে আছে তুষার। রান্নাঘর থেকে জোড়পূর্বক টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে রেখেছে তাকে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত কিঞ্চিত পরিমাণ কথাও বলে নি তার সঙ্গে। হৈমন্তী বলতে চাইলেও না। ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে ব্ল্যাংকেট আরও ভালো ভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো হৈমন্তী। বললো,
—“তুষার মানব, আমার ঠান্ডা লাগছে। দয়া করে এসির পাওয়া কমিয়ে দিন।”

তুষার শুনলো। কিছু না বলে পাশ থেকে রিমোট নিয়ে তাপমাত্রা কমিয়ে দিলো। অতঃপর আবারও আগের রুপে ফিরে এলো অতি সন্তপর্ণে। হৈমন্তী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল এতে। অর্ধৈয কণ্ঠে বললো,
—“আপনি কি এখনো অবুঝ তুষার? বাড়ির বউ রান্নাঘরে যাবে না, এটা কি কখনো হয়? শুধু শুধু জেদ করছেন কেন?”

তুষার উত্তর দিলো না। কানে যেন পৌঁছালোই না কথাগুলো। তবে চোয়াল শক্ত হলো ক্ষীণ। কাঠিন্যতা স্পষ্ট হলো চেহারায়। হৈমন্তী বোঝানোর চেষ্টা করলো,
—“এভাবে রাগ করে থাকবেন না তুষার। একটু বোঝার চেষ্টা করুন। মা একা একা সব করতে পারেন না। আমি যদি উনাকে একটু সাহায্য করতে চাই, সেখানে আপত্তি কোথায়?”
—“আপত্তি নেই। আমি শুধু আপনাকে রান্নাঘরে যেতে মানা করেছি। অন্যান্য কাজেও তো সাহায্য করা যায়। তাছাড়া রহিমা খালা আছেন কি জন্যে?”
—“অন্যান্য কাজের জন্যই রহিমা খালা আছেন। আপনারা কি রহিমা খালার বানানো খাবার খেয়েছেন কখনো? মা-ই রান্না করেন সব সময়। একা হাতে সব সামলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেন। আমি মায়ের কাজ এগিয়ে দিতে চাইছি মাত্র। আর রান্না করতে গিয়ে ওই একটু কাঁটাছেড়া হয়ই। আমি অভ্যস্ত এতে।”

তুষার মানলো না। একরোখা উত্তর দিলো,
—“তবুও আমি কিচ্ছু জানি না হৈমন্তীকা। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তার রান্না দেখবেন সমস্যা নেই। টুকটাক সাহায্য করবেন এতেও সমস্যা নেই। তবে ক্ষত শুকানো না অব্দি রান্নার কোনো কাজে হাত লাগাতে পারবেন না। কথার অমান্য হলে আমি কিন্তু আপনাকে বকবো হৈমন্তীকা।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৈমন্তী। হেরে যায়। মেনে নেয় তুষারের কথা। তুষার নিমিষেই শান্ত হয়ে যায় যেন। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসে হৈমন্তীর পানে। কাছ ঘেঁষে বসে। মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই দেখে, হৈমন্তীর ডান গালে কিঞ্চিত ময়লার আবরণ লেগে আছে। হাত এগিয়ে তা ফেলে দিতে দিতে তুষার বললো,
—“আমি জব পেয়েছি হৈমন্তীকা।”

হৈমন্তী বিমূঢ় হয়ে তাকালো। অবাক কণ্ঠে বললো,
—“জব? কিসের?”
—“একটা কোচিংসেন্টারে ইংলিশ টিচার হিসেবে।”
—“মানে? কেন? আপনার বাবার ব্যবসা তো আছেই।”
হৈমন্তীর কানে চুল গুঁজে তুষার বললো,
—“আপাতত বাবার ব্যবসা সামলাতে চাইছি না। প্রস্তুত নই। তাই প্রাথমিক ভাবে কিছু একটা শুরু করছি।”
—“কিন্তু আপনার ভার্সিটি, পড়ালেখা? এসবের ক্ষতি হবে না?”

