জল ফরিঙের খোঁজ – পর্ব ২১-২৫

0
218

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২১+22+23+24+25
.

রাত বেশ হয়েছে। মার্চ মাস তাই হালকা গরম গরম ভাব আসছে। রিখিয়া আর তুর্বী পাশাপাশি শুয়ে আছে। রিখিয়া শান্ত হয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে আছে মন খারাপ করে। কিন্তু তুর্বী তখন থেকে ছটফট করেই যাচ্ছে। কখনও এদিক ঘুরছে, কখনও ওদিক। এভাবেই চলছে। বেশ অনেকটা সময় পর রিখিয়া বলল,

” এমন করছ কেন? মন খারাপ?”

” তোরও তো মন খারাপ।”

রিখিয়া তুর্বীর দিকে ঘুরে বলল,

” হবেনা? বিহানের সাথে অকারণেই মিসবিহেভ করে ফেলেছি।”

তুর্বী লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” করার আগে মনে ছিলনা? আর তোর এত জ্বলছিল কেন হুম হুম?

” প্লিজ এখন আবার শুরু করিস না।”

” সরি বলে দে। তাহলেই তো হয়।”

” আরে ফোনটাই তো ধরছে না।”

” ডিরেক্ট দেখা করে নে।”

” হ্যাঁ এখন দেখছি সেটাই করতে হবে। তোমার কী হয়েছে?”

তুর্বী রিখিয়ার দিকে ভালোভাবে ঘুরে বলল,

” কিছুনা।”

রিখিয়া তুর্বীর চুলে আঙ্গুল নাড়তে নাড়তে বলল,

” এমনি এমনি মন খারাপ তুমি করবে না। আই নো। কিন্তু হয়েছেটা কী? অফিসে কিছু হয়েছে?”

তুর্বী মুখ গোমড়া করে উঠে বসে বলল,

” ঐ খবিশ মার্কা বসটার জন্যেই সব হয়েছে।”

রিখিয়া বেশ অবাক হল। সৌহার্দ্য আবার কী করল? ও ভ্রু কুচকে উঠে বসে বলল,

” কেন উনি আবার কী করল?”

” আমাকে সবার সামনে অপমান করেছে। সেটা করলেও ভালো ছিল। আমার ওয়ার্কিং স্কিলকেও ইনসাল্ট করেছে। আমি নাকি এই কাজের যোগ্য না।”

রিখিয়া চোখ ছোট করে বলল,

” তুমি কী করেছিলে? সে তো শুধু শুধু এসব বলবে না রাইট?”

” এবার আমি কিচ্ছু করিনি। আই সোয়ার?”

” উনি এমনিই বকলো?”

তুর্বী মুখ ছোট করে মাথা হালকা চুলকে বলল,

” আমাদের নেক্সট প্রযেক্টে বিল্ডিং এর ডিজাইনে একটু চেঞ্জেস্ আনতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার আইডয়া ওনাদের ভালো লাগেনি। বাট আই সোয়ার আমার প্লানটা সবচেয়ে বেস্ট ছিল।”

রিখিয়া হাত ভাজ করে বলল,

” তুমি নিশ্চয়ই ঠিকভাবে প্রেজেন্ট করোনি। কিংবা এমন কিছু বলেছ যার জন্যে সৌহার্দ্য রেগে গেছিল।”

তুর্বী অনেকটা অবাক হয়ে বলল,

” বাঃ রে এখন আমার দোষ হয়ে গেল? এই তুই আমার বন্ধু নাকি ঐ সৌহার্দ্য রায়হানের?”

রিখিয়া হালকা হাসল তারপর বলল,

” আমি মিঃ সৌহার্দ্যকে না চিনলেও তোমাকে খুব ভালোভাবে চিনি। তাই তুমি উল্টোপাল্টা কিছু করতেই পার।”

” দূর!”

বলে চুপচাপ শুয়ে পরল। রিখিয়াও শুয়ে পরে বলল,

” আচ্ছা শোন আমার কথা। তুমি সৌহার্দ্যর সাথে কথা বল। আমার মনে হয় লোকটা একটু ফরমাল টাইপ। কাজ নিয়ে জোকস্, হাসি-মজা এসব পছন্দ করেন না। তুমি তোমার প্লানটা একটু ফর্মাল টাইপে প্রেজেন্টেশন এর মাধ্যমে ওনাকে বোঝাও, দেখবি ঠিক পছন্দ করবে। এবং এপ্রিশিয়েট ও করবে।”

তুর্বী অনেকটা অবাক হয়ে রিখিয়ার দিকে ঘুরে বলল,

” মানে যেই কথাটা আমি নরমালি, আনন্দের সাথে, একটু মজা নিয়ে বললে ভালো লাগতো না সেই একই কথা আমি ফরমাল ওয়েতে বললে ভালো লাগবে? কী অদ্ভুত রুলস ইয়ার।”

” এতো কথা না বলে যা আমি বললাম তাই করে দেখ।”

” পারবোনা। ওনার চেয়ে S.R. অনেক গুন বেশি ভালো। অন্তত এত রুড না।”

” বাহবা! এখন S.R. ভালো হয়ে গেলো?”

” হ্যাঁ হয়েছে। এখন ঘুমা তো।”

রিখিয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল। কাল গিয়ে বিহানের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে হবে। আজ শুধু শুধুই উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছিল। বারবার ছেলেটাকে ভুল বুঝে হার্ট করে ফেলে। কিন্তু ওর কেন এত রাগ হচ্ছিল তখন? বিহানতো শুধুই ওর ফ্রেন্ড। তাহলে অন্য মেয়ের সাথে দেখে ও এতো রিঅ‍্যাক্ট কেন করল? এরকম করার তো কোন কথা ছিল না।

______________

বিহান আর সৌহার্দ্য লং ড্রাইভে বেড়িয়েছে। আজ ওদের দুজনেরই মন খারাপ। আর ওদের মন খারাপ হলে আর খুব ভালো হলে ওরা দুজন মিলে লং ড্রাইভে যায়। এখন একটা বড় মাঠে বসে আছে দুজন। বিহান বিয়ারের বোতলে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে বারবার। অনেকটা সময় পর সৌহার্দ্য বলল,

” পিচ্চু অনেক হয়েছে এবার থাম।”

” নেশা হচ্ছেনা ব্রোহ!”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বলল,

” নেশায় টলছিস তুই টলরেডি।”

বিহান একটু হাসল। সৌহার্দ্যও চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিহান বোতলে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলল,

” ওরা এমন কেন ব্রো? আমার গোটা লাইফটা শেষ করে দিয়েছে। আমার বাবা, মা, মামু সবাইকে কেড়ে নিয়েছে। আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। আমার জীবন থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। দে আর উইচ। আই হেইট ডেম। আই জাস্ট হেইট দেম।”

সৌহার্দ্য স্হির দৃষ্টিতে তাকাল বিহানের দিকে। বিহানের চোখে চিকচিক করা পানিটা স্পষ্ট দেখতে পেল ও। একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। ছেলেটাতো এরকম ছিল না। সত্যিই কী এরকম একটা জীবন ওর পাওনা ছিল? আজ ও পুরো মেয়ে জাতটাকেই ঘৃণা করে। যদিও ওর জায়গায় দাঁড়ালে ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছুই না। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে সৌহার্দ্য বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” পিচ্চু তোর মনে এখনও এই ধারণা থাকলে রিখিয়ার সাথে ফ্রেন্ডশীপ কেন করেছিস? ওও তো একজন মেয়ে।”

বিহান আরেকটু হেসে বলল,

” ও তো.. ওকে তো..”

