#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৩৩
.
পাখির কিচিরমিচির শব্দ তীব্রভাবে কানে আঘাত করতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। আড়মোড়া ভেঙ্গে কিছুক্ষণ ‘থ’ মেরে বসে রইলাম আমি। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে চালু করতেই অনেকটা অবাক হলাম। প্রতিদিনের মতো আজকে অচেনা ব্যক্তির কোনো মেসেজ আসে নি ফোনে। বরং সিম কোম্পানির মেসেজে ভরে গেছে ফোনের স্ক্রীন। ‘অবাক’ শব্দটা কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে কোনোমতে ড্রইংরুমে গিয়ে সোফায় বসে পরলাম। আজকে ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। সুতরাং আলসেমি নিয়ে সব কাজ করছি আমি। আম্মু নাস্তার প্লেট আনতেই সেটা আস্তে আস্তে খেতে লাগলাম। এমন সময় ইয়াসিন ভাইয়া বের হলেন নিজ রুম থেকে। এক হাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমার পাশে বসলেন। পরপরই চেঁচিয়ে বললেন,
— “মামী, নাস্তা দাও তাড়াতাড়ি। ক্ষুধায় ইঁদুর সুন্দরীরা পেট ফাটিয়ে ফেলছে।”
আমি বিরক্তি নিয়ে তাকালাম ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। এ ব্যক্তি কখনো সুধরাবার না। ভাইয়ার থেকে চোখ সরিয়ে টিভি দেখায় মন দিলাম। আম্মু তার জন্য নাস্তা আনতেই সে গপগপ করে খেতে লাগলেন খাবার। খেতে খেতে হঠাৎ-ই বলে উঠলেন,
— “জানিস মীরু, জীবনে প্রথম গার্লফ্রেন্ডের সাথে রাত জেগে কথা বলেছি। উফ! কি সুন্দর অনুভূতি! আচ্ছা, তুইও কথা বলিস নাকি হ্যাঁ?”
অবাক হয়ে বললাম,
— “মানে? আমি কেন রাত জেগে কথা বলব কারো সাথে?
— “মিথ্যুক! মিথ্যা বলিস, বুঝি না আমি? নতুন নতুন বিয়ে ঠিক হয়েছে। এখন তো দিন-রাত ফোনে প্রেমালাপ করবি।”
বিরক্তি নিয়ে তাকালাম ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। উনার মুখে কি এগুলো ছাড়া অন্য কথা কোনো কথা নেই? তীব্র বিরক্তিতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
— “এসব ফালতু কথা ছাড়া তুই আর কথা পারিস না, ভাইয়া?”
ইয়াসিন ভাইয়া কিছু বলার জন্য উদ্যোগ হতেই রেগে আবারো বললাম,
— “আর একটা কথা বললে তোর নাস্তার প্লেট কিন্তু ফেলে দেবো ভাইয়া।”
ভাইয়া সেখানেই চুপ। চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে গপাগপ খেতে লাগলেন খাবার। কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,
— “ভাইয়া বলেও ভাইয়ার মর্যাদা দেয় না। ফাজিল! বড় ভাইকে বকিস! অভদ্র!”
তার কথায় কান দিলাম না আমি। নিজের মতো রইলাম। পাঁচ-দশ মিনিট পর ইয়াসিন ভাইয়ার ফোন বেজে উঠল। কল রিসিভ করে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইয়াসিন ভাইয়া বেশ উচ্চস্বরে বললেন,
— “কি করছো সুইটহার্ট?”
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন,
— “তাহলে আজকেও রাত জেগে কথা বলবো ঠিকাছে। এখন তুমি রেস্ট নাও। বাই, বাই সুইটহার্ট!”
আম্মু পানির গ্লাস নিয়ে এদিকেই আসছিল। ইয়াসিন ভাইয়ার ‘সুইটহার্ট’ কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— “ইয়াসিন? এগুলো কি ধরণের কথা? কাকে বলছিস এগুলো? দ্বারা আজকেই তোর মাকে বল..!”
