হৈমন্তিকা পর্ব – ২১

0
369

হৈমন্তীকা

২১.
ঘড়িতে দশটা বেজে এক মিনিট।
রাবেয়া নয়টায় দিকে বাহিরে গিয়েছিলেন। একটু পরেই হয়তো চলে আসবেন। এদিকে তুষারের যাওয়ার নাম নেই। সে নিশ্চিন্তে সোফায় আরাম করে বসে আছে। রিমোটের বাটনে কড়া আঘাত দিয়ে টেলিভিশনের একের পর এক চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছে। তার এহেন নির্লিপ্ততায় ভীষণ বিরক্ত হৈমন্তী। হেমন্তর দিকে তাকিয়ে দেখল, সে তখনো নাস্তার টেবিলে বসে মিটিমিটি হাসছে। সেদিকে একবার কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে তুষারের কাছে এগিয়ে এলো হৈমন্তী। বিরক্ত সুরে বললো,
— “সমস্যা কি আপনার তুষার? এখান থেকে যাচ্ছেন না কেন?”

টিভি থেকে নজর সরিয়ে হৈমন্তীর মুখপানে আঁখিজোড়া স্থির করলো তুষার। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “বাসায় মেহমান আসলে তাদেরকে কি এভাবেই তাড়িয়ে দেন হৈমন্তীকা? আমি আপনার মেহমান। যান, আমার জন্য ঝটপট নাস্তা নিয়ে আসুন।”
হৈমন্তী শুনলো না। বরং অস্থির কণ্ঠে আবার বললো,
— “আপনি বুঝতে পারছেন না তুষার! মা এক্ষুণি চলে আসবেন।”
— “কিন্তু আমার এখন এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না হৈমন্তীকা।”

তার একরোখা উত্তর। হৈমন্তীর এবার প্রচন্ড রাগ হলো। রেগে কিছু বলবে, তার আগে আগেই দরজার বাহির থেকে রাবেয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো কর্ণকুহুরে। সম্ভবত কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। এবং এরপরই টুংটাং শব্দে বেজে উঠলো কলিংবেল। পরপর দু’বার। হৈমন্তী ভড়কে গেল। রাবেয়া এসে পরেছেন। এখন কি হবে? তুষারকে তো রাবেয়া চেনেন। আসরাফ সাহেবকে যদি বলে দেন এটাই তুষার, তখন? হৈমন্তীর চিন্তা বাড়লো। অজানা আশঙ্কায় হাত-পা তীব্র ভাবে কাঁপতে লাগলো। অথচ তুষার আগের ন্যায়ই শান্ত, নির্লিপ্ত, নির্বিকার!

তৃতীয়বারের মতো কলিংবেল বাজতেই হেমন্ত জিজ্ঞেস করলো,
— “আপু? দরজা কি খুলবো?”
তুষার উত্তর দিলো,
— “খুলো।”
হৈমন্তী ‘না’ বলতে চেয়েছিল। তুষারের উত্তর শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো। উঁচু গলায় বললো,
— “পাগল নাকি? বাহিরে মা দাঁড়িয়ে আছে। আপনাকে দেখে ফেললে কি হবে ভাবতে পারছেন?”

জবাবে তুষার মুচকি হাসলো শুধু। বিন্দু মাত্র পরোয়া করলো না হৈমন্তীকে। হেমন্তর পানে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “তোমার আপুর রুম কোনটা হেমন্ত?”
— “ডানদিকের টা।”
— “আচ্ছা। তুমি দরজা খুলো যাও।”

বাধ্য ছেলের মতো দরজা খুলতে চলে গেল হেমন্ত। তুষার হৈমন্তীর রুমের দিকে পা বাড়ালো। হৈমন্তীও পিছু নিলো তার। তুষার কি করছে, না করছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না হৈমন্তীর। মস্তিষ্কে তীব্র ভাবে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সে ধৈর্য হারা হয়ে উঠল। ধৈর্যহীন কণ্ঠে বললো,
— “আপনি ঠিক কি করতে চাচ্ছেন তুষার? আমার রুমে যাচ্ছেন কেন?”

