হৈমন্তিকা পর্ব – ১৩

0
383

হৈমন্তীকা

১৩.
বাইকের গতি বাড়ছে। শনশন আওয়াজে বাতাসের তীব্র ঝাপটা লাগছে কানে। ঠিক ভাবে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না হৈমন্তী। বাইকের পেছনের দিকটা আরও শক্ত করে খামচে ধরে সে চেঁচিয়ে বললো,
— “স্প্রিড কমান তুষার!”
— “ভয় পাচ্ছেন হৈমন্তীকা?”
প্রতিউত্তরে আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলো তুষার। হৈমন্তী এবার ধমক দিয়ে উঠল,
— “স্প্রিড কমাতে বলেছি, তুষার! কথা শুনছেন না কেন?”

তুষার বাইকের স্প্রিড কমালো না। বরং আরও বাড়িয়ে দিলো। এতে যেন ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল হৈমন্তীর। চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করার সময়টুকুও পেল না। কোনোমতে তুষারের কোমড়ের অংশের শার্ট শক্ত করে ধরে, চোখ-মুখ খিঁচে মূর্তির ন্যায় বসে রইলো সে। মনে মনে আল্লাকে ডাকতে লাগল। এখন বাইক থেকে পরলে নিশ্চিত হাত-পা ভেঙ্গে হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করতে হবে তার।
সরব, বাতাসের শব্দ কমে গেল। গায়ে তেমন বাতাস লাগছে না এখন। আশপাশটা কেমন নিরব, শান্ত! পিটপিট করে চোখ মেলল হৈমন্তী। রাস্তার পাশে বাইক দাঁড় করানো। মাথা থেকে হেলমেট খুলছে তুষার। হৈমন্তী চোখ মেলতেই সে বললো, “নামুন, হৈমন্তীকা।”

বাধ্য মেয়ের মতো বাইক থেকে নেমে পরলো হৈমন্তী। পরক্ষণেই কিছুক্ষণ আগের ঘটনো মনে পরতেই ক্ষীপ্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “আপনাকে তখন স্প্রিড কমাতে বলেছিলাম আমি। না কমিয়ে উলটো আরও বারিয়ে দিয়েছিলেন কেন?”
— “আপনাকে একটু জ্বালাচ্ছিলাম হৈমন্তীকা। রাগ করবেন না।”

তুষারের কথাটা ঠিক রাখতে পারলো না হৈমন্তী। রেগে গেল। ক্ষীপ্ত চোখ জোড়ার অগ্নিকুণ্ডের ন্যায় তেজ দিয়ে ভস্ম করে দিতে চাইলো তুষারকে। তুষার সেই ভয়ংকর নেত্রে চেয়ে আরও একবার আহত হলো যেন। দৃষ্টি গভীর হলো তার। বক্ষস্থলে সৃষ্টি হলো এক কঠিন ব্যাথা। সেই ব্যাথার রেশ ধরেই হেসে ফেলল সে। এগিয়ে গিয়ে হৈমন্তীর হাতের ভাঁজে হাত রাখলো। লহু স্বরে বললো,
— “চলুন, হৈমন্তীকা।”

রেস্টুরেন্টটির নাম নীড়পাতা (ছদ্মনাম)। এই অদ্ভুদ নামের রেস্টুরেন্টটির সব কিছুই কেমন অদ্ভুদ লাগছে হৈমন্তীর। চেয়ার, টেবিল থেকে শুরু করে ওয়েটারদের পোশাক-আশাকও ভীষণ রকমের অদ্ভুদ! সবাই পাঞ্চাবী পড়ে আছে। মাটির পাত্রে সার্ফ করা হচ্ছে খাবার। একপাশের দেওয়াল জুড়ে সোনালী অক্ষরে খুব সুন্দর করে লেখা, ‘মাছে ভাতে বাঙালি।’

হৈমন্তী প্রথমে ভেবেছিল, এটা শুধুই বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্ট। এজন্যই হয়তো এখানে বাঙালি সংস্কৃতি স্বতস্ফুর্ত ভাবে বিরাজমান। অথচ না। তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মেনুকার্ডে আরও বিভিন্ন দেশের খাবারের নাম উল্লেখ করা আছে। হৈমন্তী আরও একবার রেস্টুরেন্টটি ভালোভাবে দেখে নিলো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
— “আমাকে এখানে কেন এনেছেন তুষার?”
— “আমি সকাল থেকে কিছুই খাই নি হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী খানিক নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— “কেন খান নি?”
— “আপনার সঙ্গে খাবো বলে। আপনি আমাকে খাইয়ে দেবেন।”

