যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৪৪

0
813

যাও পাখি বলো তারে

৪৪.
কেক কাটা, খাওয়ানো শেষ। দুপুরের খাবার খেতে আমরা সবাই নিচে চলে গেলেও রেয়ান আসেন নি। নিজের রুমে চলে এসেছেন। আমি ডাকতে চাইলে কড়া কণ্ঠে মানা করে দিয়েছেন উনি। করুণ চোখে মেজো চাচীর দিকে তাকালাম। চাচীজান ইশারায় আশ্বস্ত করলেন আমায়। একটা প্লেটে খাবার বেড়ে সেটা নিয়ে চলে এলেন রেয়ানের রুমে। রেয়ান সোফায় বসে ল্যাপ্টপে কি যেন করছিলেন। চাচীজান তার পাশে বসতেই চোখ তুলে তাকালেন। হাতে খাবারের প্লেট দেখে ফের চোখ ল্যাপ্টপে রেখে শান্ত স্বরে বললেন,
— “ক্ষুধা নেই আম্মু।পরে খাবো।”
— “অনেকদিন হলো আমার হাতে খেয়েছিস। আয়! এখন খাইয়ে দেই।”

রেয়ান মানা করতে পারলেন না যেন। চাচীজান এক লোকমা ভাত মুখের সামনে ধরতেই চুপচাপ খেয়ে নিলেন। খাওয়াতে খাওয়াতে চাচীজান বললেন,
— “রাগ করেছিস কোন ব্যাপারে?”

উনার থমথমে গলা,
— “রাগ করি নি।”
— “নিজের মায়ের কাছে মিথ্যা বলবি?”

চাচীজানের আহ্লাদী কণ্ঠ শুনে হালকা হাসলেন রেয়ান। আবারো বললেন,
— “তুমি তো সব দেখেছো আম্মু।”
— “কি দেখেছি?”
— “সকালে ওই ভদ্রমহিলা কিভাবে মীরাকে অপমান করেছিল দেখো নি? ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে এক সাথে এক টেবিলে খাওয়া নিষেধ আমার।”

মেজো চাচী হেসে বললেন,
— “বাব্বাহ্! কি রাগ! তা, মীরুকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কারণ কি এটাই?”

রেয়ানের ছোট্ট জবাব,
— “হয়তো।”

চাচীজান আবারো হাসলেন। খাইয়ে দিতে লাগলেন রেয়ানকে। এতটুকু সময়ে মা ছেলের মাঝে রাজ্যের কথা হলো। মুহুর্তটা দ্রুত কেটে গেলেও এর রেশ রইল বহুক্ষণ।

________________

দীঘি বিছানায় বসে বই পড়ছিলো। কোত্থেকে আবদ্ধ এসে পাশে বসলো তার। বলল,
— “কি করছো?”

দীঘি উত্তর দেয় না। আবদ্ধ আবারো জিজ্ঞেস করতেই দীঘি ধীর গলায় বলল,
— “বই পড়ছি।”
— “কি বই?”
— “উপন্যাস।”
— “কার লিখা?”

বিরক্ত হয় দীঘি। ভ্রু কুঁচকে তাকায় আবদ্ধের দিকে। তেজি কণ্ঠে বলে,
— “সমস্যা কি বলুন তো! জ্বালাচ্ছেন কেন?”

আবদ্ধ মুচকি হেসে বলল,
— “চলো গল্প করি।”

দীঘি কিছুক্ষণ চুপ থাকে। হঠাৎ-ই মলিন হাসে। ক্ষীণ গলায় বলে,
— “খুব ভালো লাগে তাই না আবদ্ধ? আমাকে জ্বালাতে এত ভালো লাগে আপনার? অথচ আমার মনের অবস্থা কেমন কখনো জানতে চেয়েছেন? বারবার কেন এমন করেন আবদ্ধ? আপনার সাথে কথা বলতে অসহ্য লাগে আমার। কষ্ট হয়। কেন বোঝেন না?”

অদ্ভুদ কারণে আবদ্ধর রাগ হয়। পুরোনো দিনের কথা সে ভুলে যেতে চাইলেও দীঘি মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। ব্যাপারটা মাত্রাধিক লাগছে আবদ্ধর কাছে। রাগ নিয়ন্ত্রিণ করতে লম্বা নিশ্বাস নেয় আবদ্ধ। স্থির দৃষ্টিতে দীঘির দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে। বলে,
— “দেখো দীঘি, যা হয়েছে আমি ভোলার চেষ্টা করছি। তুমিও করো। আমাদের নতুন করে সব শুরু করা উচিত।”

দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে দীঘি। দীর্ঘক্ষণ বড় বড় নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলে,
— “কিভাবে আবদ্ধ? সবসময় কিছু না কিছু হলে আপনি সেটা বাদ দিয়ে আবারো নতুন করে শুরু করতে বলেন। আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেন না। স্বামী হিসেবে শুধু দায়িত্বই পালন করছেন আপনি। অন্য কিছু কেন নয়?”

