#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২৮
.
রাত ১২টা। রাগী ভাব নিয়ে বিছানার মাঝখানটায় বসে আছে আবদ্ধ। তখনই ওয়াশরুম থেকে মুখ মুছতে মুছতে বেড়িয়ে এলো দীঘি। আবদ্ধকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো প্রচুর। কোনো কিছু না বলে সোজা চলে গেল বারান্দায়। রাগে গা ঝিমঝিম করে উঠল আবদ্ধর। এত ইগনোর! হঠাৎ-ই পাশে থাকা কাঁচের গ্লাস ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো সে। প্রবল শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল যেন। মেজো চাচীও কয়েকবার ডেকে উঠলেন শব্দ শুনে। অথচ দীঘি একটাবার রুমেও এলো না। আবদ্ধ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
— “কিছু হয় নি আম্মু।”
সাথে সাথে মেজো চাচীর আওয়াজ কমে এলো। আবদ্ধ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। নিজেকে শান্ত রাখতে লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিলো সে। শান্ত হতেই দীঘিকে নরম কণ্ঠে ডাকলো। এবার রুমে এলো দীঘি। ফ্লোরে পরে থাকা কাঁচের টুকরো গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে আবদ্ধের দিকে তাকালো। অবাক হলো অনেকটা। আবদ্ধ এতো শান্তভাবে বসে আছে কেন? তার তো রেগে থাকার কথা। দীঘিকে আরো অবাক করে দিয়ে আবদ্ধ বলল,
— “তোমার সার্টিফিকেট গুলো রেডি রাখতে বলেছিলাম আমি। এখনো রেডি রাখো নি কেন? কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে নেই তোমার? থাকলে, সকালে যেন সব কিছু রেডি থাকে টেবিলে। আর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি আসছি।”
বলেই ধুপধাপ পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো আবদ্ধ। দীঘি বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তখনো। হচ্ছেটা কি এসব? মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। সে তো ভেবেছিল আবদ্ধ তার অভিমান ভাঙ্গাবে, কিন্তু.. ভাবতে ভাবতেই ফ্লোরে পরে থাকা কাঁচের টুকরো গুলো ডাস্টবিনে ফেলতে লাগলো সে।
ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে আবদ্ধ। শীতল হাওয়া তার সারা শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে। মুখে বিষণ্ণ ভাব নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবদ্ধ। দীঘি কেন তার সাথে এমন ব্যবহার করছে? ওইদিনের জন্য? সে তো ইচ্ছে করে ওসব বলেনি। সবার প্রতি একটু একটু করে জন্মানো ক্ষোপ না চাইতেও ঢেলে দিয়েছে দীঘির ওপর। হুট করে, হঠাৎ ভাবে কথাগুলো মুখ থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। সে দীঘিকে কষ্ট দিতে চায় নি কখনো। এসবেই মানিয়ে নিতে চেয়ে ছিল। চেষ্টা করছিল, করছে! বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। চোখ বন্ধ করে শীতের তীব্রতা অনুভব করতে লাগলো আবদ্ধ।
_____________
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দীঘি বুঝতে পারলো তার মাথা উঠা-নামা করছে। মুহুর্তেই প্রশ্ন জাগলো, সে কোথায়? একহাতে চোখ কঁচলে ভালোভাবে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করল আবদ্ধের বুকে। তড়িৎ গতিতে আবদ্ধের দিকে তাকালো দীঘি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে দীঘিকে জড়িয়ে ধরে আছে সে। হঠাৎ তীব্র লজ্জায় সজ্জিত হলো দীঘি। উফ! এত লজ্জা লাগছে কেন? দীঘি নড়েচড়ে উঠতেই আবদ্ধের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দীঘিকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবদ্ধ ভ্রু কুঁচকালো। তবে কিছু বলল না। দীঘিকে অবাক করে দিয়ে দীঘির কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো। পরপরই সময় নষ্ট না করে চলে গেল ওয়াশরুমে। বিস্ময়ে ‘হা’ গেলো দীঘি। এটা কি আদৌ আবদ্ধ-ই? নাকি কোনো এলিয়েন?
