হৈমন্তিকা পর্ব – ৩৬

0
228

হৈমন্তীকা

৩৬.
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। অস্বাভাবিক শান্ত বাতাসে শরীর শিরশির করে উঠছে। রেলিং গলিয়ে একবার নিচে উঁকি দিলো হৈমন্তী। চোখ থমকে গেল সেখানেই। কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আছে তার প্রাক্তন বারান্দাটা। ধূলোয় স্তুপ হওয়া জায়গা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ বৃষ্টির পানিতে। মনে মনে বৃষ্টিকে কৃতজ্ঞ জানালো হৈমন্তী। ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে প্রাণপ্রিয় বারান্দা একটুখানি ছুঁয়ে দিতে। হৈমন্তী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দৃষ্টি সরিয়ে গহীন কালো আঁধারে স্থির করতেই কোমরে পুরুষালী স্পর্শ পেল সে। যা তার কোমড় ছুঁয়ে দু’হাতের দু’পাশে এসে স্থান পেল। পিঠ ঠেকে গেল প্রশস্ত বুকে। হৈমন্তী ভড়কালো। চমকে উঠলো ভীষণ। ধাতস্ত হতেই বললো,
—“কি করছেন তুষার?”

তুষার উত্তর দেয় না। উলটো গমগমে স্বরে বলে,
—“বৃষ্টি হচ্ছে না? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জ্বর বাঁধানোর ইচ্ছে হয়েছে?”
হৈমন্তীর মিনমিনিয়ে উত্তর,
—“রুমে ভালো লাগছে না।”

পরপরই আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিচের বারান্দাটির দিকে তাকালো সে। জিজ্ঞেস করলো,
—“আমাদের ফ্ল্যাটে কি কেউ থাকে না? কেমন বদ্ধ বদ্ধ যে?”
—“থাকে। শুধু আপনার বারান্দা আর রুমে থাকার অনুমতি নেই।”

হৈমন্তী যেন ভীষণ অবাক হলো। বললো,
—“কেন?”
—“কারণ আমি চাই না ওখানে কেউ থাকুক। ওই বারান্দাটা আমার হৃদয়খননের একমাত্র স্বাক্ষী, সূচনা আর ভালোবাসা।”

তুষার ক্ষীণ গভীর হলো। গলায় মুখ এগিয়ে স্পর্শের প্রগাঢ়তা বাড়ালো। নাকে ঠেকলো শ্যাম্পুর মিষ্টি ঘ্রাণ। শুধু কি শ্যাম্পুর ঘ্রাণ? হৈমন্তীর নিজস্বতাও মিশে আছে এতে। হৈমন্তী থেমে থেমে কেঁপে উঠলো। আড়চোখে তাকালো তুষারের মুখপানে। কম্পয়মান গলায় বলতে চাইলো,
—“আমার ঠান্ডা লাগছে তুষার। রুমে চলুন।”
তুষার শুনলো না। আরও কিছু সময় নীরবে, নিভৃতে কাটিয়ে দিলো তারা। হৈমন্তীও দিরুক্তি করতে পারেনি। তার কি সাধ্য আছে মানা করবার?

সরব খট খট শব্দে কে যেন কারাঘাত করলো দরজার পিঠে। হৈমন্তী ছিটকে সরে গেল প্রায়। তুষারের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, সে ভ্রু কুঁচকে দৃঢ় চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। হৈমন্তী আবার নতজানু হলো। মৃদু স্বরে তাগাদা দিলো,
—“দরজায় কেউ আছে। খুলুন, যান।”

তুষার শুনলো। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো,
—“শাড়ি ভিঁজে গেছে। চেঞ্জ করে নিন। ঠান্ডা লাগবে।”
পেছন থেকে হৈমন্তী উঁচু গলায় বললো,
—“আমার কাছে আর শাড়ি নেই তো। সবগুলো ধুঁয়ে দিয়েছিলাম। শুকোয় নি এখনো।”