তুষার মুচকি হাসলো,
—“সামলে নেব।”

হৈমন্তী সন্তুষ্ট হতে পারলো না। মন খারাপ হলো ভীষণ। সে জানে, এসব করতে গিয়ে তুষারের কষ্ট হবে। ক্লান্ত হয়ে পরবে শরীর, মন। হৈমন্তীকে মুখ ফুলাতে দেখে তার নাক টেনে ধরল তুষার। বললো,
—“মুখ ফুলিয়েছেন কেন? হাসুন।”
হৈমন্তীর প্রাণহীন উত্তর,
—“ভালো লাগছে না।”
—“ভালো লাগতে হবে। কাল থেকে আপনি আবারও ভার্সিটি যাওয়া শুরু করবেন। আমার জন্য আপনার ক্যারিয়ার নষ্ট হোক, তা আমি অবশ্যই চাইবো না।”

বিষাদে আনন্দটা অত ধরা দিলো না হৈমন্তীর। শুধু ভেতরে ভেতরে অল্প খুশির রেশ জেগে উঠল। মুখে কিছু বলা হলো না। তুষার দূরত্ব কমালো। স্পর্শের প্রগাঢ়তা বারিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
—“কষ্ট হলেও আপনাকে ভালোবেসে তা পুষিয়ে নেব হৈমন্তীকা। আপনি আমার প্রশান্তি, হাসি, কান্না সবকিছু। এবার হাসুন তো দেখি। চোখটা বড্ড ব্যথা করছে। একটু জিড়িয়ে নেই।”

_____

সময়টা শরৎকাল। নদীর তীরে তীরে ফুটে আছে কাশফুল। মেঘেরা হেসে-খেলে ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল গগনে। এতো এতো মেঘের আস্তরণে আকাশের রঙটা নীলের জায়গায় সাদাই হয়ে গেল বুঝি! মাথার ওপর মিষ্টি রোদের সল্প তেজ। তবুও ঘেমে একাকার তুষার। প্রতিদিন টিউশন, কোচিংসেন্টার, ভার্সিটি– সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ঘমার্ক্ত শরীরে যেন রাজ্যের ক্লান্তি। তবে আজকের দিনটা ব্যতিক্রম। আগষ্ট হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা খাটাখাটুনির পর আজ নিজের পারিশ্রমিক হাতে পেয়েছে সে। সেই সঙ্গে সারামাসের ক্লান্তি যেন নিমিষেই হারিয়ে গেছে। ঠোঁটে দেখা দিয়েছে চমৎকার হাসি।
আসার পথে হৈমন্তীর জন্য দু’টো শাড়ি কিনলো তুষার। হাতের চুড়ি কিনলো। সঙ্গে খোঁপায় বাঁধার জন্য শুভ্র বেলীফুলের মালা। মায়ের জন্য পাতলা, সুন্দর শাড়ি। আর বাবার জন্য সাদা রঙের পাঞ্চাবী। কি ভেবে, রহিমা খালার জন্যও একটা সেলোয়ার-কামিজ নিয়ে নিলো সে।

কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো। আফতাব সাহেব বোধহয় তুষার আসার কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। পরনে এখনো অফিসের ফরমাল ড্রেস। উনার পাশেই হেনা বসে ছিলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নানান কথা বলছিলেন আফতাব সাহেবের সঙ্গে। জবাবে আফতাব সাহেব হু,হা করে ছোট্ট উত্তর দিচ্ছিলেন মাত্র।
তুষার প্রথমেই মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। লাল রঙের তিনটে প্যাকেট এগিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
—“প্রথম স্যালারি পেয়েছি মা। তোমার জন্য শাড়ি আর রহিমা খালার জন্য কামিজ এনেছি। দেখো, তোমাদের পছন্দ হয় কি-না।”

