জল ফরিঙের খোঁজ – পর্ব ৩১-৩৪

0
203

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩১+32+33+34
.

বেশ অনেকটা রাত হয়েছে। নিজের মনেই অজস্র কল্পনা জল্পনা করতে করতে তুর্বী ওর ফ্লাটের সামনে এসে পৌছলো। সৌহার্দ্য চলে যাওয়ার পর বেশ অনেকটা সময় ঠায় মেরে বসে ছিল ওখানে। সবটাই এলোমেলো লাগছিল। মানুষ অনেকসময় এমন অনেক কাজ করে ফেলে যার পরে নিজেই অশান্তিতে ভুগতে থাকে। কী ভুল করেছে সেটা জানা থাকেনা কিন্তু মনে হয় যে ভুল হয়ে গেছে, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ওখানে কতক্ষণ থেকেছে জানা নেই। এরপর কোথায় গেছে কী করেছে নিজেও জানেনা। শুধুশুধুই এদিক ওদিক হেটে বেড়াচ্ছিল। তবে দরজার সামনে এসেই টনক নড়ল ওর। এতো রাত করে ফেরার পরেও রিখিয়া ওকে ফোন করে একটাবার খোঁজ নিলোনা। এরকমতো আগে কখনও হয়নি। আজতো বিহানকে প্রপোজ করার কথা ছিল ওর। কোন ঝামেলা হয়নি তো?কিছু হয়নি তো মেয়েটার? তুর্বী দ্রুত কলিং বেল বাজালো। বেশ কয়েকবার বেল বাজানোর পরও যখন দরজা খুলল না তখন তুর্বী ধাক্কাতে লাগল। কিন্তু তবুও খোলেনি। এবার ও ঘাবড়ে গেল। কিছু করতে যাবে ঠিক তখনই দরজা খুলল রিখিয়া। রিখিয়াকে দেখে চমকে উঠল তুর্বী। ওর চোখ নাক লালচে হয়ে গেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে মেয়েটা প্রচুর কেঁদেছে। তুর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে রিখিয়া ভেতরে চলে গেল। তুর্বী বেশ অবাক হল, কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখল রিখিয়া ফ্লোরে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। ও বুঝে গেছে যে আজ ভয়ানক কিছু হয়েছে। না হলে মেয়েটা এভাবে ভেঙ্গে পরতো না। ও ব্যাগটা ফেলে গিয়ে রিখিয়াকে দুহাতে ধরে বলল,

” কী হয়েছে?”

রিখিয়া কোন পতিক্রিয়া দেখাল না, ওভাবেই বসে রইল। তুর্বী হালকা ঝাকিয়ে বলল,

” বল? বিহান কিছু বলেছে?”

রিখিয়া কথা বলছেনা তাকাচ্ছেও না তুর্বীর দিকে। তুর্বী ঠান্ডা মাথায় কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। কিন্তু রিখিয়া কোনটারই উত্তর দিল না। তুর্বী এবার একটু রেগে গেল। রেগে গিয়ে ধমকে বলল,

” রিখু বলবি কী হয়েছে?”

রিখিয়া এবার শান্ত চোখে তুর্বীর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তুর্বীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। তুর্বী থমকে গেল। রিখিয়াকে এভাবে কাঁদতে এর আগে কোনদিন দেখেনি ও। ওর হৃদপিণ্ডে গিয়ে লাগছে এই কান্না।

____________

ড্রয়িংরুমের সোফায় সৌহার্দ্য আর বিহান দুজনেই মনমরা হয়ে বসে আছে। কিছুই ভালোলাগছেনা এখন ওদের। বিহানতো ঐ সময়ের পর থেকে একদম চুপ হয়ে আছে। নিজের পরে আজ প্রথম অন্য কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট দিয়েছে ও। আগেতো শুধুই নিজেকে কষ্ট দিত। অপরাধবোধে শেষ হয়ে যাচ্ছে ও। এতো জঘন্য কাজ কীকরে করল? রাগ সত্যিই ভয়ংকর। রাগের বসে নেওয়া সিদ্ধান্ত আর কাজের জন্যে কোন না কোন দিন মানুষকে পস্তাতেই হয়। তাইতো জ্ঞানী ব্যাক্তিরা বলেন যে, রাগান্বিত অবস্থায় কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিও না। জিম ওয়েবও বলেছেন যে, ‘রাগ হল নষ্ট হয়ে যাওয়া আবেগ।’ সুতরাং নষ্ট কোন কিছুই ভালো ফল বয়ে আনতে পারেনা।
এদিকে সৌহার্দ্য কফিশপ থেকে বেড়িয়ে একটা নিরিবিলি পার্কে বসে বেশ অনেকসময় কেঁদেছিল। যাকে বলে নিরব কান্না। না গলা দিয়ে আওয়াজ হয়েছে, আর চোখ দিয়ে তেমন জল পরেছে। তবুও এই কান্নাটা অদ্ভুত যন্ত্রণার ছিলো, ভীষণ যন্ত্রণার। ওখান থেকে সোজা বিহানের ফ্লাটেই এসছিল ও। কিন্তু বিহানকে কিছু না বলেই ওয়াশরুমে শাওয়ার নিতে চলে গেছে। লম্বা শাওয়ার নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে এরপর বেড়িয়েছিল। কিন্তু বিহান বুঝে গেছিল যে কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে, আর সেটা তুর্বীকে নিয়ে। প্রথমে বিহান কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সৌহার্দ্য স্বাভাবিক হওয়ার পরে বিহান প্রশ্ন করায় সৌহার্দ্য তুর্বীর বলা কথাগুলো বলে দেয়। সবটা শুনে বিহান চুপ হয়ে গেছিল। কিছুই বলেনি। কী বলবে? তুর্বীতো সৌহার্দ্যকে আগেই বলে রেখেছিল। সৌহার্দ্য দুর্বল হয়ে পরেছে এতে তুর্বীর হাত ছিলোনা। তুর্বী যখন বুঝতে পেরেছে যে সৌহার্দ্য দুর্বল হয়ে পরেছে তখন নিজেই সরে গেছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে তুর্বীর এই ছেলেমানুষীর জন্যই কিন্তু সৌহার্দ্যর মত একটা ছেলে আজ এতোটা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু ও নিজে কী করেছে? ওতো ইচ্ছে করে, জেনে বুঝে একটা মেয়েকে কষ্ট দিয়েছে। ভাগ্যিস রিখিয়া এখনও ওকে ভালোবাসেনি। তাহলে সারাজীবনেও নিজের অপরাধের জন্যে আফসোস মিটতো না ওর। তবে নিজের ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে বিহানের খুব কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট। আচ্ছা রিখিয়াও কি সৌহার্দ্যর মতই কষ্ট পাচ্ছে? না, রিখিয়া নিশ্চয়ই এতোটাও কষ্ট পাচ্ছেনা। সৌহার্দ্যতো তুর্বীকে ভালোবাসে কিন্তু রিখিয়াতো ওকে ভালোবাসে না। তাই এতোটা বেশি কষ্ট পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কলিং বেলের আওয়াজে দুজনেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। বিরতিহীনভাবে কেউ কলিংবেল চেপে যাচ্ছে। বিহান উঠতে নিলে সৌহার্দ্য বলে উঠল,

”আমি যাচ্ছি”

বিহান বসে রইল। সৌহার্দ্য গিয়ে দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে বেশ অনেকটাই অবাক হল। কারণ তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। সৌহার্দ্য কিছু বলবে তার আগেই তুর্বী হনহনে পায়ে ভেতরে চলে গেল। সৌহার্দ্য বোকা বনে গেল তুর্বীর এরকম কাছে। তুর্বী ভেতরে গিয়ে দেখে বিহান বসে আছে ফ্লোরে। তুর্বীকে দেখে বিহান দাঁড়িয়ে গেল। তুর্বী এগিয়ে গিয়ে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে দিল বিহানকে। বিহান গালে হাত রেখে অবাক হয়ে তাকাল। আসলে রিখিয়া সবটাই খুলে বলেছে তুর্বীকে। আর এসব শুনে নিজেকে সামলাতে পারেনি ও। রিখিয়া বারণ করার পরেও ঐ মুহূর্তেই ও বিহানের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে। আরেকটা থাপ্পড় মারতে গেলে কেউ ওর হাত ধরে ফেলল। তুর্বী সেদিকে তাকিয়ে দেখে সৌহার্দ্য রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তুর্বী হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

” হাত ছাড়ো। মেরে ফেলব ওকে আজ আমি।”

তুর্বী এগোতে নিলে সৌহার্দ্য ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

” তোমার সাহস কীকরে হয় আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার? দেখ তুর্বী, তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমার সব ছেলেমানুষী মেনে নেই। তার মানে এই নয় তুমি আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তুলবে আমি মেনে নেব। কী করেছি ও? থাপ্পড় মারলে কেন?”