নিঃসংকোচ আবদার। হৈমন্তী বিমূঢ় হয়ে বার কয়েক বার পলক ফেলল। তুষার তখনো মেনুকার্ড দেখতে ব্যস্ত। তার অভিব্যক্তি ভীষণ শান্ত, স্বাভাবিক। উঁচু গলায় হাঁক ছেড়ে ওয়েটারকে ডাকলো সে। মেনুকার্ড থেকে কিছু খাবার ওর্ডার করে হৈমন্তীকে বললো,
— “আমার কাছে এসে বসুন হৈমন্তীকা। ওখান থেকে আপনার অসুবিধে হবে।”
হৈমন্তী উদাস নয়নে তাকালো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “আপনি এবার বেশি বেশি করছেন না তুষার?”
— “একদমই না।”

হৈমন্তীর চোখে চোখ রেখে খুব গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো সে। হৈমন্তীর উদাসীনতা বাড়লো। বিরক্তি ছেয়ে গেল সর্বাঙ্গে। আরও একবার তুষারকে বোঝানোর চেষ্টা করলো সে,
— “দেখুন তুষার, আপনি যদি এই আবদারটা আমাকে একজন ছোট ভাই হিসেবে করতেন, বিশ্বাস করুন, আমি সেটা পূরণ করতাম। কিন্তু আপনি তা করছেন না। আমি আপনার বয়সে তিন বছরের বড় তুষার। আমাদের এভাবে একসাথে ঘোরার মানে নেই। আপনাকে খাইয়ে দেওয়ার মানে নেই। আপনি যা চাইছেন তা কখনো সম্ভব নয়। আমাদের সমাজ, পরিবার এটা কখনোই মানবে না। মূল কথা, আমিও আপনাকে চাইছি না। তবে কেন আমার পেছনে ঘুরে নিজের সময় নষ্ট করছেন আপনি? কেন বুঝতে পারছেন না, এটা অসম্ভব!”

কথাগুলো বলে শুকনো ঢোক গিললো হৈমন্তী। জবাবের অপেক্ষা করতে লাগল। তুষার কিছুক্ষণ চুপচাপ, নির্নিমেষ চেয়ে রইলো তার মুখপানে। পরক্ষণেই ঠোঁটে বিস্তর হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। কাতর চোখ খানায় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে নিষ্পাপ স্বরে আওড়ালো,
— “কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি হৈমন্তীকা। আপনি কেন সেটা বুঝতে পারছেন না?”

হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল হৈমন্তীর। ছেলেটা এমন অবুঝের মতো করছে কেন? এটা বিদেশ না! বাংলাদেশ! যেখানে নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে ভালোবাসা মানে, মেয়েটা ছেলেটাকে ফাঁসিয়েছে। নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে বিয়ে করা মানে, ছেলেটার কপাল খারাপ!

_____

অনবরত কলিংবেলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। থামছেই না। রাবেয়া বেশ বিরক্তি সহিত রান্নাঘর থেকে বেরলেন। দরজার কাছে যেতে যেতে রোষপূর্ণ গলায় হাঁক ছাড়লেন, “কে?”
অতঃপর দরজা খুলতেই বিরক্তি যেন উবে গেল উনার। দরজার সামনে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আফতাব সাহেব। রাবেয়াকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন,
— “আসরাফ সাহেব বাসায় আছেন? উনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

রাবেয়া থেমে থেমে বললেন,
— “আ-আছে। ভেতরে আ-সুন।”
— “ভেতরে ঢুকবো না। উনাকে এখানে ডাকুন।”
— “জি।”

এরপর ভেতরে ঢুকে আসরাফ সাহেবকে ডেকে আনলেন রাবেয়া। নিজে চলে গেলেন রান্নাঘরে। ইলিশ মাছ বোধহয় এতক্ষণে পুড়েই গেল! এ নিয়ে রাবেয়ার চিন্তার শেষ নেই।
আসরাফ সাহেব আফতাব সাহেবকে দেখে খানিক হাসলেন। বিনয়ের সঙ্গে বললেন,
— “কোনো সমস্যা ভাই? এ সময়ে আসলেন!”
আফতাব সাহেব কোনো ভণিতা ছাড়াই গম্ভীর স্বরে বললেন,
— “যতদ্রুত সম্ভব অন্য বাসা দেখুন। আগামী মাসে বাসা ছেড়ে দিতে হবে আপনাদের।”
আসরাফ সাহেবের কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো। বিস্ময় নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন,
— “মানে? কেন? আমাদের দ্বারা কি কোনো ভুল হয়েছে ভাই?”
— “সেটা আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করুন। আপনার মেয়ে কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে?”
— “হ্যাঁ। কিন্তু আমার মেয়ে কি করেছে?”