সেকথার আর উত্তর পাওয়া গেল না। ধীর স্থির হয়ে দরজার কাছে গিয়ে নব ঘোরালো তুষার। হেনাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুঁচকানো ভ্রু স্বাভাবিক করলো। হেনা খুবই শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—“ভাত খাবি না? নিচে আয়। ভাত বাড়ছি।”
তুষার মায়ের মতো করেই বললো,
—“নিচে খাবো না। রহিমা আন্টিকে বলো রুমে খাবার আনতে।”
হেনা জোড় করলেন,
—“রাগ মনে পুষে রাখিস না বাপ। হৈমন্তীকে নিয়ে নিচে আয়।”
—“আমরা এখানেই খাবো মা।”

হেনা হতাশায় ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছোট্ট করে “আচ্ছা।” বলে চলে যেতে নিলেই পিছু ডাকলো তুষার। হেনা পেছনে ফিরে তাকালেন। তুষার নরম গলায় প্রশ্ন করলো,
—“তুমি ভাত খেয়েছ মা?”

প্রশ্নটায় কি যেন ছিল। মন ভরে উঠলো উনার। ঠোঁটে অল্প হাসি ফুটিয়ে তিনি জবাব দিলেন,
—“খাবো। একটু পর।”
—“তোমার কয়েকটা শাড়ি পাঠিয়ে দিও মা। হৈমন্তীকার পরার কাপড় আনা হয় নি।”

ওমনি হেনা যেন ব্যস্ত হয়ে পরলেন। তুষারকে ক্ষীণ ধমক দিয়ে বললেন,
—“একি! আগে বলবি না? আমি আনছি। দ্বারা।”

হেনা যেতেই দরজা লাগিয়ে দিলো তুষার। হৈমন্তীকে আগের মতোই ভেঁজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
—“ঠান্ডা লাগছে হৈমন্তীকা? আপাতত আমার একটা টি-শার্ট পরে নিন। আমি এসি বন্ধ করে দিচ্ছি।”

_____

দুপুর গড়াতেই রুমে বসে থাকতে আর ভালো লাগলো না হৈমন্তীর। কতক্ষণ আর শুয়ে, বসে কাটানো যায়? তুষার মানা করা সত্ত্বেও তা অবজ্ঞা করে নিচে নেমে এলো সে। রান্নাঘরে তাকে দেখে অনেকটা অবাকই হলেন হেনা। বিস্মিত স্বরে বললেন,
—“হৈমন্তী, তুমি এখানে যে? কিছু দরকার ছিল?”

হৈমন্তী নিচু গলায় বললো,
—“এমনি। আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে হলো। কি বানাচ্ছেন আন্টি?”

হেনা হাসলেন। চুলার মাছগুলো উল্টিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বোকা মেয়ে। আন্টি বলছো কাকে? মা ডাকবে।”
কথার পিঠে হৈমন্তীও হাসলো। কিছু বলার আগেই আফতাব সাহেবের হাঁক শোনা গেল হঠাৎ। হেনা দ্রুত হাত চালিয়ে অন্য চুলা থেকে চায়ের কেতলি নামালেন। এক চামচ চিনি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা চা ঢাললেন কাপে। তারপর হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে অনুরোধের সুরে বললেন,
—“উনাকে একটু চা-টা দিয়ে আসতে পারবে হৈমন্তী? আমার হাতে কাজ তো! নয়তো আমিই যেতাম।”

হৈমন্তী করুণ চোখে তাকালো। তাকে যেতে হবে চা দিতে? হেনা তার সংশয় দেখে একটু হাসলেন। আবারও বললেন,
—“ভয় নেই। বকবে না। আমি কাল রাতে বুঝিয়েছি উনাকে।”

হৈমন্তী যেন একটু সাহস পেল। চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল ড্রইংরুমে। আফতাব সাহেব টিভি দেখছিলেন। তখনো হৈমন্তীকে খেয়াল করেননি তিনি। হৈমন্তী আমতা আমতা স্বরে বললো,
—“আপনার চা আঙ্কেল।”