তুর্বী হাত ছাড়িয়ে বলল,

” সেটা তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো। যে ও কী করেছে?”

সৌহার্দ্য একবার বিহানের দিকে তাকিয়ে তারপর আবার তুর্বীর দিকে তাকি ভ্রু কুচকে বলল,

” কী করেছে ও?”

বিহান এতক্ষণ হয়ে যাওয়া কান্ডে অবাক হয়নি। ও বুঝতে পারছে তুর্বী কেন এসব বলছে। তাই ও সৌহার্দ্যকে থামাতে যাবে তার আগেই তুর্বী বলল,

” ঠকিয়েছে আপনার ভাই রিখুকে। মিথ্যা অভিনয় করে, ইচ্ছে করে মেয়েটাকে নিজের প্রতি দুর্বল করে দিয়েছে। আর আজ যখন রিখিয়া ওকে ভালোবাসে, যখন ও আজ খুশি মনে বিহানকে ভালোবাসি বলতে যাচ্ছিল তখন আপনার ভাই ওকে ছুড়ে ফেলে দিল।”

সৌহার্দ্য বেশ অবাক হল। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু কিছু একটা ভেবে ও তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

” হতেই পারেনা। হ্যাঁ এটা ঠিক যে বিহান অন্যরকম। অনেক মেয়ের সাথেই ওর সম্পর্ক ছিল বা আছে। কিন্তু ও আজ অবধি কাউকে ঠকায় নি। সেই সব মেয়েরা জেনে শুনেই টাইমপাসের জন্যেই আসতো ওর কাছে। যদিও আমি এসব সমর্থন করিনা। কিন্তু এটাও জানি ইচ্ছে করে ও কারো মন ভাঙবেনা। হয়তো রিখিয়া ভালোবেসে ফেলেছে ওকে। কিন্তু তারমানে তো এটা না যে বিহানকেও ভালোবাসতে হবে। বিহান হয়তো রিখিয়াকে বন্ধু হিসেবেই দেখেছে। তাইতো বিহান?”

বিহান কিছুই বলছে না। যে মুহূর্তে তুর্বী বলেছে রিখিয়া ওকে ভালোবাসে , সেই মুহূর্তে বিহান থমকে গেছে। কিছু বলার মত ভাষা ওর নেই। সৌহার্দ্য বলল,

” এখন রিখিয়া ভালোবেসে ফেললে ওর কী দোষ? তবে হ্যাঁ রিখিয়া মেয়েটা যথেষ্ট ভালো। আমি বিহানকে বোঝাবো যাতে ভেবে দেখে কিন্তু ফোর্সতো করতে পারিনা তাইনা?”

তুর্বী তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল,

” তোমার ভাই আগে কারো মন ভেঙ্গেছে কিনা আমি জানিনা। কিন্তু আজ ভেঙ্গেছে। হ্যাঁ আজ ও ইচ্ছে করেই মন ভেঙ্গেছে রিখুর।”

” সেটা তোমার মনে হতে পারে। আমার সেরকম কিছুই মনে হচ্ছেনা। আর তাছাড়াও তোমার মুখে এরকম কথা মানায় মিস তুর্বী আহমেদ?”

তুর্বী একটু অবাক হল সৌহার্দ্য ‘তুর’ না বলে পুরো নাম নেওয়াতে। তাই অবাক কন্ঠে বলল,

” মানে?”

সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

” বাদ দাও। রিখিয়া কষ্ট পেয়েছে বলে তুমি কষ্ট পেয়ে এসব করেছ আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এতে ওর দোষ নেই। তবুও আমি দেখছি বিহানকে মানানো যায় কি-না। তাই এখানে সিনক্রিয়েট করোনা, এটা তোমার ছেলেমানুষীর জায়গা নয়। ইউ ক্যান গো।”

” এখানে থাকতে আসিনি আমি। তবে আপনার ভাইকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন আমি ঠিক বলছি নাকি না।”

বলে তুর্বী চলে গেল। স‍ৌহার্দ্য তুর্বীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করল। তবে ও বিহানকে তখনই কিছু জিজ্ঞেস করল না। বিহান তো প্রায় পাথরের মত বসে আছে। রিখিয়া সত্যিই ওকে ভালোবেসে ফেলেছে ব্যাপারটায় যতটা চমকেছে তারচেয়েও বেশি নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে। কী করেছে কী ও?

কিছুক্ষণ পর সৌহার্দ্য এসে বসল বিহানের পাশে। কিছুক্ষণ বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল,

” রিখিয়া মেয়েটা কিন্তু ভালো। তুই ভেবে দেখতে পারিস।”

বিহান চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

” ভাবার কোন জায়গা আমি রাখিনি ব্রো। তুর্বী যা বলেছে সবটাই সত্যি। ঠকিয়েছি আমি মেয়েটাকে। ওর মন ভেঙ্গে দিয়েছি, ইচ্ছে করে। শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে।”

সৌহার্দ্য এরকম কথা শোনার জন্যে মোটেও তৈরী ছিলোনা। বিহান এমন করতেই পারেনা। ও একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

” তুই গিল্টি ফিলিং থেকে এসব বলছিস না? রিখিয়া কষ্ট পেয়েছে তাই তোর গিল্টি ফিল হচ্ছে। তাই তুই তোর নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিচ্ছিস তাইতো? ”

বিহান শক্ত কন্ঠে বলল,

” না ব্রো আমি যেটা বলছি একদম সত্যিই। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে গেছিলাম। যা করেছি ইচ্ছে করেই করেছি। আর যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ওকে কষ্ট দেব বলেই এসব করেছি আমি।”

সৌহার্দ্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ বিহানের দিকে। চোখ ছলছল করছে ওর। ও ভাবতেও পারেনি নি যে বিহান এমন একটা কাজ করবে। ও নিজেই এবার প্রচন্ড জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। বিহান অবাক হল। ও জানে ও যা করেছে তারপর সৌহার্দ্যর এরকম আচরণ করা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে চড়টা আশা করেনি। কিন্তু বিহানকে আবার অবাক করে সৌহার্দ্য আরেকটা থাপ্পড় মেরে বলল,

” আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি তুই এতোটা নিচে নামবি। অধঃপতন হয়েছিল তোর আমি জানতাম। জেনে শুনেও তোকে ছাড় দিতাম শুধুমাত্র তোর অতীতের কথা ভেবে। কিন্তু তাই বলে এতো জঘন্যতম কাজ করবি সেটা ভাবি নি।”

বিহান মাথা নিচু করে নিল। সৌহার্দ্য আবার বলল,

” রিখিয়ার মত একটা ভালো মেয়ের সাথে এরকম করার আগে তোর বিবেক তোকে আটকায় নি? এখনতো আমার মনে হচ্ছে তোর মধ্যে বিবেক বলে কিচ্ছু নেই। বাবা, ফুপা-ফুপি ঠিক বলেছিল তুই কারও যোগ্য নস। এখনতো আমার সন্দেহ হচ্ছে পাঁচ বছর আগে তোর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছিল, রেপিস্ট এর যে ট্যাগ তোর নামের আগে বসেছিল সেটা আদোও মিথ্যা অভিযোগ কি-না। এখনতো আমারও সন্দেহ হচ্ছে, সত্যিই নির্দোষ ছিলি তো?”

