#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৩৮
.
— “তোমার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে কেন? সারারাত বসে বসে মশা মারো নাকি?”
প্রশ্নটা শুনে রাগ হলো প্রচুর। একে তো উনি কাল রাতে আমাকে ঘুমাতে না দিয়ে, নিজে আমার কোলে আরাম করে ঘুমিয়েছেন। এখন আবার তার এসব কথাবার্তা! চোখ সরু করে একটা ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে। উনি যেন দেখেও দেখলেন না আমাকে। আমার একদম শরীর ঘেঁষে বসে পড়লেন। আমাদের সামনে যে আবদ্ধ আর দীঘি বসে আছে সেই জ্ঞানটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছেন উনি। এদিকে আবদ্ধ আর দীঘি মুখ চেপে হাসছে। এতে আমি লজ্জা পেলেও রেয়ান বিন্দু মাত্র পান নি। গম্ভীর মুখ নিয়ে ভ্রু’জোড়া কুঁচকে ফোন চাপছেন উনি। আদৌ কি অন্যদিকে খেয়াল আছে উনার? মনে তো হয় না।
ট্রেনের কেবিনে বসে আছি আমরা। উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম যাবো। সেখান থেকেই ফুফিদের নিয়ে এক সাথে যাওয়া হবে রাঙামাটি। রেয়ান, আমি, দীঘি আর আবদ্ধ একটা কেবিনেই রয়েছি। সুতরাং, আমার সঙ্গে দীঘির এবং রেয়ানের সঙ্গে আবদ্ধের কথা বলেই পার হয়ে যাচ্ছে সময়। কিন্তু একসময় ক্লান্তিতে সবাই চুপ হয়ে যাই আমরা। দীঘি আবদ্ধের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। আর আবদ্ধ দীঘির মাথার ওপর নিজের মাথা রেখে। ট্রেনের জানালা থেকে আসা বাতাসে বরাবরই চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। বিরক্ত লাগছে। কপাল ঢেকে পরা চুল একহাতে কানে গুঁজে আড়চোখে রেয়ানের দিকে তাকালাম। তার মনোযোগ ফোনের ভেতরই। চোখ ফিরিয়ে নিলাম আবার। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে জানালা গলিয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। খানিকবাদ পর অনুভব করতে পারলাম, আমার কাঁধে হালকা ভারী কিছু অবস্থান করেছে। দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে গেলাম। রেয়ান আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছেন। উনি কি ঘুমিয়ে গেছেন? এত কম সময়ে? ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে উনার ভারী কণ্ঠ শোনা গেল,
— “আমার দিকে নির্লজ্জর মতো তাকিয়ে থাকবে না মরুভূমি।”
চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আমার। আমি নির্লজ্জর মতো তাকাচ্ছি? আমি? রাগে ফুঁসে উঠলাম। বললাম,
— “আমার কাঁধ থেকে মাথা সরান। দূর হোন আমার সামনে থেকে। নিজের এই চেহারা কখনো আনবেন না আমার সামনে।”
তৎক্ষণাৎ মাথা সরিয়ে ফেললেন রেয়ান। অবাক হলাম। আমি ভাবি নি উনি এত দ্রুত মাথা সরিয়ে ফেলবেন। অবাক নয়নে উনার দিকে তাকাতেই চট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলেন উনি। মুখে দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে চোখ মেরে বললেন,
— “এবার কিভাবে দূর করবে মরুভূমি?”
উনার এমন কান্ডে বিরক্ত হলাম আমি। চুপ রইলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “ঝগড়া করবে না?”
— “আপনি কি আমার সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য এমন করছেন?”
— “অবশ্যই। ঝগড়া করার সময় তোমার মুখের রাক্ষসী রাক্ষসী লুকটা জাস্ট আমাকে আমার ফেভারিট ভূতের মুভির কথা মনে করিয়ে দেয়।”
বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম। আর কিছু বলার পান নি উনি? শেষে কি-না রাক্ষসী? মুহুর্তেই আবার রেগে গিয়ে বললাম,
— “আপনি মাত্রাধিক অসভ্য রেয়ান। আপনার এই অসভ্য মুখটা বন্ধ রাখুন।”
উনি বেপরোয়া গলায় বললেন,
— “আমার মুখ, আমার ইচ্ছা। তোমার কথা শুনবো নাকি?”
প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম,
— “আলবাদ শুনবেন।”
উনার ভ্রু নাঁচিয়ে প্রশ্ন,
— “কেন?”
— “কারণ আমি আপনার সম্পর্কে বোন।”
উনি কিছু বললেন না। তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। প্রায় অনেক্ষণ। তারপর হঠাৎ-ই মৃদু ধমকে উঠলেন,
— “থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেবো একদম। আমি তোমার ভাই? তুমি আমার সম্পর্কে বোন হও? আর একবার কথাটা বললে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো। বেয়াদব!”