এটুকু বলতে বলতে বিহান ঘুমিয়ে পরল। সৌহার্দ্য ‘ পিচ্চু, পিচ্চু’ বলে কয়েকবার ডেকেও সাড়া পেলনা। দুহাতে বিহানকে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। কিছুক্ষণ বিহানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” এমন কিছু করিস না পিচ্চু যার জন্যে সবার মত আমাকেও তোকে ছেড়ে দিতে হয়। তোকে ছেড়ে দেওয়া আমার কাছে মৃত্যুর চেয়েও বেশি কষ্টকর হবে। মেরে ফেলিস না আমায়।”

কিছুক্ষণ ওখানে বসিয়ে রেখে সৌহার্দ্য বিহানকে ধরে উঠিয়ে গাড়িতে তুলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করতে শুরু করল। মনটা প্রচন্ড রকম খারাপ হচ্ছে। প্রথমত বিহান। আর দ্বিতীয়ত তুর্বী সারাদিনেও ওর ফোন ধরেনি। কাল অফিসে আসবে তো? নাকি জব ছেড়ে দেবে? এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে ওর।

_____________

সৌহার্দ্য অফিসে বসে কাজ করছে আর বারবার সিসি টিভিতে স্টাফ রুম চেক করছে। কিন্তু তুর্বীর দেখা নেই। মনটা অস্হির হয়ে উঠছে। তুর্বী কী সত্যিই আর আসবেনা? না আসলে ওর কী? ওর কেন এত খারাপ লাগছে? তুর্বীতো একটা সামান্য স্টাফ। এরচেয়ে বেশি কিছুতো না। এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বীকে দেখতে পেল ও। সবে ডেস্কে এসে বসেছে। সাথেসাথেই মুখে হাসি ফুটে উঠল ওর। দ্রুত পিওন দিয়ে ডেকে পাঠালো তুর্বীকে। বেশ অনেকটা সময় পর দরজায় কেউ নক করে বলল,

” মে আই কাম ইন?”

সৌহার্দ্য সাথে সাথেই বলল,

” ইয়াহ কাম।”

তুর্বী গম্ভীর মুখে ভেতরে এলো। সৌহার্দ্য ইশারা করতেই চেয়ারে বসে বলল,

” কিছু বলবেন স্যার?”

সৌহার্দ্য দুইহাত একত্র করে তার ওপর থুতনি রেখে বলল,

” তুমি কী শিওর যে আমাদের প্লানে তুমি যেই চেঞ্জেস আনতে চাইছিলে সেটা পার্ফেক্ট?”

তুর্বী একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” সেটাকি এখন মেটার করে?”

” অবশ্যই করে। তাইতো জানতে চাইছি।”

” আমি আমার কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস স্যার। তাই আমি অবশ্যই কোন ইউলেস কথা বলব না।”

” কাল মিটিং ক্যান্সেল করে দিয়েছি। আজ বিকেলে আবার হচ্ছে। তুমি যেই চেঞ্জগুলোর কথা বলছ সেটা প্রেজেন্টেশন আকারে অফিসিয়াল ওয়েতে সবার সামনে প্রেজেন্ট করবে।”

তুর্বী একই ভঙ্গিতে হেসে বলল,

” কেন? এবার কী ঘটা করে অপমান করবেন?”

” ভেবে নাও আমার করা আপমানের যোগ্য জবাব দেওয়ার একটা সুযোগ পাচ্ছ।”

তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকাল। স‍ৌহার্দ্য হেসে বলল,

” ইয়েস। সরি বলবনা তোমাকে। কারণ সরি বললেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না। তাই একটা সুযোগ দিচ্ছি। প্রুভ ইউর সেলফ। এন্ড প্রুভ দ্যাট আই ওয়াজ রং।”

সৌহার্দ্যর কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুর্বী। সৌহার্দ্য আবার বলল,

” তোমার হাতে সময় খুব কম আছে। যাও আর প্রেজেন্টেশন রেডি কর।”

তুর্বী কিছু না বলে চুপচাপ উঠে চলে গেল। সৌহার্দ্য তুর্বীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা করে একটা শ্বাস ফেলল। ও এখন বুঝতে পারছে তুর্বী অন্তত অফিসিয়াল ব্যাপারে কোন ভুলভাল কথা বলবে না। আর ওর মন বলছে আজ বিকেলে তুর্বী যোগ্য জবাব দেবে। সরি বলার চেয়ে এই অপরচুনিটি দেওয়াটাই বেশি ভালো ছিল বলে ওর মনে হয়।

___________

বিকেলের দিকে রিখিয়া বিহানের সাথে দেখা করতে একটা জায়গায় যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানেনা। কিছুদিন আগে ওকে একটা জায়গার ঠিকানা দিয়ে বিহান বলেছিল প্রতি রবিবার এখানে আসে। বিহান ফোন ধরছেনা তাই না বলেই চলে এলো। ঠিকানা অনুযায়ী এসে দেখে এটা একটা অনাথ আশ্রম। রিখিয়া বেশ অবাক হল। এখানে বিহান কেন আসবে? অবাক হয়েই ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে আশ্রমের বড় মাঠের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল রিখিয়া। দুচোখে এমনিতেই মুগ্ধতা এসে ভর করল। বিহানের এক নতুন রূপের সাথে পরিচিত হল ও।

#চলবে…

[ আমি ভার্সিটি এডমিশন সিকার। আর সব এডমিশন পরীক্ষাগুলো দ্রুতই এগিয়ে আসছে। এইসময় শারিরীক আর মানসিক দুইভাবেই চাপ পরে যায়। আর গল্প লেখা শুধু টাইপিং এর ব্যাপার না ভাবতে হয় প্লট সাজাতে হয়। তাই হুটহাট যদি কোনরকম লিখে দিয়ে দেই আপনাদের পড়ে ভালো লাগবে না। আর যতক্ষণ পর্ব আমার মনমত না হয় দিতে ইচ্ছা করেনা। একটু লেটে পড়েও যদি পড়ে শান্তি পান সেটা ভালো নয় কী? এমন অনেক গল্প আছে যেটা আপনারা ৪/৭ দিন পরপরও পড়েন। সেখানে এক বা দুই দিন পরপর গল্প পড়তে হয়ত খুব বেশি অসুবিধা হবেনা। যেহেতু আগে আমি প্রতিদিনই গল্প দিতাম কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা চাইলেও সম্ভব নয়। আশা করি বুঝবেন। ধন্যবাদ। ]

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২২
.

কিছু কিছু মানুষের বাইরের রূপের সাথে ভেতরেও সুপ্ত একটা রূপ থাকে। যেটা সে সবাইকে দেখাতে চায় না। সকলের আড়ালে রাখতে চায়। রিখিয়াও আজ বিহানকে আলাদাভাবে আবিষ্কার করল। রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ভেতরে এলো। বিহান অনেকগুলো বাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলছে। বিহান নিজের চোখ বেঁধে রেখেছে আর বাচ্চাগোলোকে খুঁজছে। বাচ্চাগুলোও মজা করে যাচ্ছে বিহানের সাথে। রিখিয়া বিষ্মিত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতেই বিহানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগোতে এগোতে ওর খেয়ালই নেই কখন বিহানের কাছে চলে গেছে। হঠাৎ করেই বিহান রিখিয়াকে বাচ্চা ভেবে ধরে ফেলল। ঘটনার আকষ্মিতায় রিখিয়া চমকে উঠল। সব বাচ্চারাও থেমে গেল। বিহান সাথেসাথেই বুঝতে পারল এটা কোন বাচ্চা না। একহাতে রিখিয়াকে ধরে রেখেই আরেক হাত দিয়ে চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে রিখিয়াকে দেখে অবাক হয়ে গেল। রিখিয়া এখানে চলে আসবে ও বুঝতে পারেনি। এখানে কেন আসল মেয়েটা। ও দ্রুত রিখিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

” তুমি এখানে?”

রিখিয়া কানের পিঠে চুলগুলো গুজে নিয়ে বলল,

” আসলে আপনার সাথেই দেখা করতে এসছিলাম।”

বিহান বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা তাকিয়ে আছে। বিহান মুচকি হেসে বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে বাচ্চাদের ভেতরে যেতে বলল। আর এটাও বলল যে ওদের জন্যে খাবার চলে আসছে তাড়াতাড়ি। বাচ্চাগুলো হাসিমুখে ভেতরে চলে গেল। বাচ্চারা ভেতরে যেতেই বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” হঠাৎ এখানে দেখা করতে এলে যে?”