ভাবনার মাঝেই আবদ্ধের ঝাঁঝালো কণ্ঠ শোনা গেল,
— “ইউ হেভ টেন মিনিট’স দীঘি৷ দ্রুত নিজের সার্টিফিকেট টেবিলে গুঁছিয়ে রাখো। নতুবা সারা জীবনের জন্য পড়ালেখার কথা ভুলে যাও।”
দীঘির সন্দেহ মিটে গেলো। এটা আবদ্ধ-ই। তার নিরামিষ বর! ভাবতেই আনমনে হেসে উঠল দীঘি। আবারো আবদ্ধের তীব্র ধমক খেয়ে হেলতে, দুলতে নিজের সার্টিফিকেট খুঁজতে লাগলো।
১৩.
শীতের সকাল মানেই একটু দেড়িতে ঘুম থেকে ওঠা। সেক্ষেত্রে আমিও বেতিক্রম না। সকাল ১০টা বাজে অথচ বিছানায় গা এলিয়ে আছি এখনো। হঠাৎ ফোনের তীব্র ‘টু,টাং’ শব্দে আরামদায়ক ঘুমটা বিস্বাদে পরিণত হলো আমার। ঘুমু ঘুমু চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই ঘুম উবে গেলো আমার। দ্রুত উঠে বসলাম বিছানায়। কি-বোর্ডের অক্ষরগুলো চেপে প্রবল ক্ষোপ নিয়ে কেউ মেসেজ দিয়েছে,
— “নিশ্চয়ই ভুলে গেছো আমাকে? তাই একটু মনে করাতে চলে আসলাম। দিনকাল ভালো কাটছে তো? যত ভালো থাকার থেকে নাও মেয়ে। আমি তোমার জীবনে পুরোপুরি না এলেও যখন আসবো, ঘুম হারাম করে দেবো তোমার।”
বারবার পড়লাম মেসেজটা। দুদিন মেসেজ না দেওয়ায় সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম লোকটার কথা। কিন্তু এ লোক আমার সব খবরাখবর কিভাবে জানে? এমন কি মনের কথাও তার জানা। কে সে? জানতে ইচ্ছে করলেও জানার উপায় খোলা নেই! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম নিচে। বাসার প্রায় সব সদস্যই ড্রইংরুমে বসে আছেন। আমি গিয়ে মেজো চাচীর পাশে বসে পড়লাম। চাচীজান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “নাস্তা নিয়ে আসবো? খাবি এখন?”
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। বললাম,
— “তোমার হাতে খাবো।”
চাচীজানও মুচকি হেসে সায় দিলেন। তিনি চলে যেতেই সামনে তাকালাম আমি। রেয়ান নামক ভয়ংকর মানুষটা আমার ঠিক সামনে বসে। ভ্রু কুঁচকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আমায়। চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। পাশে বসে থাকা মেহেরুন তখন ভ্রু নাঁচিয়ে মুখ ভরা হাসি নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “কিরে মীরু? দিনকাল কেমন যায়?”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
— “মানে?”
এবার ইয়াসিন ভাইয়া বললেন,
— “মানে বুঝো না? ছোট খুকি? সবুজ ভাইয়া থেকে সব শুনেছি আমরা।”
একটু থেমে তিনি একরাশ বেদনা নিয়ে আবারো বললেন,
— “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মীরু। তুইও এই মেহুরুইন্নার মতো আমাকে একলা সিঙ্গেল রেখে চলে গেলি? এত সার্থপর তোরা? ছিঃ!”
আমি আর মেহেরুন পাত্তা দিলাম না ইয়াসিন ভাইয়ার কথায়। নিজেদের মতো গল্প করতে লাগলাম। এতে ইয়াসিন ভাইয়ার মুখ ফুলে বেলুনের মতো হয়ে গেলো মুহুর্তেই।
সকালে একটা কাজে আবদ্ধ চলে যায় বাহিরে। সম্ভবত দীঘির ভর্তির জন্য। বিকেলে আবদ্ধ বাসায় আসতেই সব ভাই-বোন মিলে ঘুড়তে বেড়লাম। দীর্ঘমান নদীর ঠিক মাঝখানটায় তৈরি একটা ব্রীজ। সেখানেই আমাদের গাড়ি থামলো। আশেপাশে মানুষের আনাগোনা প্রবল হলেও ভীড়ের মতো কোনো কোলাহল নেই। পাঁচ-ছয়টা ফুচকার দোকানও আছে এখানে। খোলা আকাশের নিচে বসে ফুচকার স্বাদ নিতে ব্যস্ত কিছু কিছু মানুষ। এসব দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না আর। পাশে কে দাঁড়িয়ে আছে তা না দেখেই বললাম,
— “আমি ফুচকা খাবো। কেউ এনে দাও আমায়।”
পাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলল,
— “এসব বাজে খাবার খেতে হবে না। চুপচাপ নদী দেখো।”
কথাটা মোটেও ভালো লাগলো না। আন্দাজ করতে পারছি কথাটা কার হতে পারে। আন্দাজ মতে পাশে তাকাতেই দেখলাম রেয়ান দাঁড়িয়ে। মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
— “আপনি না খেলে না খান। আমি খাবো।”
উনি ডান ভ্রু কুঁচকালেন। আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে বললেন,
— “তুমি জানো এগুলো কি দিয়ে বানায়? ময়লা – আবর্জনা আর নোংরা পানি দিয়ে। এগুলো খাবে তুমি?”