রহিমা খালা কাছাকাছিই ছিলেন। তার জন্য কাপড় এনেছে শুনে, তিনি খুশিতে কেঁদেই দিলেন যেন। হেনা পর পর প্যাকেট খুললেন। পাঞ্চাবী দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
—“পাঞ্চাবী দিলি যে? কার এটা? তোর?”
তুষারের সহজ স্বীকারোক্তি,
—“বাবার জন্য এনেছিলাম।”

আফতাব সাহেব পত্রিকা থেকে মুখ তুলে তাকালেন। একবার আড়চোখে হেনার হাতের পাঞ্চাবীটি দেখে নিলেন। মনে মনে পছন্দ হলেও তা প্রকাশ করলেন না তিনি। ভ্রু কুঁচকিয়ে বললেন,
—“নতুন চাকরি করে স্যালারিও পেয়ে গেলে। বাবাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? তাছাড়া অন্য জায়গায় চাকরিই-বা করতে হবে কেন? আমার ব্যবসা আছে কি জন্যে?”
—“তোমার ব্যবসা ওটা তোমার বাবা। আমার না। আমি নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতে চাচ্ছিলাম। কতকাল আর তোমারটা খাবো? আমার বয়সটাও বোধহয় ব্যবসা সামলানোর হয় নি। আরেকটু বড় হই। চিন্তা করে দেখব।”

তুষার আর এক দন্ড দাঁড়ালো না। চোখের অদূরে মিলিয়ে যেতেই হেনা থেকে পাঞ্চাবীটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিলেন আফতাব সাহেব। উল্টেপাল্টে দেখলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর বিড়বিড়ালেন,
—“আমার ছেলের পছন্দ তো একদম আমার মতো।”

_____

রুমে ঢুকেই দরজাটা নিঃশব্দে লাগিয়ে দেয় তুষার। দেখতে পায়, তার হৈমন্তীকা শুকনো শাড়ি আর শার্ট হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে আলমারিতে রাখছে। সে এগিয়ে যায়। হৈমন্তীর পেছন বরাবর একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
—“আপনার শাড়ির রাজ্যে আরও দু’টো শাড়ি যোগ হচ্ছে হৈমন্তীকা। দ্রুত জায়গা খালি করুন। নয়তো ওরা কিন্তু খুব রাগ করবে।”

আকস্মিক স্পর্শ, ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো কাঁপিয়ে তুললো হৈমন্তীর সর্বাঙ্গ। ভয় পেল ভীষণ। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে ধমক দিয়ে উঠলো,
—“পাগল হয়েছেন? জানেন কতটা ভয় পেয়েছি আমি?”
—“আমি তো পাগলই হৈমন্তীকা।”
হালকা হেসে হাতের প্যাকেটগুলো সামনে ধরল তুষার। হৈমন্তী নিলো তা। প্যাকেট হাতড়াতেই সিঁদুর রঙা একটি শাড়ি বেরিয়ে এলো। কাজ নেই শাড়িটিতে। তবুও কি দারুণ চোখ ধাধানো সুন্দর। শাড়ির ওপর একবার হাত বুলালো সে। পাশ হতে তুষার বললো, “আমি না বলা অব্দি এ শাড়িটি কখনো পরবেন না হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী তুষারের মুখপানে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
—“কারন আমি চাই শুধু আমিই এ শাড়িতে আপনাকে দেখব। আর কেউ না।”

হৈমন্তী আঁখিপল্লব পিটপিট করে চাইলো। “আচ্ছা।” বলে রেখে দিলো শাড়িটি। অন্য প্যাকেটেও একটি শাড়ি ভাঁজ করে রাখা। গাঢ় নীল রঙের। হৈমন্তী সেটাও রেখে দিলো। হাতে এবার শুধু দু’জোড়া কাঁচের চুড়ি। চুড়িগুলোর কয়েকটা ভেঙ্গে গেছে ইতিমধ্যে। মন খারাপ করে হৈমন্তী বললো,
—“চুড়িগুলো তো ভেঙ্গে গেছে তুষার।”