” আপনি বলেছিলেন প্রতি রবিবার বিকেলে এখানে আসেন তাই..”

” কিছু বলবে?”

” আমার সেদিনের বিহেভিয়ারের জন্যে রেগে আছেন তাইনা?”

বিহান ঠোঁট চেপে একটু হাসল তারপর রিখিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” সেটা ফ্যাক্ট না। ফ্যাক্ট ইজ আমার যদি অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক থেকেও থাকে তাতে তোমার কেন এত রাগ হচ্ছিল? তোমার কী যায় আসে?”

রিখিয়া একটু অস্বস্তিতে পরল। কী উত্তর দেবে ও? উত্তরটাতো ওর নিজেরই অজানা। তাই মাথা নিচু করে ওড়নায় আঙ্গুল পেচাচ্ছে। বিহান রিখিয়ার দিকে আরেকটু ঝুঁকে বলল,

” বাই এনি চান্স তুমি আমায় ভালো-টালো বেসে ফেলোনি তো?”

রিখিয়া ভ্রু কুচকে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান গলা ঝেড়ে বলল,

” নাহ পরতেই পারো। আফটার অল এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে য‍দি আশেপাশে থাকে তো প্রেমে পরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং না পরাটাই অস্বাভাবিক।”

রিখিয়া হাত ভাজ করে বলল,

” তাইনা?”

বিহান নিজের কলারটা ঠিকভাবে সেট করে বলল,

” হ্যাঁ তাইতো।”

রিখিয়া হেসে দিয়ে বিহানের বাহুতে একটা ধাক্কা মারল। বিহানও হাসল। হাসিটা থামিয়ে রিখিয়া বলল,

” এখানে কী করতে আসেন?”

” আসলে এখানে বাচ্চাগুলো খুব প্রিয় আমার। ওদের সাথে খেলতে, মজা করতে, খাওয়াতে। তাই প্রতি রবিবার এখানে আসি। ওদের সাথে খেলি, খাওয়াই, মাঝেমাঝে ওদের নিয়ে শপিং করতেও যাই।”

রিখিয়ার মনে পরল আগে একবার বিহানকে দেখেছিল শপিংমলে বাচ্চাদের সাথে। ও একটু না, অনেকটাই অবাক হল। বিহানের এমন রূপে ও সত্যিই ভীষনরকম অবাক হয়েছে। বিহানের যে এরকম একটা রূপ আছে সেটা ও জানতোই না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” আচ্ছা। আপনি ওদের এত ভালোবাসেন কেন? কোন বিশেষ কারণ?”

বিহান মলিন হেসে বলল,

” হয়তো ওদের সাথে আমার বিশেষ মিল আছে তাই।”

রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,

” কী মিল?”

” ওরাও এতিম। আমিও কোথাও না কোথাও এতিম। ওদের বাবা-মা নেই তাই এতিম। আমার থেকেও নেই তাই আমি এতিম।”

রিখিয়া বিহানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেনা। বাবা-মা থাকতেও বিহান নিজেকে এতিম বলছে কেন? রিখিয়া কিছু বলবে তার আগেই একটা লোক বড় বড় দুটো বক্স নিয়ে এলো যার মধ্যে খাবার এলো। বিহান একগাল হেসে বলল,

” চল ওদের খাবার দিয়ে দেই। তুমিও হেল্প কর আমাকে।”

রিখিয়া মাথা নেড়ে উঠে গেল। ভেতরে গিয়ে সব বাচ্চাদের খাবার দিল দুজন মিলে। এই এতিম বাচ্চাদের নিজের হাতে খাবার দিতে পেরে আর ওদের এই হাসি মুখটা দেখে তৃপ্তিতে দুচোখ ভরে যাচ্ছে রিখিয়ার। এক অদ্ভুত শান্তি। এরজন্যে সারাজীবন বিহানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে ও। এর মধ্যে রিখিয়ার সাথেও বাচ্চাদের ভালো বন্ডিং হয়ে গেল। কারণ রিখিয়া খুব ভালোবেসে মিশেছে ওদের সাথে। একটা বাচ্চাতো বলেই বিহানকে বলেই ফেলল,

” ভাইয়া এই আপুটা কী আমাদের ভাবী হন?”

কথাটা শুনে রিখিয়া চমকে গেল। চরম অস্বস্তিতে পরে গেল ও। বিহান ঠোঁটে কামড়ে হেসে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল,

” কেন? ভাবী হিসেবে মানাচ্ছে না?”

বাচ্চাটা বোকলা দাঁতে হেসে বলল,

” পার্ফেক্ট আছে।”

রিখিয়া চরম অবাক হল। আজকালকার বাচ্চাগুলো কী বিচ্ছু। খাওয়া শেষে আবারও খেলল ওরা। এবার রিখিয়াও যোগ দিল। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা দিন কাটলো রিখিয়ার। আজ বিহানকে সে নতুনভাবে দেখল। নতুনভাবে চিনল। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে বিহানের প্রতি যা আগে কখনও হয়নি।

_____________

স‍ৌহার্দ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। বাকি সবাই তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। এখন ওর প্রেজেন্টশন দেওয়ার পালা। যেখানে ও ওর প্লানটা সবার সামনে দেখাবে। মনে মনে ভীষণ ভয় করছে ওর। কারণ ওর লাইফের প্রথম প্রেজেন্টেশন এটা। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তুর্বীকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

” স্টার্ট কর।”

তুর্বী একটু গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

” আপনি ঠিকই বলেছিলেন স্যার। কাজের জায়গাটা মজা করার জায়গা না। সেরকম করা উচিতও না।”

এটুকু বলে একটু থামল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” কিন্তু, যদি কাজের জায়গাটায় আমরা নিজেদের জন্যে কমফরটেবল করে তুলতে পারি দেন আই থিংক ইটস গুড ফর আস। কারণ তাহলে প্রত্যেকটা স্টাফ নিজের মত করে আনন্দ নিয়ে কাজ করতে পারবে। কারণ কাজের প্রেশার বা একটানা কাজ করা যেকারো জন্যেই বোরিং। সো যদি প্রত্যেকটা স্টাফ নিজের কাজের মধ্যে রিলাক্স করার বা নিজেকে কমফরটেবল রাখার একটা সুযোগ পায় তাহলে তারা কাজটা যেমন ভালোভাবে করতে পারবে একইসাথে তাদের ওপর স্ট্রেসটাও কম পরবে।”

সৌহার্দ্য তুর্বীর বচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে গেছে। কে বলবে এই মেয়েটা এতটা ইনফরমাল, ছটফটে। তুর্বী স্লাইড চেঞ্জ করে বলল,

” সো, যদি আমাদের আগের প্লানের স্টাফ রুমে কোওয়ার্কিং স্পেসটা আরেকটু বাড়াতে পারি। তাহলে সেটা যেমন স্টাফদের কমফর্ট জোন দেবে। স্টাফদের লম্বা সময় অফিসে কাজ করতে ইচ্ছা হবে। দে উইল এনজয় দেয়ার অফিস। ভিসিটরদের ভিসিট করতেও সুবিধা হবে। ”

একজন কলিগ বলল,

” কিন্তু এতটা জায়গা তো নেই।”

আরেকজন বলল,

” এনড হোয়াট এবাউট বাজেট?”

