#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৭+18+19+20
.
তুর্বী অবাক হয়ে দেখছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিকে আর ভাবছে এই লোকটা এখানে কীকরে এল? কারণ ওর সামনে সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে। সৌহার্দ্যর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়াল তুর্বী। ও হা করে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। তুর্বী মুখ এক ইঞ্চি ফাঁক করে হা করে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য ওর মুখের সামনে তুরি বাজাতেই তুর্বী হকচকিয়ে গেল। সৌহার্দ্য ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” সবসময় এভাবে দৌড়দৌড়ি, লাফালাফি না করে চলতে পারোনা?”
তুর্বী গলা ঝেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” আপনি এখানে? এই কেবিনে কী করছেন? এই আমি যেখানে যাই সেখানেই আপনাকে থাকতে হয়? ফলো করছেন নাকি আমাকে? দেখুন আপনি যদি সেটা চিন্তাও করে থাকেন তো ভুলে যান। কারণ আপনি চেনেন না আমাকে। আমি রেগে গেলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। আপনি জানেন না আমি কী করতে পারি? তো আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করুন হ্যাঁ?”
সৌহার্দ্য এতক্ষণ হাত ভাজ করে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে শুনছিল। তুর্বীর কথা শেষ হতেই সৌহার্দ্য নিজের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
” তোমার বলা শেষ?”
তুর্বী ভ্রু কুঁচকে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে, এরপর বলল,
” হ্যাঁ শেষ। এবার বলুন আপনি এখানে কেন? আর স্যার কোথায়”
সৌহার্দ্য একটু হাসল। তারপর নিজের নাক স্লাইড করে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোমার স্যার ব্যাঙ্গালর আছেন আর আমি আজ থেকে আপনার বস, মানে স্যার।”
তুর্বী অবাক হয়ে বলল,
” আমার বসের তো আরো কিছুদিন পর যাওয়ার কথা ছিল। আর আপনি আমার স্যার কীকরে.. মানে আপনিই ওনার ছেলে?”
সৌহার্দ্য মেকি একটা হাসি দিয়ে বলল,
” জি। সৌহার্দ্য রায়হান, সান অফ শফিক রায়হান।”
কথাটা শুনেই তুর্বী একটু ঘাবড়ে গেল। বসের ছেলের সাথে মানে ওর বর্তমান বসের সাথে এভাবে কথা বলল? আর এর আগেও তো যতবার কথা হয়েছে ততবার এমন উট্কো ব্যবহার করেছে। এখন ওর কী হবে? এসবের জন্যে ওকে ফায়ার করে দেবে না তো? এসব ভেবে তুর্বী জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে বলল,
” সরি স্যার। আসলে আমি..”
এটুকু বলে মাথা নিচু করে রইল। কী আর বলবে? সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” ইটস ওকে। আসুন জরুরী কথাটা সেড়ে নেই?”
তুর্বী মনে মনে স্বস্তি পেল। যাক কোন ঝামেলা অন্তত হল না। সৌহার্দ্য নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। তুর্বীর মেজাজ ভীষণ খারাপ হল। এই লোকটাকেই ওর বস হতে হল? দুনিয়াতে কী বসের অভাব পরেছিল? এখন কী হবে কে জানে? সৌহার্দ্য বসতে বললেই তুর্বী গিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল। সৌহার্দ্য ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে বলল,
” আমি কাল রাতে তোমার মেইলটা ভালোভাবে রিড করেছি। ইট ওয়াস গুড! ইন ফ্যাক্ট ভেরী গুড। বেশ নতুনত্ব আছে। অনেক ইম্পর্টেন্ট আর ইউনিক ডিজাইন পেয়েছি। আমার ভালো লাগল তাই এপ্রুভ করলাম। ইউ আর সিলেক্টেড ফর আওয়ার নিউ প্রজেক্ট, ওয়েলকাম টু দা টিম।”
তুর্বী খুশি হয়ে হেসে দিয়ে বলল,
” থ্যাংকিউ স্যার। থ্যাংকস আ লট।”
” খুব তাড়াতাড়ি এই প্রজেক্ট নিয়ে মিটিং হবে। গ্রুপের সবাই যার যার প্লান বলবে। নেক্সট বিল্ডিং টা একটা অফিস রুমের জন্যে হবে। বিজনেস অফিস হবে। একটা ফাইল পাঠাচ্ছি তোমাকে ওটা পড়ে নিয়ে নিজের মত করে ডিজাইন করে নাও। ”
” ওকে স্যার।”
” হুম। বাট তোমার মেইল কোয়ালিটিতে বেশ গন্ডগোল আছে।”
তুর্বীর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ও ভয়ে ভয়ে বলল,
” কেন স্যার? কোন কিছু ভুল লিখেছি? আই মিন উল্টোপাল্টা কিছু?”
সৌহার্দ্য মাথা নেড়ে বলল,
” নাহ তেমন কিছুই না। কিন্তু লেখাগুলো বেশ ইনফরমাল ছিল। এটা তোমাকে মাথায় রাখতে হবে যে তুমি অফিসে তোমার সিনিয়রদের কাছে মেইল পাঠাচ্ছো, তোমার কোন বন্ধুকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ না। সো এতো ইনফরমাল হলে চলবেনা। তাই ওয়ার্ড সিলেকশনে একটু সতর্ক হবে। ল্যাঙ্গুয়েজ এতো কুল টাইপেরনা করে যথেষ্ট ফরমাল করবে। ক্লিয়ার?”
তুর্বী মাথা নেড়ে বলল,
” ওকে স্যার!”