বিহান এবার অবাক চোখে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। চোখ ভরে এলো ওর। সারা দুনিয়া যে মুহুর্তে ওর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল তখন এই সৌহার্দ্য ওকে দুহাতে আগলে রেখেছিল। সে ভাইয়ের মুখে এই কথা শুনে বুক ফেটে যাচ্ছে ওর। সৌহার্দ্য ওখানে আর দাঁড়াল না। বিহানের ওপর রেগে থাকলেও শেষের কথাটা মন থেকে বলেনি ও। কিন্তু বলে ফেলেছে। কী করত? আজকে ওর দুজন ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকেই ও আঘাত পেয়েছে। একজন ওর মন ভেঙেছে, আরেকজন বিশ্বাস। বাতাসও আজ বড্ড বিষাক্ত লাগছে। সৌহার্দ্য যেতেই বিহান হাটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পরল। চোখ দিয়ে দু ফোটা জলও গড়িয়ে পরল। সত্যিই নিকৃষ্ট এক ব্যাক্তি ও। তাইতো সবাই ওকে ছেড়ে চলে যায়। সৌহার্দ্যও চলে গেল। কাউকে কাঁদিয়ে নাকি কেউ সুখে থাকতে পারেনা। রিখিয়াকে কাঁদিয়েছে বলে না হয় ওও এখন কাঁদছে মেনে নিল। কিন্তু মায়া? মায়া কীকরে এখনও সুখে আছে? ওরও তো শাস্তি প্রাপ্য ছিল তাইনা? কিন্তু তার বদলে মিথ্যা অপবাদের দহনে বিহান নিজেই পাঁচ বছর যাবত জ্বলছে। এ কেমন অবিচার?

ঐদিকে তুর্বী আর রিখিয়া মুখোমুখি চুপচাপ বসে আছে। রিখিয়াকে তুর্বী ওর আর সৌহার্দ্যর সব ঘটনাই খুলে বলেছে। রিখিয়া এখনও উত্তর দেয়নি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিখিয়া বলল,

” তুমি কষ্ট কেন পাচ্ছ? তোমার তো এক্সপিরিমেন্ট ফুলফিল হয়েছে তাইনা? আমারই ভুল ছিল সেদিন মজার ছলে ওনার নাম নিয়েছিলাম।”

” রিখু আমি..”

” অনেক রাত হয়েছে। ক্লান্তি আমি, একটু ঘুমাব তুর্বী।”

রিখিয়ার মুখেও ‘তুর্বী’ ডাকটা শুনে তুর্বী অবাক হল। কিছু বলার আগেই রিখিয়া গিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে পরল। তুর্বী কয়েকবার ডাকার পরেও সাড়া দিলোনা রিখিয়া। তুর্বী হতাশ হয়ে এসে বেডে বসে দুহাতে চুল টেনে ধরল। আচ্ছা ও কী সত্যিই বিশাল বড় অন্যায় করে ফেলেছে? রিখিয়া আর সৌহার্দ্য দুজনেই এভাবে দূরে ঠেলে দিল ওকে? যদিও সৌহার্দ্যকে ও নিজেই দূরে ঠেলেছে। কিন্তু সেটাতো সৌহার্দ্যর ভালোর জন্যেই।

ভোররাত, চারপাশটা খুব বেশিই নিস্তব্ধ। বিশাল এক তুফানের পর যেমন সবকিছুই শান্ত হয়ে যায়। পরিবেশটা আজ ঠিক সেরকমটাই মনে হচ্ছে। সবকিছুই একেবারে এলোমেলো হয়ে গেছে। আজ শুধু শুধু দুটো ভালোবাসার সম্পর্ক ভাঙেনি। হয়তো দুটো বন্ধুত্বের সম্পর্কও ভেঙ্গে গেছে। একদিনের ঝড়ে সবটা ওলোটপালট হয়ে গেছে, সবটা।

#চলবে…

[ বর্ষণের সেই রাতে দেব। তবে গভীর রাত হয়ে যাবে। কিছু করার নেই। দুটোই দিচ্ছি আজ তাই একটু ধৈর্য ধরতেই হবে। ]#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩২
.

মাঝখানে আরো একটা বিষাক্ত দিন কেটে গেল। সৌহার্দ্য বিহানের ওখান থেকে ফিরে নিজের রুমে ঢুকেছে কিন্তু আর বেড় হয়নি, দরজাও খোলেনি। সৌহার্দ্যর মত শান্ত ছেলেরও আজ সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করেছে। দিনের শেষে বিহান আর তুর্বীর সাথে একটু কথা বলার ইচ্ছেটুকু হয়েছিল ওর। কিন্তু কোথাও একটা আটকে গেছে। বিহানও গোটা দিনটা নিজের ফ্লাটে গুটিয়ে বসে ছিল। সৌহার্দ্যর শেষের কথাটার জন্যে ওর প্রতি বেশ অনেক্ষণ অভিমান ছিল ওর। কিন্তু পরে বুঝল যে ও যা করেছে তার জন্যে এটাই প্রাপ্য ছিল। সৌহার্দ্য নিজের জায়গায় ঠিক। পরে বিহান সৌহার্দ্যকে কয়েকবার ফোন করার পরেও সৌহার্দ্য ফোন ধরেনি। রিখিয়াকে ফোন করতে লজ্জা করছে ওর। কোন মুখে কথা বলবে? কী বলবে? মেয়েটার সাথে এতোবড় অন্যায় করার পরেও কী কিছু বলা যায়? তবুও নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে রিখিয়াকে ফোন করেছিল কিন্তু রিখিয়া ধরেনি ফোন। বরং একপর্যায়ে সুইচড অফ করে দিয়েছে।

অপরদিকে রিখিয়া সারাদিন তুর্বীর সাথে তেমন কোন কথা বলেনি। তুর্বীর ওপর অনেকটাই বিরক্ত ও। তুর্বীর দোষ আছে কী নেই সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু ওর ছেলেমানুষীর জন্যে একটা ছেলে যে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে সেটা নিশ্চিত। ওর নিজেরও যে মন ভেঙেছে তাই সৌহার্দ্যর কষ্টটা খুব ভালোভাবে উপলব্দি করতে পারছে। আর তুর্বী প্রচন্ড মানসিক অশান্তিতে রয়েছে। না রিখিয়া ঠিকভাবে কথা বলছে আর না সৌহার্দ্য ফোন ধরছে। সৌহার্দ্যর সাথে একটু কথা বলা জরুরি ওর। কিন্তু ছেলেটা ফোনটাই ধরছেনা। এখন সত্যিই ওর কান্না পাচ্ছে।

ঐ পুরো দিনটা চারজনেরই প্রচন্ড অস্হিরতা, কান্না আর ছটফটানিতেই কেটেছে। পরবর্তী সকালটা একটু অন্যরকমই হল। সারাদিন ভেবে সৌহার্দ্য আর রিখিয়া দুজনেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেটা হয়তো এবার চারটি জীবনের মোড় সত্যিই ঘুরিয়ে দেবে।

____________

সকালে আজ দ্রুতই রোদের আলো ছড়িয়ে পরেছে চারপাশে। সকাল সকাল রোদের উজ্জ্বল আলো চারপাশে ঝকঝক করছে। ভ্যাঁপসা গরম চারদিকে। একটু অস্বস্তিকর পরিবেশ আজ। শফিক রায়হান সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। আজ অনেক ভোরেই দেশে ফিরে এসেছেন সে। সৌহার্দ্য সিঙ্গেল সোফায় ওনার মুখোমুখি বসে আছে। চায়ের কাপটা টি-টেবিলে রেখে শফিক রায়হান বললেন,

” তুমি সত্যিই ব্যাংকক যেতে চাইছ?”

” হ্যাঁ বাবা! এমনিতেই তোমার এখন বয়স হয়েছে। তারওপর এতো বারবার বিদেশ জার্নি ঠিক হবেনা তোমার জন্যে। আর ওখানকার অফিসটাও ওরা ঠিকভাবে সামলাতে পারছেনা। আমারতো এদিকে কোন কাজ নেই। তাই আমি ওখানে থাকলে সবদিক দিয়েই ভালো হবে।”

সৌহার্দ্যর মা অবাক হয়ে শুনছেন। কী বলছে কী তার ছেলে? চলে যাবে এখান থেকে? শফিক রায়হান বললেন,

” তুমি তো দেশ ছেড়ে যেতে চাইতেনা। বিশেষ করে তোমার ঐ আদরের ভাইকে ছেড়ে। হঠাৎ কী হল?”

