#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২১
.
গভীর রাত। খোলা জানালা আর বারান্দা থেকে তরতর করে চাঁদের আলো প্রবেশ করছে রুমে। সেই সাথে শীতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডাও বিরাজ করেছে রুমটিতে। কম্বলের নিচে শুয়ে থাকা দীঘি আবদ্ধের গায়ের সাথে আরো ঘেঁষে তার বুকে মাথা রেখে আছে। আবদ্ধ কেমন জড় পদার্থের মতো চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে রয়েছে। আসলেই কি ঘুমিয়ে? দীঘি যে এখনো জেগে আছে! আবদ্ধ কেন ঘুমিয়ে গেল এত তাড়াতাড়ি। না! আবদ্ধ দীঘিকে রেখে ঘুমাতে পারবে না। ঘুমালেও তাকে জাগিয়ে দেবে দীঘি। এমন মনোভাব নিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে দীঘি বলে উঠল,
— “আবদ্ধ? ঘুমিয়ে গেছেন? উঠুন! আমি এখনো ঘুমাই নি। আপনিও ঘুমাতে পারবেন না। উ..ঠু..ন!”
শেষের বাক্যটা বেশ টেনে টেনে চেঁচিয়ে বলল দীঘি। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে আবছা ভাবে তাকালো আবদ্ধ। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে রাগি ভাব এনে বলল,
— “সমস্যা কি দীঘি? ঘুমাচ্ছিলাম!”
— “আমি ঘুমাই নি। আপনি কিভাবে পেরেছেন আমাকে রেখে ঘুমাতে? আমি যেহেতু জেগে আছি আপনাকেও জেগে থাকতে হবে।”
দীঘির কণ্ঠে তেজ আর অভিমান। এসব সহ্য করতে করতে যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে আবদ্ধ। মনের বিরুদ্ধে আর কত? তবুও শান্ত রইল সে। শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সেই ঝাঁঝালো কণ্ঠই বেরিয়ে এলো কণ্ঠনালি থেকে,
— “একটু বেশি বেশি করছো না দীঘি? তুমি টায়ার্ড না হলেও আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। ঘুম আসছে আমার। প্লীজ ঘুমাতে দাও।”
দীঘির মন গললো না। সে আরো জেদী ভাব নিয়ে বলল,
— “উহু! আমি যতক্ষণ ঘুমাবো না আপনিও ঘুমাতে পারবেন না।”
আবদ্ধ যেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে উঠল। কণ্ঠে রসিকতা এনে বলল,
— “ভূতের কাছে যাও তুমি। ওদেরও তোমার মত কোনো কাজ নেই। আজাইরা সব। তোমার আজগুবি কথা ওরা মন-প্রাণ সব দিয়ে শুনবে। ভূতেরাও নির্ঘুম রাত কাটাবে আর তুমিও। তাই টাইম ওয়েস্ট না করে ভূতেদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে আসো। শুধু শুধু আমাকে বিরক্ত করো না।”
দীঘি মলিন মুখ করে তাকিয়ে রইল আবদ্ধের দিকে। কাঁচুমাচু করে বলল,
— “আমি ঘুমাতে চাই কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। আপনি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে থাকলে আমার ভয় লাগে। প্লীজ ঘুমাবেন না।”
দীঘির অনুরোধ কাজে লাগলো এবার। আবদ্ধ ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে বলল,
— “সত্যি ঘুমাতে চাও?”
দীঘি ছোট্ট করে বলল,
— “হুঃ!”
আবদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ কি হলো কে জানে! দীঘিকে জাপটে ধরল সে। বুকের সাথে দীঘির মাথা চেপে ধরে দীঘির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল,
— “ঘুমাও। ভয় পাবে না, আমি তোমার আগে ঘুমাচ্ছি না।”
প্রশান্তির হাসি হাসলো দীঘি। আবদ্ধ আস্তে আস্তে দুর্বল হচ্ছে দীঘির প্রতি। নিজের এমন ভাবনায় নিজেই লজ্জায় আটখানা হয়ে উঠল। এরমধ্যে ঘুমানোর জন্য আবদ্ধের কড়া ধমক শুনতে পেল সে। সব ভাবনা দূরে ঠেলে ঘুমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অদ্ভুদ ভাবে, নিমিষেই ঘুমিয়েও পড়ল সে।
_____________________
হাড় কাঁপানো শীতে কম্বল থেকে বের হওয়াও যেন দায়। কম্বলের সাথে একদম আঠার মতো লেগে আছি আমি। শুনেছি শীতে নাকি রাতে ঘুম ভালো হয়? অথচ আমার ঘুম আসছে না। বার বার জানতে ইচ্ছে করছে, ‘রেয়ান ভাই কি কালকের মতো আজকেও বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন?’ উহুম! জানার এই অদম্য ইচ্ছেটা কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছি না আমি। একবার বাইরে গিয়ে দেখে আসলে কেমন হয়? কিছুক্ষণ ভেবে শেষে যাবো বলেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। একসাথে দু’টো চাদর গায়ে জড়িয়ে শীতে মৃদু কাঁপতে কাঁপতে বেড়িয়ে এলাম কটেজ থেকে। নিরাশ হলাম! রেয়ান ভাই বাহিরে নেই। হতাশ হয়ে আবারো কটেজে ফেরার জন্য উদ্যোগ হতেই পেছন থেকে ভারী কণ্ঠে কেউ বলে উঠল,
— “মিস মরুভূমি? জ্বীন জাতীয় কিছু ধরেছে নাকি তোমাকে? গভীর রাতে বাহিরে এভাবে হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছো কেন? আমার তো এখন তোমাকে ভয় লাগছে।”
প্রথমে ভারী কণ্ঠে বললেও শেষের কথাগুলো মজা করে বললেন সে। আমি পেছনে ফিরতেই অনেকটা চমকে গিয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলাম। আমার এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন রেয়ান ভাইয়া। কিন্তু এতক্ষণ তো উনি এখানে ছিলেন না। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলেন? আমার ভাবনার মাঝেই উনি আবারো বলে উঠলেন,
— “মিস! আমি জানি আমি সুন্দর। আমাকে পরেও দেখতে পারবে। ফাস্ট আন্সার দাও!”
ভাবনায় ছেদ ঘটলো আমার। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
— “আপনি এখানে কিভাবে? মানে, আপনাকে তো এতক্ষণ দেখিনি এখানে।”
উনি চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন আমার দিকে। পরক্ষণেই মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। সামান্য ঝুঁকে কণ্ঠকে মোটা করে বললেন,
— “আমি জ্বীন। তোমাকে শাস্তি দিতে এসেছি।”
বলতে বলতেই হেসে দিলেন উনি। হাসির তীব্রতা বাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
— “সিরিয়াসলি? তুমি দেখো নি আমায়? পাগলের ডাক্তারের বদলে দেখছি চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে তোমাকে।”
রেগে তাকালাম উনার দিকে। উনি আগের নেয়ই হাসছেন। ইচ্ছে করছে উনার চুলগুলো সব ছিঁড়ে ফেলতে। যেহেতু এমনটা করতে পারবো না সেহেতু বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পরপরই গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,
— “কোথায় ছিলেন আপনি? দেখিনি কেন আপনাকে?”
— “কটেজের দরজার সামনে বসে হেডফোনে গান শুনছিলাম। লাইট জ্বালানো নেই বিধায় দেখনি। অবশ্যক লাইট জ্বালানো থাকলেই বা কি? তোমার যে চোখ!”
কথা শেষ হবার আগেই চোখ পাকিয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনি মুচকি হাসলেন। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে বললেন,
— “তো? এত রাতে বাহিরে কি? ঘুমাবে না?”
আমি উদাসীন গলায় বললাম,
— “ঘুম আসছে না।”
একটু থেমে আবারো বললাম,
— “চলুন নদীর পাড়ে যাই।”
উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। মুহুর্তেই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “শীতের মাঝে নদীর পাড়? অসম্ভব! শীতে কাঁপছো তুমি। যাও ঘুমাতে!”
নিজ জায়গা থেকে একটুও নড়লাম না আমি। ত্যাড়ামো করে দাঁড়িয়েই রইলাম। উনি আরো কয়েকবার বললেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। অধৈর্য হয়ে তীব্র ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
— “তোমাকে যেতে বলেছি মরুভূমি!”
সিক্ত নয়নে উনার দিকে তাকালাম আমি। একরাশ অভিমানে অদ্ভুদভাবে চোখটা ভিঁজে এসেছে আমার।উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কাতর কণ্ঠে বললেন,
— “নির্ঘাত পাগল করে দিবে আমায়। এত এত অভিমান?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বললেন,
— “চাদর ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নাও নদীর পাড়ে যাচ্ছি আমরা।”
অভিমান মাথায় চড়ে গেছে আমার। তুমুল রাগ নিয়ে বললাম,
— “যাবো না আমি।”
সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটলো রেয়ান ভাইয়ের। আগের ফরমে ফিরে এলেন উনি। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “যাবে না?”
