#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৩৯
.
হঠাৎ হঠাৎ শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে আবদ্ধকে। কিন্তু সেই শীতল বাতাস তার শরীরকে শীতল করতে পারলেও মনকে শান্ত করতে পারছে না। আবদ্ধ ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে দীঘির দিকে। দু’আঙুল কপালে ঘঁষে দ্রুত দীঘির মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। শান্ত স্বরে বলে,
— “এবোরশন করে ফেলো দীঘি।”
দীঘি চমকায়। থমকে যায় এক মুহুর্তের জন্য। পরক্ষণেই একটু হাসার চেষ্টা করে বলে,
— “মজা করছেন?”
আবদ্ধের শক্ত কণ্ঠ,
— “না।”
আবারো চমকে যায় দীঘি। বিস্ময়ে দু’কদম পিছিয়ে যায় সে। কাতরতা নিয়ে বলে,
— “এমন ভাবে বলছেন কেন আবদ্ধ? আপনি কি খুশি নন?”
আবদ্ধ জবাব দেয় না। এগিয়ে এসে দীঘির হাত ধরতেই হাত সরিয়ে নেয় দীঘি। মৃদু চেঁচিয়ে বলে,
— “উত্তর দিন।”
আবদ্ধ একটুও বিচলিত হয় না। যেন সে জানতো এমন কিছুই হবে। শান্ত ভঙ্গিতে দীঘির হাত ধরে রুমে নিয়ে যায়। সোফায় বসাতেই দীঘি আবারো কাতর কণ্ঠে বলে,
— “বলুন না আবদ্ধ, এমন করছেন কেন? তখন মজা করে এ-এবোরশনের কথা বলেছিলেন তাই না?”
আবদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। দীঘির হাত দু’টো নিজের দু’হাতের ভাঁজে শক্ত করে ধরে শান্ত কণ্ঠে বলে,
— “দেখো দীঘি, আমরা দু’জনেই এখন ছোট। তোমার পড়ালেখা, আমার পড়ালেখা, দুজনের ক্যারিয়ার, সব মিলিয়ে এখন বেবি নেওয়া সম্ভব না। আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি এখনো অনেক ছোট। বেবি নেওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি নও। তাই এ বেবি নেওয়া অসম্ভব আমাদের জন্য। আমার কথা শুনে এবোরশণ করে ফেলো। কালকে আমরা হসপিটালে যাবো, ঠিকাছে?”
কথাটা শুনে দীঘি সোফা ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ায়। অবাক চোখে আবদ্ধের দিকে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলে,
— “আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন আবদ্ধ? এসব সামান্য কারণে একটা ছোট্ট শিশুকে, আপনার নিজের সন্তানকে হত্যা করবেন?”
আবদ্ধ নিজেও উঠে দাঁড়ায়। বলে উঠে,
— “সন্তান জন্ম দিলেই শুধু হয় না দীঘি। তাদের সঠিক ভাবে লালনপালনও করতে হয়। যা আমরা দু’জনেই পারবো না।”
দীঘির উত্তেজিত কণ্ঠ,
— “কেন পারবো না? আমি নাহয় বোকা। কিন্তু আপনি? আপনি তো এডাল্ট। তাছাড়া আমরা না পারলেও মা তো পারবেন আমাদের বেবিকে দেখেশুনে রাখতে। তখন নাহয় আস্তে ধীরে মার থেকে আমিও সব শিখে নেবো।”
আবদ্ধ এক কদম এগিয়ে যায় দীঘির দিকে। অধৈর্য হয়ে বলে,
— “আমি এখন বেবি চাই না দীঘি।”
মুহুর্তেই দীঘি শান্ত হয়ে গেলো যেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,
— “কেন চান না? শুধু মাত্র নিজের ক্যারিয়ার গড়তে তাই তো? উফ! আমি কিভাবে ভুলে গেলাম, আপনার তো আত্মসম্মান সবার আগে। ভার্সিটিতে কেউ যদি জানে এ বয়সে আপনার একটা বেবিও আছে তখন তো আপনাকে কেউ পাত্তা দেবে না। এক বাচ্চার বাবা শুনে কোনো সুন্দরী মেয়ে কি আপনাকে পাত্তা দেবে? না। ব্যাপারটা আপনার আত্মসম্মানে লাগবে। থাকতে পারবেন না আপনি। এজন্যই তো আমার বাচ্চা খুন করতে চাইছেন তাই না? জানোয়ার!”
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবদ্ধর। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও পারছে না আবদ্ধ। রাগী কণ্ঠে বলে উঠে,
— “আর একটা কথা বলবে না দীঘি। বেশি বাড়াবাড়ি করছো তুমি।”
দীঘি আরো দ্বিগুণ রেগে বলে,
— “আমি বাড়াবাড়ি করছি? এটা যদি বাড়াবাড়ি হয় তাহলে আমি আরো বাড়াবাড়ি করবো। শুনছেন আপনি? আপনি একটা জানোয়ার, অমানুষ। খুনি আপনি। আমার সাথে আলিঙ্গন করতে তো কোনো সমস্যা হয় নি আপনার। তাহলে বাচ্চা জন্ম দিতে সমস্যা হচ্ছে কেন?”