সৌহার্দ্য কিছু বলছেনা। শফিক রায়হান গম্ভীর মুখে বললেন,

” ওহ তাহলে আমার কথাই সত্যি হয়েছে। ভাইয়ের প্রতি অন্ধবিশ্বাস আর ভালোবাসার দাম দিয়ে দিয়েছে, তাইতো?”

সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে বলল,

” আচ্ছা বাবা তুমিতো চাও আমি বিজনেস দেখি। সেটাইতো করতে চাইছি। সমস্যা কোথায়?”

” ঐ ছেলের জন্যে আমাদের থেকে দূরে কেন যাচ্ছো।”

” বাবা আমি বাচ্চা নই। ওখানে একজন দরকার তাই যাচ্ছি। প্লিজ কথা বাড়িও না।”

” তো কবে যাচ্ছো?”

” টিকেট পেলেই চলে যাবো।”

সৌহার্দ্যকে ওর বাবা-মা দুজনেই অনেক বোঝালেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ও ওর সিদ্ধান্তে অটল। রেগে গিয়ে শফিক রায়হান বিহানের বাবা-মাকে কল করে সবটা জানালেন। ওনারাও সৌহার্দ্যকে ফোন করে আটকানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভ হয়নি। যার ফলে ওনারা বিহানের ওপর আরও ক্ষেপে বেশি গেলেন। ওনাদের মতে বিহানই সব নষ্টের মূল।

____________

সৌহার্দ্য আজ একটু বেড়িয়েছে, কালকে ফ্লাইট তাই কেনাকাটা করবে আর অফিসেও একটু যেতে হবে তাই। তুর্বী এদিকে অপেক্ষা করছে কবে সৌহার্দ্য আসবে অফিসে আর ও কথা বলবে। ওর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সৌহার্দ্যকে অফিসে আসতে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে একবারও না তাকিয়ে কেবিনে চলে গেল। তুর্বীও পেছন পেছন গেল। নক না করেই ভেতরে ঢুকে পরল ও। সেটা দেখেও সৌহার্দ্য কিছু বলল না। ও ফাইল দেখায় ব্যস্ত। তুর্বী সৌহার্দ্যর সামনে গিয়ে হাফানো কন্ঠে বলল,

” সৌহার্দ্য আমার কিছু বলার আছে তোমাকে।”

” কন্টিনিউ।”

” দেখ আমি জানি তুমি আমার জন্যে হার্ট হয়েছো। বাট ট্রাস্ট মি আমি এরকমটা চাইনি।”

সৌহার্দ্য ফাইল দেখতে দেখতেই বলল,

” চ্যাপ্টারটা অনেক আগেই ক্লোজ হয়ে গেছে। সো আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। অন্যকিছু বলার থাকলে বল।”

তুর্বী অসহায় গলায় বলল,

” সৌহার্দ্য আ’ম সরি।”

” ডোন্ট বি। এতে তোমার কোন দোষ নেই। আর হ্যাঁ কাল থেকে আবার বাবা বসবেন অফিসে। সো ওনার সাথে নতুন প্রযেক্ট নিয়ে কথা বলে নিও।”

” মানে? আঙ্কেল, আই মিন স্যার ফিরে এসছেন?”

” ইয়া, এন্ড আমি ব্যাংকক চলে যাচ্ছি। ওখানকার অফিসটা আমিই দেখব।”

তুর্বী যেন আকাশ থেকে পরল। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” চলে যাচ্ছো মানে?”

সৌহার্দ্য কঠিন গলায় বলল,

” আমি বাংলাতে বলেছি। না বোঝার কিছু নেই। আর এতে তো তোমার কিছু যায় আসারও কথা না তাইনা? সো ইউ মে গো।”

তুর্বী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সৌহার্দ্য চলে যাবে? ও নিজেকে সামলে বলল,

” সৌহার্দ্য এভাবে তোমার ফ্যামিলি, বিহানকে ছেড়ে তুমি..”

” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস। ইউ ক্যান গো।”

” সৌহার্দ্য তুমি..”

” তুর্বী যাও। আমি চাইনা তোমার সাথে মিসবিহেভ করতে।”

তুর্বী মাথা নিচু করে বেড়িয়ে গেল। কিন্তু সৌহার্দ্য চলে যাবে ব্যাপারটা মানতে পারছেনা। কিছুতেই না। সৌহার্দ্যও ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটাবার কী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলা যেতোনা যে ‘সৌহার্দ্য যেওনা। আমি তোমাকেই ভালোবাসি, আর তোমার সাথেই থাকতে চাই?’ তাহলে হয়তো সবটা অন্যরকম হত।

বিহান রিখিয়ার অফিসের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিখিয়ার সাথে কথা বলা দরকার। ওর অন্যায়ের জন্যে মেয়েটার কাছে আরেকবার ক্ষমা চাইতেই হবে। সৌহার্দ্যর যাওয়ার ব্যাপারটা জানে ও। বিহানের বাবা-মা ফোন করে বলেছে। সাথে বিহানকে নানারকম কথাও শুনিয়েছে। বিহানের মা তো বলেই ফেলেছে, ‘তোকে জন্ম দেওয়ার জন্যে আর মাসুল গুনতে হবে? আর কত ধ্বংস করবি তুই? মরে যেতে পারিস না?’ ফোনটা কেটে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল বিহান। এসবে এখন আর কষ্ট হয়না ওর। এরচেয়েও কঠিন কথা শুনেছে ও। তবে সৌহার্দ্যর চলে যাওয়ার কথা শুনে ও বিচলিত হয়ে যায়। সৌহার্দ্যর সাথে দেখা করে ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টাও করেছে বিহান কিন্তু লাভ হয়নি। সৌহার্দ্য ঠিককরে কথাই বলেনি।
রিখিয়া ওর অফিস থেকে বেড়িয়ে দেখে বিহান দাঁড়িয়ে আছে গেইটের সামনে। রিখিয়া মনটা কেমন করে উঠল। এ কী হাল করেছে ছেলেটা নিজের? কী হয়েছে ওর? কিন্তু বিহানের দেওয়া আঘাতের কথা মনে পরলেই ও নিজেকে সামলে চলে যেতে নিল। কিন্তু বিহান পথ আটকে বলল,

” রিখিয়া আমার কথাটা শোন প্লিজ।”

” পথ ছাড়ুন।”

বিহান ওখানেই হাত জোড় করে বলল,

” রিখিয়া আমি যা করেছে রাগের মাথায় করে ফেলেছি। বিশ্বাস কর রাগটা কমতেই আমি আমার ভুল বুঝেছি কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। তুমি এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ভালোবেসে ফেলবে বুঝিনি আমি। জানি অনেক কষ্ট দিয়েছি কিন্তু..”

রিখিয়া একটু হেসে বলল,

” ভুল মানুষকে ভালোবাসলে কষ্ট পেতেই হয়। তাই আমিও পাচ্ছি। এটা নতুন কিছু না। আর কিছু বলবেন?”

” প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে।”

এভাবে ক্ষমা চাওয়ার পরেও ক্ষমা না করার মত কঠিন হৃদয় এখনও রিখিয়ার হয়নি। তাই রিখিয়া বলল,

” দিয়েছি। ক্ষমা করে দিয়েছি।”

বিহান করুণ কন্ঠে বলল,

” রিখিয়া বিশ্বাস কর, তোমার ভালোবাসার বদলে যদি আমি তোমাকে কিছু দিতে পারতাম আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হতোনা। কিন্তু মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দ্বিতীয়বার ঠকাতে পারবনা তোমাকে।”

রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,

” কিছুই দিতে হবেনা। তাছাড়াও আমি কাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”

বিহান অবাক হয়ে বলল,

” কী?”

” হুম চলে যাচ্ছি।”

” তোমার জব?”