তুর্বী আবার স্লাইড চেঞ্জ করে বলল,

” যদি আমরা আমাদের আগের প্লানে রাখা মাঝখানের এই পার্টিশনটা বাদ দিতে পারি। তাহলে অনেকটা জায়গা বেঁচে যাবে। আর সেইজায়গাটাকেই আমরা ইউস করতে পারি লাইক দিস।”

বলে তুর্বী পরের স্লাইডে ওর বানানো মডেলটা দেখালো আর সেই মডেলের বেসিকটা ব্যাখা করে বলল,

” হ্যাঁ এতে করে বাজেট একটু বেড়ে যাবে ঠিকই কিন্তু যদি আমরা একটু ভালো করে দেখি তাহলে এখানকার কোওয়ার্কিং স্পেস এন্ড চাহিদা দুটোই বাড়বে। এন্ড উইথ দ্যাট উই ক্যান কভার আপ। এতে আমাদের লস হবেনা। কজ উইস্টান চার্চিল সেইড, ‘ We shape our building, and thereafter they shape us”

সবাই হাততালি দিয়ে উঠল তুর্বীর অসাধারন প্রেজেন্টেশন দেখে। অথচ কালকে তারাই ওর ওপর হাসছিল। সৌহার্দ্য একদৃষ্টিতে দেখছে তুর্বীকে। তুর্বী একপলক সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আই থিংক আপনারা এটা ভেবে দেখবেন।”

বলে তুর্বী চলে গেল। সৌহার্দ্য মুচকি হাসল। আজ প্রথমবার ও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ওর একটুও আফসোস হচ্ছেনা। বরং ভালো লাগছে। যেন এটাই চাইছিল ও। সৌহার্দ্য আনমনেই বলে উঠল,

” সি ইজ ইম্প্রেসিভ!”

#চলবে…

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৩
.

বিহানের সাথে অনাথ আশ্রমে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েই ফ্লাটে ফিরেছে রিখিয়া। বিহানই ড্রপ করে দিয়েছে ওকে। ওর জীবনের সেরা দিনগুলোর মধ্যে একটা ছিল আজকে। অনাথ বাচ্চাগুলোর সাথে কিছুটা সময় কাটানোতে যে কতটা শান্তি আর আনন্দ থাকে সেটা এর আগে বোঝেনি। ফ্লাটে এসে রুমে এসে দেখে তুর্বী নেই এখানে। ও বেশ অনেকটা অবাক হল। তুর্বী কী আসেনি এখনও? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে ব্যালকনি তে তাকিয়ে ওর মেজাজটা খারাপ হল। কারণ তুর্বী রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এতো করে বারণ করে এরকম করতে, মেয়েটাকে কিন্তু মেয়েটা শোনেই না। হুটহাট কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হবে? রিখিয়া ব্যাগটা রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে তুরের হাত ধরে টেনে রেলিং থেকে নামিয়ে বলল,

” এসব কী তুর? কতবার বলেছি তোমাকে এরকম করবে না?”

তুর্বী মাথা চুলকে বিরক্তি নিয়ে বলল,

” আরে আমি ভালোভাবেই ধরে রেখেছিলাম তো।”

” দুর্ঘটনা জানিয়ে ঘটেনা।”

” আচ্ছা তোর এতো দেরী কেন হল? কোথায় গিয়েছিলি?”

” বিহানের সাথে দেখা করতে।”

তুর্বী ভ্রু বাঁকা করে বলল,

” বাহ! ভালোই তো শুরু হয়েছে তোদের।”

রিখিয়া হেসে রেলিং এ হেলান দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ হ্যাঁ মজা নিতে থাকো। আজ তোমার প্রেজেন্টেশন ছিল না? কেমন হল?”

” জানিনা। কিন্তু আমার প্লানটাই এপ্রুভ হয়েছে।”

” আরেহ বাহ! দ্যাটস লাইক মাই গার্ল।”

তুর্বী কলারটা উঠিয়ে একটু ভাব নিয়ে বলল,

” দেখতে হবে কে করেছে বুঝলি।”

” তো তোমার বস কথা বলেছে পরে তোমার সাথে?”

” বলতে চেয়েছিল ইগনোর করে চলে এসছি। মামাবাড়ি নাকি হ্যাঁ? যখন ইচ্ছে সবার সামনে অপমান করবে। আবার ইচ্ছে হলে ডেকে মিষ্টি কথা বলবেন। আর আমিও সেভাবে নাচবো? হতেই পারেনা।”

রিখিয়া তুর্বীর পিঠে চাপড় মেরে বলল,

” বড় হও এবার।”

তুর্বী খিলখিলিয়ে হেসে দিয়ে বলল,

” তো আমাকে দেখে কী বাচ্চা লাগে? আমার কথা ছাড় তুই এটা বল যে বিহানের জন্যে কিছু ফিল করিস। ”

রিখিয়া হাসি থামিয়ে দিল। ও নিজেও বুঝতে পারছেনা আদোও বিহানের জন্যে ও কিছু ফিল করে কী না। তবে বিহানের আশেপাশে থাকতে ওর ভালোলাগে। বিহানের করা দুষ্টুমিগুলো ও এনজয় করে। যেই বিহানকে একদিন ওর অসহ্য লাগত সেই বিহানকেই একদিন না দেখলে ওর কাছে দিন অসম্পূর্ণ মনে হয়। এই অনুভূতির নাম ওর জানা নেই। তবে এটুকু জানে যে ওর অনুভূতি আছে। অবশ্যই আছে।

___________

আরো দুটো দিন কেটে গেল, এরমধ্যে সৌহার্দ্য তুর্বীর সাথে কথা বলতে চাইলেও তুর্বী ইগনোর করে চলেছে। শুধুমাত্র অফিসিয়াল কথা ছাড়া কোন কথাই বলে না। স‍ৌহার্দ্য অফটপিক কোন কথা বললেই তুর্বী এড়িয়ে যায়। এমনিতেই সৌহার্দ্য রায়হান পরিচয়ে অফিস, S.R. পরিচয়ে রেডিও স্টেশন সামলাতে সামলাতে বেচারা হিমসীম খাচ্ছে তারওপর এই মেয়েটা। কী করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। এই মেয়েটাকে কে বোঝাবে যে ওর বাড়তি বকবক, দুষ্টুমি, বাচ্চামো এসব না দেখলে ওর ভালোলাগেনা। একদম ভালোলাগেনা।

মিসেস নাহার আজ রান্নাঘরে জমিয়ে রান্না করছেন। মেয়ে আর জামাই এসছে। তার চেয়ে বড় কথা বিহানও এসছে। শফিক রায়হান তো আপাতত আর এই বাড়িতে নেই তাই সৌহার্দ্য জোর করেই নিয়ে এসছে। তিন ভাইবোন আর দুলাভাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে এখন। কিন্তু সৌহার্দ্যর মনোযোগ আড্ডায় কম অন্যদিকে বেশি। বিহান ব্যাপারটা লক্ষ্য করে হালকা করে একটা ধাক্কা মেরে বলল,

” সমস্যা কী? কী ভাবছিস।”

সৌহার্দ্য হালকা চমকে উঠল, এরপর মাথা নেড়ে ‘কিছুনা’ বোঝালো। নুসরাতের হাজবেন্ড ইকবাল বলল,

” আরে শালাবাবু বলে ফেলতো। আমরাইতো।”

বিহান বলল,

” ওয়ান সেকেন্ড, তুর্বীকে নিয়ে কিছু হয়নিতো।”

নুসরাত একটু অবাক হয়ে বলল,

” তুর্বী?”

সৌহার্দ্য বাঁধা দেওয়া সত্ত্বেও বিহান ওদের সবাইকে সবটা খুলে বলল। সবটা শুনে নুসরাত বলল,

” বাপড়ে আমার ভাইটাও তাহলে প্রেমে পরতে পারে?”

সৌহার্দ্য কিছু না বলে হাসল। কিন্তু নুসরাতকে বলল না ‘এমন কিছুই না’। কেন বলল না নিজেও জানেনা। তবে কী সত্যিই প্রেমে পরেছে? এসব ভাবনার মাঝে বিহান বলল,

” কী হয়েছে সেটাতো বলবি এবার?”