” এন্ড ইয়েস! নট অনলি ওয়ার্ড সিলিকশন।”
কথাটা বলে সৌহার্দ্য তুর্বীর টিশার্টের দিকে তাকাল যেটাতে একটা কার্টুন দেওয়া। সৌহার্দ্যর দৃষ্টি অনুসরণ করে তুর্বীও তাকাল তাকিয়ে দেখল কার্টুনটা। ও বুঝে গেল সৌহার্দ্য কী বলতে চাইছে। ও অসহায় দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যর দিকে তাকাতেই সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বলল,
” দিস ইজ আ ওয়ার্কপ্লেস। লেটস রেসপেক্ট দ্যা ওয়ার্ক প্লেস।”
তুর্বী জোরপূর্বক এক হাসি দিয়ে বলল,
” ওকে স্যার।”
বলে কোনরকমে কেবিন থেকে দৌড়ে পালাল তুর্বী। সৌহার্দ্য তুর্বীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল আর মনে মনে ভাবল, ‘ অবশেষে ভাগ্য আমাদের আবার দেখা করালো, কালকে মেইল চেইক করতে গিয়ে তোমার মেইল পরেই তোমাকে চিনে ফেলেছিলাম। আর তোমাকে সোজা করতে একমাত্র আমিই পারব। নাও জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।’
_____________
বিহান আর রিখিয়া একে ওপরে মুখোমুখি বসে আছে একটা কফিশপে। রিখিয়া দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে আর বিহান গালে হাত দিয়ে দেখছে রিখিয়াকে। মেয়েটা একটু বেশিই লাজুক। অথচ এই লাজুকতাতেই বিহান না চাইতেই বারবার ঘায়েল হয়ে চলেছে। কিছুতেই বেড়োতে পারছেনা এই অনুভূতির জ্বাল থেকে। এদিকে রিখিয়া মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে, কেমন একটা লাগছে ওর। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,
” তো মিস, কফিতো অর্ডার করো? কোনটা খাবে?”
রিখিয়া নিচু কন্ঠে বলল,
” আপনি যেটা অর্ডার করেন।”
” এটা কোন কথা? তোমার তো পছন্দ আছে নাকি? ”
রিখিয়া আর কোন উপায় দেখতে না পেয়ে বলল,
” নরমাল মিল্ক কফি হলেই হবে।”
” শিওর তুমি?”
” হুম শিওর।”
বিহান ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্যে ব্লাক কফি আর রিখিয়ার জন্যে মিল্ক কফি ওর্ডার করে নিল। এরপর রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে ওর হাতের ওপর হাত রাখল। সাথেসাথেই একটু নড়ে উঠল রিখিয়া, অবাক দৃষ্টিতে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান মুচকি হেসে বলল,
” তুমি কী আনইজি ফিল করছ?”
রিখিয়া কী বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। ওর সত্যিই এবার অস্বস্তি হচ্ছে একটু কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা। বিহান রিখিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
” দেখ আমার সামনে এত হেজিটেশনের কিছু নেই। আমাকে নিজের বন্ধু ভাবতে পারো।”
রিখিয়া এবার চোখ তুলে ভালোভাবে তাকালো বিহানের দিকে। বিহান আবারও বলল,
” আমি এতোটাও খারাপ নই যে আমার সাথে বন্ধুত্ব করা যাবেনা। কী বল?”
রিখিয়া এখনও কিছু বলছেনা শুধু হাত কচলে যাচ্ছে। কী বলবে কী করবে বুঝতে পারছেনা। বিহান বলল,
” তুমি কী এখনও ভাবছ যে আমি ঐরকম ক্যারেক্টারলেস, বাজে টাইপের ছেলে।”
রিখিয়া হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
” এ মা ন্ না। আমি এরকম কিছুই ভাবছি না। আসলে..”
বিহান ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আসলে?”
” আসলে আমি এর আগে তুর ছাড়া কারো সাথেই এরকমভাবে ফ্রি হয়ে মিশিনি তো তাই__”
বিহান দুইহাতের ওপর থুতনি রেখে বলল,
” হুম তো কী হয়েছে? আজ থেকে আমার সাথে মিশবে?”
রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। এরমধ্যেই কফি চলে এল। বিহান আবার বলল,
” আচ্ছা সমস্যা নেই। কফি চলে এসছে। এবার তুমি কফি খেতে খেতে ভাবো যে আমার সাথে ফ্রেন্ডশীপ করা যায় কি-না। কফি শেষ হলে ডিসিশন জানিও।”
কথাটা বলে বিহান কফি খাওয়ায় মনোযোগ দিল। রিখিয়া মগ হতে নিয়ে ভাবছে বিহানের কথা। কী করা উচিতওর সেটাই ভাবছে। ছেলেটাযে খারাপ না সেটা ও একদিনে বুঝে গেছে। এখন প্রশ্ন হল ফ্রেন্ডশীপ করবে কী না? এসব ভাবতে ভাবতে কফি খাওয়া শেষ হয়ে গেল। রিখিয়া বিহানের দিকে তাকাল। বিহান মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” ফ্রেন্ডস?”
রিখিয়া ভাবছে ও কী করবে? হাত বাড়াবে? না-কি না? কোনটা ঠিক হবে?
#চলবে..
[ কয়েকদিন ব্যস্ততায় কাটছে তাই ছোট পর্ব দিচ্ছি। দু-একদিনের মধ্যে ফ্রি হয়ে গেলে আবার বড় পার্ট দেব। আশা করি সমস্যা বুঝবেন।]
#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৮
.
রিখিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে রিখিয়া। বিহানকে যতদিন রিখিয়া দেখেছে আর যতটুকু চিনেছে তাতে ওর কাছে খারাপ মনে হয়নি। তাহলে বন্ধুত্ব করতে তো কোন আপত্তি নেই। বরং এখন যদি রিখিয়া হাত না বাড়ায় সেটাই প্রচন্ড খারাপ হবে। বিহান ইনোসেন্ট চেহারা করে বলল,
” আরে কিছু তো বলো? আমার হাত তো ব্যাথা হয়ে গেল। ফ্রেন্ডশীপ করতে এরকম ভাবনায় মগ্ন হতে এই প্রথম কাউকে দেখলাম।”
রিখিয়া হেসে দিয়ে হাত বাড়িয়ে বিহানের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
” ফ্রেন্ডস।”
বিহান উচ্ছাসিত কন্ঠে বলল,
” দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।”
রিখিয়া মুচকি হাসল। দুজনেই বেশ অনেকটা সময় চুপ ছিল। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে রিখিয়া বলল,
” তাহলে আজ উঠি আমি?”