তুষার ততক্ষণে সরে এসেছে। শার্ট ছেড়ে টি-শার্ট জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। ভ্রু কুঁচকে সে বলে,
—“ভেঙ্গে গেছে? আচ্ছা। আমি আবার এনে দেব।”
সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে উঠলো হৈমন্তী,
—“না, না। লাগবে না। আমার এমনিতেই তো অনেক কাঁচের চুড়ি আছে।”
—“আপনার না লাগলেও আমি এনে দিব। রেখে দেবেন নয়তো ফেলে দেবেন। আপনার ইচ্ছা।”

হৈমন্তী কথা বাড়ানোর আর সাহস পেল না। মনে হলো, জেদি তুষার মানব রেগে যাচ্ছে। কিন্তু রাগছে কেন সে? মানা করায়? এই সামান্য কারণে কেউ রাগে? প্রশ্নে উত্তর না পেলেও তুষারের হাঁক আবারও শোনা গেল,
—“আমার তোয়ালেটা আনুন হৈমন্তীকা।”

চুড়িগুলো আলমারির ভেতর রেখে নিচের ড্রয়ার খুললো হৈমন্তী। তোয়ালে নিয়ে তুষারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তুষার আবার বললো,
—“পেছনে ঘুরুন।”
কপালে দৃঢ় ভাঁজ ফেলে বিনাবাক্যে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো হৈমন্তী। মৃদু স্বরে শুধাল, “কি হয়েছে?”
তুষার উত্তর দিলো না। পকেট থেকে বেলীফুলের মালা বের করলো। হৈমন্তীর আধখোলা খোঁপায় সযত্নে বেঁধে দিতে লাগলো। তারপর আবারও হাত টেনে সামনে দাঁড় করালো তাকে। একমনে, নিষ্পলক ভাবে, নির্নিমেষ চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিছু প্রহর। ক্ষীণ আওয়াজে আওড়ালো,
—“মাশাল্লাহ। আমার মায়ের পর আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী আপনি।”

হৈমন্তী লজ্জায়, অস্থিরতায় নতজানু হলো তৎক্ষণাৎ। গালজোড়া আজও রাঙা হয়ে উঠলো। ভাবলো, সাজহীন চেহারায় তাকে কি সত্যিই সুন্দর লাগছে? নাকি শুধু তুষারের দৃষ্টিতেই সে অপরুপ সুন্দরী?
মুখের কাছে গাঢ় নিশ্বাস টের পেতেই সম্বিৎ ফিরলো তার। তুষারকে নিজের অতি নিকটে আবিষ্কার করলো। সঙ্গে সঙ্গে বুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সে। তুষার নাক ফুলিয়ে ছোট ছোট চোখে তাকালো। অভিযোগ করে বললো,
—“ধাক্কা দিয়েছেন কেন?”
হৈমন্তীর কড়া কণ্ঠস্বর,
—“ফ্রেশ না হয়ে কি ফাজলামি শুরু করেছেন তুষার? আর টি-শার্ট পড়েছেন কেন? আপনি না গোসল করবেন? ধোঁয়া টি-শার্ট একদম নষ্ট করে দিলেন!”

_____

প্রকৃতিপ্রেমী হৈমন্তীর ভোরবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না। রোজ যখন তার কোলে মাথা রেখে তুষার কোরআন তেলওয়াত করে, গম্ভীর পুরুষালী গলায় সেই তেলওয়াত শুনতেই সে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। আলতো স্পর্শে চুলের ভাঁজে ভাঁজে হাত বুলিয়ে দেয়। এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দেয়। শীতল স্রোত বয়ে যায় মনের গহীন কোণে। প্রতিটি নিশ্বাস হয় প্রশান্তিময়।
হঠাৎ হৈমন্তীর পেটের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। গা গুলিয়ে আসলো। তেঁতো একটা ঝাঁঝ গলায় এসে খুব বাজেভাবে ঠেকলো। উপচে আসতে চাইলো যেন। কোনোমতে হৈমন্তী বললো,
—“একটু উঠে বসুন তুষার। আমার কেমন যেন লাগছে।”