ইকবাল আর নুসরাতও বারবার জোর করছে বলার জন্যে তাই বাধ্য হয়ে সৌহার্দ্য বলেই দিল সবটা। সবটা শুনে বিহান আবার ওর সেই বিখ্যাত দমফাটা হাসি দিল। ইকবাল আর নুসরাতও মিটমিটিয়ে হাসছে। সৌহার্দ্য বলল,

” হাসিস না ইয়ার। ঝামেলায় আছি।”

এরমধ্যেই মিসেস নাহারের ডাক পরল আর নুসরাত আর ইকবাল উঠে চলে গেল। বিহান কোনমতে হাসি থামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সৌহার্দ্যর কাঁধে হাত রেখে বলল,

” ব্রো। নিজের ফর্মে গিয়ে ট্রায় কর, ঠিক হবে।”

বলে ডাইনিং এ চলে গেল। সৌহার্দ্যও চুপচাপ ভাবতে বসল।

____________

সন্ধ্যার পর তুর্বী সব গুছিয়ে নিয়ে তুর্বী ঠিকভাবে রেডি হয়ে বেড় হল অফিস থেকে। পার্কিং এরিয়া পাস করার সময় পেছন থেকে ‘তুর্বী বলে ডেকে উঠল’। তুর্বী পেছনে তাকিয়ে দেখল সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বীকে দাঁড়াতে দেখে সৌহার্দ্য এগিয়ে আসল। তুর্বী স্বাভাবিকভাবে বলল,

” কিছু বলবেন স্যার?”

” চল আমার সাথে।”

” কোথায়?”

” কাজ আছে।”

” অফিসিয়াল কিছু?”

” না।”

” আমি এখন কোথাও যাবোনা স্যার। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে ফিরতে হবে।”

সৌহার্দ্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে তুর্বীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” তুমি আমাকে না করছ?”

তুর্বী ইতস্তত করে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,

” দেখুন স্যার। আপনি আমার বস, সেটা অফিসের ভেতরে। এখন অফিস টাইম শেষ হয়ে গেছে। সো ইউ কান্ট ওর্ডার মি নাও।”

” আরে আমার কথাটাতো শোন?”

” সরি, বাট আমার সময় নেই।”

অন্যসময় হলে তুর্বী ঠিক শুনতো কিন্তু এখন তো ও সৌহার্দ্য ওপর যথেষ্ট রেগে আছে। তাই ইচ্ছে করেই কথা শুনছেনা। শুনবেও না। সেদিন এভাবে সবার সামনে অপমান করার সময় মনে ছিল না। তুর্বী চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে বলল,

” কথাগুলো ইমপর্টেন্ট।”

তুর্বী ত্যাড়াভাবে জবাব দিল,

” আমার ফেরাটা আরও বেশি ইম্পর্টেন্ট।”

সৌহার্দ্যর এবার একটুখানি রাগ লাগছে। মেয়েটা তো কোন কথাই শুনতে চাইছে না। এসবের কোন মানে হয়? ও নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে আঙ্গুল দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,

” লাস্ট টাইম বলছি। যাবে কী না?”

তুর্বী ঘাড়ত্যাড়ার মত করে বলল,

” নাহ মানে হল নাহ।”

সৌহার্দ্য হঠাৎ করেই তুর্বীকে কোলে তুলে নিল। তুর্বী বোকার মত তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। ও ভাবেও নি সৌহার্দ্য এমন কিছু করবে। সৌহার্দ্য তুর্বীকে গাড়িতে বসিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে তুর্বী কিছু বুঝে উঠতে পারল না। ও সবটা ঠিকভাবে বুঝতে বুঝতে সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট করে ফেলেছে। তুর্বী সৌহার্দ্যকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে কিন্তু ও কোন উত্তরই দিচ্ছে না ও ওর মত গাড়ি চালাচ্ছে।

পার্কের একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে সৌহার্দ্য আর তুর্বী। তুর্বী দুইহাত এক করে থাই এর ওপর রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আসলে পার্কে এনে বসানোর পরেও তুর্বী কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করেছে। সৌহার্দ্য ‘সরি’ বলায় শান্ত হয়েছে। বেশ কয়েকবার ‘সরি’ বলার পর তুর্বী বলেছে ভেবে দেখছে। আর সেই ভাবা এখনও চলছে। সৌহার্দ্য এবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,

” ম্যাম? ভাবা হয়নি?”

তুর্বী আড়চোখে একবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

” সরি এক্সেপ্ট করতে পারি একটা শর্তে।”

সৌহার্দ্য অবাক হল। সরি এক্সেপ্ট করার জন্যেও শর্ত? তবুও বলল,

” সেটা কী?”

তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে ঘুরে বসে উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,

” আমার বয়ফ্রেন্ড হবেন? বিয়ে কমিটমেন্ট কিচ্ছু দরকার নেই। জাস্ট বয়ফ্রেন্ড। হ্যাঁ?”

সৌহার্দ্য বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” জাস্ট ফ্রেন্ড শুনেছিলাম। জাস্ট বয়ফ্রেন্ড কী জিনিস?”

তুর্বী হাসি মুখেই চঞ্চলতার সাথে বলল,

” মানে হল আমরা রিলেশন এ থাকব। কিন্তু কোন কমিটমেন্ট, ন্যাকামো, সিরিয়াসনেস লাইক ‘তোমায় ছাড়া এ জীবন ব্যর্থ’ এসব লেইম জিনিস থাকবেনা। শুধুই টাইম পাস ওয়ালা রিলেশনশীপ। এগ্রি? নাকি অন্য ছেলেদের মত আপনিও এটা শুনে ইউটার্ন মারবেন?”

#চলবে…

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৪
.

তুর্বীর এরকম অফার শুনে সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে গেল প্রায়। মেয়েটা এরকম কেন? এর আগে কেউ নিজেরই বসের সামনে এধরণের কথা বলার সাহস কেউ দেখিয়েছে কী-না ওর জানা নেই ওর। সৌহার্দ্য চোখ তুর্বীর দিকে পরতেই তুর্বী ভ্রু নাচাল। অর্থাৎ ও উত্তর শোনার জন্যে উৎসাঝঝহি। সৌহার্দ্যও গম্ভীরমুখে তুর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” একটু ভেবে বলছি।”

তুর্বী মাথাটা দুলিয়ে ভাবুক হয়ে বলল,

” হুম ভাবুন ভাবুন।”

বলে অন্যদিকে মুখ করে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইতে শুরু করল। সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হাসল। ব্যাপারটা বেশ হল। মেয়েটার কাছাকাছি থাকার জন্যে এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর কী হতে পারে। তুর্বীকে ভালোবাসে কীনা জানেনা ও কিন্তু মেয়েটার কাছাকাছি থাকতে চায়। ওকে ভালোবাসতে চায়। ওর সাথে সময় কাটাতে চায়। তুর্বীর নিজের অজান্তেই সৌহার্দ্যর হাতে চাঁদ দিয়ে দিল। এবার তুর্বীর কাছাকাছি থেকে ও এটাও বুঝতে পারবে যে আদোও ও তুর্বীকে ভালোবাসে কি-না। আর যদি বুঝতে পারে যে ও তুর্বীকে ভালোবাসে। তাহলে? তুর্বীতো বলেই দিয়েছে ও সিরিয়াস না। তখন কী তুর্বী রাজি হবে ওর হতে? কেন হবেনা? আর যদি নাও হয় তাহলে বিয়ে করবে। হয়ত রিলেশন সিরিয়াসলি করতে চায়না কিন্তু বিয়েতো করবে কখনও না কখনও। তাহলে ওকে করতে নিশ্চয়ই অাপত্তি করবে না। এসব কথা মনে মনে আওরে নিয়ে সৌহার্দ্য হালকা গলা ঝাড়ল। তুর্বী ঘুরে তাকাতেই সৌহার্দ্য মুখটা একটু নির্দোষ টাইপ করে বলল,

” একটা জিনিস ভেবে দেখলাম যে ভুল যখন করেছি তখন সরি তো এক্সেপ্ট করাতেই হবে, এখন সরি এক্সেপ্ট করার শর্ত যদি এটাই হয় দেন কী আর করার? আই এগ্রি।”

তুর্বী চোখ বড় বড় করে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য যে এভাবে মেনে নেবে সেটাও। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সন্দিহান কন্ঠে বলল,

” সিরিয়াসলি?”

সৌহার্দ্য একটু ঝুকে তুর্বী নাক আঙ্গুল দিয়ে ঘষা দিয়ে বলল,

” সিরিয়াসলি?”