” ছেড়ে দিয়েছি। ওখানে জব অফার আছে একটা, ভালোই। বাড়িতে বাবা মার কাছেও থাকা হবে আর চাকরিও করা হবে। যাই হোক আসছি। ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ, দয়া করে ভবিষ্যতে কোন মেয়ের মন নিয়ে এভাবে খেলবেন না। সবাই রিখিয়া হয়না।”

বিহানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিখিয়া চলে গেল। বুক ফেটে কান্না আসছে ওর। ভালোই যখন বাসেনা তখন আবার ওর সামনে কেন এল? এক মুহূর্তের জন্যে ও ভেবেছিল বিহান ওকে ফেরাতে এসছে, ওকে বলত এসছে যে, ‘সরি মহারানি আমি তোমাকেই ভালোবাসি, শুধু প্রথমে বুঝতে পারিনি।’ কিন্তু বিহান এরকম কিছুই বলল না। বিহানের চোখ অকারণেই ছলছল করে উঠল। যদি পারত মেয়েটাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলত, ‘ভালোবাসি’। তাহলে হয়ত মেয়েটার কষ্টটা কমত। কিন্তু মিথ্যে বলে আবার মেয়েটাকে ঠকাতে পারবেনা ও। মেয়েটা তাহলে আরও বেশি কষ্ট পাবে। কারণ ভবিষ্যতে যে ও রিখিয়াকে ভালোবাসতে পারবে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা ও। তাই হতাশ হয়েই ফিরে গেল।

_____________

সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। চারপাশটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রিখিয়া। বাইরে দিয়ে নিজেকে মোটামুটি সামলে নিলেই মনের ক্ষতটা এখনও তাজা। এই ক্ষত এত দ্রুত ভালো হবার নয়। তুর্বী এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে রেলিং এ হাত রেখে বলল,

” এখনও রেগে থাকবি আমার ওপর?”

” আমি তোমার ওপর রেগে নেই তুর্বী। শুধু একটু বিরক্ত। এরকমটা না করলেও পারতে।”

” ইয়ার প্লিজ তুর্বী তুর্বী করিসনা। হার্ট হই আমি। আর কী করতাম আমি? ভালো না বেসেও সংসার করতাম ওর সাথে? টিকতো সেই বিয়ে? পরে আরও বেশি কষ্ট পেতোনা?”

রিখিয়া কিছু বলল না। তুর্বী বলল,

” আচ্ছা ছাড়। ঐ বিহানের জন্যে নিজেকে কষ্ট দিস না প্লিজ।”

রিখিয়া শান্ত কন্ঠে বলল,

” আমি আমাদের বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”

তুর্বী অবাক হয়ে বলল,

” মানে?”

” ওখানে একটা ভালো জবের অফার এসছে। যদিও এখানকার চেয়ে বেতন আট হাজার কম। তাতে কী? ফ্লাটের ভাড়াইতো আমার ভাগে দশ হাজার চলে আসে। ওখানে তো সেটা লাগবে না। এমনিতেও বাবা মা অসুস্থ। আমার এখন ওখানেই থাকা উচিত।”

” এক মিনিট! এক মিনিট! কী বলতে কী চাইছিস তুই? তুই চলে যাবি? ইউ মিন তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?”

রিখিয়া মলিন হেসে বলল,

” একদিন তো যেতেই হতো তুর্বী। সময়টা হয়তো এখনই।”

তুর্বী চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” দেখ আমি জানি তুই ডিপ্রেসড কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নিস না প্লিজ। দেখ একটু..”

রিখিয়া তুর্বীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল,

” আমায় যেতে হবে তুর্বী। বাবা-মার এখন আমাকে দরকার। কখন কী হয়ে যায় বলা যায়না। আমি যাচ্ছি, কিছু করার নেই।”

তুর্বী এবার কান্নামাখা গলায় বলল,

” তুই ছাড়া এখানে আমার কেউ নেই ইয়ার।”

এবার রিখিয়ারও গলা ধরে আসছে। তবুও নিজেকে শক্ত করে তুর্বীর কাধে হাত রেখে বলল,

” আমি আসার আগেও তো একাই ছিলে। আমাদের জীবনে এমন অনেক মানুষ হঠাৎ করেই আসে, খুব কাছের কেউ হয়ে ওঠে, আবার হঠাৎ করেই একদিন চলে যায়। অনেক দূরে। এটাই বাস্তবতা, আর তোমাকে সেটা মানতে হবে।”

কথাটা বলে রিখিয়া চলে গেল রুমে। আসলে এই জবটার কথা আরও আগেই বলেছিল ওর ওখানকার এক বান্ধবী। কিন্তু ও শুধু তুর্বীর কথা ভেবেই যায়নি। কিন্তু এখন আর এই শহরে থাকা সম্ভব না। শহরটা বড্ড বিষাক্ত লাগছে ওর কাছে। এখানে থাকলে ও বাঁচবেনা। মরে যাবে, নিশ্চিত মরে যাবে। ভাগ্যিস পোস্টটায় নতুন জয়েন করা লোকটাও কিছুদিন আগে জব ছেড়ে দিয়েছে। তুর্বী ভেতরে এসে দেখে রিখিয়া ব্যাগ গোছাচ্ছে। তুর্বী অস্হির হয়ে সব আবার এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

” রিখু প্লিজ যাসনা।”

রিখিয়া আবার সব গোছাতে গোছাতে বলল,

” ছেলেমানুষী করোনা তুর্বী। যেতে হবে।”

তুর্বী অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল রিখিয়ার দিকে। কিছু একটা ভেবে বলল,

” আমায় সকালে ঘুম থেকে কে তুলবে ? অফিসে লেট হয়ে যাবোতো। এলার্মে কাজ হয়না আমার তুই জানিস।”

” বেশ কয়েকটা এলার্ম দিয়ে রেখ। পরে আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে যাবে।”

” আমার কফি কে বানাবে। তুই জানিস আমার কফি জঘন্য হয়।”

” করতে করতেই ভালো হবে।”

” আর আমার..”

রিখিয়া এবার একটু রেগে বলল,

” বাচ্চা নও তুমি তুর্বী। আর এসব করে লাভ নেই আমাকে যেতে হবে।”

কথাটা বলে রিখিয়া ওয়াসরুমে চলে গেল। তুর্বী ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদেই দিল। এদিকে সৌহার্দ্য চলে যাচ্ছে কাল। আর রিখিয়াও। একা এই শহরে কীকরে থাকবে ও? ও তো দম আটকেই মরে যাবে একপ্রকার।

সকাল সকাল বাবা মার কাছে বিদায় নিয়ে সৌহার্দ্য এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছে। ওনারা চেয়েও আটকাতে পারেন নি। এয়ারপোর্টে নেমে দেখে বিহান দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে ওর একরাশ অসহায়ত্ব। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যাচ্ছে বিহানও সাথে যেতে যেতে বলল,

” ব্রো প্লিজ যাস না। তুই যা বলবি আমি করব কিন্তু প্লিজ ডোন্ট গো।”

সৌহার্দ্য একটা ঢোক গিয়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমায় যেতে হবে। ওখানকার অফিসে এঈজন থাকা জরুরি।”

” আরে এতোদিন চলেছে বাকিদিনও চলে যাবে। প্লিজ যাসনা।”

কিন্তু সৌহার্দ্য শুনছেনা। বিহানও এটা ওটা বলে ওকে আটকাতে চাইছে। বিহান আর সামনে যেতে পারবেনা। তাই সৌহার্দ্যর হাত ধরে আটকে বলল,

” প্লিজ।”

সৌহার্দ্য হাত ছাড়িয়ে বলল,

” ছেলেমানুষী ছেড়ে বাড়ি যা। যাওয়াটা কোনভাবেই ক্যান্সেল করা যাবেনা।”

বিহান এবার জেদ ধরে বলল,

” আমি ওতো কিছু জানিনা। তুই যাচ্ছিস না।”