তুষার সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো। আয়াত শেষ করে কোরআন সাবধানে রেখে দিলো বেডসাইড টেবিলে। কিছু বলবে তার পূর্বেই মুখে হাত চেপে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল হৈমন্তী।
তুষারের কপালের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে এলো। সেও হৈমন্তীর পিছু নিলো। ওয়াশরুমের নব ঘুরাতে গিয়ে দেখল, ভেতর থেকে লক। দরজায় কারাঘাত করলো তুষার। নরম সুরে একরাশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে ডাকলো,
—“হৈমন্তীকা? কি হয়েছে? দরজা খুলুন।”

ওপাশ থেকে কোনো সারাশব্দ পাওয়া গেল না। মিনিট পেরতেই শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো হৈমন্তী। নিমিষেই ফ্যাকাশে, নিস্তেজ হওয়া মুখখানা বুক ভারি করে তুললো তার। দু’বার করে গলায়, কপালে হাত ছোঁয়ালো। চাপা স্বরে বললো,
—“জ্বর তো নেই। বেশি খারাপ লাগছে?”
হৈমন্তী মিনমিনিয়ে উত্তর দিলো,
—“ঠিক আছি আমি।”

তুষার বিশ্বাস করলো না সেকথা। নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো হৈমন্তীকে। ললাটে অধর ছুঁইয়ে বললো,
—“আপনি ঠিক নেই হৈমন্তীকা। সত্যি করে বলুন। দূর্বল লাগছে বেশি?”
হৈমন্তীর চোখ বন্ধ। তুষারের বক্ষস্থলে লেপ্টে নেতিয়ে গেছে সে। ক্ষীণ আওয়াজে বলতে লাগলো,
—“আমার ইদানিং কিচ্ছু ভালো লাগে না। আপনার সাথে থাকতে ইচ্ছে করে। খেতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন ঘুমাতে ইচ্ছে করে। বমি পায়। খুব বমি পায়। তখন নিজেকে অসহায় লাগে। ভীষণ দূর্বল মনে হয়।”

আবারও কপালে চুমু খেল তুষার। চিন্তিত সুরে বললো,
—“কালই আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো হৈমন্তীকা। হামি দিচ্ছেন। ঘুম আসছে? আসুন, ঘুমাবেন।”

_____

পরেরদিনই হৈমন্তীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল তুষার। কিছু টেস্ট করানো হলো। রিপোর্ট কাল বিকালে দেবে।
হৈমন্তীর অসুস্থতার কথা শুনে হঠাৎই নরম হয়ে উঠলেন আফতাব সাহেব। নিজে ডেকে হৈমন্তীর অসুস্থতার খবর নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। গম্ভীর, অহংকারী মানুষটার হঠাৎ এহেন পরিবর্তনে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল হৈমন্তী। মনে হচ্ছিল, এক বাবা যেন নিজ মেয়ের সঙ্গেই কথা বলছেন। হেনা দূর থেকে তাদের দেখে মিটিমিটি হাসছিলেন। যাক! আল্লাহ্ তার স্বামীকে সঠিক বুঝ দিয়েছেন।

আকাশে বসবাসরত সূর্যের মন বোধহয় আজ প্রচন্ড খারাপ। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে সে। চারপাশটা ছাঁয়ায় ঢেকে গেছে। আবহাওয়া ক্ষীণ শীতল, ক্ষীণ উষ্ণ। সন্ধ্যা হতে হতেই উষ্ণ ভাবটা যেন মিইয়ে গেল আরও। কোথা থেকে যেন গ্রাম বাংলার ব্যাঙের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে কাকের দল বাসায় ফিরবার জন্য কা, কা ডাকে তোড়জোড় করছে। বাতাসের তীব্রতা খুব।