তুর্বীকে আর কে পায়? এতোটাই খুশি ব্যাপারটাতে ও যে উত্তেজনায় সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে ধরল। সৌহার্দ্য অবাক হয়নি কারণ তুর্বীকে এখন ও মোটামুটি চেনে। তাই ও কী করতে পারে আর না পারে সেটা সৌহার্দ্য জানে। তাই সৌহার্দ্য তুর্বীর পিঠে একহাত রেখে বলল,

” তুর্বী সবাই দেখছে।”

তুর্বী সৌহার্দ্যকে না ছেড়ে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল,

” তাতে কী? এখন তো আমরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড রাইট?”

” হ্যাঁ কিন্তু এভাবে দেখলে লোকে খারাপ ভাববে।”

তুর্বী সৌহার্দ্যকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

” ভাবুব গে। আই ডোন্ট কেয়ার।”

সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলে আছে। তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল। সৌহার্দ্য হাসিটাকে প্রসারিত করে মাথা নেড়ে ‘কিছু না বোঝাল’। তুর্বী একটু আড়মোড়া ভেঙে বলল,

” প্রপোজ করুন।”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বলল,

” কী?”

” এতে অবাক হওয়ার কী আছে? প্রেম করবেন না? সেটা হয়? আগে তো প্রপোজ করতে হয়। সেরকমটাইতো জানি। করুন!”

” আমি?”

” নয়ত কী আমি?”

” না..”

সৌহার্দ্যকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তুর্বী রেগে গিয়ে বলল,

” আপনি করবেন নাকি?”

সৌহার্দ্য বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। এই মেয়ে নিজেই অফার টা দিল, এখন ওকে বলছে প্রপোজ করতে? বাহ রে বাহ। আর কী কী দেখতে হবে ওকে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল এরপর তুর্বীর দিকে তাকাল। লাইটের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে মুখটা, অজস্র চঞ্চলতা যেন ভর করেছে ওর মুখে, এক অদ্ভুত মায়া, স‍ৌহার্দ্য সেই মুখের দিকে বেশ অনেকটা সময় তাকিয়ে থেকে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,

” আই লাভ ইউ।”

তুর্বীর হঠাৎ করে কেমন যেন উঠল। কারণটা জানেনা কিন্তু ওর মনে হল ওর হৃদপিণ্ড এক সেকেন্ডের জন্যে থেমে গেছিল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” হুম।”

তুর্বীর আওয়াজে সৌহার্দ্যরও হুস এল। ও ভ্রু কুচে বলল,

” শুধু হুম?”

তুর্বী অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

” আই লাভ ইউ টু কী বলতেই হয়?”

সৌহার্দ্যর খুব হাসি পাচ্ছে এখন। মেয়েটা বেশিই অদ্ভুত। কিন্তু ওকে দিয়ে বলিয়ে ছেড়েছে তুর্বীকে তো ও ছেড়ে দেবেনা তাই মেকী হেসে মাথা ঝাকাল অর্থাৎ ‘ হ্যাঁ বলতে হয়’। তুর্বী মুখ ফুলিয়ে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে তারপর বলল,

” আই লাভ ইউ টু।”

তুর্বীর মুখে কথাটা শুনতে বেশ ভালো লাগল সৌহার্দ্যর। ও জানে তুর্বী মন থেকে বলেনি কিন্তু তবুও ওর ভালোলেগেছে। খুব বেশি ভালোলেগেছে। তুর্বী বলল,

” তারমানে আমারও আজ থেকে বয়ফ্রেন্ড আছে রাইট?”

সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ। পুরো কিডন্যাপ করে নিয়েছো।”

” আর সেটা অাপনি?”

” দুঃখজনকভাবে।”

তুর্বী কিছু না বলে মুচকি হাসল। দুজনেই চুপ করে রইল বেশ অনেকটা সময়। তবে মনটা যথেষ্ট চঞ্চল হয়ে রয়েছে দুজনেরই। নিরব ভেঙ্গে তুর্বী বলে উঠল,

” আইসক্রিম খাবেন?”

সৌহার্দ্য কয়েকসেকেন্ড তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

” আজকে দিনটা আপনার মিস ভয়ংকরী। যা চাইবেন তাই হবে।”

তুর্বী চোখ ছোট ছোট করে তর্জনী আঙ্গুল উঁচু করে বলল,

” পাক্কা?”

সৌহার্দ্য তুর্বীর আঙুলের সাথে নিজের হাতের আঙ্গুল লাগিয়ে ধরে বলল,

“পাক্কা।”

______________

এলোমেলো বিছানাটা নিজের হাতে যত্ন নিয়ে ঠিক করছে রিখিয়া। মন খুব একটা ভালো নেই। বাড়ির অবস্থা তেমন ভালোনা। ওর ভাই একদমই টাকা পাঠায়না। ও একা চাকরি করে, শহরে থেকে চাকরী করে তারপর সেখান থেকে আবার পরিবারের জন্যে পর্যাপ্ত টাকা পাঠানো যে কত কঠিন সেটা শুধুমাত্র তারাই বোঝে যাদের এটা করতে হয়। মানুষের সুখ নামক জলফড়িং বড্ড অধরা রকমের। যখনই মনে হয় যে হাতে চলে আসবে উড়ে কোথাও একটা চলে যায়। তবুও আবার সেটাকে খুঁজতে তার পেছনেই ছোটে মানুষ। মানুষযে বড্ড সুখপ্রিয়। তুর্বী এসে পেছন থেকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল রিখিয়া। প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হাসল রিখিয়া। তুর্বীর দুইহাতের ওপর হাত রেখে বলল,
এসছো?”

” কী ব্যাপার এত খুশি যে? কার বারোটা বাজিয়ে এসছো?”

তুর্বী রিখিয়াকে ছেড়ে বিছানায় বসে ব্যাগটা রেখে বলল,

” তো তোর কী মনে হয়? আমি শুধু মানুষের বারোটা বাজাই।”

রিখিয়া একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

” বাপড়ে! তুমি আরও কিছু করো? গুড ভেরী গুড।”

” রিখু!”

” আচ্ছা বলো কী হয়েছে?”

তুর্বী টেনে রিখিয়াকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল,

” অবশেষে আমার ইক্সপিরিমেন্ট সফল হবে।”

” কীসের?”

” কীসের আবার? প্রেমের!”

রিখিয়া বড়বড় চোখ করে তাকাল তুর্বীর দিকে।কথাটা ঠিক হজম হয়নি ওর। ও অবাক কন্ঠেই বলল,

” কোন অসহায় ছেলেটাকে এভাবে বলির বাকরা বানালে বলোতো?”

তুর্বী কলার ঠিক করতে করতে বলল,

” কে আবার সৌহার্দ্য। তোর চয়েজ আছে জানিস। তুই সেদিন ওনার নাম না নিলে আমার তো মাথাতেই আসতোনা ওনার কথা।”

” উনি রাজি হলেন?”

” বলেছে কে?”

” তুমি।”

” তাহলে? রাজি না হয়ে উপায় আছে।”

রিখিয়া অসহায় ভাবে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলল। এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে যে কেন মজা করে বেচারার নামটা বলেছিল সেদিন, অকারণেই ফাসল। রিখিয়া চিন্তিত কন্ঠে বলল,

” উনি জানেন তো তোমার দিক থেকে তুমি সিরিয়াস নও?”

তুর্বী বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ! আমি কিছু লুকিয়ে করিনা। তুইও বিহানকে বলে দেখ। তোদেরও একটা এক্সপিরিয়েন্স হয়ে যাবে।”

” আমার এসবের দরকার নেই। আমি ভালোবাসলে একজনকেই বাসব নিজের সবটা দিয়ে। আর এমন কাউকেই বাসব যার সাথে আমি সারাজীবন কাটাতে পারব। আর সেও শুধু আমাকেই ভালোবাসবে। বুঝলি?”