কথাটা শেষ হবার আগেই ইয়াসিন ভাইয়া দ্রুত বলে উঠলেন,
— “মামী, তুমি যা শুনেছো সব ভুল। আমি তো আমার ছেলে ফ্রেন্ডকে শিখাচ্ছিলাম কিভাবে গার্লফ্রে.. মানে.. হ্যাঁ! ইংরেজী ওয়ার্ড শিখাচ্ছিলাম। বেচারা মুর্খ তো।”
আম্মু বিশ্বাস করলেন না কথাটা। সূক্ষ্ণদৃষ্টিতে ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে পানির গ্লাসটা রেখে চলে গেলেন। সাথে সাথে বুকে হাত রেখে বড় একটা নিশ্বাস ফেললেন ইয়াসিন ভাইয়া। বিড়বিড় করে উঠলেন,
— “বড় বাঁচা বাঁচলাম আল্লাহ্!”
ভাইয়ার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছি আমি। হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধী খেলে গেল মাথায়। ইয়াসিন ভাইয়াকে বললাম,
— “ভাইয়া? সত্যিটা আম্মুকে বলে দেই আমি? কি বলিস?”
ইয়াসিন ভাইয়া করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন এবার। তেঁতো কণ্ঠে বললেন,
— “কি ঘুঁষ নিবি?”
— “বেশি কিছু না। তোর ফোনটা আধা ঘন্টার জন্য আমায় দিয়ে দেয়।”
— “তোর ফোন নাই?”
— “আমি তোকে দিতে বলেছি।”
ইয়াসিন ভাইয়া জেদী কণ্ঠে বললেন,
— “দিবো না। কি করবি কর যা।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। রান্নাঘরে যাবো যাবো ভাব নিয়ে বললাম,
— “তাহলে আমি আম্মুকে বলে দিচ্ছি। ফুফিকে বললেও মন্দ হবে না।”
সাথে সাথে ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন ইয়াসিন ভাইয়া। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
— “আমার ফোনটার খেয়াল রাখিস মীরু। অনেক নরম সে। দেখিস ভাঙ্গে না যেন। আমার জান এটা। বাই, বাই আমার কলিজা।”
ইয়াসিন ভাইয়ার এসব নাটক দেখতে দেখতে অভ্যস্ত আমি। সুতরাং, সেদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে এলাম রুমে। কিন্তু পরে মনে হলো, আমি ফোনটা নিয়েছি কেন? পরক্ষণেই একটা ইচ্ছে জাগলো মনে। ইয়াসিন ভাইয়ার ফোন দিয়ে রেয়ানকে কল করলে কেমন হয়? তবে এমন করায় উনি কি না কি মনে করবেন! পরপরই ভাবলাম, আমি তো আর কথা বলছি না। উনার আওয়াজ শুনেই কল কেটে দেবো। এতে তো উনি বুঝতে পারবেন না আমি কল করেছিলাম। ভেবেই কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনের ডায়াল লিস্টে গেলাম। ‘আব্রাহাম ভাই’ সার্চ দিতেই পেয়ে গেলাম উনার নম্বর। কল দেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই কল রিসিভ করলেন উনি। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “হ্যাঁ, ইয়াসিন বল।’
আমি চুপ হয়ে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। কল কেটে দেবো এমন সময় উনি আবারো বললেন,
— ” ইয়াসিন? কথা বলছিস না কেন? সব ঠিক আছে তো ওখানে? মরুভূমি ঠিক আছে?”
এবারো চুপ আমি। হাত পা প্রচন্ড কাঁপছে। মস্তিষ্কে অনেক প্রশ্ন জমা হলেও প্রশ্ন করার ক্ষমতা নেই। কলও কাঁটছি না এবার। ওপাশে উনিও চুপ। প্রায় অনেক্ষণ নিরব থেকে হঠাৎ রেয়ান বললেন,
— “মরুভূমি? ইয়াসিনের ফোন তোমার কাছে কেন?”