— “না।”
— “ঠিকাছে তাহলে।”
বলেই হাত চেপে ধরলেন আমার। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন সরু পথটার মাঝে। আমি শতবার মানা করার পরও শুনলেন না। উল্টো রেগে বললেন,
— “আর একটা কথা তো কাঁধে তুলে হাঁটবো একদম।”
বিস্ময়ে হা হয়ে আছি আমি। সে নিজের মতোই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আমায়। ১৫-২০ মিনিটের রাস্তা ১০ মিনিটে অতিক্রম করলাম আমরা। রাগে, অভিমানে মুখ ফুলিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। তার মুখেও গম্ভীর ভাব। কিছুক্ষণ যেতেই আড়চোখে তাকালাম উনার দিকে। আগের সেই গম্ভীর ভাব নেই এখন। উনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। নরম কণ্ঠে বললেন,
— “মরুভূমি? সামনে তাকাও।”
তার এমন আদুরে ডাক অগ্রাহ্য করতে পারলাম না আমি। সামনে তাকালাম। সাথে সাথে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আমার। বিশাল বড় নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। খোলা আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। যার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে নদীর পানিতে। প্রফুল্ল মনে একরাশ হেসে তাকালাম রেয়ান ভাইয়ের দিকে। উনি কেমন অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কিছু না বলেই হাত টেনে হাঁটতে লাগলেন উনি। এবার আর বাঁধা দিলাম না। হাঁটতে লাগলাম উনার সাথে। দু’জনেই চুপচাপ হাঁটছি। চুপচাপই আমরা! তবে আমাদের নিরবতা যেন অনেক কিছুই বলছে। কি? তা অজানা দুজনেরই।
০৬.
দেখতে দেখতে যাওয়ার সময় চলে এলো। পরেরদিন সকালেই কাপ্তাই থেকে সবাই দাদা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথিমধ্যে আংকেলদেরকে তাদের বাসায় নামিয়ে গেরাজ থেকে নিজেদের গাড়ি আর বাইক নিয়ে ফিরেছি আমরা। এবার বাইকে ইয়াসিন ভাইয়া আর সবুজ ভাইয়া বসেছেন বিধায় গাড়িতে একদম মাঝখানের সীটটায় জায়গা হয়েছে আমার। আর রেয়ান বসেছেন সামনে ড্রাইভারের সীটের পাশের সীটটায়।
এসেই সবাই লম্বা একটা ঘুম দিয়েছি। উঠতে উঠতে রাত ৮টা বেজে যায় আমার। শরীরে চাদর জড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে নিচে যেতেই ভ্রু কুঁচকে গেলো আমার। ড্রইংরুমে সবার মুখই কেমন থমথমে। কিছু কি হয়েছে? খোঁচা মেরে মেহেরুনকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল,
— “আব্রাহাম ভাইয়া নাকি সবুজের সাথে তার বাড়িতে যাবে কাল সকালে। কিন্তু মেজো চাচ্চু চাচ্ছেন না সেটা। আর আব্রাহাম ভাই উঠে পরে লেগেছেন যাওয়ার জন্য। এজন্যই মেজো চাচ্চু আর চাচীর মন খারাপ।”
আমি মেজো চাচ্চু আর চাচীজানের দিকে তাকালাম। উনারা মুখ কালো করে বসে আছেন সোফায়। এমনি হলে চাচ্চু যেতে মানা করতেন না। কিন্তু রেয়ান ভাই একবার সবুজ ভাইয়ার বাড়িতে গেলে ওখান থেকেই সোজা ঢাকায় চলে যাবেন। এখানে আর আসবেন না। এজন্যই চাচ্চু যেতে দিচ্ছেন না তাকে। কিন্তু রেয়ান ভাইকেও তো আটকানো সম্ভব নয়। সবকিছু বোধগম্য হলেও সবার কিছু করার নেই। শুধু দীর্ঘশ্বাসই ফেলতে পারবেন সবাই। আমারও যে ঢাকা যেতে ইচ্ছে করছে। কত কাজ বাকি ওখানে!
___________________
চলবে…