যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ১৩

0
549

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ১৩
.
দীঘির মা ফোন দিয়েছিলো একটু আগে। ঘুড়তে এসেছে বিধায় অল্প একটু কথা বলেই ফোনটা রেখে দেয় দীঘি। তাছাড়া মনটাও যে ভালো নেই তার। উদাসীন হয়ে আমাদের সবার দিকে এক এক করে তাকিয়ে রইলো সে। চাকমা আংকেলের মেহেরুনের সমান দু’জন মেয়ে আছে। একটু আগে তারাও এসে যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে। ইয়াসিন ভাইয়া তো তাদের পেয়ে খুশিতে গদগদ। কিভাবে তাদের নিজের প্রতি ইম্প্রেস করা যায় তাই-ই এপ্লাই করছেন উনি। যা দেখে আমরা সবাই হেসে কুটিকুটি। দীঘি আমাদের এই আনন্দই চুপচাপ দেখছে। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চমকে গিয়ে পাশে তাকায় দীঘি। আবদ্ধ দাঁড়িয়ে। বেশ গম্ভীর কণ্ঠে দীঘিকে বলল,

—” সরি। ”

দীঘি যেন হাতে চাঁদ পেল। মুখ ভরে হাসলো সে। খুশিতে খিলখিল করে হেসে বলে উঠল,

—” আমি তো রাগ করি নি। তবে আশাও করিনি আপনি আসবেন। ভেবেছিলাম আমি নিজেই যাবো আপনার কাছে। আপনাকে বিরক্ত করতে।”

আবদ্ধ বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,

—” বড় বাঁচা বাঁচলাম। ”

দীঘি আবারও খিলখিল করে হাসলো। আবদ্ধের বাহু দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতেই আবদ্ধ মৃদু চেঁচিয়ে উঠল,

—” সবার সামনে এসবের মানে কি দীঘি? বাইরে আমরা। লাজ-লজ্জা ভুলে গেছো?”

দীঘি তৎক্ষণাৎ বাহু ছেড়ে দিলো। করুণ স্বরে বলল,

—” সরি! ”

পরপরই আবারও বলল,

—” আমি রাতে রুমে আপনার কোলে বসে থাকবো। তখন কিন্তু বকতে পারবেন না।”

আবদ্ধ আড়চোখে দীঘির দিকে তাকালো মাত্র। এ মেয়েকে যে কিছু বললেও দোষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আবদ্ধ।

____________________

কমির আর মুন্নি বাসায় পৌঁছে ফোন করতেই যার যা লাগবে তার একটা তালিকে দিয়ে দিলাম সবাই। সন্ধ্যার পরপরই তারা এসে পৌঁছাবে এখানে। আপাতত এখন ইয়াসিন ভাইয়ার কান্ড দেখতে ব্যস্ত আমরা। বিকালের ঝলমলে রোদ আমার মুখে এসে পড়ছে। শীতকাল হওয়ায় বেশ আরাম লাগছে। তবে আমার এই আরাম হয়তো কারো ভালো লাগে নি। আংকেল আমাদের সবাইকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে বলেছেন। কেননা আর এক-দুই ঘন্টা পরই সন্ধ্যা নেমে পরবে। অগত্যা সবাই চলে এলাম বাড়ির ভেতরে। বাড়িটার বাহিরটা যেমন প্রাচীন ভেতরটা তার থেকে একটু আধুনিক। তবে কিছু কিছু জিনিস প্রাচীনকালের কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের। যেমন বৈদ্যুতিক পাখার পাশাপাশি বেতের তৈরি সোফার সঙ্গে লাগানো রাজাদের আমলের বড় বড় হাত পাখাও আছে। একটা লম্বা দড়ির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেগুলো। দড়িটা টানলেই হাত পাখাগুলো জোড়ে জোড়ে দুইদিকে ঘুরতে শুরু করে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাচীন জিনিসও আছে সাজানো। সম্ভবত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রাচীনে ব্যবহৃত জিনিস। সেগুলোই এক এক করে দেখছি আমি। বলা যায় একটা ছোটখাটো জাদুঘর এটা। দেখা শেষে একটু পাশে তাকাতেই রেয়ানকে দেখতে পেলাম। উনি কানে হেডফোন গুঁজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। মুহুর্তেই মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধী এলো আমার। সর্বদা উনি আমার পেছনে এসে আমাকে ভয় দেখান। আজকে আমি দেখাবো। ভেবেই আশেপাশে তাকালাম। সবাই অনেকটা দূরে থাকা বেতের সোফায় বসে বসে গল্প করছে। ইয়াসিন ভাইয়ারাও সেখানে আছে। এদিকটায় কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না অত। তাই সুযোগ বুঝে পা টিপে টিপে চলে গেলাম রেয়ানের কাছে। উনি একমনে চোখ বন্ধ করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে আছেন। আস্তে আস্তে ওনার পেছনে দাঁড়িয়ে উনার কান থেকে হেডফোন এক টানে খুলে মৃদু চেঁচিয়ে বললাম,