আবদ্ধ উত্তর দিতে পারে না। তার রাগ হচ্ছে নিজের ওপর, দীঘির ওপর। রাগের মাথায় পাশে থাকা বালিশ ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে সে। দীঘি ভড়কে যায়। টলমলে চোখে আবদ্ধর দিকে তাকিয়ে থাকে। আবদ্ধ দু’হাতে মুখ ঢেকে নিচের দিকে ঝুঁকে আছে। এভাবে কেটে যায় কিছু মুহুর্ত। মাঝে মাঝে দীঘির ফোঁপানোর শব্দ কানে আঘাত হানছে। মন আর মস্তিষ্ককে স্থির রেখে আবদ্ধ সোজা হয়ে বসে। দীঘির হাত ধরে ম্লান কণ্ঠে বলে,
— “তুমি কি আর একবার আমার হবে না দীঘি? আর একবার কি সুযোগ দেবে না? আমি ক্লান্ত এসবে। দিনশেষে এই তুমিটাকে পাচ্ছি না আমি। তুমি কি আমার হবে না?”

দীঘি কিছু বলতে পারে না কান্নায়। আচমকা জড়িয়ে ধরে আবদ্ধকে। আবদ্ধর বুকের সাথে নিজেকে লেপ্টে রাখে তীব্রভাবে। আবদ্ধও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে দীঘিকে। বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তার।

_________________

গভীর রাত। অথচ না ঘুমিয়ে রেয়ানের জন্য কফি বানাচ্ছি আমি। এটা অবশ্যক উনারই আদেশ। যা পালন করতে হচ্ছে আমায়। ঘুমু ঘুমু চোখে কোনোমতে কফি বানিয়ে দ্রুত পায়ে চলে এলাম উনার রুমে। উনি বিছানায় বসে ল্যাপ্টপে কাজ করছিলেন। আমি তার কাছে আসতেই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “পার্মিশন ছাড়া রুমে এসেছো কেন? ম্যানার্সল্যাস! পার্মিশন নিয়ে আবার রুমে আসো।”

রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলাম আমি। কখনো উনার রুমে পার্মিশন নিয়ে ঢুকেছি বলে তো মনে পড়ছে না। রেয়ানও তো কখনো বলেন নি। অথচ আজকে বলছেন। নিশ্চয়ই আমাকে জ্বালাতে করছেন এসব। আমিও ত্যাড়ামো করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি জোড়ে নিশ্বাস ফেলে সল্প ভাষায় বললেন,
— “আমি কিন্তু তোমায় কামড়ে দেবো মরুভূমি।”

ভড়কে গেলাম। দিক-বেদিক না দেখে সোজা চলে এলাম রুমের বাহিরে। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম ওভাবেই। তারপর দরজার ওপাশ থেকে মৃদু ভাবে বললাম,
— “আসতে পারি?”
কিছুক্ষণ পর উনার জবাব,
— “আসো।”

সঙ্গে সঙ্গে রুমে ঢুকে গেলাম আমি। উনার সামনে কফির মগ ধরতেই নিয়ে নিলেন সেটা। ল্যাপ্টপে কিছু ইংরেজী লেখা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে একটু পর পর পান করছেন কফি। আমি চলে যেতে নিলে উঁচু গলায় বলে উঠলেন,
— “যেতে বলি নি। পাশে বসো।”

গুটিসুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। ধীর গতিতে উনার পাশে বসলাম। উনি একমনে কাজ করছেন আর কফি পান করছেন। এদিকে শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছেন আমাকে। প্রবল আকারে বিরক্ত হচ্ছি। কিছুক্ষণ পর ল্যাপ্টপটা শব্দ করে বন্ধ করে এক নিশ্বাসে কফি শেষ করে ফেলেন উনি। আচমকা আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। আমার এক হাত নিজের চুলের মাঝে রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তারপর ওভাবেই ধীর গলায় বললেন,
— “মিউ-মিউ মরুভূমি? তুমি আমার জন্মদিনে কিচ্ছু দাও নি আমায়।”

অভিমানে ভরা তার কণ্ঠ। শুনে বড্ড হাসি পেলো আমার। তবে হাসলাম না। তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
— “১২টা বেজে শেষও হয়ে গেছে। তার সাথে আপনার বার্থডেও শেষ।”
— “তাহলে আজকে আমার দ্বিতীয় বিয়ে?”