বিহান ভ্রু কুচকে বলল,
” উঠবে মানে কী হ্যাঁ? কোথায় উঠবে? এখনতো সবে অল্প কিছুক্ষণ হল। ফ্রেন্ডশীপ যখন করেছ তখন আজ লাঞ্চ অবধি আমার কাছে থাকতে হবে।”
” কিন্তু..”
” নো মোর কিন্তু। চলো এখন আপাতত বাইরে থেকে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।”
বলে রিখিয়ার হাত ধরে উঠিয়ে হাটা দিল। রিখিয়ার বিহানের ওর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা লাগছে ওর। যেরকম টা এর আগে কোনদিন হয়নি।
বিহান গাড়ি চালাচ্ছে আর মাঝেমাঝে শিশ বাজিয়ে যাচ্ছে। রিখিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে আর কিছুক্ষণ পরপর আড়চোখে বিহানকে দেখছে। বিহান গাড়িটা একটা শপিং মলের সামনে থামালো। রিখিয়া আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
” এখানে থামালেন কেন?”
বিহান সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বলল,
” না নামলে বুঝব কীকরে?”
রিখিয়া কোন কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। বিহান আবারও রিখিয়ার হাত ধরেই হাটতে হাটতে মলের ভেতরে নিয়ে গেল। বিহান রিখিয়াকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে একটা জুয়েলারির দোকানে গেল। সেখানে গিয়ে একটা এটা ওটা দেখতে শুরু করল। রিখিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। বিহান কী করতে চাইছে বুঝতে পারছেনা ও। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে বিহান একটা হালকার ওপর পেন্ডেন্ট খুঁজে নিল। রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
” এটা কার জন্য?”
বিহান মুখে হালকা হাসি রেখে রিখিয়াকে ধরে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিল। রিখিয়া অবাক হয়ে ঘুরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর গলায় পেন্ডেন্টটা পরিয়ে দিল বিহান। রিখিয়া চরমভাবে অবাক হল। পেন্ডেন্টটা পরানো শেষ হওয়ার পরেই রিখিয়া অবাক হয়ে ঘুরে বিহানের দিকে ঘুরে বলল,
” এটা..”
” আমাদের বন্ধুত্বের প্রথম দিন এটা তাই আমার পক্ষ থেকে ছোট্ট গিফট।”
” এটার কী দরকার ছিল?”
” আমার বন্ধুকে আমি গিফট করছি। সেটা নিশ্চয়ই তোম কাছে পার্মিশন নিয়ে করব না।”
রিখিয়া মুচকি হাসল। কিছু একটা ভেবে বলল,
” কিন্তু আমি তো আপনার জন্যে কিছুই…”
” আরে ছাড়োতো। সময় আর সুযোগ মত দিয়ে দিও। তাহলেই হবে। এবার চলো তোমার এখানের কাজ আপাতত শেষ।”
বলে অাবারও রিখিয়ার হাত ধরে বাইরের দিকে হাটা দিল। রিখিয়া বারবার নিজের গলায় হাত দিচ্ছে। আর বিহানের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটাকে একেবারে নতুন করে আবিস্কার করছে ও। এরপর বিহান রিখিয়াকে নিয়ে বেশ অনেক্ষণ ঘুরলো। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে পায়ে হেটেই ঘুরেছে ওরা। হাটতে হাটতে রাস্তায় বিক্রি হওয়া খাবারও হাটতে হাটতে খেয়েছে দুজনে। আর এই কয়েকঘন্টাতে বিহান এমনভাবে মিশেছে আর কথা বলেছে যে রিখিয়াও এখন অনেকটাই ফ্রি হয়ে গেছে বিহানের সাথে। লাঞ্চ করে রিখিয়াকে ওর ফ্লাটের সামনে ড্রপ করে দিল বিহান। রিখিয়া ‘বাই’ বলে নামতে গেলেই বিহান বলল,
” আবার কবে দেখা হচ্ছে?”
” যেদিন আপনি চাইবেন।”
” নাম্বারটা সেভ করে রেখ।”
রিখিয়া মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল। বিহান রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
_____________
সৌহার্দ্য আজ অফিস থেকে ফিরে সোজা বিহানের ফ্লাটেই গেল। কারণ ওর মন যখন সবচেয়ে বেশি খারাপ হয় বা সবচেয়ে বেশি ভালো হয় তখন ও বিহানের কাছেই আসে। আজ ওর মনটা খুব ভালো। কারণ হয়ত তুর্বীকে পেয়েছে তাই। তুর্বীর সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ও ভাবতেও পারেনি। তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে মেয়েটাকে পাওয়ার ইচ্ছা ছিল ওর। ও চাইলেও এটা অস্বীকার করতে পারছেনা যে ঐ একটা রাতে ও মেয়েটার প্রতি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পরেছে। বিহানের ফ্লাটে ঢুকে সৌহার্দ্য দেখল বিহান সোফায় হেলান দিয়ে বসে আরামে পপকর্ণ খেতে খেতে মুভি দেখছে। সৌহার্দ্য বুঝতে পারল আজ বিহানও বেশ আনন্দে আছে। কিন্তু ওর আনন্দের কারণটা কী? সৌহার্দ্য ভেতরে গিয়ে ব্যাগটা রেগে বিহানের পাশে বসে টাই খুলতে খুলতে বলল,
” কী ব্যাপার এতো খুশি যে?”
বিহান হেসে পপকর্ণ মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল,
” আমিতো নতুন কোন মেয়ে পেলেও খুশি হয়ে যাই। তোর মন ভালো কেন সেটা বল। তুইতো মামুর অফিসে বসতেই চাইতি না। আজকে বসলি তাও এত ভালো মন নিয়ে ফেরত আসলি?”
