#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৩৪
.
‘ অপেক্ষারত হয়ে খুঁজি গো তোমায়,
সকাল – সন্ধ্যা পাওয়ার আশায়।
ও প্রিয়তম, শুনছো কি আমায়?
বড্ড ভালোবাসি যে তোমায়.. ‘
কড়া লিকারে তৈরি চা এক চুমুকে শেষ করে বারান্দা থেকে রুমে চলে এসেছি আমি। টেবিলে চায়ের কাপটা রাখতেই টেবিলের কোণে ঝুলতে থাকা মেরুন রঙের একটি প্যাকেটে নজর গেলো আমার। মেলা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসতেই রেয়ান প্যাকেটটি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমায়। এখনো খুলে দেখা হয়নি এটি। প্যাকটটা নিয়ে ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। আস্তে আস্তে প্যাকেটটির ভেতরের জিনিসটা বের করতেই দেখতে পেলাম একটা ধূসর রঙের শাড়ি। আলতোভাবে ছুঁয়ে দিলাম শাড়িটি। বেশ নরম তুলতুলে। সুন্দরও ভীষণ। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। রেয়ানের দেওয়া ঝুমকা এবং শাড়ি একসঙ্গে রেখে দিলাম আলমারিতে। কেউ নেই, অথচ গোপনে বেশ কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কাল আমার বিয়ে! দিনটা সম্পূর্ণ অভাবনীয় আমার জন্য। কখনো কি ভেবেছিলাম উনার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে? মোটেও না। তারওপর একদম প্রথমে যে রেয়ান ভাইকে দেখেছিলাম আমি, উনি এখনের সে নন। সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ। যে কিনা নিজের অনুভূতিগুলো বিশেষ ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। একজন মানুষকে নিজের কথা দ্বারা বিমোহিত করতে পারেন।
রাতটা শত ভাবনায়ই কেটে গেলো আমার। সকালের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল এমন সময় ইয়াসিন ভাইয়া এসে হাজির হলেন রুমে। এসেই নিজের কর্কশ কণ্ঠে জোড়ে জোড়ে ডেকে উঠলেন,
— “মীরু? ঘুম থেকে উঠ। দ্রুত!”
নড়েচড়ে উঠলাম আমি। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলেছি। ইয়াসিন ভাইয়া আবারো ডাকলেন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমি চোখ মেলে তাকাতেই ভাইয়া উত্তেজিত গলায় বললেন,
— “দ্রুত উঠ। বেলা ১০টা বাজতে চলল।”
বড় একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে বসলাম। আরেকটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। ঘুমু ঘুমু চোখে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম সকাল ৬টা বাজে। মুহুর্তেই রাগ এসে ভর করল আমার মাঝে। চোখ পাকিয়ে তাকালাম ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
— “এটা তোর সকাল ১০টা? ফাজলামি করছিস ভাইয়া?”
ইয়াসিন ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
— “একদম না। সারা রাত গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার পরও ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম আদরের বোনটাকে একটু জাগিয়ে দেই। ভালো করেছি না?”
জবাব দিলাম না। পাশ থেকে বালিশ নিয়ে একাধারে ছুঁড়ে মারলাম ভাইয়ার মুখে। বেয়াদপ লোক, তাও হাসছে। রুম থেকে চলে যেতে যেতে মুচকি হেসে বলে উঠলেন ইয়াসিন ভাইয়া,
— “যত রাগার রেগে নেয়। আমার কাজ তো শেষ। এখন ঘুমাতে না পারলেই হয়।”
রাগে গা জ্বলে উঠল যেন। উঠে দাঁড়িয়ে শব্দ করে বন্ধ করে দিলাম রুমের দরজা। তারপর চুপচাপ বসে রইলাম বিছানায়। এখন শত চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না আমার। সুতরাং, একটা উপন্যাসের বই নিয়ে পড়তে লাগলাম।
ঘন্টা কয়েক পর দরজায় কারো আঘাতের শব্দ পেয়ে দরজা খুললাম আমি। হাতে শাড়ি, গহনা নিয়ে আম্মু দাঁড়িয়ে আছেন। দরজা খুলতেই সেগুলো আমার হাতে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
— “দ্রুত তৈরি হয়ে নেয় মীরা। তোর মেজো চাচ্চুরা একটু পরই এসে যাবেন। দ্রুত!”