বলে লাগেজটা নিতে গেলেই সৌহার্দ্য আটকে নিয়ে বলল,

” আমি বাবাকে কথা দিয়েছিলাম ভবিষ্যতে যদি তোর কোন অন্যায়ের প্রমাণ আমি পাই তাহলে আমি নিজে তোকে ত্যাগ করব। কাছে থাকতে সেটা সম্ভব নয়। আর আমি আমার দেওয়া কথার খেলাপ করিনা।

বিহান শুধু তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য চলে গেলে বিহান শ্বাস নেবে কীকরে? কে আছে সৌহার্দ্য ছাড়া ওর? ওর একা জীবনে যেটুকু বেঁচে ছিল সবটাই তো সৌহার্দ্যর জন্যে ছিল। না হলে তো পাঁচ বছর আগেই মরে যেতো। সৌহার্দ্য না থাকলে ও মরে যাবে, একদম মরে যাবে। কিন্তু তবুও কিছু বলল না। সৌহার্দ্য চলে গেল ভেতরে। ওরও কষ্ট হচ্ছে। গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছেনা। বিহান আর তুর্বীকে দেখতে পাবেনা ভাবলেই সব ফাঁকা লাগছে ওর। কিন্তু না চাইলেও অনেক কিছু ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। কিছু করার থাকেনা। বিহান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর যাওয়ার দিকে। চোখ দিয়ে আপনাআপনি জল গড়িয়ে পরল।
এদিকে রিখিয়াকেও আটকাতে পারেনি তুর্বী, চলে গেছে ও। তুর্বী কোন চেষ্টাতেই কাজ হয়নি। ভাগ্য অনেক যত্ন করে এই চারজনকে এক সুতায় গেঁথেছিল। একটা টানে সেই সুতো ছিড়ে আজ চারজন চারদিকে ছড়িয়ে পরল। ভাগ্য কী আবার কোনদিন এক করবে ওদের? ওরা কী আদোও কোনদিন পাবে জলফড়িঙের খোঁজ?

#চলবে…#জলফড়িঙের-খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৩
.

অবাধ্য সময় তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলেছে। সে কখনই কারো কথা শোনেনা, বোঝেনা, কারও অপেক্ষাও করেনা এটা সবাই জানে। কিন্তু তবুও সময়কে হাতের মুঠোয় বেঁধে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা অনেকেই করে। আবার অজান্তেই সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া মানুষেরও অভাব নেই। কেউ নিজের সুখের সময়টাকে ধরে রেখে দিতে চায়, আবার কেউ কষ্টের সময়গুলোকে দ্রুত পার করে ফেলতে চায়। কিন্তু সময়তো তার নিজস্ব ধারাতেই চলে। কারো সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। আবার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী তো সময় শুধু মানুষকে নিরাশ করতেই পটু। দেখতে দেখতে দুটো বসন্ত পেরিয়ে গেছে। সময় নিজের সাথে সাথে অনেককিছুই বদলে দিয়েছে। কিন্তু যত যাই হোক জীবন কারোর জন্যে থেমে থাকেনা। তাই সকলের জীবনই নিজের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে এগোচ্ছে সেটাই ভাবার বিষয়।

” Thanks sir, hope you got your answer. It was good to talk. see you at the next meeting.”

” Sure.Good luck to you.”

কথাটা বলে সামনের ব্যাক্তির সাথে হ্যান্ডশেক করে তাকে বিদায় দিল সৌহার্দ্য। ল্যাপটপটা বন্ধ করে চোখ থেকে চিকন ফ্রেমের চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল। এরপর টেবিলের ওপরের লাল বাটন চাপতেই দ্রুত দরজার সামনে একজন ছেলে এসে উপস্থিত হয়ে বলল,

” ইয়েস স্যার?”

” পুট এভরিথিং ইন ওর্ডার এন্ড দেন গো। আ’ম লিভিং।”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। সৌহার্দ্য কিছু না বলে অফিস থেকে বেড়িয়ে গেল নিজের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে। সৌহার্দ্য ফ্লাটে ঢোকার সাথেসাথেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা জানতে চাইলেন যে এখন সৌহার্দ্য কী খাবে এখন। সৌহার্দ্য বলল,

” ব্রিং আ কাপ অফ ব্লাক কফি।”

মহিলাটি কফি আনতে চলে গেলেন। সৌহার্দ্য ফ্রেশ হতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে এসে টেবিলে রেখে চলে গেল। সৌহার্দ্য ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এসে কফির মগটা হাতে নিয়ে চলে গেলো বারান্দায়। বিশাল উঁচু বিল্ডিং এর ব্যালকনি থেকে দেখছে শহরটাকে। বেশ রাত হয়ে গেছে। তবুও শহরটাতে আলো ঝলমল করছে। সূর্য ডুবে যাওয়ায় আলোর বোধ হয় কোন কমতি হয়না এ শহরে। বরং আলোর মাত্রা বেড়ে যায় বলেই মনে হয় সৌহার্দ্যর কাছে। আকাশচুম্বী সব টাওয়ার, বিশাল বিশাল আধুনিক স্হাপত্য, এতো আলো, নিচের সমতল বিস্তৃত রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা অগনিত যানবাহন। ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ব্যাংককের এই সৌন্দর্য দেখছে সৌহার্দ্য। কিন্তু উপভোগ করছে কি-না সেটা বলা মুসকিল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে চোখজোড়া নিচে নামালো সৌহার্দ্য। হাসিটাতে সম্ভবত তাচ্ছিল্যই মিশে ছিল। হয়ত নিজের ওপরই হাসল ও। সত্যিই জীবনটা অদ্ভুত দিকে মোড় নিয়েছে ওর। দুই বছর অনেকটা সময় কাউকে বদলে দেওয়ার জন্যে। সৌহার্দ্যর মধ্যেও বদল ঘটেছে তবে সেটা অন্যরকম। সৌহার্দ্য আগের মত থাকলেও নিজের জীবন নিয়ে ওর আর কোন সিরিয়াসনেস নেই। ও ওর বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবছেও না। ওর জীবনের এখন একটাই উদ্দেশ্য যতদিন বেঁচে আছে ততদিন বাবার এই ব্যবসা সামলে যাওয়া। নিজের জীবন নিয়ে অদ্ভুত ভাবনা ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠল ওর। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল ওর মা মিসেস নাহার ফোন করেছে। সৌহার্দ্য ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিলো। মিসেস নাহার সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

” কেমন আছিস, বাবা?”

সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বলল,

” ভালো।

”নিজে থেকে একটু ফোনও তো করতে পারিস বল। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখার কোন মানে আছে?”

” গুটাতে আর পারলাম কই? এতোগুলো পিছুটান আছেতো। গুটিয়ে তো অন্যকেউ গেছে। ছাড়ো এসব, তুমি কেমন আছো? বাবা কেমন আছে? আপুই ঠিক আছে তো? আর চ্যাম্প?”

” আমরা সবাই ঠিক আছি। তোর ফুপা-ফুপি বলছিল..”

বিহান শক্ত কন্ঠে বলল,

“ওনারা কী বলছিল আমি শুনতে চাইনা।”

মিসেস নাহার লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

“তুই তোর কথা বল, সবার কথা আর কত ভাববি? এবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নে।”

” সবতো গোছানোই আছে।”

মিসেস নাহার এবার একটু রাগী কন্ঠে বললেন,

” না নেই, আর কত এভাবে থাকবি। এবারতো বিয়ে করে নে। নাতি-নাতির মুখ দেখে মরতে দিবিনা না-কি? মেয়েতো আমরা ঠিক করেই রেখেছি। তুই এলেই বিয়ে হবে।”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বলল,

” মা আমি আগেই বলেছি যা বলার। এসব বলতে ফোন করোনা প্লিজ। আমি কিন্তু ধরব না।”

” আচ্ছা ঠিকাছে বলবনা আর।”

সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” বিহানের কোন খোঁজ পেয়েছ?”

