হৈমন্তিকা পর্ব – ২৮

0
361

হৈমন্তীকা

২৮.
রোদের কড়া উত্তাপে ঘেমে একাকার তুষারের শার্ট। শরীর মেজমেজ করছে। মাথায় যন্ত্রণার ক্ষীণ প্রলেপ। বাসার কলিংবেল কাজ করছে না। দু’তিনবার চাপলেও যান্ত্রিক গান/বাজনাগুলো শোনা যাচ্ছে না একদমই। নির্জীব সবটা। বার কয়েকবার দরজায় কড়া নাড়লো তুষার। মিনিট পেরোতেই রহিমা খালা দরজা খুলে দিলেন। তাকে দেখে কেমন অদ্ভুদ ভাবে তাকালেন। তুষার পাত্তা দিলো না সেসবে। সে এখন ভীষণ ক্লান্ত। রুমে গিয়ে একটু ঘুমানোই যেন এই মুহুর্তে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আফতাব সাহেব আজ কাজে যান নি। সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। তুষার একবার সেদিকে তাকালো। এরপর দেখেই নি এমন ভাব করে সিঁড়ির দিকে এগোতেই আফতাব সাহেব তার কড়া ডাকে থামিয়ে দিলেন তাকে। প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, “দুদিন পর কোথা থেকে আসা হচ্ছে তোমার? ভবঘুরে হচ্ছ নাকি রাস্তার বখাটে? নিজের বাসা থাকতে বাহিরে বাহিরে দিন পার করার সাহস কে দিলো তোমায়?”

তুষার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকালো। শীতল মেজাজ নিয়ে শান্ত স্বরে বললো, “শুধু নিজের বাসা থাকলেই হয় না বাবা। বাসায় শান্তিও থাকতে হয়।”
— “তুমি কি বলতে চাচ্ছো? এখানে শান্তি নেই? তো কোথায় আছে? ওই মেয়ের কাছে? শুনো তুষার, ওই মেয়ে ভালো না। টাকার জন্য তোমাকে ফাঁসাচ্ছে। তুমিও বোকার মতো কাঁটাযুক্ত রাস্তায় হাঁটছ।”

তুষারের শান্ত অভিব্যক্তিতে ক্ষীণ ঘাটা পরলো। দৃষ্টি প্রখর হলো, চেহারায় এলো কাঠিন্যতা। জবাবে ভীষণ হিম করা গলায় বললো,
— “আমি কাঁটাযুক্ত রাস্তায় হাঁটছি না বাবা। সুবাসে আচ্ছাদিত ফুলে পা রাখছি। নিস্বার্থ মেয়েটার কোমল হৃদয়ে নিজের স্থান তৈরির চেষ্টা করছি। উনি আমাকে ফাঁসায় নি বাবা। আমি ফাঁসিয়েছি উনাকে। যদি খারাপই হওয়ার হয়, তাহলে আমি খারাপ। উনি না।”

আফতাব সাহেব যেন তেঁতে উঠলেন। পরের মেয়ের জন্য নিজের প্রতি ছেলের এই অবহেলা সহ্য করতে পারছেন না। ছেলেটা তার কথা শুনতে চাইছে না কেন? আগের চেয়েও উচ্চশব্দে চেঁচিয়ে উঠলেন আফতাব সাহেব,
— “মেয়েটা যে তোমার কাছে ভালো সাজার চেষ্টা করে আমাদের থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, তা কি বুঝতে পারছো না তুমি? অন্ধ হয়ে গেছ? আমি কখনো তোমার খারাপ চেয়েছি? ভুল এডভাইস দিয়েছি কখনো?”
— “দেওয়ার আর কি বাকি রেখেছ? ছোট বেলা থেকেই তো দিয়ে আসছো।”

আফতাব সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকালেন। অপমান আর রাগে শক্ত হয়ে এলো উনার মুখশ্রী। ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে বললেন,
— “ওই মেয়ে তোমার ব্রেনওয়াস করে ফেলেছে। নিজের বাবার প্রতি ভড়কাচ্ছে। পাগল বানিয়ে ছেড়েছে তোমাকে। রাস্তার কুকুরও এর চেয়ে ভালো।”

তুষারের ইচ্ছে করলো না প্রতিউত্তরে কিছু বলতে। রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এসে আফতাব সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হেনার দিকে একবার দৃষ্টি ফেললো সে। নীরবে চলে গেল নিজ রুমে। আফতাব সাহেব বিড়বিড় করে উঠলেন, “বেয়াদব।”
হেনা কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারলেন না। স্বামীর ক্রোধে ভরা দৃষ্টি আর মেজাজ দমিয়ে দেয় তাকে। কপাল হাত রেখে সশব্দে বসে পরেন সোফায়। বাবা, ছেলের রেশারেশিতে বাজে ভাবে আটকে গেছেন তিনি। চিন্তায় মাথা ভীষণ ভাবে ব্যথা করছে উনার।