একবার রেয়ানের দিকে তাকিয়ে আরেকবার ফুচকার দিকে তাকালাম। উহু! ফুচকা না খেলে চলছে না। কতদিন পর চোখের সামনে পেলাম, হাত ছাড়া করে দেবো? কখনোই না। কঠিন কণ্ঠে বললাম,
— “একদম আমার ফুচকাকে বাজে বলবেন না। খেয়েছেন কখনো ফুচকা? কত মজার খাবার, আর আপনি..”
কথা শেষ হবার আগেই উনি বললেন,
— “খেতে মানা করেছি আমি।”
আমি মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে যেতে বললাম,
— “আমি খাবোই। আপনার কথা শুনবো নাকি?”
হুট করে আমার হাত শক্ত করে ধরে ফেললেন উনি। ফুচকার দোকানে গিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন আমায়। নিজে বসলেন আমার পাশের চেয়ারে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “ফুচকা খাবে তো। খাও!”
বলেই ফুচকাআলাকে বললেন এক প্লেট ফুচকা দিতে। এক প্লেট ফুচকা নিমিষেই খেয়ে ফেললাম আমি। তারপর আরো কয়েক প্লেট খেলাম। কিন্তু অবাক করা বিষয়, এত সময়ে একটা কথাও বলেন নি উনি। শেষের প্লেট থেকে ফুচকা খেতে খেতে উনার দিকে তাকাতেই ‘খু-খু’ করে কেশে উঠলাম। উনি কেমন সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যা প্রচন্ড অস্বস্তিতে ফেলছে আমায়। কয়েক সেকেন্ড আমায় কাঁশতে দেখে কিছু বললেন না রেয়ান। পরপরই থমথমে কণ্ঠে ফুচকাআলাকে বললেন,
— “মামা, পানি দিন ওকে।”
পানি পান করতেই যেন প্রাণ ফিরে পেলাম আমি। মুখ মুছে রেয়ানের দিকে তাকাতেই উনি আবারো বললেন,
— “আর ফুচকা খাবে?”
একটু অবাক হলেও সাথে সাথে মাথা ডানে-বামে নাড়ালাম। ফুচকার দাম মিটিয়ে আমার হাত টেনে দাঁড় করালেন উনি। হাত ছেড়ে দিলেন পরপরই। একপলক আমার দিকে তাকিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলেন। আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। উনি কি ভুলে গেছেন আমি উনার সাথে এসেছি? একবার বললেনও না ‘চলো!’ বিষয়টা ভালো না লাগলেও কিছু বললাম না। উনার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ উনি বললেন,
— “ঝাল তো কম খাও নি। ঝাল লাগছে?”
— “না। আমার অভ্যেস আছে।”
এরপর নিরবতা চলল আমাদের মাঝে। নিরবতা ভেঙ্গে বললাম,
— “একটা কথা বলি?”
— “না।”
— “বলি প্লীজ..!”
উনি একপলক তাকালেন আমার দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিলেন আবার। শান্তভাবে বললেন,
— “বলো।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
— “আপনি প্রথমে আমাকে ফুচকা খেতে মানা করছিলেন। আবার নিজেই খাওয়ালেন। কেন?”
তার সহজ উত্তর,
— “কারণ এরপর থেকে এসব জায়গায় তুমি আর ফুচকা খেতে পারবে না।”
অবাক হয়ে বললাম,
— “মানে।”
— “বাংলাতেই বলেছি।”
রেগে তাকালাম তার দিকে। মানুষটা সর্বদা ত্যাড়া কথা বলেন। বললেই বা কি? উনার কথা শুনছে কে?
___________________
চলবে…