” না রে। কোথায় পাবো। দু’বছর যাবত ছেলেটার কোন খোঁজ নেই। জানিনা কোথায় চলে গেছে।”

সৌহার্দ্য একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে ফোনটা রেখে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল। সবকিছুই এমন এলোমেলো হওয়ার কী খুব দরকার ছিল? দু’বছর আগে দেশ ছেড়ে আসাটা কী ভুল ছিল? হয়ত। কিন্তু ও কী করত? ওতো মানুষ। পরপর দুজন কাছের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ধাক্কা সামলাতে পারেনি ও। ওখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তাইতো চলে এসছিল। ওর মা এখন বিয়ের জন্যে মাঝেমাঝেই খুব চাপ দিচ্ছে ওকে। কিন্তু ওতো পারেনি আর কাউকে মনে জায়গা দিতে। একবার চেষ্টা করেছিল। ভেবেছিল এখানেই বিয়ে করবে। মেয়েটাকে ভোলা প্রয়োজন। কিন্তু পাত্রীর সাথে দুমিনিট কথা বলেই অস্হির হয়ে পরেছিল ও। পারছিল না অন্যকাউকে নিয়ে কিছু ভাবতে। মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে অবশেষে মস্তিষ্কের হার হয়েছিল। করতে পারেনি অন্যকাউকে বিয়ে। কিন্তু ওর বাবাও নাছোড়বান্দা নিজেই মেয়ে দেখে রেখে দিয়েছে, সৌহার্দ্য ফিরলে যেকোন ভাবেই হোক বিয়ে দেবেনই। একটা ছেলে এভাবে চিরকুমার হয়ে বসে থাকবে সেটা মানা যায়না। কিন্তু সৌহার্দ্য মনে তো এখনও এক রমনীর চঞ্চলতা খেলা করে, সেই খিলখিল হাসি, অদ্ভুত কথা, কীকরে ভুলবে? সারাদিন মন থেকে সরিয়ে রাখলেও প্রতিটা নিস্তব্ধ রাতে তুর্বী নামক এই নিষ্ঠুর রমনী হামলা করে সৌহার্দ্যর স্মৃতিজুড়ে, ক্ষতবিক্ষত করে দেয় হৃদয়কে। কেমন আছে ও? নিশ্চয়ই ভালো আছে! আচ্ছা এখনও কী একাই আছে? না-কি বিয়ে করে নিয়েছে। কথাটা ভাবলেই আজও গলা শুকিয়ে আসে সৌহার্দ্যর। আর বিহান? সৌহার্দ্য বিদেশ চলে যাওয়ার পর সৌহার্দ্যর বাবা, বিহানের বাবা-মা সবার ক্ষোভ বিহানের ওপরেই পরে। সেদিন বিহানের বাবা বিহানের ফ্লাটে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মত মেরেছিল বিহানকে। প্রথমবারের মত এবারেও বিহান টু শব্দটিও করেনি। পরেরদিন বিহানকে আর ওর সেই ফ্লাটে দেখা যায়নি। কোথায় আছে সেটা আদোও কেউ জানেনা। খবরটা অনেক পরে পৌঁছেছিল সৌহার্দ্যর কানে। সবটা শুনে বেশ রেগে গেছিল সৌহার্দ্য। ফুপার সাথে কথা কাটাকাটিও হয়েছে। তবে ও ফিরতে পারেনি। বিহানের কথা ভেবে সৌহার্দ্যর ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড় হল। একসঙ্গে কাটানো অনেক স্মৃতি এসেও ভর করল মনে। সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে অস্বুট স্বরে বলল, ‘বিহান’।

___________

প্রচন্ড গরম পরেছে। বিকেল হয়ে গেছে কিন্তু রোদ এখনও মাথার ওপরে আছে এমনই মনে হচ্ছে আজ। যেমন তীব্র ঝলমলে আলো তেমনই তার উষ্ণতা। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন এই গরম প্রায় সবার অবস্থাই নাজেহাল করে দেয়। লোডশেডিং হয়ে গেছে। গ্রামগঞ্জে এই লোডশেডিং নামক ঘটনাটা তুলনামূলক একটু বেশিই ঘটে। যা খুব বিরক্তিকর। কারেন্ট না থাকায় গরমে সবার অবস্থা আরও খারাপ। রিখিয়া অফিসরুমে নিজের টেবিলে বসে ঘাম মুছছে আর লিখছে। গরমে খুব কষ্ট হচ্ছে এই মুহূর্তে ওর। হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল শাফিন হাওয়া করছে ওকে। এ দু’বছরে শাফিনের সাথে রিখিয়ার সম্পর্কটা একটু ভালো হয়েছে। গ্রামে চলে আসার পর ওকে অনেকভাবে হেল্প করেছে শাফিন। ওর বাবে-মাকেও অনেক সাহায্য করে। ওখান থেকেই আস্তে আস্তে ফ্রি হয়েছে দুজন। প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হলেও পরে রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,

” শাফিন ভাই, আপনি এখানে?”

উত্তরে শাফিনও মুচকি হেসে বলল,

” এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম ভাবলাম দেখা করে যাই। বাড়ি ফিরবে না?”

” হ্যাঁ হাতের কাজটা শেষ করেই ফিরব।”

” চল তাহলে একসাথে ফেরা যাক।”

রিখিয়া সম্মতি জানালো। কাজ শেষ করে দুজনেই গ্রামের রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে যাচ্ছে। হঠাৎ শাফিন দেখল আইসক্রিম ওয়ালা যাচ্ছে। রিখিয়া খাবে কি-না জিজ্ঞেস করতে রিখিয়া হ্যাঁ বলে দিল। কারণ প্রচন্ড গরম পরেছে তাই ঠান্ডা কিছু খেলে ভালোই লাগবে। তবে এই আইসক্রিম দামী ক্রিমি আইসক্রিম নয়। এটা কাঠিওয়ালা সস্তার আইসক্রিম, যাকে আইসবারও বলে। দুজনেই ওরেঞ্জ ফ্লেবারটাই নিল। দুজনে পায়ে হেটে এগোচ্ছে আর আইসক্রিম খাচ্ছে। গাছপালা থাকায় মাঝেমাঝে হালকা বাতাসও লাগছে। হঠাৎ শাফিন বলে উঠল,

” কিছু ভেবেছ রিখিয়া?”

রিখিয়া জানে শাফিন কী জানতে চাইছে। কিন্তু ওর উত্তর বদলানোর নয়। তাই বরাবরের মত চুপ করে রইল। শাফিনও রিখিয়ার মৌনতার মানে বুঝে ফেলল, তাই আর কিছু বলল না।

বাড়ি ফিরে রিখিয়া দেখতে পেলো ওর ভাই রায়হান আজও এসছে। রিখিয়ার ভ্রু কুচকে গেল। এই দু-বছরে কম করেও হাজারবার এসছে। রিখিয়া বিয়ে করবেনা এটা সে কেন বুঝতে চায়না? রিখিয়া বিরক্তি নিয়ে রুমে চলে গেল। রায়হান বরাবরের মতই কিছুক্ষণ চিল্লাচিল্লি করে চলে গেল। রায়হান চলে যাওয়ার পর রিখিয়া ওর বাবা মায়ের কাছে এলো। এতক্ষণে চেঞ্জ করে নিয়েছে ও। বাবার শরীর ইদানিং খুব খারাপ হয়ে গেছে, যেকোন সময় যা খুশি হয়ে যাবে তাই রিখিয়া রায়হানের ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গিয়ে বলল,

” বাবা তোমার ঔষধ সব ঠিকঠাক আছে তো? শেষ হলে মনে করে বলো কিন্তু।”

রেজাউল ইসলাম গম্ভীর মুখে বললেন,

” এখানে বস।”

রিখিয়া কথা না বাড়িয়ে বসল। রেজাউল ইসলাম ওর মাথায় হাত রেখে বলল,

” অনেকতো করলি মা আর কত? নিজের জীবনটাকে আর নষ্ট করিস না। বিয়েটা করে নে এবার। শাফিনকে দেখেছি আমি। খুব ভালো ছেলে।”

রিখিয়া অসহায় গলায় বলল,

” বাবা তুমিও এবার আমাকে জোর করবে?”