সৌহার্দ্য পপকর্ণ হাতে নিয়ে বলল,
” তুর্বী আমার একজন এম্লয়ী।”
বিহান অবাক হয়ে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
” লাইক রিয়েলি।”
” আমিও অবাক হয়েছিলাম। একটা সুযোগ খুঁজছিলাম ওর সাথে দেখা করার কিন্তু এভাবে পেয়ে যাবো সেটা ভাবিনি।”
” ওয়াও ব্রো। কিন্তু তুই মেয়েটাকে কেন খুঁজছিলি সেটা বলতো?”
সৌহার্দ্য সোফায় হেলান দিয়ে হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
” সেটাইতো এখনও জানিনা ভাই!”
বিহান হালকা বাঁকা হেসে আবারও পপকর্ণ মুখে ঢুকিয়ে বলল,
“জেনে যাবে, জেনে যাবে। কী হল সেটা বল।”
সৌহার্দ্য বিহানকে সবটা বলল অফিসে ঠিক কী কী হয়েছে, সবটা শুনে বিহান হাসতে হাসতে সোফা থেকে পরে যাবে এমন অবস্থা। সৌহার্দ্যও মুচকি মুচকি হাসছে। হাসতে হাসতে বিহান বলল,
” তুই তো এক সপ্তাহে মেয়েটাকে সোজা করে দিবি।”
” সোজা করার জন্যেই তো এতকিছু।”
” দেখ, ওকে সোজা হতে দেখে তুমি না বাঁকা হয়ে যাও।”
সৌহার্দ্য বিহানের পিঠে থাপ্পড় মেরে বলল,
” চুপ যাহ।”
” আপু চলে গেছে?”
” হ্যাঁ আজ সকালেই গেছে। রাতে ফোন করবে।”
” আজ থাকবি এখানে?”
” হুম।”
” চল আজ আবার তাহলে রান্নার এক্সপিরিমেন্ট করা যাক?”
” চলো ভাই!”
এরপর দুই ভাই মিলে আবার ছুটল রান্নাঘর ওলোটপালট করতে।
_____________
তুর্বী আলমারি খুলে সব জামাকাপড় গুলো বার করছে আর ছুড়ে ছুড়ে এদিক ওদিক ছড়াচ্ছে। রিখিয়া ভ্রু দেখছে ওকে। তুর্বী সব এলোমেলো করেই যাচ্ছে। রিখিয়া এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
” কী করছ বলোতো?”
তুর্বী ড্রেস দেখতে দেখতে বলল,
” আরে কাল অফিসে যাওয়ার জন্যে ড্রেস লাগবেতো না কী?”
” হ্যাঁ তো সব এলোমেলো করার কী আছে?”
” তোকে তো বললাম তুর। আমার বস মানে বিহানের বন্ধু ঐ সৌহার্দ্য রায়হান কী কী বলেছে।”
রিখিয়া হাসল। ও তুর্বীকে আগেও বলেছিল যাতে অফিসে এসব কার্টুন-ফার্টুন, বাচ্চাটাইপ, ইনফরমাল পোশাক পরে না যায়। কিন্তু তুর্বী শুনতোনা। কিন্তু সৌহার্দ্য একদিনেই শুনিয়ে ছেড়েছে। রিখিয়া এসব ভাবতে ভাবতে তুর্বী সৌহার্দ্যকে অনুকরণ করে বলল,
” ইট’স আ ওয়ার্কপ্লেস, লেটস রেসপেক্ট দা ওয়ার্কপ্লেস। হুহ, আরে ভাই কাজের সাথে পোশাকের কী কানেকশন কেউ আমাকে বোঝাবে প্লিজ!”
রিখিয়া ফিক করে হেসে দিল। তুর্বী বিরক্ত হয়ে বলল,
” হাসিস না রিখু। হেল্প মি ইয়ার।”
রিখিয়া হাসতে হাসতেই বলল,
” আচ্ছা সরো দেখছি।”
রিখিয়া অনেক্ষণ খুঁজে একটা একটা ফর্মাল ড্রেস বের করে তুর্বীর হাতে দিয়ে বলল,
” নাও এটা পরো তাহলেই হবে।”
তুর্বী নাক কুঁচকে বলল,
” দূর! এখন এসব পরে যেতে হবে অফিসে। ওই লোকটার জীবনে ভালো হবেনা, দেখে নিস।”
রিখিয়া বিছানায় বসে বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ আমার মহামানবী, আপনার বাক্য তো ব্রহ্মবাক্য তাইনা?”
তুর্বী জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ সেটাই হবে। এবার বলতো বিহানের সাথে ডেট কেমন গেল?”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” ডেট?”
” না মানে দিনটা কেমন ছিল?”
” ভালোই। লোকটাকে আজ অন্যরকমভাবে আবিষ্কার করলাম জানিস। বাইরে দিয়ে একটু অন্যরকম ঠিকই কিন্তু মন বেশ ভালো।”
” হুমম, বুঝলাম যে তুই..”
বলতে বলতে তুর্বীর চোখ রিখিয়ার গলায় যেতেই তুর্বী বলল,
” এই এটাতো তোর পেন্ডেন্ট না। পেন্ডেন্ট টা কে দিল?”
রিখিয়া পেন্ডেন্টটায় হাত দিয়ে একটা লাজুক হাসি দিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
” বিহান দিয়েছে।”
তুর্বী হেসে দিয়ে রিখিয়ার থুতনি ধরে বলল,
” ওলে আমার লজ্জাবতীরে। এখনই এত লজ্জা হুম?”
এটুকু বলে হাসতে হাসতে হঠাৎই রিখিয়া মুখটা গোমড়া করে ফেলল। গোমড়া মুখ নিয়েই বলল,
” আমারই কপালে কিছু জুটছেনা। দুনিয়াতে কী একটা জিনিস নেই যে আমার শর্তে রাজি হয়ে রিলেশনে আসবে!”