রুমে এসে আর হাত-মুখ ধুলো না তুষার। ঘর্মাক্ত শরীর, ধূলোবালিতে জর্জরিত পোশাক নিয়েই সটনা হয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়। পকেট থেকে ফোন বের করলো। পাওয়ার বাটন চাপতেই লকস্ক্রীনে হৈমন্তীকার শাড়ি পড়া একটা ছবি জ্বলজ্বল করে উঠলো। হৈমন্তী লাজুক হাসছে। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামবর্ণ মেয়েটাকে কি মায়াবী লাগছে! তুষার গভীর নয়নে চেয়ে রইলো। দৃষ্টিতে তার একসাথে মাদকতা, অস্থিরতা, গভীরতা আর অশান্ত মনের বেহায়া চাহনি। থেকে থেকে সূদীর্ঘ শ্বাস ফেললো তুষার। মিইয়ে যাওয়া গলায় কৃত্রিম হৈমন্তীকে বলতে লাগলো,
— “আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি হৈমন্তীকা। আমার তীর্থ মনটা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। প্রণয়ের দহনে আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি আমি। আমার হাতটা শক্ত করে ধরুন হৈমন্তীকা। টেনে আনুন আমায়। আমি আমার স্বস্তি ফিরে পেতে চাই। আপনার হাতে হাত রেখে সারাপথ হাঁটতে চাই। বিরতিহীন, মুগ্ধতার সঙ্গে—। হৈমন্তীকা? আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবেন? মাথা খুব যন্ত্রণা করছে। সহ্য করতে পারছি না।”

_____

রাত গভীর। তিনটা কি সাড়ে তিনটা।
দরজার খটখট শব্দে হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙ্গে গেল হৈমন্তীর। ডিমলাইটের ক্ষীণ আলোয় অস্পষ্ট রুমটিতে একবার চোখ বুলালো। কেউ নেই রুমে। আবার খটখট শব্দ হতেই হৈমন্তী কথা বললো, “কে? মা তুমি এসেছো?”

কিন্তু না! রাবেয়ার কোনো সারাশব্দ পেল না সে। একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারল, রুমের দরজা নয়, বরং বারান্দার দরজায় কেউ কারাঘাত করছে। হৈমন্তীর ঘুম পুরোপুরি উবে গেল এবার। মনে মনে ভয়াবহ ভীতিতে সিটিয়ে গেল সে। বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো। বারান্দার দরজার কাছাকাছি এসে চুপচাপ হয়ে রইলো। এবার খটখট শব্দের পাশাপাশি তুষারের গলার আওয়াজ পেল হৈমন্তী। চোখ একটু বা’দিকে যেতেই বিছানায় বেজে উঠা ফোনটা নজরে এলো। কল এসেছে ফোনে। তুষার তৈমুরের কল। হৈমন্তী নিশ্চিত হলো। দ্রুত দরজা খুলতেই অবিন্যস্ত, এলোমেলো তুষারকে ফোন হাতে দেখতে পেল। যার পরনের শার্টটা কুঁচকানো, চুল অগোছাল, ফ্যাকাশে – বিধ্বস্ত চেহারা। তাকে দেখেই সে বিরক্ত গলায় অভিযোগ করে উঠল,
— “আপনাকে বাসা পাল্টাতে বলেছিলাম হৈমন্তীকা। এই চিপাচাপা, বন জংগলে ভরপুর জায়গাটা দিয়ে বারান্দায় উঠতে পারছিলাম না আমি। এই দেখুন! হাত ছিঁলে গেছে আমার।”

বলে নিজের হাত এগিয়ে দেখালো তুষার। গোটানো শার্টের হাতার কুনুইয়ের একটু নিচে গভীর ভাবে ছিঁলে গেছে। মুহুর্তেই উদগ্রীব হয়ে উঠলো হৈমন্তী। উৎকণ্ঠা দেখালো তাকে। ব্যথাতুর নয়নে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় বললো,
— “আপনাকে এভাবে আসতে কে বলেছে তুষার? কল দিতেন, আমিই নিচে আসতাম। তাছাড়া আসারই বা কি দরকার ছিল? দেখুন, কি গভীর ভাবে ছিঁলে গেছে। আমি ঔষুধ আনছি, দাঁড়ান!”

হৈমন্তী চলে যেতে চাইলে বাঁধা দিলো তুষার। তাকেও টেনে বারান্দায় আনলো। জোড় করে মেঝেতে বসিয়ে আকস্মিক কোলে মাথা রেখে পা গুটিয়ে শুয়ে পরলো। শরীর শক্ত হয়ে এলো হৈমন্তীর। নিশ্বাস ভারি হলো। জড়োসড়ো হয়ে প্রচন্ড অস্বস্তিতে পরে গেল সে। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও, ওড়না ছাড়া তুষারের সামনে থাকাটা বড্ড অস্থির করে তুলছে হৈমন্তীকে। অথচ তুষার স্বাভাবিক। সে হয়তো বিষয়টা দেখেই নি।
তুষার হঠাৎ তার হাত টেনে নিজের চুলের ভাঁজে নিয়ে গেল। আবদার করে বললো, “চুলে হাত বুলিয়ে দিন হৈমন্তীকা।”

হৈমন্তীর সর্বত্র দেহ যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। মস্তিষ্ক চাইছে তুষারকে কোল থেকে উঠিয়ে দিতে। কিন্তু মস্তিষ্কের কথা শুনছে না হস্তজোড়া। পরিচালকহীন, নিজের মর্জি মতো হাত বুলাতে লাগলো তুষারের উষ্কখুষ্ক চুলে। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে মনে জোড় দিয়ে বললো,
— “হেমন্ত জেগে যাবে তুষার। আপনার যাওয়া উচিত এখন।”

প্রতিউত্তরে ঘুমে কাতর কণ্ঠ শোনা গেল, “চলে যাবো। আর একটু।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here