কথাটা বলেই রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। পরপরই চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন আমার কোলে। সব মিলিয়ে আমি বোকা বনে গেলাম। শূণ্য অনুভূতির মাঝে একরাশ রাগ এসে হাজির হয়েছে মনে। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। শান্ত চাহনীতে রেয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু মুহুর্ত। জানালা গলিয়ে আসা শীতল বাতাসে রেয়ানের চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি আলোয় তার মুখটা আরো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। অজান্তেই মুচকি হাসলাম আমি। আস্তে আস্তে আমার হাত চলে গেল তার চুলে। আলতো ভাবে উনার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ফোন বেজে উঠল রেয়ানের। ততক্ষণে রেয়ান ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেছেন। পরপর তিনবার বেজে উঠায় ভাবলাম হয়তো জরুরি কিছু। উনার হাতে আলগা ভাবে থাকা ফোনটা আস্তে করে নিয়ে নিলাম নিজের হাতে। উহু! জরুরি কিছু না। সিম কোম্পানি থেকে আসা কয়েকটা মেসেজ মাত্র।
একবার ফোন রাখতে গিয়েও ফোন রাখলাম না আমি। উনার ফোনের ওয়ালপেপারে আমার আর তার ঝর্ণা স্পর্শ করার ছবিটা এখনো বিদ্যমান। আচ্ছা, আর কি কি ছবি আছে উনার ফোনে? আমার ছবি আছে কি? চরম আগ্রহে ফোনের পাসওয়ার্ড খুলতে লেগে গেলাম আমি। প্রথমে উনার পুরো নাম দিলাম। হলো না। শুধু ‘রেয়ান’ নামটা দেওয়ার পরও হলো না। না হলো আমার পুরো নাম দিয়ে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। আর একবার পাসওয়ার্ড ভুল হলেই ফোন লক হয়ে যাবে। ফোনটা রেখে দেবো এমন সময় মনে হলো ‘মরুভূমি’ লিখে একবার চেষ্টা করলে কেমন হয়? মনে সাহস জুগিয়ে ফোনে ‘মরুভূমি’ নামটা টাইপ করতেই খুলে গেলো লক। মুহুর্তেই একগাল হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে। লক খুলতেই ওয়ালপেপারে এবার আরেকটা ছবি ভেসে উঠল। আমাদের আকদের দিন মাথা নিচু করা অবস্থায় আমার ছবি। বিস্মিত হলাম। এটা কখন তুললেন উনি? আপাতত প্রশ্নটা মাথা থেকে বাদ দিয়ে কি মনে করে মেসেজে ঢুকলাম আমি। কয়েকটা মেসেজের পর একটা মেসেজে চোখ যেতেই চোখ আটকে গেলো আমার। এটা তো সেই অচেনা ব্যক্তির মেসেজ, যেগুলো আমাকে কয়েকদিন আগেও পাঠানো হতো। তার দেওয়া কিছু থ্রেট আর আমার রেগে গিয়ে লিখা কিছু মেসেজ। এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। অত্যাধিক বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে একবার রেয়ানের দিকে তাকাচ্ছি তো একবার ফোনের দিকে। জ্ঞান শূণ্য হয়ে গেছি। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব।
___________________
রাঙামাটি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায় সবার। আবদ্ধ আর দীঘি হালকা পাতলা নাস্তা করেই চলে যায় নিজ রুমে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর আবদ্ধ যখন স্নিগ্ধ বাতাসের খোঁজে বারান্দায় চলে যায়, তখন দীঘি মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। রুমে এসে আবদ্ধকে দেখতে না পেয়ে দীঘি অবাক হয়। বারান্দায় একবার উঁকি দিতেই আবদ্ধর ছায়া দেখতে পায় সে। আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত পায়ে চলে যায় বারান্দায়। নিঃশব্দে আবদ্ধের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আবদ্ধ বুঝতে পারে দীঘির উপস্থিতি। মুচকি হেসে বলে,
— “কি হয়েছে? এমন চোরের মতো করছো কেন?”
দীঘি রাগী দৃষ্টিতে তাকায় আবদ্ধের দিকে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
— “আমি চোরের মতো করছি? আপনি করছেন চোরের মতো। আপনার সব চোরের মতো করছে।”
আবদ্ধ শব্দ করে হেসে বলল,
— “আমার সব চোরের মতো করলে তো আমার অর্ধাঙ্গিনীও চোরের মতো করছে তাই না? নিজেকে নিজে চোর বলছো?”
রেগে যায় দীঘি। কিছু না বলে আবদ্ধের দিকে মুখ বাঁকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। আবদ্ধ আবারো হাসে। কিছু সময় নিরবতায়ই কাটে তাদের। পাশাপাশি থেকে, বাতাসের তীব্রতা অনুভব করে তারা। হঠাৎ দীঘি মিনমিনিয়ে বলে উঠে,
— “আপনাকে একটা কথা বলার ছিল আবদ্ধ।”
— “বলো।”
আগের চেয়েও দ্বিগুণ মিনমিনিয়ে এবং তোতলিয়ে দীঘি বলল,
— “আ-আসলে আ-বদ্ধ.. কথাটা আমি ঢাকায়ই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম এখানে বললে বেশি ভালো হবে। আপনার মনও ভালো থাকবে আর সবাই একসাথে থাকবো তাই..!”
আবদ্ধ এবার ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,
— “কি বলবে বলো। আমি শুনছি।”
দীঘি চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। কি বলবে বুঝতে পারছে না। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে দীঘির। মনে সাহস জুগিয়ে প্রায় অনেক্ষণ চুপ থেকে পরমুহুর্তেই বলে উঠলো দীঘি,
— “আপনি বাবা হবেন।”
কথাটা শুনে অপর দিক থেকে আবদ্ধের কোনো সারাশব্দ এলো না। তাই আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো দীঘি। আবদ্ধ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে এটা শুনে খুশি।
________________
চলবে…
(খাপছাড়া আর ছোট পর্বের জন্য আমি দুঃখীত।মাথা ব্যথার জন্য অত ভালো লিখতে পারি নি।)