তুষার বাসায় ফিরলো অবিন্যস্ত ভাবে। এলোমেলো, অপরিপাটি অবস্থায়। হেনা চকিতে তাকালেন। তুষারের হাতের রিপোর্টের কাগজটা একবার দেখে বললেন,
—“রিপোর্টে কি এসেছে তুষার? হৈমন্তীর কি হয়েছে?”
তুষার কিছুক্ষণ কিছুই বলতে পারলো না। সোফায় বসলো অপ্রস্তুত ভাবে। হেনা কি ভেবে রহিমা খালাকে পানি আনতে বললেন। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন,
—“কথা বলছিস না কেন তুষার? রিপোর্টে কি এসেছে?”

তুষারের কানে যেন সেকথা ঢুকলো না। ঘোলা চোখে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে, অবিশ্বাস্য গলায় হেনাকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমি কি সত্যিই বাবা হচ্ছি মা?”

উপরিউক্ত কথাটির অর্থ বুঝতে একটু সময় লাগলো হেনার। পরমুহুর্তে অর্থ উদ্ধার হতেই খুশিতে উত্তেজিত হয়ে পরলেন তিনি। এগিয়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু খেয়ে প্রশ্ন করলেন,
—“আমি দাদি হচ্ছি?”
তুষার উত্তর দেয় না। হেনা তাড়াতাড়ি সোফা থেকে নিজের ফোন হাতে নেন। আফতাব সাহেবের নম্বর ডায়াল লিস্ট থেকে বের করতে করতে উৎফুল্ল মনে বলে উঠেন,
—“তোর বাবাকে সুখবরটা দিতে হবে। আসার সময় মিষ্টি আনতে বলবো।”

তুষার এবারও নিশ্চুপ। ভেতরকার অনুভূতি ঠিক অনুধাবন করতে পারছে না সে। ভয়ংকর কিছু অনুভব করতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। আগের মতোই বসে আছে ঘোলা দৃষ্টি নিয়ে।

_____

রুমে এসেই হৈমন্তীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তুষার। প্রায় পাঁচ-দশ মিনিট নড়চড়হীন ওভাবেই স্থির ছিল তারা। প্রবল কঠিন বাঁধনে হৈমন্তীর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। নিজেকে ছাড়াবার ক্ষীণ প্রয়াস করে সে বললো,
—“ব্যথা পাচ্ছি তুষার। ছাড়ুন।”

কোনোরূপ অভিব্যক্তি পাল্টালো না তার। হৈমন্তী আবার বললো,
—“তুষার, কি হয়েছে? ছাড়ুন।”

তুষার শুনলো না তবুও। ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে অসংখ্যবার অধর ছোয়ালো। কেঁপে উঠলো হৈমন্তী। একটু পর তুষার সরে আসতেই সে কিছু বলবে, তার আগেই আবারও তাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো তুষার। দ্রুততার সঙ্গে কোলে মাথা রেখে উদরে মুখ গুঁজলো। খানিক্ষণ ওভাবেই চোখ বুজে রাখলো। নেত্রে ভর করলো তন্দ্রার ঘোর। ঘুমিয়ে পরতে পরতে তুষার অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
—“আমি বাবা হচ্ছি হৈমন্তীকা। আপনি মা হচ্ছেন।”

ঘনঘন নিশ্বাস বারি খাচ্ছে পেটে। তুষার ঘুমিয়ে গেছে। আস্তে করে কোল থেকে তুষারের ভারি মাথাটা বালিশে রাখলো হৈমন্তী। দেয়াল ঘড়িতে ৮টা বাজছে। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কি সত্যিই মা হচ্ছে? তার গর্ভে কি সত্যিই তাদের অংশ বেড়ে উঠছে? আচ্ছা, তুষার কি মজা করছে তার সঙ্গে? দ্বিধান্বিত হয়ে আবারও লম্বা শ্বাস-প্রশ্বাসের আনাগোনা শুরু হলো। একহাত পেটের ওপর রাখলো হৈমন্তী। চুপ করে অনুভব করতে লাগলো মুহুর্তটা।