টিভি দেখার মাঝেই ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। পাশ ফিরে হৈমন্তীকে দেখে তা যেন আরও গাঢ় হলো। গাম্ভীর্যের গভীরতা বাড়লো সেই সঙ্গে। তবে অবাক বিষয়, সত্যিই তাকে কিছু বললেন না আফতাব সাহেব। গমগমে মুখশ্রী নিয়ে একবার তাকালেন মাত্র। পরপরই বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন সেখান থেকে।

তুষারের দেখা মিললো এর কিছুক্ষণ পরই। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে উঁচু গলায় হৈমন্তীকে ডাকলো সে। রান্নাঘর থেকে গুটিগুটি পায়ে হৈমন্তী কাছাকাছি আসতেই বললো,
—“আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি হৈমন্তীকা। আপনি আর কতক্ষণ এখানে থাকবেন? মায়ের রান্না শেষ হয়েছে?”

হৈমন্তী মাথা দুলিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ। কোথায় যাচ্ছেন?”
—“টিউশন আছে। আপনি রুমে চলে চান। আমি না আসা অব্দি বের হবেন না। ঠিকাছে?”

হৈমন্তী এবারও মাথা দুলালো। বিস্তর হাসলো তুষার। হৈমন্তীকে কাছে টেনে কপালে অধর ছোঁয়ালো। কোমল স্বরে বললো,
—“নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো।”

বলে সে আর দাঁড়ালো না। ব্যস্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল ড্রইংরুম হতে।

_____

কোলাহলে পূর্ণ এলাকা বৃষ্টির কারণে বড্ড নিস্তব্ধ। দৌঁড়ে যে যার গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ছাতা হাতে ধীর পায়ে হাঁটছে রাস্তায়। উপভোগ করছে বৃষ্টিমূখর পরিবেশ। বারান্দার দরজা আটকে দিয়েছে হৈমন্তী। পানির ছিঁটায় ফ্লোর ভিঁজে যাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে আছে আধখোলা জানালার একপাশে। পরনে হলুদ রঙের জামদানি শাড়ি। শাড়িটা হেনা দিয়েছেন। ভীষণ সুন্দর দেখতে।
চিন্তায় মগ্ন হৈমন্তী তুষারের আগমন টের পেল না। তুষার নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। মৃদু স্বরে ডাকলো,
—“হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী ক্ষীণ চমকে পেছনে তাকালো। কাকভেঁজা তুষারকে দেখতেই আঁতকে উঠে বললো,
—“আল্লাহ! পুরো ভিঁজে গেলেন তো। ছাতা নিয়ে যান নি সাথে?”
তুষার হাতের ব্যাগগুলো ফ্লোরে রেখে বললো,
—“না। ভুলে গিয়েছিলাম।”

বলে হাতের ঘড়িটা খুলে রাখলো ড্রেসিংটেবিলে। শার্টের বোতাম খুলতে নিলেই ধমক দিয়ে উঠলো হৈমন্তী,
—“এখানে খুলছেন কোন আক্কেলে? ওয়াশরুমে যান।”

তুষার হাসলো। এক কদম হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে প্রথম তিনটে বোতাম খুলতেই উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠলো হৈমন্তী। তুষারের হাসির শব্দ বাড়লো। হাসির দমকে নেত্র কোণে গুটিকয়েক ভাঁজ পরলো, নাক লাল হলো ভীষণ। হৈমন্তী মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর স্বরে আবার বললো,
—“ফাজলামি না করে ওয়াশরুমে যান।”

তুষার পাত্তা দিলো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো,
—“আপনাকে রাগলে মারাত্বক লাগে হৈমন্তীকা। আসুন, কাছে আসুন। একটু ছুঁয়ে দেই।”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল হৈমন্তী। ক্ষীণ লজ্জায় মিইয়ে গেল। উঁচু গলায় বললো,
—“আপনি যাবেন?”

হাসতে হাসতে তুষারের জবাব,
—“যাচ্ছি। ব্যাগে আপনার জন্য শাড়ি এনেছিলাম। ভিঁজে গেছে সম্ভবত। একটু দেখুন তো।”

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here