তুষার এবারও জবাবহীন। রুমে প্রবেশ করেই সোজা বারান্দায় চলে গেল সে। বারান্দার আশপাশটা দেখতে দেখতে বললো, “এ বারান্দাটা মোটেও পছন্দ হয় নি আমার হৈমন্তীকা। কেমন বন,জঙ্গলে ভরপুর! শ্বশুর বাবাকে বলুন বাসা পাল্টাতে। নয়তো বিয়ের পর আপনি যখন রাগ করে বাবার বাড়ি চলে আসবেন, তখন বারান্দা বেয়ে উপরে উঠতে বেশ কষ্ট হবে আমার।”

বলতে বলতে বামদিকের রেলিংয়ে ওপর পা ঝুলিয়ে বসে পরল তুষার। হৈমন্তী এতক্ষণ চুপচাপ তুষারের কান্ড দেখলেও এবার ভয় পেয়ে গেল ভীষণ। আতঙ্কিত গলায় মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো, “রেলিং থেকে নামুন তুষার! পরে যাবেন!”

তুষার দূর্বোধ্য হাসলো। নামলো না। সিক্ত গলায় অনুরোধ করল, “মিথ্যে হলেও একবার আমাকে ভালোবাসি বলবেন হৈমন্তীকা?”

নিঃসংকোচ, সুপ্ত আবেদন। হৈমন্তীর বক্ষস্থল কেমন কেঁপে, কেঁপে উঠলো। তোলপাড়ের খানিক আভাস পেল সর্বাঙ্গে। কাঁপতে লাগলো গলা। অচল কণ্ঠস্বরে ধমক দিতে চাইলো,
— “আপনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। নামুন রেলিং থেকে!”
— “আগে বলুন ভালোবাসি।”

ভেতরে ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো হৈমন্তী। শপথ করলো, সে ভালোবাসি বলবে না। অথচ না বলেও উপায় নেই। ড্রইংরুম থেকে রাবেয়ার হাঁক শোনা যাচ্ছে। আসরাফ সাহেবের গলাও শুনতে পাচ্ছে সে। হৈমন্তী নিজের শপথ রক্ষা করতে পারলো না। চোখ, মুখ খিঁচে বলে ফেললো, “ভালোবাসি… তুষার।”

মুহুর্তেই প্রকৃতি যেন অস্বাভাবিক ভাবে নীরব হয়ে গেল। কৃত্রিম কোলাহলগুলো কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উচ্চারণ করেই ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলো হৈমন্তী। বক্ষস্থল প্রবল ভাবে ওঠা-নামা করছে তার। হঠাৎ ধপ করে এক আওয়াজে ধীর,স্থীর ভাবে চোখ মেলে তাকালো সে। তুষারকে রেলিংয়েল ওপর না দেখতে পেয়ে আত্মা যেন শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল। ভীতু মনে দ্রুত রেলিংয়ের দিকটায় ছুটে গেল সে। দৃষ্টি ফেলল নিচে। তাকে ভয়াবহ ভয় পাইয়ে তুষার দিব্যি পাইপ বেয়ে দু’তলা থেকে নিচে নেমে গেছে। নেমে আর উপরে তাকায় নি। চশমা খুলে তা পকেটে রাখতে রাখতে চলে গেছে সেখান থেকে। হৈমন্তী তবুও তাকিয়ে রইলো তুষারের এক্ষুণি ধুলিসাৎ হওয়া স্থানটির দিকে। দৈবাৎ মায়ের উঁচু গলার ডাকাডাকিতে সম্বিৎ ফিরলো তার। দ্রুত ড্রইংরুমে পদচারণ করতেই আসরাফ সাহেবের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো তাকে।