সরব ফোনের রিংটোন-এ চমকে উঠলো সে। তুষারের ফোনের রিংটোন এটা। কিন্তু ওর ফোনটা কোথায়? এদিক ওদিক তল্লাশি জারি করে তুষারের প্যান্টের পকেট থেকে উদ্ধার হলো ফোনটা। স্ক্রীনে বড় হাতের ইংরেজি অক্ষরে ‘শ্বশুড় বাবা’ লিখা। হৈমন্তী ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকালো। শ্বশুড় বাবা কে? তার বাবা? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? আসরাফ সাহেব তুষারকে কেন ফোন দেবেন? ভাবনার অকুল পাথারেই কল কেটে গেল। দু’সেকেন্ড বাদ আবারো বেজে উঠলো ফোনটা। হৈমন্তী এবার আর কালবিলম্ব করলো না। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে চুপচাপ রইলো।
ওপাশ থেকে আসরাফ সাহেব থমথমে গলায় প্রথমেই বললেন,
—“হ্যালো তুষার। আমার মেয়ের রিপোর্ট কি নিয়ে এসেছ তুমি? কি এসেছে? গুরুত্বর কিছু কি হয়েছে ওর? হ্যালো?”

বাবার কণ্ঠ শুনে হৈমন্তী বিহ্বল, বিমূঢ়। গলা কাঁপছে। চোখে জলেরা এসে ভীর জমাচ্ছে জোড়সোড় ভাবে। কান্না আটকাতে চাইলো হৈমন্তী। বললো,
—“বাবা.. আমি হৈমন্তী।”

ওপাশ হতে চুপ হয়ে গেলেন আসরাফ সাহেব। কিছুক্ষণ পর সিক্ত কণ্ঠে বললেন,
—“কেমন আছিস মা? এই অধম বাপকে কি একটাবারও মনে পরে নি তোর? একবার ফোন দিস নি কেন?”
আসরাফ সাহেব দেখবেন না, তা জেনেও অপর পাশ থেকে জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়ালো হৈমন্তী। সশব্দে কেঁদে উঠলো। বার বার বলতে লাগলো,
—“আমি তোমার কাছে যাবো বাবা। আমাকে নিয়ে যাও।”

কান্নার শব্দে জেগে উঠলো তুষার। ডান হাতে চোখ কচলে হৈমন্তীর দিকে তাকালো। হৈমন্তীকে কাঁদতে দেখে তড়িং গতিতে উঠে বসলো সে। কোমল স্বরে প্রশ্ন করলো,
—“কাঁদছেন কেন হৈমন্তীকা? পেটে ব্যথা হচ্ছে? খারাপ লাগছে?”
প্রতিউত্তরে “বাবা” “বাবা” বলে অস্ফুট ডাক আওড়াতে লাগল হৈমন্তী। তুষার তার থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো। স্ক্রীনে একবার তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
—“আমি আপনাকে পরে ফোন করছি আব্বু। ও কাঁদছে তো।”

কল কেটে ফোন সাইডে রাখলো তুষার। হৈমন্তী তখনো কাঁদছে। এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে চেপে ধরলো সে। মোলায়েম স্বরে বললো,
—“হুশ! কান্না থামান হৈমন্তীকা। আপনার কষ্ট দেখে আমার বাবু আর বাবুর আব্বুও কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে।”