চমকে উঠলাম। সাথে সাথে কল কেটে দিলাম আমি। ভয় লাগছে। অস্বস্তি লাগছে শুধু শুধুই। বুঝতে পারছি না, উনি বুঝলেন কিভাবে ফোনের ওপাশে আমি?
__________________
লম্বা একটা ঘুম শেষে ছাদে চলে আসি আমি। সাথে ইয়াসিন ভাইয়াও ছিলেন। আমরা দু’জন টুকটাক কথা বলছিলাম, এমন সময় পাশের ছাদে শুভ ভাইয়ার আগমন ঘটলো। আমরা কেউই খেয়াল করিনি তাকে। হঠাৎ শুভ ভাইয়ার কণ্ঠ শোনা গেল। উচ্চস্বরে উনি বলছেন,
— “মীরা সাহেবা, কেমন আছো?”
শুভ ভাইয়াকে দেখে মুচকি হাসলাম। নম্রভাবে বললাম,
— “আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
— “এই তো আছি এক রকম। তোমার পাশে উনি কে? কখনো তো দেখিনি এ এলাকায়।”
ইয়াসিন ভাইয়া নিজ থেকে হাত বাড়িয়ে দিলেন শুভ ভাইয়ার দিকে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
— “আমি মীরুর ভাই, ইয়াসিন। আপনি?”
পাশাপাশি ছাদ হওয়ায় একে অপর থেকে বেশি দূরত্বে নেই আমরা। সেহেতু শুভ ভাইয়াও হাসি মুখে ইয়াসিন ভাইয়ার হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন,
— “আমি শুভ। আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।”
ইয়াসিন ভাইয়া বললেন,
— “আমারও ভালো লাগলো।”
কথা বলার মাঝে হঠাৎ ইয়াসিন ভাইয়ার ফোন বেজে উঠল। অন্যপাশে গিয়ে ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে আবারো চলে এলেন আমাদের মাঝে। শুভ ভাইয়াকে দ্বিধান্বিত গলায় বললেন,
— “আমাদের এখন যেতে হবে ভাইয়া। প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড। আপনার সাথে দেখা হয়ে সত্যিই ভালো লেগেছে।”
শুভ ভাইয়া মুচকি হাসলেন শুধু। কিছু বললেন না। উনার মুখের গঠন দেখেও বোঝা যাচ্ছে না কিছু। একপলক শুভ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম আমরা। ফ্ল্যাটের কাছাকাছি আসতেই ভাইয়াকে প্রশ্নাতীত কণ্ঠে বললাম,
— “ভাইয়া? কিছু কি হয়েছে? ছাদ থেকে নিয়ে এলি কেন?”
ইয়াসিন ভাইয়ার নির্বিকার কণ্ঠ,
— “তোর হবু বর আসবে একটু পর। মেলায় যাবি তুই আর সে। তাই রেডি হতে বলেছে।”
অবাক চাহনীতে ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে তাকালেও কিছু বললাম না। বাসায় গিয়ে আম্মুও বললেন রেডি হয়ে নিতে। বাধ্য মেয়ের মতো আমিও রেডি হয়ে নিলাম।
_________________
গাড়িতে বসে আছি আমি আর রেয়ান। জালানা গলিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বাহিরের দিকে। অথচ মন আমার অন্যদিকে। ভয়, লজ্জা দু’টোই কাজ করছে আমার মাঝে। সকালের ঘটনার জন্য যদি রেয়ান কিছু বলেন? তখন কি জবাব দেবো আমি? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে এ বিষয়ে পুরো রাস্তা একটা কথাও বলেন নি রেয়ান। তবুও অস্বস্তি যেন বেড়েই চলছে আমার।
মেলার আসার পর কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করি আমরা। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের হাঁটার দূরত্বও কমে আসে আমাদের। পাশাপাশি হাঁটছিলাম দু’জন। বেশ কয়েকটা জিনিসও কেনা হয়েছে ইতোমধ্যে। শেষে চাচীজানের জন্য কিছু জিনিস দেখছিলাম আমি। হঠাৎ পাশ থেকে রেয়ান বলে উঠলেন,
— “সকালে ইয়াসিনের ফোন দিয়ে কল দিয়েছিলে কেন? মিস করছিলে বুঝি?”