” হ্যাঁ সেই শুরু থেকেই শুনে আসছি। একটু কফি দে না প্লিজ।”

রিখিয়া যথেষ্ট চিন্তিত মুখ নিয়ে কিচেনে গেল।সৌহার্দ্যকে যেটুকু দেখেছে আর বিহানের মুখ থেকে যতদূর শুনেছে তাতে করে সৌহার্দ্য যথেষ্ট সিরিয়াস একটা ছেলে। আর জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে এত লাইটলি সে নেবে না। কিছু তো ব্যাপার আছে। সৌহার্দ্য তুর্বীর জন্যে কিছু ফিল করে না তো? তাহলেতো সর্বনাশ! তুর্বীর মনে কখনও এত সহজে অনুভূতি জাগবে না সেটা রিখিয়া জানে। যদি সেরকম কিছু হয় তো এটাতো নিশ্চিত যে সৌহার্দ্য কষ্ট পাবে।

_____________

রাত বারোটা চার বাজে। বিহান ধীরহাতে বোর্ডের ওপর রাখা সাদা কাগজে তুলি চালিয়ে যাচ্ছে। তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে আর গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে। অর্ধেক আঁকা হয়েছে সবে। এরমধ্যেই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল রিখিয়া ফোন করেছে। একটু অবাক হল ও। কারণ রিখিয়া ওকে নিজে থেকে ফোন কোনদিনও করে না। হঠাৎ আজ করল যে? ফোনটা হাতে নিয়ে একটা বাঁকা হাসি হাসল ও। তারপর রিসিভ করে বলল,

” বাহবা। মহারানির আজ নিজে থেকে আমার কথা মনে পরল যে।”

রিখিয়া ঠোঁট চেপে একটু হেসে বলল,

” কেন পরতে পারেনা?”

” পারে। কিন্তু অবাক হলাম।”

” মাঝে মাঝে অবাক হওয়া ভালো। স্বাস্থ্যের জন্যেই।”

” তো এটা কে আবিষ্কার করল? ডক্টর রিখিয়া ইসলাম?”

বলে বিহান হেসে দিলো, রিখিয়াও হাসল খানিকটা। বিহান হাসি থামিয়ে বলল,

” খেয়েছো?”

” হম আপনি?”

”হুম।”

দুজনেই বেশ অনেকটা সময় চুপ ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,

” দেখা করবে।”

রিখিয়ার আজ কী হল জানেনা কোনরকম সংকোচ ছাড়াই বলে দিল,

‘হুম।’

বিহান আবারও ঠোঁটে বাকিয়ে হাসল। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” আচ্ছা কাল অফিস থেকে বেড় হওয়ার সময় পিক করে নেব।”

এরপর দুজনেই প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি কিছু কথা বলল। বেশির ভাগই ছিল অপ্রয়োজনীয় কথা। এমনিই বলা হয় যেগুলো। ফোনটা রেখে মুচকি হাসল বিহান। ফোনটা পাশে ফেলে রেখে আবার তুলি চালানো শুরু করল। একটা বাজ পাখির চোখ টাইপ কিছু একটা আঁকছে ও। এবার ওর চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হল, হাত আরও দ্রুত চলছে। আবারও গুনগুনিয়ে গাইছে, ”আমাকে খুঁজে দে জলফড়িং”। পেন্টিং শেষ করে লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো বিহান। এরপর বাজপাখির সেই চোখটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “রিখিয়া ইসলাম?” বলে আবারও একই ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্যের এক হাসি হাসল।

#চলবে…

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৫
.

দুপুর দুটো বাজে। সৌহার্দ্য আর তুর্বী দুজনে সৌহার্দ্যর কেবিনে বসেই কাজ করছে। সৌহার্দ্য কাজ করছে আর আড়চোখে তুর্বীকে দেখছে। তুর্বীর সেদিকে নজর নেই ও একমনে ডিজাইন আঁকছে। ল্যাপটপে চোখ রেখে সৌহার্দ্য বলল,

” লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে তো লাঞ্চ করবে না?”

তুর্বী মাথা তুলে তাকালো সৌহার্দ্যর দিকে তারপর পেন্সিলের ক্যাপ লাগাতে লাগাতে বলল,

” হুম। আমি ক্যান্টিনে যাচ্ছি। আর আপনিও খেয়ে নিন।”

” চুপচাপ বস। খাবার নিয়ে এসছি আমি।”

সৌহার্দ্যর মুখে এই কথা শুনে বেশ অবাক হল তুর্বী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,

” নিয়ে এসছেন মানে?”

সৌহার্দ্য নিচে রাখা খাবারের ব্যাগটা উঠিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,

” এখন থেকে আমার সাথে বসেই লাঞ্চ করবে। বাড়ি থেকে দুজনের খাবারও নিয়ে আসব আমি।”

” কেন? আমিতো ক্যান্টিনেও খেয়ে নিতে পারি তাইনা?”

সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

” এখানে খেতে সমস্যা কোথায়? নাকি কেউ কিছু বলতে পারে সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছো?”

তুর্বী তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল,

” আরে দূর! এসব আমি কোন কালেই ভাবি না।”

” আচ্ছা ফাইন একসাথেই খাবো।”

” বেটার, এখন ঝটপট সার্ভ করে দাও।”

তুর্বী হাত ভাজ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল অর্থাৎ ‘আমি পারব না’। সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

” বস থেকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে সাহস বেড়ে যাচ্ছে তোমার ইদানিং। মুখে মুখে তর্ক করছ?”

তুর্বী সৌহার্দ্য দিকে মেকি একটা হাসি দিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল অর্থাৎ ‘ যা খুশি ভাবুন আমার কী?’ সৌহার্দ্য ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। এই মেয়েকে কিছু বলে কোন লাভ নেই। একে যদি বিয়ে করে, তবে বিয়ের পর ওর অবস্থাটা কী হবে সেটা কল্পনা করেও বেচারা শিওরে উঠছে। সেসব কল্পনা জল্পনা বন্ধ করে খাবারের বক্সগুলো বেড় করে টেবিলে রাখল, তারপর নিজেই দুটো প্লেটে খাবার সার্ভ করল। একটা প্লেট তুর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” নিন ম্যাম খেয়ে নিয়ে উদ্ধার করুন।”

তুর্বী প্লেট নিজের কাছে নিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে খেতে শুরু করে দিল। সৌহার্দ্য কয়েক সেকেন্ড তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও প্লেটটা হাতে নিয়ে বলল,

” তুর্বী? আমি তোমাকে তুর বলে ডাকতে পারি? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড দেন!”

তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকালো, পরে মুখের খাবার শেষ করে বলল,

” এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে? যদিও এই নামে আমাকে একমাত্র রিখিয়া ডাকে। অাপনিও আজ থেকে ডাকতে পারেন। আমার প্রবলেম নেই।”

সৌহার্দ্য মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তুর্বীও নিজের মত করে খাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ পর তুর্বী বলল,

” আচ্ছা আমি আপনাকে আপনি করে কেন বলছি? আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড, সো তুমি করে বলাই উচিত রাইট?”

” হুম একদম রাইট। কিন্তু অফিসে থাকাকালীন কারো সামনে তুমি বলার দরকার নেই।”

” ওকে ফাইন।”

খাওয়ার সময় ওরা আর কোন কথা বলেনি। খাওয়া শেষ করে দুজন আবার কাজে মনোযোগ দিল। কাজ করতে করতে তুর্বী আর সৌহার্দ্য দুজনেরই ঘাড় ব্যাথা করছে। তাই সৌহার্দ্য পিওনকে বলে দুই মগ কফি অানালো। সৌহার্দ্য কফি খেতে খেতেও টুকটাক কাজ করছিল। কিন্তু তুর্বী উঠে কেবিনের সাথে জয়েন্ট ব্যালকনিতে চলে গেলো। রেলিং এ ভর দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে কফি খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই সৌহার্দ্য ওর পাশে এসে দাঁড়াল। তুর্বী তাকাতেই সৌহার্দ্য বলল,

” আচ্ছা এর আগে তোমার কোন রিলেশন ছিলোনা এটাতো ক্লিয়ার। কাউকে ভালোও লাগেনি কখনও?”