রিখিয়া মজা করে বলল,
” কেন? তোমার বস আছেতো। তাকেই বেছে নাও।”
তুর্বী বিস্ফোরিত চোখে তাকাল রিখিয়ার দিকে। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” নট আ ব্যাড আইডিয়া! এটাতো ভাবিই নি আমি। মাঝেমাঝে মজার ছলে কাজের কথা বলিস তুই। ইয়াপ!”
রিখিয়া অবাক হয়ে তাকাল তুর্বীর দিকে। ও তো মজা করেছিল তুর্বীর সাথে মেয়েটাতো সিরিয়াসলি নিয়ে নিল।
#চলবে…
#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৯
.
তুর্বী চুপচাপ বসে একটা মডেল ড্র করছে আর আড়চোখে মাঝেমাঝে সৌহার্দ্যকে দেখছে। আজ সৌহার্দ্যর কেবিনে বসে বসেই কাজ করছে এই। এই প্রজেক্টে ও নতুন তাই সৌহার্দ্যর কাছে বসেই সবটা বুঝে নিচ্ছে। বেশ অনেকটা সময় কাজ করার পর লম্বা একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল তুর্বী। সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। নিজের বসের সামনে বসে এমন করে কেউ? এমন কেন মেয়েটা? তুর্বীর চোখ সৌহার্দ্যর দিকে পরতেই দ্রুত ঠিকঠাক হয়ে বসল ও। লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে তাই ক্যান্টিন থেকে ও দুজনের জন্যেই খাবার আনালো সৌহার্দ্য। দুজনে একসাথেই খেতে শুরু করল। খাওয়ার মাঝে হঠাৎ করেই তুর্বী বলে উঠল,
” আচ্ছা স্যার আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”
সৌহার্দ্য চামচ মুখের কাছে নিয়েও সরিয়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে অবাক হয়ে তাকাল তুর্বীর দিকে। তুর্বী হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
” না মানে আমিতো জাস্ট এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। এখন তো আর কাজ করছিনা তাই।”
বলতে বলতে গলার আওয়াজ কমে এল ওর। সৌহার্দ্য দুই হাতের ওপর নিজের থুতনি রেখে বলল,
” আমি তোমার বন্ধু? নাকি বেয়াই যে এসব গল্প করতে চাইছ আমার সাথে?”
তুর্বী উৎসাহিত হয়ে বলল,
” হতে সমস্যা কোথায় বলুন। দেখুন যেকোন সম্পর্কের সাথে যদি বন্ধুত্বের সম্পর্ক মিশে থাকেনা তাহলে সম্পর্কটা পারফেক্ট হয়। যেমন আপনার আর আমার মধ্যে বস এম্প্লয়ীর সম্পর্ক। এখন যদি তার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কও মিশে যায় তাহলে আমাদের বস এম্প্লয়ীর সম্পর্কটাও পারফেক্ট হবে।”
সৌহার্দ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল,
” তোমার বলা শেষ?”
” বলুননা গার্লফ্রেন্ড আছে?”
” সেটা জেনে তুমি কী করবে?”
” নাহ এমনিই জানার জন্যে।”
সৌহার্দ্য আবার খাওয়া শুরু করে বলল,
” চুপচাপ খাও, লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাবে।”
” স্যার বলুন না।”
সৌহার্দ্য এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলল,
” তুর্বী চুপচাপ খাও।”
তুর্বী কোন কথা না বলে মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করল। সৌহার্দ্যর খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। ও গালে হাত দিয়ে দেখছে তুর্বীকে দেখছে। ও জানে তুর্বী কেন এই প্রশ্ন করেছে। এখন তাহলে নিজের রিলেশনশীপের এক্সপিরিমেন্ট করতে বলির বাকরা ওকেই বানাতে চাইছে তুর্বী? ভাবতেই প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে ওর। তবুও অনেক কষ্টে হাসিটা আটকে মুখে গাম্ভীর্য রেখে দিয়েছে।
_____________
ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে মার্কেটে ঢুকেছে রিখিয়া। টুকটাক কিছু জিনিস কিনতে হবে ওকে। দোকানে ঘুরে ঘুরে জিনিস কিনছে আর নাকের নিচের ঘামটা মুছে নিচ্ছে ও। হঠাৎ করেই মাথায় কেউ টোকা মারতেই অবাক হয়ে পেছনে ফিরে তাকাল রিখিয়া। তাকিয়ে দেখে বিহান দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি মুচকি হাসছে সে। রিখিয়া হেসে দিয়ে বলল,
” আপনি এখানে?”
” এসছিলাম কাজে। ভাগ্যক্রমে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল।”
বলে রিখিয়ার হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে রিখিয়া হাটতে শুরু করল, বিহানও হাটছে ওর পাশেপাশে। রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ভালো আছেন?”
” হুম আছিতো। তোমার কী খবর?”
” এইতো চলে যাচ্ছে।”
” তুর্বী কেমন আছে?”
” হুম ভালো।”
” কী খাবে বল?”
” না না কিছুই খাবো না।”
” সেটা বললে হবেনা । খেতে হবে। কারণ আমার এখন খিদে পেয়েছে। আর আমি আগেও বলেছি আমার একা খেতে ভালো লাগেনা।”
” পাগল আপনি?”
” হ্যাঁ ওই একটুখানি। বেশি না।”
রিখিয়া হেসে দিল, বিহানও হাসল। হাটতে হাটতে ওরা ওখানেরই একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট টাইপ দোকানে বসল। রোল আর চা ওর্ডার করল দুজনেই। রিখিয়া কিছু বলছেই না, বিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” ইউ নো তুমি অনেকটা ডাউন টু আর্থ টাইপ! আজকালকার দিনে এরকম খুব একটা দেখা যায় না। বাট ইউ নো আই লাইক ইট!”