হকচকিয়ে গেলাম। লজ্জার পেলাম অনেকটা। অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
— “আমি করিনি কোনো কল।”
রেয়ান বাঁকা হেসে বললেন,
— “তাই? কিন্তু ইয়াসিন যে বলল সকালে তুমি ওর ফোন নিয়েছিলে।”
বুঝতে বাকি রইল না, ধরা খেয়ে গেছি আমি। এখন শত মিথ্যা বললেও কাজ হবে না। সুতরাং, চুপ রইলাম। একটা ‘টু’ শব্দও করলাম না আর। তবে কিছুক্ষণ পর যখন আড়চোখে তার দিকে তাকালাম, তখন তাকে নিঃশব্দে হাসতে দেখেছি আমি। সামনের দিকে চেয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছেন উনি।
_________________
মেলায় ঘোরাফেরা শেষে রেয়ান আমাকে পৌঁছে দেন আমাদের বাসায়। গাড়ি থেকে নামতেই আমার সাথে সাথে উনিও নামলেন। সামনে আগাবো তখনই দেখা হয়ে যায় শুভ ভাইয়ার সাথে। শুভ ভাইয়া আমাকে দেখে বললেন,
— “আরে মীরা সাহেবা? এসময় কোথা থেকে এলে?”
মুচকি হেসে বললাম,
— “মেলায় গিয়েছিলাম একটু।”
শুভ ভাইয়া এবার রেয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— “উনি কে? তোমার ভাই?”
এ প্রশ্নের উত্তর কি দেবো আমি? শুধু মুচকি হাসলাম। আড়চোখে রেয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শুভ ভাইয়ার দিকে। হুট করে ভারী কণ্ঠে বলে উঠেন,
— “আমি মীরার ফিয়ন্সে। আপনি?”
কথাটা শুনে মুখ চুপসে গেলো শুভ ভাইয়ার। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালেন আমার দিকে। ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করলেন। রেয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “নাইস টু মিট ইউ।”
রেয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন শুধু। কিছু বললেন না।
এদিকে অবস্থা খারাপ হতে দেখে তাড়াতাড়ি বিদায় জানিয়ে আমি চলে এলাম ফ্ল্যাটে। আমার যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রেয়ানও চলে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে বরাবরের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন শুভ ভাইয়ার দিকে।
এ ঘটনার পর, ঠিক রাতেই হন্তদন্ত হয়ে ইয়াসিন ভাইয়া রুমে ঢুকলেন আমার। আমি তখন বিছানায় বসে উপন্যাসের বই পড়ছিলাম। আমার কাছে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে ভাইয়া বললেন,
— “মীরু? শুনেছিস কিছু? আব্রাহাম ভাই নাকি বলেছেন তিনি কালকেই তার আর তোর আকদ করাতে চান। সকালেই নাকি মামা-মামী হুজুর নিয়ে আসবেন।”
কথাটা শুনে মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে যেন। ইয়াসিন ভাইয়া কি বলছেন এগুলো? পাগল হয়ে গেছেন নাকি?
_________________
চলবে…
(গল্প কেমন হচ্ছে জানাবেন প্লীজ। বারবার মনে হচ্ছে গল্প খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে, খারাপ হচ্ছে। রি-চেক করিনি। ভুল-ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)