আফতাব সাহেব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন এবার,
— “আপনার মেয়ে আমার ছেলেকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। যেই দেখেছে আমার ছেলের অনেক টাকা, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল! সেই আমার ছেলের গলায় ঝুলতে চলে এসেছে। আমার ছেলের মাথা খেয়ে ফেলেছে আপনার মেয়ে। ওকে ছাড়া আমার ছেলে যেন কিছু বুঝেই না। অথচ, আপনার মেয়ের কি নাকট! নিজেই আমার ছেলের মাথা নষ্ট করে, নিজেই কমপ্লেইন করছে আমার ছেলে কি-না আপনার মেয়েকে বিরক্ত করে। আরে, আপনার মেয়েই একটা থার্ড ক্লাস! নিজের চেয়ে ছোট ছেলেকে নিজের প্রেমের জালে ফাঁসাচ্ছে…”

বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় মুহুর্তেই রেগে গেলেন আসরাফ সাহেব। আফতাব সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “ভদ্র ভাবে কথা বলুন! আমার মেয়ে কেমন তা আপনার থেকে জানতে হবে না আমার। নিজের ছেলের দোষ আমার মেয়ের ঘাড়ে চাপাবেন না। খবরদার!”
আফতাব সাহেব আরও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “আপনাদের থেকে ভদ্রতা শিখতে হবে না আমার। নিজেরা আগে শিখে আসুন গিয়ে। আগামী মাসের প্রথম তারিখেই যেন এ ফ্ল্যাটে আপনাদের কাউকে না দেখতে পাই আমি। নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব আপনাদের। কি ভেবেছেন আপনারা? আমার ছেলেকে নিজের বশে আনতে চাইবেন, আর আমি আনতে দিবো? কক্ষনো না!”

আসরাফ সাহেব প্রতিবাদ করতে গিয়েও করলেন না। আফতাব সাহেবের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলেন। আসরাফ সাহেবের মতে নিরবতাই সবচেয়ে বড় অপমান। তাছাড়া, কুকুর ঘেউঘেউ করলে কি আমাদেরও ঘেউঘেউ করতে হবে? নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু কোনো ভাবেই পারছেন না। শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওদিকে আফতাব সাহেব চেঁচামেচি করেই যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে উপর,নিচ তলার ফ্ল্যাট থেকে মানুষ চলে এসেছে দেখতে। চেঁচামেচি শুনে রাবেয়া রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলেন। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি হয়েছে হৈমন্তীর আব্বু? আফতাব ভাই এত চেঁচাচ্ছেন কেন?”

আসরাফ সাহেব উত্তর দিলেন না। শক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মেঝেতে।

_____

হৈমন্তী তখনই বেরিয়ে গেছে রেস্টুরেন্ট থেকে। তুষার শত ডাকলেও থামে নি। রিকশা পাওয়া মাত্রই উঠে বসে তাতে।
নিজের ফ্ল্যাটে আসতেই খানিকটা অবাক হয় সে। প্রতিদিনের তুলনায় একটু বেশিই শান্ত আজকের পরিবেশ। আসরাফ সাহেব সোফায় চুপচাপ বসে ছিলেন। সেদিকে একবার তাকিয়ে হৈমন্তী যেতে নিলেই, পেছন থেকে উনার গম্ভীর ডাক, “এদিকে আয় হৈমন্তী।”

__________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~ রি-চেক করিনি। ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থী৷ আর অনেকেই অভিযোগ করছেন, আপনাদের নিউজফিডে গল্প পৌঁছাচ্ছে না। তাই সবাই আগামী কয়েকটা পর্বে রেসপন্স করবেন প্লিজ। মূলত, সাইলেন্ট রিডারদেরই এ সমস্যা বেশি হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here