—” ভৌঁ! ”

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো উনি বিন্দু মাত্র চমকে উঠলেন না, বা ভয়ও পান নি। বুঝতে পারছি না সবাই যেন না শুনে এজন্য কি বেশিই আস্তে চেঁচিয়েছি আমি? কিন্তু আমার তো মনে হয় না। একটু হলেও তো চমকানোর কথা! উনি কেন চমকান নি? ভাবতেই ভ্রুটা কুঞ্চিত হলো আমার। উনি ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকালেন। আমার দিকে একবার ডান ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে হাতে থাকা ফোন স্ক্রল করতে করতে বললেন,

— “ওয়াট? অটিস্টিকের মতো করছো কেন?”

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—” আমি অটিস্টিক? ”
উনার নির্লিপ্ত কণ্ঠ,
—” অবশ্যই! ”

বলেই আবারও মনোযোগী হলেন ফোনে। আমি সেভাবেই দাঁড়িয়ে। উহু! কোনো কিছু করেও উনাকে বিরক্ত করতে বা রাগাতে পারছি না আমি। সোজা উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম এবার। উনি একবার তাকালেন আমার দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

— “মতলব কি মিস? বলে ফেলো।”

আমি দাঁত বের করে হাসলাম। বললাম,

— “আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইছি রেয়ান ভাই। কিন্তু আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না। তাই আমি চাই আপনি বিরক্ত হন।”

উনি আনমনেই বললেন,

— ” আচ্ছা। ”

আমার এমন জরুরি কথায়ও উনার এত অমনোযোগী ভাব মোটেও ভালো লাগলো না আমার। উনার দিকে এক কদম এগিয়ে বললাম,
— ” এই যে শুনুন না! ”
উনি ঢং করে বললেন,
— ” শুনছি, বলুন না! ”

তার ঢংয়ে পাত্তা দিলাম না আমি। উত্তেজিত হয়ে বললাম,

—” জানেন আপনার শার্টে তিন তিনটা তেলাপোকা হাঁটছে। নিজের চোখে দেখেছি আমি। এখনও আছে। পিঠে হাত দিয়ে দেখুন!”

উনি হয়তো বিশ্বাস করলেন কথাটা। ভাবলাম এবার বুঝি আমার প্লেন সাকসেসফুল হবে। কিন্তু না! উনি উনার পিঠে হাত রাখতে গিয়েও রাখলেন না। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললেন,

—” তোমার কি আমাকে বোকা মনে হয় মিস? আমি শার্ট না, জ্যাকেট প্লাস গেঞ্জি পড়েছি। তুমি শার্ট কোথায় দেখলে?”

নিজের বোকামিতে নিজেরই রাগ হলো। কোনোমতে হেসে বললাম,
—” ঐ একই। জ্যাকেটেই হাঁটছে তেলাপোকা। আপনি হাত দিয়ে দেখুন না।”
—” নো নিড! থাকলে থাকুক। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি হাত দিয়ে দেখো, ফেলে দাও। আমার ইচ্ছে করছে না।”

আমার এই এক সমস্যা। কোনো কাজ আদৌ জীবনে ঠিক করেছি কিনা সন্দেহ। এ কাজের বেলায়ও ফলাফল শূণ্য। দুঃখ মনে উনার দিকে আড়চোখে একবার তাকালাম। উনি তো ফোনে ব্যস্ত! চোখ ফিরিয়ে ইয়াসিন ভাইয়াদের কাছে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,

— ” খারুস! ”

ইয়াসিন ভাইয়াদের কাছে যেতেই দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। কারণটা কি? ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে তাকাতেই ইয়াসিন ভাইয়া ফিসফিসিয়ে খোঁচা মারা কণ্ঠে বললেন,

—” তলে তলে এগুলো চলে তাই না? ”

আমি অবাক হয়ে বললাম,

—” কি চলে? ঠিক করে বল! ”

ইয়াসিন ভাইয়া বেশ এটেটিউট নিয়ে বললেন,

—” দেখলাম রেয়ান ভাইয়ের সাথে কি খুচুরখুচুর করছিলি। সকালেও দেখেছি। পছন্দ-টছন্দ করিস নাকি? করলে ট্রিট দিতে হবে এই বড় ভাইকে। নাহলে সবার কাছে ফাস করে দেবো এটা।”