রিখিয়া একটু হাসল। বিহান আবারও বলল,
” আচ্ছা তোমার বিএফ বা এইটাইপ কিছু আছে?”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” কেন বলুন তো?”
” এমনিই জানতে চাইলাম। না বলতে চাইলে সমস্যা নেই আই ওন্ট মাইন্ড।”
রিখিয়া হেসে দিয়ে বলল,
” বলার মত তেমন কিছুই নেই। আমার ওসব নেই।”
বিহান উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
” আমার আগেই মনে হয়েছিল আমার কাছে তুমি এমন কিছুই বলবে।”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” মানে?”
” মানে তোমাকে দেখে সেরকম মেয়ে মনে হয়না সেটাই বললাম।”
রিখিয়া এবার কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
” আপনার জন্যে একটা জিনিস আছে।”
বিহান অবাক হয়ে বলল,
” আমার জন্যে?”
” হুম কিছু দেওয়ার ছিলতো? আমি এমনিতেও আপনার সাথে দেখা করতাম কিন্তু আজ দেখা হয়ে গেল। তাই দিয়ে দেওয়াই ভালো।”
বিহান এক্সাইটেড হয়ে বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ দেখাও কী এনেছ।”
রিখিয়া ওর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বড় প্যাকেট বাড় করে বিহানের কাছে দিল। বিহান বেশ উৎসাহ নিয়েই প্যাকেটটা খুলল। প্যাকেটটা খুলে বেশ অবাক হলো। কারণ একবক্স রঙের টিউব আর তুলি আছে। বিহানের সত্যিই খুব পছন্দের জিনিস এগুলো। ও হাসি মুখে রিখিয়ার দিকে তাকাতেই রিখিয়া বলল,
” আপনার তো পেন্টিং করতে খুব ভালোলাগে তাইনা? তাই এটা আপনার জন্যে।”
বিহান প্যাকেটটা নিজের কাছে রেখে বলল,
” থ্যাংক ইউ।”
রিখিয়া একটু আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আচ্ছা আপনি কখনও কোন মেয়ের ছবি এঁকেছেন?”
বিহান বেশ অনেকটা সময় চিন্তা করার ভান করে বলল,
” এখনও তো না। কিন্তু যদি কোনদিন আঁকি তাহলে তোমার টাই আঁকব। প্রমিস।”
রিখিয়া একটু লাজুক হাসল। বিহান বলল,
” তবে একটা সমস্যা আছে।”
” কী সমস্যা?”
” লোকে বলবে অবশেষে আমি একটা পেত্নীর ছবি এঁকেছি।”
রিখিয়া অবাক হয়ে তাকাল বিহানের দিকে। তারপর বিহান গায়ে তিন চারটা কিল মারল। বিহান হাসছে শব্দ করে। রিখিয়াও একপর্যায়ে হেসে দিল।
______________
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। একয়েদিনে অনেককিছু বদলেছে। রিখিয়া আর বিহানের সম্পর্ক অনেক নরমাল হয়েছে। বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওদের। বলতে গেলে তার চেয়েও বেশি কিছু। আর ওপরদিকে তুর্বী আর সৌহার্দ্যর বস এম্প্লয়ীর সম্পর্ক না বদলালেও তুর্বী নিজের অদ্ভুত বিহেভিয়ার দিয়ে বেশ জালিয়েছে ওকে। তবে ওপর দিয়ে রেগে যাওয়ার ভান করলেও মনে মনে বেশ এঞ্জয় করে তুর্বীর এসব বিহেভিয়ার। আজ ওদের প্রজেক্টের ফার্স্ট মিটিং হচ্ছে। প্লান প্রেজেন্ট করা হয়ে গেছে সবাই মিলে সেই নিয়েই সৌহার্দ্যর সাথে ডিসকাস করছে। এরমধ্যে হঠাৎ করেই তুর্বী বলে উঠল,
” স্যার? আমার মনে হয় আমাদের প্লানে একটু চেঞ্জ অানা দরকার।”
সবাই সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল তুর্বীর দিকে। এত দক্ষ আর্কিটেক্টদের প্লানে চেঞ্জ আনতে চাইছে এই মেয়েটা? তাও এত কমদিন জয়েন করে। সৌহার্দ্যও অবাক হচ্ছে। কিন্তু বলার সুযোগ তো দিতে হবে তাই বলল,
” কীরকম চেঞ্জ?”
তুর্বী বলল,
” স্যার আমাদের অফিসের স্টাফ রুমটার যেই ডিজাইন করেছি সেটা আরেকটু কমফরটেবল করা উচিত যাতে এম্প্লয়ীরা অফিসে একটু রিল্যাক্সে কাজ করতে পারে।”
সৌহার্দ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল,
” কীরকম?”
তুর্বী এবার ওনাদের বিভিন্ন কিছুর সাথে কম্পেয়ার করে, এক্সামপল দিয়ে সবটা বোঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু কেউ বুঝতে পারল না। এমনকি সৌহার্দ্যও না। ওর পয়েন্ট কারো কাছেই ক্লিয়ার না। কারণ তুর্বী সব উট্কো এক্সামপশ দিচ্ছে যেমন, ওয়াসরুম, নাইট ক্লাব ইত্যাদি টাইপ। সৌহার্দ্য ভাবল এবারও হয়ত তুর্বী ফালতু টাইম ওয়েস্ট করছে এস ইউসয়াল। তাই হুট করেই ধমক দিয়ে বলল,
” স্টপ ইট!”
তুর্বী কেঁপে উঠল হালকা। সৌহার্দ্য রাগী গলায় বলল,
” এটা অফিস! তোমার মজা করার জায়গা না। কাজ করতে ইচ্ছে হলে কর নয়ত ছেড়ে দাও চাকরি। সবকিছু সবার জন্যে না। আর সবকিছু নিয়ে মজা করাও ঠিক না। এত মজা করার শখ থাকলে সার্কাস জয়েন কর। ইটস বেটার ফর ইউ।”
তুর্বী আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে ওর ওপর। তুর্বী কিছু না ফলে ওর ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেল রুম থেকে।
#চলবে…
#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২০
.