কথাটা কেমন শোনালো না? হুট করে কেউ কথাটা শুনলে ভাববে, লোকটা দ্বিতীয় বিয়ে করছে। উনার বলার ধরণ শুনে রাগ হলো আমার। শক্ত করে চুল টেনে ধরলাম। চোখ বন্ধ অবস্থায় রেয়ান বাঁকা হেসে বললেন,
— “বাচ্চা বিড়ালের মতো বাচ্চামো শুরু করে দিয়েছো?”

উত্তর দিলাম না। এতে উনার হাসি আরো দীর্ঘ হলো যেন। নিঃশব্দে কিছু সময় হেসে তারপর বললেন,
— “মরুভূমি? চলো এক জায়গায় যাবো।”
ভ্রু কুঁচকে বললাম,
— “কোথায়?”

চোখ মেলে তাকালেন রেয়ান। আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তবে কিছু বললেন না। উঠে বসলেন। পরপরই আমার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন।

গ্রীষ্মকাল হলেও রাঙামাটির রাতের আবহাওয়াটা ঠান্ডা ঠান্ডা। অল্প শীত শীত লাগছে। এই অল্প শীতের মাঝে আমায় ছাদে নিয়ে এসেছেন রেয়ান। ফলে শীতটা আরো তীব্রভাবে লাগছে। শীত লাগার দরুণ অন্যদিকে খেয়ালই করছি না তেমন। ভাবনায় ছেদ করে রেয়ান ছাদের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড় করালেন আমায়। আশপাশের সৌন্দর্য দেখে চমকে উঠলাম। চাঁদের আলো তীব্রভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বিশেষ করে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে জ্যোৎস্না-টা আরো বেশি। সরাসরি চাঁদের আলো পড়ছে আমার শরীরে। আকাশের টিমটিম করা বড়, ছোট তারাগুলোকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে। এরমাঝে হুট করে আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলেন রেয়ান। চমকে উঠলাম। অবাক চাহনীতে তার দিকে তাকাতেই সে মুচকি হাসলেন। পকেট থেকে একটা আংটি বের করে আমার সামনে ধরলেন। কি হচ্ছে তা একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছি আমি। তবে কিছু বলতে পারছি না। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছি মাত্র।

রেয়ান একরাশ মুগ্ধ চাহনী নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। খানিকটা উত্তেজিত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলে উঠলেন,
— “মরুভূমি?
সে কি জানে তুমি আমার কে? সে কি জানে আমার জীবনে তোমার মূল্য কতটুকু? তাকে বলো, আমার সবটা জুড়ে তুমি। তাকে বলো, আমার সব স্বপ্নের উদ্দেশ্য তুমি। এই মরুভূমি? ক্যান ইউ বি মাই মিসেস এগেইন? ক্যান ইউ বি মাই লাভ ফর এভার, এভার, এভার এন্ড এভার?”

উনি বলা শেষ করলেন। অদ্ভুদ চাহনীতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ভেতরটা অনুভূতিতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলেও বাহিরটা আমার শূণ্য। পরক্ষণেই লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করল আমার মুখ। তার দিকে তাকাতেই পারছি না। উনি এবার একটু ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “এই মেয়ে? হাতটা কি দেবে এ জীবনে?”

লজ্জা আরো বেড়ে গেলো যেন। এই মুহুর্তেও তার বকা শুনতে হলো আমার? মস্তিষ্ক বিশ্রীভাবে গালাগালি করছে আমায়। ছিঃ বলছে। কষ্ট লাগলো। হাত দিলাম না তাকে। ভাবলাম, হয়তো রাগ ভাঙ্গাবেন। কিন্তু আমারো বুঝা উচিত ছিল, এ মানুষটার কাছে ভালো কিছু আশা করা একটা দুঃস্বপ্নের বেশি কিছুই না। হলোও তাই। রাগ ভাঙ্গানোর বদলে নিজেই আমার হাত নিজের কাছে টেনে নিলেন। অনামিকা আঙ্গুলে আংটি পড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমার কানের কাছে ঝুঁকে ঠোঁট কামড়ে হেসে বললেন,
— “তুমি পুরোনো হয়ে গেছো মরুভূমি। তাই দ্বিতীয় বিয়ে করছি। দাওয়াত রইলো।”

অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলাম মাত্র। চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেছে আপনা আপনি। উনি নিঃশব্দে হাসছে। কত বড় ফাজিল হলে এমন বলতে পারে একজন মানুষ। বেয়াদব লোক!

চটে গিয়ে জোড় গলায় বলে উঠলাম,
— “অসভ্য, অভদ্র, বাজে লোক!”
বরাবরের মতো উনার একই জবাব,
— “ধন্যবাদ, অসভ্যের বউ।”

__________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here