তুর্বী হেসে দিয়ে একটু উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,

” লেগেছিল তো। আমি যখন ইন্টারে উঠলাম একটা ছেলে এসছিল। এতো কিউট যে কি বলব। এতো কিউট কোন ছেলে হতে পারে ভাবিও নি। পুরো ক্রাশ খেয়ে গেছিলাম। উফফ! এখনও মনে পরলে দিল ধাক ধাক করে।”

সৌহার্দ্যর এবার একটু রাগ হচ্ছে। ওর সামনে অন্য একটা ছেলের এভাবে প্রশংসা করছে? ও কী বুঝতে পারছেনা যে সৌহার্দ্যর রাগ হচ্ছে ভীষণভাবে। এখন তো মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করেই ভুল করছে। এসব ভাবতে ভাবতে তুর্বী আবার বলল,

” ওনার্স সেকেন্ড ইয়ারেও একটা ছেলেকে ভালো লেগেছিল। যদিও দেখতে খুব একটা ভালো না কিন্তু পার্সোনালিটিটা জোস। কী আর বলব আপনাকে। আর..”

” থাক আর বলতে হবেনা।”

সৌহার্দ্য রাগ আর বিরক্তির মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বলল,

” হয়েছে। আর বলতে হবেনা।”

” থাকবে কেন শুনুন না, লাস্ট ওয়ান।”

” বললাম তো থাক।”

কিন্তু তুর্বীতো কথা শোনার পাত্র না। ও বলবেই। তাই বলল,

” আরে আপনাকে যেদিন ফার্স্ট দেখলাম গাড়িতে। ফুল কালো পরে ছিলেন। কিছুক্ষণের জন্যে চোখ আটকে গেছিল। ভালোরকমের ক্রাশ খেয়েছিলাম কিন্তু। মানতে হবে।”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টি অন্যরকম হয়ে উঠল। তুর্বীর চোখ সৌহার্দ্যর চোখে পরতেই সৌহার্দ্যর চাহনী দেখে হঠাৎই একটু লজ্জা পেল। নিজেকে সামলে চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য তুর্বীর হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে এলো। তুর্বী একটু অবাক হয়ে তাকাল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে তুর্বীর চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিতে দিতে বলল,

” তারমানে তোমার এডাল্ট বয়সের ক্রাশ আমি? আর এডাল্ট বয়সের ক্রাশগুলো কিন্তু অনেকটা পাকাপোক্ত হয় তাইনা?”

তুর্বী ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” আচ্ছা?”

সৌহার্দ্য তুর্বীর কপালে কপাল লাগিয়ে বলল,

” হুম। পার্মানেন্ট হতে চাও না-কি?”

তুর্বী সৌহার্দ্যর কাধে হাত রেখে বলল,

” আপাতত টেম্পোরারই থাক। পরেরটা পরে দেখা যাবে স্যার!”

” তুমি করে বলার কথা ছিল ওকে।”

” হুম।”

” হুম?”

” হুম।”

সৌহার্দ্য হেসে দিল সাথে তুর্বীও। দুজনের মধ্যেই কিছু অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। এইরকম অনুভূতির সাথে দুজনের কেউই পরিচিত নয়।

_____________

বিহান আর রিখিয়া দুজনে একটা বিল্ডিং এর ছাদে বসে আছে। এই বিল্ডিং এরই রেস্টুরেন্টে এসছিল ওরা। ওখান থেকেই ছাদে এসছে। ছাদে দুজনে পাশাপাশি বসে থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,

” চুপ করে আছো কেন?”

” এমনিই। এই নিরব পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছে।”

” নিরবতা! খুব অদ্ভুত জিনিস তাইনা? মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ভাবনাকে বাইরে বেড় করে নিয়ে আসতে পারে। কতরকম চিন্তা এসে ভর করে মাথায়।”

রিখিয় বিহানের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,

” এতো গম্ভীর কথাও বলতে পারেন?”

বিহান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমি সবকিছুই পারি। শিল্পী মানুষতো তাই হয়ত।”

” নতুন কোন পেন্টিং করেন নি?”

” করেছিতো। দুটো। কেন?”

” আমাকে দেখালেন না এখনও?”

” দেখিয়ে দেব সময় করে। কিন্তু হঠাৎ এতো আগ্রহ?”

” প্রেমে পরে গেছি।”

বিহান চোখ বড়বড় করে তাকাল রিখিয়ার দিকে। রিখিয়া হেসে দিয়ে বলল,

” আরে আপনার পেন্টিং এর। আপনার প্রেমে পরতে বয়েই গেছে। আপনি আর যাই হোক প্রেমে পরা টাইপ ছেলেদের মধ্যে পরেন না।”

” হ্যাঁ সেটা ঠিক। আমার প্রেমে পরা যায় না। ইন ফ্যাক্ট পরা উচিতও না।”

এটুকু বলে বিহান একটু হেসে আবার আকাশের দিকে তাকাল। রিখিয়া ভাবল যে বিহান কষ্ট পেল না তো? কিন্তু ও তো সম্পূর্ণটাই মজা করে বলেছিল। তাই কথাটা ঘোরাতে রিখিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চলুন আজ ফিরে যাই।”

বিহান বলল,

” কেন? নিস্তব্ধ এই সন্ধ্যায়, দমকা হাওয়ার মধ্যে আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে তোমার কোন আপত্তি আছে?”

বিহানের কথা শুনে একটু অবাক হয়ে তাকালো। বিহান মুচকি হেসে বলল,

” কী? ভিজবেনা?”

রিখিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রিখিয়া তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালো, বিহানও দাঁড়ালো। রিখিয়া একটু দৌড়ে যেতে নিলেই বিহান হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বৃষ্টির গতি বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। দুজনেই ভিজে চুবচুবে হয়ে যাচ্ছে। বিহান একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রেখে দিয়েছে রিখিয়াকে। বিহানের মুখ থেকে ফোটায় ফোটায় পানি রিখিয়ার মুখে পরছে। রিখিয়া ঠিক করে তাকাতেও পারছেনা। অনেক কষ্টে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান মুখে এখনও বাঁকা হাসি লেগে আছে। নিজের চার আঙুল দিয়ে আলতো করে রিখিয়ার গালে স্লাইড করে বলল,

” সবসময় পালাতে চাইলেই কী পালানো যায় ম্যাডাম?”

বিহানের এরকম কন্ঠস্বরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল রিখিয়ার মধ্যে। তবুও নিজেকে সামলে বলল,

” ছা-ছাড়ুন।”

” সত্যিই ছেড়ে দেব?”

বিহান কথাটা এমনভাবে বলল যে রিখিয়ার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। এই ‘ছেড়ে দেব’ শব্দটা কেন যেনো নিতে পারলোনা ও। কিছু না ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বিহানকে। বিহান হতভম্ব হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিও নিজ গতীতে পরেই যাচ্ছে। বিহান রিখিয়ার পিঠে হাত রাখতেই হালকা করে কেঁপে উঠল ও। হুস এলো যে কী করছে সে। তাই চমকে গিয়ে নিজেই ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল বিহানের থেকে। বিহানের দিকে তাকাতেও পারছেনা ও লজ্জাতে। তাই ওখানে না দাঁড়িয়ে একপ্রকার দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। বিহান ও মুচকি একটা হাসি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেজা চুলগুলো নেড়ে নিজেও রিখিয়ার পেছনে গেল।

#চলবে…

[ ফেসবুকে ঢুকতে সমস্যা আমারও হচ্ছিল। Vpn এর ব্যাপারে আমি জানতাম না। এসব বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সুতরাং গল্পও দিতে পারিনি। অতঃপর আপনাদের তীব্র ভাই আজ আমাকে হোয়াটস অ‍্যাপে জানালো vpn এর কথা। তাই আজ গল্প পেলেন 😐। আর পর্ব ছোট হয়নি এভারেজ টাইপ আছে। এরচেয়ে বড় দেওয়া আপাতত সম্ভব না। হ্যাপি রিডিং]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here