সাথে সাথে দীঘির গালে চড় মেরে দেয় আবদ্ধ। রক্ত লাল চোখে তাকিয়ে থাকে দীঘির দিকে। দীঘি অবাক হয়। পরপরই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। ফ্লোরে বসে পরে। আবদ্ধের সহ্য হয় না এসব। রুম থেকে বের হয়ে ছাদে চলে যায় সে।
_______________
বিছানায় বসে আছেন রেয়ান। বারবার মীরাকে কল দিলেও তার কল ধরছে না মীরা। এতে বিরক্ত রেয়ান। প্রচুর রকমের বিরক্ত। ক্ষিপ্ত হয়ে ফোন ছুঁড়ে মারেন বিছানায়। পরপরই শীতল হাওয়া পেতে চলে আসেন ছাদে। আপাতত মনটা শান্ত চাই তার। নতুবা রেগে গিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবেন উনি। ভাবনা মতে ছাদে পৌঁছাতেই অবাক হন রেয়ান। ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আবদ্ধ। আবদ্ধ কখন থেকে সিগারেট খায়? ধীর পায়ে আবদ্ধের পাশে গিয়ে দাঁড়ান রেয়ান। থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের দু’পকেটে দু’হাত রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান আকাশের পানে। আবদ্ধের উদ্দেশ্যে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন,
— “ধুমপান করছিস কবে থেকে?”
আবদ্ধ চমকে গিয়ে পাশে তাকায়। রেয়ানকে দেখে অবাক হয়। সে খেয়ালই করে নি রেয়ান তার পাশে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় আবদ্ধ। আধ খাওয়া সিগারেট ফ্লোরে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে। বিষণ্ণতা নিয়ে বলে,
— “ওই মাঝে মাঝে। বেশি মন খারাপ হলে একটা, দুটা খাই।”
রেয়ান এবার শান্ত ভাবে বলেন,
— “আজ কেন মন খারাপ?”
আবদ্ধ যেন এটারই অপেক্ষা করছিল। নিজের ভেতরের কথাগুলো কাউকে বলা খুব প্রয়োজন তার। এতে মন হালকা হয়। হয়তো সমস্যার সমাধানও পাওয়া যায়। সুতরাং, দেড়ি না করে আবদ্ধ কোনো জড়তা ছাড়া বলে উঠে,
— “দীঘির সাথে কয়েকদিন ধরেই ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেছে আমার। ভুলে.. কিভাবে যেন ভুল করে ফেলেছি আমি..! ও প্রে-প্রেগন্যান্ট।”
রেয়ান চমকে গেলেও তা প্রকাশ করেন না। ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— “তো এতে সমস্যা কিসের?”
আবদ্ধ অপরাধীর ন্যায় বলে,
— “আমি এখন বাচ্চা চাই না ভাই। কিন্তু দীঘি মানছেই না ব্যাপারটা। এবোরশন করতে রাজী হচ্ছে না। এ নিয়ে একটু আগেও ঝগড়া হয়েছে আমাদের। রাগের মাথায় ওকে থাপ্পড় দিয়েছি আমি।”
কথাটা শুনে ভ্রুটা আরো কুঁচকে গেলো রেয়ানের। আবদ্ধের মাথায় জোড়ে চড় মেরে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন,
— “এর জন্য থাপ্পড় মারবি? নরপশু নাকি তুই? রাস্তার ছেলেদের মতো কি বউ পেটানো শিখে গেছিস?”
আবদ্ধ মিনমিনিয়ে বলে,
— “তুইও তো থাপ্পড় দিয়ে থাকিস মীরাকে।”
— “আমি দেই ওর দোষে। শাসণে কিংবা ওর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করে। তুই কি এ তিনটা কারণের মধ্যে একটা কারণেও মেরেছিস ওকে? না। আচ্ছা, দীঘির দোষটাই বা কোথায়? সামান্য কারণ দেখিয়ে মা থেকে সন্তানকে আলাদা করতে চাইবি আর মাও করে দেবে? এত সহজ?”