তুর্বী চলে যাওয়ার পর সৌহার্দ্য নিচের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। এরপর চারদিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। সৌহার্দ্য বুঝতে পারছে যে একটুবেশিই রুড হয়ে গেছে ও মেয়েটার সাথে। কিন্তু এখনতো আফসোস করে লাভ নেই। যা করার তা তো করেই ফেলেছে। মেয়েটা একটু দুষ্টুমি করে ঠিক আছে তাই বলে এভাবে সবার সামনে ইনসাল্ট করাটা ঠিক হয়নি। ওর সাথে কথা বলতে হবে। সৌহার্দ্য সবার দিকে তাকিয়ে একটা গম্ভীর স্বরে বলল,
” স্টপ লাফিং।”
সবাই সাথেসাথেই চুপ করে গেল। সৌহার্দ্য পুনরায় একই স্বরে বলল,
” মিটিং আজকের মত ক্যান্সেল।”
এটুকু বলে সৌহার্দ্য উঠে বেড়িয়ে গেল কনফারেন্স রুম থেকে। বেড়িয়ে প্রথমে নিজের কেবিনে গিয়ে ল্যাপটপ রেখে এরপর সোজা স্টাফ রুমে চলে গেল তুর্বীর সাথে কথা বলতে। কিন্তু তুর্বীর ডেস্কে গিয়ে দেখে তুর্বী নেই। তুর্বীকে দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হল সৌহার্দ্য। তাহলে কী অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে নাকি মেয়েটা। সৌহার্দ্য দ্রুত নিজের ফোন বেড় করে তুর্বীর নম্বরে ডায়াল করল। কিন্তু তুর্বীর ফোন রিসিভ করছে না। বারবার ডায়াল করার পরেও কোন লাভ হলোনা। ফোন বাজছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। সৌহার্দ্য নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল। মিস ভয়ংকরী ভীষণ ক্ষেপেছে। রাগ ভাঙনো এবার মুশকিল হবে। কী কী করতে হবে কে জানে? ‘ অল দা বেস্ট সৌহার্দ্য বেটা’ নিজেই নিজেকে এই কথাটা বলে সান্ত্বনা দিল সৌহার্দ্য।
তুর্বী সিএনজির পেছনে বসে বসে একটু পরপর নাক টানছে। ওর নাক লাল হয়ে আছে। কিন্তু ওর চোখে জল নেই। তুর্বী যখন কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে তখন ওর চোখ আর নাক এমন লাল হয়ে যায়। ফোন বেজে চলেছে অনেক্ষণ যাবত কিন্তু তুর্বী ধরছে না দেখছেও না কে ফোন করেছে। প্রচন্ড রেগে আছে ও। ও এমনিতে কেমন ও জানেনা। কিন্তু নিজের কাজ নিয়ে ও যথেষ্ট সিরিয়াস। ও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। আর তাছাড়াও এটা ওর স্বপ্ন। আর ওর স্বপ্নটা যে ওর কাছে কী সেটা একমাত্র ওই জানে। সেখানে ঐ লোকটা ওকে সবার সামনে এভাবে কীকরে বলল? এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে ওর কোন যোগ্যতাই নেই। আচ্ছা? সত্যিই কী সব ভুলভাল বকছিল? ওর কোন যোগ্যতাই নেই? সিএনজির ড্রাইভার বলল,
” ম্যাম স্টানে চলে এসছি এবার কোনদিকে যাবো?”
তুর্বী রেগে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
” জাহান্নামে চলুন।”
” অ্যা?”
” হ্যাঁ। জাহান্নামের রাস্তা চেনেন? চিনলে সেদিকেই চলুন।”
সিএনজি ড্রাইভার বোকার মত তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। কিছুক্ষণ পরও যখন সিএনজি চলছেনা তখন তুর্বী প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলল,
” এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে চলুন? হা করে দেখছে।”
ড্রাইভারও এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
” কোনদিকে যাবো?”
তুর্বী আগের চেয়ে দ্বিগুন রেগে বলল,
” ডানে চলুন না ভাই।”
ড্রাইভার চোখ ঝাপটে একটা লম্বামত শ্বাস ফেলল। তারপর ডানে টার্ন করল। কিন্তু মনে মনে ভাবছে যে কোন পাগলকে এনে গাড়িতে তুলেছে ওপরওয়ালা জানেন। তুর্বীর সেদিকে কোন পাত্তা নেই ও ওর মত বসে রাগে ফুসছে আর কান্না আটকে রাখার জন্যে জোরে জোরে নাক টানছে।
______________
রিখিয়া আর বিহান একটা পার্কে পাশাপাশি বসে বসে বাদাম খেতে খেতে মাঝেমাঝে হালকাপাতলা গল্প করছে। বিহান নিজেই বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে রিখিয়াকে। রিখিয়া বিকেলবেলা অফিস থেকে বেড়োনোর পরই দেখেছে বিহান দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। এটা এখন মাঝেমাঝেই হয়। ওরা মাঝমাঝেই একেওপরের সাথে ঘোরে, দেখা করে, সময় কাটায়। আজও এখানে এসছে সময় কাটাতে। কিছুক্ষণের নিরবতার পর বিহান বলল,
” আচ্ছা তোমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই আপাতত?”
রিখিয়া একটু অবাক হয়ে বলল,
” বিয়ে?”
” হ্যাঁ বিয়ে। এখনতো তুমি জব করছো। মোটামুটি সেটেল হয়ে গেছ লাইফে। এবার একটা পার্টনার খুঁজে নিতে হবে তাইনা?”
রিখিয়া মুচকি একটুখানি হেসে বলল,
” সবসময় চাইলেই কী বিয়ে করে ফেলা যায়?”