প্রতিউত্তরে কিছু বললাম না আমি। বাধ্য মেয়ের মতো শাড়ি, গহনাগুলো নিয়ে দরজা আটকে দিলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈরি হতে লাগলাম।
__________________
অবশেষে আকদটা হয়েই গেলো আমাদের। সবার মুখেই লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। চারদিকে হৈ-হুল্লোড়, অথচ আমি অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি সোফায়। একধরণের দ্বিধা কাজ করছে আমার মাঝে। আমার প্রতি কি রেয়ানের আদৌ কোনো অনুভূতি কাজ করে? প্রশ্নটা মাত্রাধিক জটিল আমার জন্য। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে রেয়ানের দিকে তাকালাম। তার ঘোরলাগা দৃষ্টি আমার ওপর। আচ্ছা, এ দৃষ্টির অর্থ কি? বুঝেও যেন অনেকটা অবুঝ আমি। চোখ সরিয়ে ফেললাম। কিন্তু, রেয়ান বেহায়ার মতো তাকিয়েই রইলেন আমার দিকে। একবারের জন্য চোখের পলকও ফেললেন না। এ নিয়ে খানিক্ষণ পরই আবদ্ধ আর ইয়াসিন ভাইয়া হাসি-ঠাট্টা শুরু করে দিলেন। তবুও চোখ ফেরানোর নাম নেই তার। এদিকে লজ্জায় আটখানা আমি।
আব্বু, মেজো চাচ্চু ফোনে ফুফি, ছোট চাচ্চুদের সঙ্গে কথা বলছেন। হুট করে আকদ হয়ে যাওয়ায় আসতে পারেন নি তারা। তবে দু’দিন পর আসবেন বলে মন স্থির করেছেন ফুফি আর ছোট চাচ্চু। এবং এর রেশ ধরেয়েই উৎসব মূখর পরিবেশটা যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অনেক্ষণ সবার সাথে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করার পর আমাকে আর রেয়ানকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো আমার রুমে। রুমে এসেই ধপ করে বিছানায় বসে পরলেন রেয়ান। যেন এটা তারই রুম। আমার দিকে তাকিয়ে ডান ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
আমিও বসে পরলাম তৎক্ষণাৎ। উনি অস্পষ্ট হাসলেন। পরক্ষণেই সেটা দমিয়ে আবারো বললেন,
— “এত সেজেছো কেন? ভূত লাগছে দেখতে।”
ছোট ছোট চোখে তাকালাম উনার দিকে। আমি এত সেজেছি? কোথায়? নাকি উনি চোখে বেশি দেখছেন? পরপরই উনার মুচকি হাসি দেখে বুঝতে পারলাম, উনি মজা করছেন। রাগ হলো আমার। দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
— “আমি সাজি নি এত। আমাকে সুন্দরই লাগছে। বরং আপনি ঘেমে ভূত হয়ে গেছেন।”
উনি ভ্রু কুঁচকালেন। নিজেকে নিজে একবার স্কেন করে নিলেন। চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ চাহনী নিয়ে বললেন,
— “তাই? আমার তো মনে হচ্ছে না। তাছাড়া এখনো পুরোপুরি শীত যায় নি। তারওপর বৃষ্টি হয়েছে সকালে। এমন পরিবেশে আমি ঘেমে গেছি? একটু তো পরিস্থিতি বুঝে মিথ্যা বলো।”
রেগে বললাম,
— “এখন কি আমাকে আপনার থেকে মিথ্যা বলা শিখতে হবে?”
উনি মাথা দু’পাশে নাড়িয়ে বললেন,
— “উহুঃ!”
রাগ যেন আরো বেড়ে গেলো আমার। কথা নেই, বার্তা নেই, সব জায়গাতে ‘উহুঃ!’ এসময়েও উনার ফাজলামি করতে হবে? আমি উনার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাতেই উনি হেসে দিলেন। মজার ছলে বললেন,
— “রেগে গেলে তোমাকে টমেটো পেত্নী লাগে।”
রাগান্বিত স্বরে আমার জবাব,
— “আর কিছু?”
উনি কিছু বলবেন তার আগেই ফোন বেজে উঠল তার। ফোনের স্ক্রীনে একবার তাকিয়ে ফোন সাইলেন্ট করে দিলেন উনি। শান্ত স্বরে বললেন,
— “আমার যেতে হবে মরুভূমি। আসছি।”
বলেই দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। সাথে সাথে আমিও দাঁড়ালাম। উনি যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললাম আমি। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলাম। বাঁকা হেসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রেয়ান। উনি যান নি এখনো? কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। উনার বাঁকা হাসি আরো প্রশস্ত হলো। হুট করে আমার দিকে ঝুঁকে ডান গালে পরপর দু’বার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলেন। আমি বরফের নেয় শক্ত হয়ে রইলাম। একটু আগের তার স্পর্শ এখনো লেগে আছে গালে। হাত-পা কাঁপছে। মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু একটা কথাই বারবার মনে আসছে, ‘এটা কি হলো?’
আমার এমন অবস্থা দেখে হেসে দিলেন রেয়ান। আরেকটু ঝুঁকে আমার কানে কিছু বলতেই চোখ বড় বড় করে তাকালাম তার দিকে। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলাম। অস্বস্তি আর লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে আমার। আড়চোখে উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, উনি ঠোঁট কামড়ে হাসছেন। লজ্জা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো আমার। উপায়ান্তর না পেয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললাম আমি। উনার সামনে আর এক মুহুর্তও থাকা চলবে না আমার। নতুবা, লজ্জায় শেষ হয়ে যাবো আমি। ওয়াশরুমের দরজা ভেদ করে কারো হাসির শব্দ শুনতে পেলাম আমি। হয়তো আমার এমন কান্ড দেখে রেয়ান হাসছেন। এখন রাগ লাগছে আমার। আমাকে এমন লজ্জায় ফেলে উনি হাসছেন? বদ লোক একটা।
__________________
চলবে…