আবদ্ধ করুণ চোখে তাকিয়ে বলে,
— “কিন্তু ভাই, ও অনেক ছোট।”
আবদ্ধের এমন ছেলেমানুষি কথায় রাগ লাগছে রেয়ানের। রাগী কণ্ঠে বলেন,
— “ভুল করার সময় মনে ছিল না ও ছোট? সরি টু স্যে, তুই যা করছিস তা একজন মানুষিক রোগী ছাড়া কেউ করে না। নিজের সন্তানকে মারতে চাইছিস? সিরিয়াসলি? আমার কি মনে হয় জানিস? তুই তোর ক্যারিয়ারের জন্য এমন পাগলামি করছিস। দীঘির তো এখনো কোনো সমস্যাই ধরা দেয় নি আর তুই আগেই মেয়েটাকে ছোট ছোট বলে উপাধি দিচ্ছিস। থাপ্পড়ও মেরে দিয়েছিস। আগে ডাক্তারের কাছে যাবি, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দীঘির যত্ন নিবি। তারপর যদি কোনো সমস্যা হয় তখন দীঘির এবোরশন কর। কেউ কিছু বলবে না। কেননা, স্ত্রী একটাই। সন্তান পরেও নেওয়া যাবে। কিন্তু না। তুই আগেই অস্থির হয়ে কাহিল। কেন? নিজের ক্যারিয়ার ছাড়া তো অন্য কোনো কারণ দেখছি না আমি। জানিস কি আবদ্ধ? তোকে এখন স্বার্থপর, অমানুষ ছাড়া কিছুই লাগছে না আমার।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেয়ান। আড়চোখে আবদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখলেন আবদ্ধের চোখে পানি। বিরক্ত হলেন এবার। ধমকে দিয়ে উঠলেন,
— “কি সমস্যা? কাঁদছিস কেন? আশ্চর্য!”
হঠাৎ-ই রেয়ানকে জড়িয়ে ধরে আবদ্ধ। নাক টেনে বলে উঠে,
— “আমি কি সত্যি ভুল করেছি ভাই?”
কাঁটা গায়ে যেমন নূন ছিঁটালে ব্যথা আরো তীব্র হয়, তেমনি বিরক্তির মাঝে কেউ অবুঝের মতো কথা বললে সে বিরক্তি আরো বেড়ে যায়। রেয়ানের ঠিক এমনই অবস্থা। আবদ্ধকে সরানোর চেষ্টা করে আবারো ধমকে উঠেন রেয়ান,
— “আমি কি এতক্ষণ কৌতুক শুনিয়েছি তোকে। সর এখান থেকে। মাথামোটা!”
আবদ্ধ সরলো না। ওভাবেই বলল,
— “সরি ভাই। আমি এখনই ক্ষমা চাইবো দীঘির লাছে। এবার অনতত অমানুষ বলিস না আমাকে।”
— “এখন কি অমানুষ না হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইবি? নিজ থেকে না?”
— “ভাই? এমন বলছিস কেন?”
আবদ্ধকে নিজের থেকে সরিয়ে রেয়ান বললেন,
— “তো কি বলব? গাঁধার মতো এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
আবদ্ধ মাথা চুলকে হাসার চেষ্টা করলো। পরপরই দ্রুত পায়ে চলে গেল সেখান থেকে। উদ্দেশ্য, দীঘির কাছে ক্ষমা চাইবে সে।
_____________
আবদ্ধ যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ছাদে কাটালেন রেয়ান। কিছু একটা মনে পড়তেই ছাদ থেকে নেমে চলে আসেন। নিঃশব্দে আমার রুমের কাছে এসে দরজা ছোট্ট করে ধাক্কা দেন। দরজা খোলাই ছিল। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন রেয়ান। আমি তখন ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। আয়নায় রেয়ানের প্রতিবিম্ব দেখেই উঠে দাঁড়ালাম। অবাক হলাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, উনি সত্যিই আমার রুমে। এর রাতে উনি এখানে কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাতেই উনার গম্ভীর কণ্ঠ,
— “একশত কল দিয়েছে? ফোন কোথায়?”
অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বললাম,
— “ইচ্ছে করে ধরি নি।”
— “কেন?”
ক্রুদ্ধ গলায় বললাম,
— “আপনি আমার ফোনে আননোন নাম্বার দিয়ে মেসেজ দিতেন কেন?”
ভ্রু কুঁচকে তার প্রশ্ন,
— “তাই বলে ফোন ধরবে না?”
— “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। কেন করেছেন এমন?”
তার নির্লিপ্ত কণ্ঠ,
— “তোমাকে জ্বালাতে ভালো লাগে।”
আমি রাগী কণ্ঠে বললাম,
— “তাই বলে এমন করবেন?”
— “আমার ইচ্ছে।”
— “আপনি একটা বাজে লোক।”
— “জানি।”
রেগে গিয়ে বললাম,
— “ফালতু।”
— “আমার বউ ফালতু।”
চোখ বড় বড় করে বললাম,
— “আপনি আমাকে ফালতু বললেন?”
উনি ভ্রু নাঁচিয়ে বললেন,
— “আমি তো আমার বউকে বলেছি। তোমাকে বলেছি নাকি?”
অতিরিক্ত রাগে চুপ হয়ে গেলাম আমি। মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। হুট করে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন রেয়ান। ঝুঁকে গিয়ে চুমু খেলেন গালে। পরপরই বিছানায় আরাম করে বসে বললেন,
— “ওই লাল টমেটো। কফি বানিয়ে আনো তো।”
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে। তার কথা আমার কানে গিয়েছে কিনা সন্দেহ। বিস্ময়ে হা করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি মাত্র।
_____________
চলবে…