আমি প্রথমে ছোট ছোট করে তাকালাম তার দিকে। পরক্ষণেই মাথায় হাত দিয়ে আস্তে একটা বারি দিতেই ইয়াসিন ভাইয়া ‘ও মাগো!’ বলে শব্দ করে উঠলেন। যেন উনাকে ছুড়ি দিয়ে কেটে কুঁচিকুঁচি করছি আমি। এদিকে মেহেরুন বলে উঠল,

—” মীরু? ইয়াসিন সত্যি বলছে নাকি? তুই রেয়ান ভাইয়াকে পছন্দ করিস? উনি তোর সাথে কথাও বলে? বইন আমার সাথে উনার একটু কথা বলিয়ে দেয় না প্লীজ!”

ওপাশ থেকে সবুজ ভাইয়া গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

—” ক্রাশ-ফ্রাশ বাদ দাও মেহেরুন। তুমি এখন বুকড্!”

কথাটা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল মেহেরুনের। আমি আর ইয়াসিন ভাইয়া হেসে উঠলাম মৃদু শব্দ করে।

__________________

রাত ৮টার মাঝেই করিম আর মুন্নি এসে যায়। আমরাও ফ্রেশ হয়ে নি এ ফাঁকে। পরে সবাই মিলে প্লেন করি ছাদে আড্ডা দেবো। যেই ভাবা সেই কাজ! হালকা-পাতলা নাস্তা করেই সবাই চলে এলাম ছাদে। আবদ্ধ আর রেয়ানকেও চাকমা আংকেলের দুই মেয়ে জোড় করে নিয়ে এসেছে ছাদে। শীত কাল! তাও আবার আমরা রাঙামাটির মতো অঞ্চলে। রাতে ছাদে আসায় ঠান্ডাটা যেন একটু বেশিই লাগছে আমাদের। তবুও ভালো লাগছে আমার। গল্পের এক ফাঁকে মেহেরুন বলল সবুজ ভাইয়া নাকি দারুণ গান গায়। এটা শুনেই আংকেলের বড় মেয়ে সবুজ ভাইয়ার কাছে বায়না ধরলো তাকে গান গেতে হবে। সবুজ ভাইয়ারও এক কথা,

—” যতই প্রেম করি না কেন English গান আর Sad song ছাড়া আর কোনো গান গেতে পারবো না আমি। তাছাড়া একটা গিটারও প্রয়োজন। যা এ মুহুর্তে নেই। সো আমি গান গাইছি না।”

মোট কথা উনি গান গেতে চান না। তাই এসব শর্ত দিয়ে রেখেছেন আমাদের। কিন্তু আংকেলের মেয়েগুলো নাছোড়বান্দা। ছোট মেয়ে হিমানী বলল তার কাছে নাকি গিটার আছে। এক দৌঁড়ে নিজের রুম থেকে গিটার নিয়ে এসেছে সে। সবুজ ভাইয়ার সব শর্তেও রাজী সে। অগত্যা সবুজ গাইয়াকে গান গেতে হলো। উনি গিটার হাতে নিয়ে টুংটাং শব্দ বাজাতে লাগলেন। এক দৃষ্টিতে মেহেরুনের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠলেন,

You and I
We’re like fireworks and symphonies exploding in the sky
With you, I’m alive
Like all the missing pieces of my heart
They finally collide

So stop time right here in the moonlight
’cause I don’t ever wanna close my eyes

Without you, I feel broke
Like I’m half of a whole
Without you, I’ve got no hand to hold
Without you, I feel torn
Like a sail in a storm
Without you, I’m just a sad song
I’m just a sad song
~We The Kings

গানের পুরোটা সময় আমি এক এক করে সবার দিকে তাকাচ্ছিলাম। আবদ্ধ মাথা নিচু করে ছিল আর দীঘি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ইয়াসিন ভাইয়া তো ভিডিও করতে ব্যস্ত। আর আমাদের রোমিও জুলিয়েট মানে সবুজ ভাইয়া আর মেহেরুন চোখে চোখ রেখে ছিল পুরোটা গান জুড়ে। অন্যদিকে পুরোটাক্ষণ শুধু চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করেছিলেন রেয়ান। আংকেলের মেয়েগুলো তার দিকে তাকিয়ে কেন যেন মুচকি মুচকি হাসছিল। যা মোটেও পছন্দ হয় নি আমার। মোটেও না!

___________________

চলবে…
(রি-চেক করিনি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here