হৈমন্তী ফুঁফানোর শব্দ অল্প কমালো। বুকের সঙ্গে মিশে গিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে অভিমান নিয়ে বললো,
—“আপনি খুব পাষাণ তুষার মানব। খুব নিষ্ঠুর। বাবার সঙ্গে আপনার কথা হয়, আমাকে জানান নি কেন?”
—“এমনি এমনি জানাবো নাকি? পুরো একমাস খাটতে হয়েছে আমাকে। তারপর যেয়ে আপনার হিটলার বাবা মেনেছেন। তাই সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
হৈমন্তী বুকে আলতো চড় দিয়ে বললো,
—“আমার বাবা মোটেও হিটলার না।”

জবাবে হাসতে লাগলো তুষার। পরক্ষণেই কি ভেবে হৈমন্তীকে নিজ বুক হতে সরিয়ে সোজা হয়ে বসালো। আলমারির দিকে এগিয়ে গেল ব্যস্ত পায়ে। হৈমন্তী দু’হাতে চোখের পানি মুছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিতে দেখছে তুষারের কান্ড। তুষার আসলে চাইছেটা কি?
সেদিনে সিঁদুর রঙা শাড়িটি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো তুষার। ব্যস্ত অথচ স্বাভাবিক স্বরে বললো,
—“শাড়িটা পরে নিন হৈমন্তীকা। উঠুন।”
হৈমন্তী অবাক হলো,
—“এখন এ শাড়ি– কেন?”
তুষার তখন স্নিগ্ধ চোখে তাকালো,
—“আপনাকে লাল শাড়ি পরিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার কথা দিয়েছিলাম হৈমন্তীকা। মাঝরাতে হাতে হাত রেখে রাস্তায় হাঁটার কথা দিয়েছিলাম। অধরে অধর ছোঁয়ানোর কথা দিয়েছিলাম। তবে বিয়ের রাতে তা সম্ভব হয় নি হৈমন্তীকা। আজকে, এই মুহুর্তে আমি আমার কথা রাখতে চাইছি। উঠুন। শাড়িটা পড়ে আসুন।”

_____

নির্জন, নিস্তব্ধ রাত। কোথাও কেউ নেই। কাকপক্ষীরাও অদৃশ্য। মাঝে মাঝে বাতাসে ঝোপঝাড় নড়ে উঠছে। পাতা ঝড়ে পরছে ডাল হতে। একধরণের শিরশির আওয়াজ কানে এসে বাজছে।
হৈমন্তীর ভয় লাগছে বড্ড। তুষারের হাত খামচে ধরেছে প্রবল শক্তিতে। তুষার তাকালো। নরম গলায় প্রশ্ন করলো, “ভয় লাগছে হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, লাগছে।
—“তবে চলুন। ফিরে যাই।”
—“উহু! আমার ভালোও লাগছে।”

মিনমিনিয়ে বলা কথাটা শুনে হেসে দিলো তুষার। হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পরল হৈমন্তীর পেটের কাছে। হৈমন্তী হকচকালো। ভড়কে যাওয়া নয়নে পিটপিট করে দেখতে লাগল তুষারকে।
তুষার শাড়ির আঁচল সরিয়ে উদরে চুমু খেল। অধরের স্পর্শ স্থির রাখলো দীর্ঘক্ষণ। তারপর পেটের ঠিক মধ্যিখানে কপাল ঠেকিয়ে কাঁপা স্বরে বললো,
—“আমার পৃথিবীকে সুন্দরের চেয়েও সুন্দর বানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ হৈমন্তীকা।”

_____________

সমাপ্ত~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

[আমার প্রায় সব গল্পেই শেষ পর্বে এসে আমি তাড়াহুড়ো করি। এটাতেও আংশিক তাড়াহুড়ো ছিল। কিছু টুইস্ট আসবে বলেও আমি বড় হবে দেখে গল্পে আনিনি। শেষ পর্বটা সময় নিয়ে মনের মতো করতে চেয়েছি। তবুও হয়তো ক্রুটি রয়েই গেছে।
আমার পাঠকমহলকে আমার প্রচন্ড মনে পরবে। তাদের জন্য আমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here