” কেন যাবেনা কেন?”
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমারটা ছাড়ুন। আপনিও তো এখনও বিয়ে করেন নি। আপনিও তো করতে পারেন।”
” কালসাপ ঘরে তুলতে বলছ?”
রিখিয়া চমকে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কীহ?”
বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা একটু হেসে বলল,
” হুম, আর তাদের সেই বিষ কালসাপের বিষের চেয়েও ভয়ংকর। এতটাই ভয়ংকর যে না মেরেও সারাজীবনের মত মেরে দেয়। শ্বাস তো চলে কিন্তু দেহে প্রাণ থাকে না।”
রিখিয়া ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। কী বলতে চাইছে? কালসাপ কাদের বলছে? মেয়েদের? রিখিয়ার মুখ দেখে সাথেসাথেই শব্দ করে হেসে দিল বিহান। কোনমতে নিজের হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল,
” আরে ইয়ার আই ওয়ার জাস্ট কিডিং। আমার কথা এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন?”
রিখিয়া লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বিহানের কাধে একটা চাপড় মেরে বলল,
” এরকম করে কেউ? কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
বিহান এখনও হাসছে। বিহানের হাসি দেখে রিখিয়াও হেসে দিল। হাসার সময় কত সুন্দর লাগে ছেলেটাকে তাকিয়েই থাকতে মনে চায়। কিছুক্ষণ হাসার পর হাসি থামিয়ে বিহান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” চল ওঠো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ফিরবে না?”
রিখিয়াও হ্যাঁ বলে উঠে দাঁড়াল। দুজনে কিছুক্ষণ হাটার পর হঠাৎ করেই একটা মেয়ে এপ্রকার দৌড়ে এল বিহানের কাছে। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
” বিহান! এখানে কী করছ তুমি? তুমি সেই বলেছিলে ফোন করবে কিন্তু এখনও করনি।”
রিখিয়া চোখ ছোট ছোট করে দেখছে দুজনকে। বিহান মেকি হেসে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে রিখিয়ার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে বলল,
” না আসলে ইদানিং একটু বেশিই ব্যস্ত থাকি তো তাই। সরি হ্যাঁ?”
” আরে ছাড়োতো। আজ ফ্রি আছোতো? আসব তোমার ফ্লাটে?”
বিহান কী বলবে বুঝতে পারছেনা বারবার শুধু রিখিয়াকে দেখছে। রিখিয়ার এবার প্রচন্ড পরিমাণ রাগ হচ্ছে। কিন্তু কেন রাগ হচ্ছে সেটা জানেনা তবে মেয়েটার বারবার বিহানের গায়ে পরতে দেখে মাথা গরম হয়ে উঠছে ওর। ও তো ভেবেছিল বিহান বদলে গেছে। কিন্তু এখনও কী এরকমই আছে। মেয়েটা রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আর ও কে? তোমার সাথে এখানে কী করছে?”
রিখিয়া দাঁত করমর করে বিহানের দিকে একটু তাকিয়ে কোন কথা না বলে লম্বা লম্বা পা ওখান থেকে চলে গেল। বিহান ঐ মেয়েটাকে বলল,
” আমি আসছি। বাই।”
মেয়েটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিখিয়ার পেছনে ছুটলো। বিহান পেছন থেকে রিখিয়াকে ডেকে যাচ্ছে কিন্তু রিখিয়া শুনছে না নিজের মত করে হেটে যাচ্ছে। বিহান দৌড়ে দৌড়ে রিখিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাফানো কন্ঠে বলল,
” আরে দাঁড়াও। এত জোরে হাটো কীকরে? আ’ম টায়ার্ড।”
রিখিয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,
” পথ ছাড়ুন।”
বলে যেতে নিলেই বিহান আবার পথ আটকে বলল,
” আরে আমার কথাটাতো শুনবে ইয়ার!”
” কী শুনবো হ্যাঁ? আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনি এখন এসব আর করেন না। কিন্তু আপনিতো একটুও বদলান নি। একচুয়ালি আপনার মত ছেলেরা বদলায়ও না। ভুলটা আমার ছিল যে আমি ভেবেছিলাম আপনি সুধরে গেছেন।”
বলে রিখিয়া যেতে নিলেই বিহান ওর হাত চেপে ধরে কাছে এনে বলল,
” কী ভাব নিজেকে? একাই দেখবে? একাই শুনবে? একাই বুঝবে? একাই বলবে? আরে আমাকেও তো এক্সপ্লেইন করতে দেবে? মেয়েটা কী বলেছে কানে শোননি? অনেকদিন হল যোগাযোগ করিনা ওর সাথে। মানেটা বুঝতে পারছ না? এগুলো সব পাস্ট। আরে আমার তো ওর নামটাও মনে নেই ইয়ার।”
রিখিয়ার এবার হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা যদি শোনে বিহানের ওর নামটাও মনে নেই নিশ্চয়ই হার্ট এটাক করবে। বিহান বলল,
” কী হল এখন দাঁড়িয়ে আছ কেন যাও?”
রিখিয়া খানিকটা ইতস্তত করে বলল,
” আসলে..”
” কোন আসলে নকলে নয়। এক মিনিট।”
বলে রাস্তা থেকে একটা সিএনজি থামিয়ে একপ্রকার জোর করেই রিখিয়াকে তুলে দিল। রিখিয়া এত করে কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু বিহান শুনলোই না। বরং ড্রাইভারকে বলে সিএনজি চালাতে বলে দিল। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়েও দিলেন। রিখিয়া মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আসলেই ও একটা গাধা। কিছু না বুঝে শুনেই রিঅ্যাক্ট করে ফেলে। বিহান তো রেগে গেছে এখন রাগ কীকরে ভাঙাবে কে জানে?
#চলবে…
[ ‘বর্ষণের সেই রাতে’ গল্পটা সাড়ে বারোটার পরে দেব। ]