— “তোর বন্ধু কই হৈমন্তী? দেখছি না যে!”
— “চলে গেছে বাবা।”

রাবেয়া তখন ডাইনিং টেবিলে বসে ঠান্ডা পানি পান করছিলেন। বন্ধু কথাটা শুনে অনুসন্ধানী গলায় বললেন,
— “কোন বন্ধু এসেছে রে? ছেলে নাকি মেয়ে? নাম কি?”
হৈমন্তী জবাব দিলো, “ছেলে। তৈমুর নাম।”
রাবেয়ার কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো,
— “তৈমুর? কোন তৈমুর? আফতাব ভাইয়ের ছেলে তুষার তৈমুর?”
তুষারের নাম শুনতেই তেঁতে উঠলেন আসরাফ সাহেব। প্রলয়ংকরী ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “এখানে ওই ছেলের নাম আসছে কোত্থেকে? তৈমুর কি অন্য কারো নাম হতে পারে না? কথায় কথায় ওই ছেলের নাম নিতে হবে কেন তোমার? আর ভাই কিসের হ্যাঁ? আফতাব সাহেব কোন জনমের ভাই লাগে তোমার?”

রাবেয়ার মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। চোখ জ্বলে চিকচিক করতে লাগলো। ছেলে মেয়ের সামনে এভাবে না বললে হতো না? তিনি নতজানু হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। হেমন্ত আর হৈমন্তীও নীরবে প্রস্থান করলো ড্রইংরুম।

_____

আজ অনেকদিন পর ভার্সিটি এসেছে হৈমন্তী। চিরচেনা কৃষ্ণচূড়া গাছটির ছায়াতলে বসে আছে। বই পড়ার পাশাপাশি বারবার আড়চোখে ভার্সিটির মূখ্য গেটের দিকে তাকাচ্ছে সে। পাশেই বসে বসে বাদাম চিবুচ্ছিল পারু। হৈমন্তীকে বারবার গেটের দিকে তাকাতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “কিরে! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিস কেন বারবার? কাউকে খুঁজচ্ছিস?”

হৈমন্তী চমকে উঠলো যেন। থতমত গলায় বললো,
— “কা–কাউকে না। কাউকে খুঁজছিলাম না।”
পারু তার দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করলো,
— “মিথ্যা বলছিস? আমি জানি তুই কাকে খুঁজছিস।”
— “উলটাপালটা কথা বলিস না। আমি কাউকে খুঁজছি না।”

হৈমন্তীর কথা বিশ্বাস করলো না পারু। ডিটেকটিভের সত্ত্বা নিজের মাঝে বহন করে বললো,
— “আমার মনে হয়, তুই তুষারকে খুঁজছিস। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, ও আজকে ভার্সিটি আসে নি।”
হৈমন্তী আনমনেই জিজ্ঞেস করে ফেললো,
— “কেন আসেনি?”

এবং প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই বিশাল বড় বিপদে পরে গেল সে। পারু নামক ভয়ংকর জীবটি হামলে পরে বললো,
— “দেখেছিস? আমি বলেছিলাম না, তুই তুষারকেই খুঁজছি? তুষারকে তুই ভালোও বাসিস। কিন্তু স্বীকার করতে চাচ্ছিস না।”

হৈমন্তী উত্তর দিলো না। আগ্রহীন দেখালো তাকে। পারু নিজ থেকেই আবার বলতে লাগলো,
— “দেখ হৈমন্তী, তোর হাবভাব বলে দেয় তুই তুষারকে ভালোবাসিস। তাছাড়া একদিন না একদিন আঙ্কেলও মেনে নেবেন তোদের সম্পর্ক। তাহলে কেন ছেলেটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিস? তুষার সত্যিই ভালোবাসে তোকে হৈমন্তী।”
ওপাশ থেকে হৈমন্তী অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে উঠলো, “বাবা মানবে না পারু। কক্ষনো মানবে না।”

____________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here