রেজাউল ইসলাম একটু কেশে নিয়ে বললেন,

” জোর না মা, আমিতো বাবা। কোন বাপের তার মেয়েকে এভাবে দেখতে ভালোলাগে বল? তাও আমি সুস্থ থাকতাম, বড়লোক হতাম একটা কথা ছিল। আমি আজ আছি কাল নেই। তোকে কার ভরসায় রেখে যাবো তুই বল? আমি জানি আমার মেয়ে অনেক স্ট্রং। সে একা বাঁচতে জানে। কিন্তু আমারও তো ইচ্ছে যে তোর একটা সাজানো সংসার হোক।”

রিখিয়া মাথা নিচু করে ফেলল। কান্না আসতে চাইছে ওর কিন্তু কাঁদতে পারবেনা বাবা-মার সামনে। রিখিয়ার মা বললেন,

” হ্যাঁ তুমিই বোঝাও। আমি তো বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেললাম। এখন যে তোমার বুঝ হয়েছে এটাই অনেক। তবুও তো শাফিন ছেলেটা এখনও ওকে চায়। আমাদের মত বাড়ির মেয়েকে যে ওনারা নিতে চান এটাই তো ভাগ্য।”

” আহা, এভাবে বলছ কেন? আমার মেয়ে একদম খাটি সোনা। নিতে তো চাইবেই।”

” হ্যাঁ সেই সোনা সিন্দুকে তুলে রেখে দাও। বলছি বয়সতো আর কম হচ্ছেনা। এরপর বেশি বয়স হলে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারব? আমরা যখন থাকবনা ওর কী হবে ভেবে দেখেছ?”

রিখিয়া ছোট শ্বাস ফেলে উঠে চলে গেল ওর রুমে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুজে কেঁদে ফেলল। ওরও তো স্বপ্ন আছে। একজন ভালো স্বামী, শশুর বাড়ি, সংসারের। আর পাঁচটা মেয়ের মত ওও স্বাভাবিক জীবন চায়। কিন্তু ও কী করবে? যতবার সবাই বিয়ের কথা তোলে বিহানের মুখটা ভেসে ওঠে, বিহানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো বড্ড মনে পরে। ভালোবাসাটা আজ ও একইরকম আছে, পারেনি ও বিহানকে ভুলে যেতে, পারবেও না। তারমানে এটা নয় যে ওর বিয়ে না করতে চাওয়ার কারণ বিহান। যেখানে ও জানে বিহান কোনদিন ওর হবেনা তখন তার কথা ভেবে বিয়ে না করে সারাজীবন বসে থাকাটা ভিত্তিহীন। ওর বাবা-মার কথা ভেবেই বিয়ে করতে চায়না ও। মানুষ দুটো তে ওকে ছাড়া বড্ড অসহায়। আচ্ছা বিহান নিশ্চয়ই ওর ভালোবাসার বা পছন্দের কাউকে বিয়ে করে ভালো আছে। ও সবসময় ভালো থাক এটাই চায় রিখিয়া। ও না হয় সারাজীবন একতরফা ভালোবেসে যাবে। মোবাইলটা হাতে নিতেই ওয়ালপেপারে তুর্বীর সাথে ওর ছবিটা দেখে কান্নার গতি বেড়ে গেল ওর। কেমন আছে তুর্বী? কোথায় আছে? গ্রামে আসার পর ওর বাবা স্ট্রোক করে বসে। সবকিছুর মধ্যে তুর্বীর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে তুর্বীকে ফোনে আর পায়নি ও। দুমাস পর রিখিয়া শহরে গেছিল ওর খোঁজ নিতে কিন্তু সেখানে পায়নি ওকে। অফিসে গিয়ে শুনল যে তুর্বী ঐ জব ছেড়ে দিয়েছে। তুর্বী এখন কোথায় সেটা রিখিয়ার জানা নেই। ছবিটাতে হাত বুলিয়ে ফোনটা বুকে চেপে ধরে একটু আওয়াজ করেই কেঁদে দিয়ে বলল, ” মিসিং ইউ তুর।”

#চলবে…#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৪
.

কিছুক্ষণ আগে সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে। সকালের নরম, স্নিগ্ধ, শুভ্র আলো এসে ছড়িয়ে পরেছে গোটা সিলেট শহর জুড়ে। বিভিন্ন উঁচু নিচু পাহাড় আর বিস্তৃত সবুজ প্রকৃতির ওপর সূর্যের হালকা আলোর এই আভা যেন প্রকৃতিকে চোখ ধাধানো রূপে সাজিয়ে তুলছে। অন্ধকার রুমটাকে বাইরের আলো জানালার পর্দা ভেদ করে হালকা আলোকিত করেছে। শান্ত কক্ষটি হঠাৎই এলার্মের আওয়াজে নিজের নিরবতা হারালো। টি-টেবিলে রাখা টেবিল ঘড়িটি বেজে বেজে জানান দিচ্ছে যে সাতটা বেজে গেছে। এলার্মের এই বিরক্তিকর শব্দে ভ্রু কুচকে গেল তুর্বীর। বালিশে মুখ গুজে ডান হাত বাড়িয়ে এলার্মটা বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু একটুপর ফোনেও এলার্ম বেজে ওঠল। তুর্বী বুঝে গেল যে ও এখন আর ঘুমোতে পারবেনা। অফিস যেতে হবে। আজ প্রেজেন্টেশন আছে। তাই বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে একটা খোপা করে নিল। সামনের কাটা ছোট চুলগুলো উন্মুক্তই রয়ে গেল। উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরাতেই সকালের স্নিগ্ধ আলো সারা রুমে ছড়িয়ে গেল। তুর্বী লম্বা হাই তুলতে তুলতে ওয়াসরুমে চলে গেল। ব্রাশ করে একেবারে শাওয়ার নিয়ে বেড় হল। মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে রেখেই কিচেনে চলে গেল। গ্যাস অন করে এক কফি বানিয়ে মগে ঢেলে মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। কফি খেতে খেতে সিলেটের মিষ্টি সকালটা দেখছে। চোখদুটো বহু দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। কিন্তু গভীরভাবে ভেবে চলেছে কিছু একটা। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে কফির সাথে সাথে ভাবনাও শেষ করল। এরপর ভেতরে গিয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে অফিসে পৌঁছালো। অফিসে ঢুকে এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা নিজের ক্যাবিনে চলে গেল। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে কনফারেন্স রুমে চলে গেল। গিয়ে দেখে ওর জুনিয়ররা এসে বসে আছে। ও যেতেই ওনারা দাঁড়িয়ে গেল। তুর্বী বসার সাথেসাথে ওনারা বসে পরলেন। ওপরপাশে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

” সব রেডি আছে?”

” ইয়েস ম্যাম।”

বলে ছেলেটি তুর্বীর দিকে একটা পেনড্রাইভ দিল। তুর্বী পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল,

” সব করে নিয়েছ?”

সবাই ‘হ্যাঁ’ বলল। তুর্বী ল্যাপটপ অন করে পেনড্রাইভটা ইনসার্ট করে সব চেক করে নিল। এরমধ্যেই ওদের কম্পানির এমডি সহ আরও দুজন ক্লাইন্ট চলে এলো। তুর্বীসহ বাকিরাও দাঁড়াল। ওনারা বসে পরার পর বাকিরাও বসল তুর্বী বাদে। ও সামনে গিয়ে প্রজেক্টরে খুব সুন্দরভাবে নেক্সট প্রজেক্টের প্লান, ডিজাইন সব এক্সপ্লেইন করল। যেটা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। এরকমভাবে প্রেজেন্ট করতে খুব কম মানুষই পারে। প্লান পছন্দ না হওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। তাই ডিলটা ফাইনাল করে ক্লাইন্টরা এমডি কে কনগ্রাচুলেট করে চলে গেল। এম ডি সাহেবও তুর্বীর ওপর খুব খুশি। খুশি না হওয়ার কোন কারণ নেই! তুর্বীর কারণেই অনেক বড় বড় প্রজেক্ট আর ডিল পায় এই কম্পানি। এ দুই বছরে অনেক কিছু বদলেছে। নিজের স্বপ্ন নামক জলফড়িং কে ধরতে পেরেছে ও। এই দুই বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলে ও আজ একজন সিনিয়র আর্কিটেক্ট হতে পেরেছে। এবং কম্পানির বেস্ট একজন এমপ্লয়ী। সবাই মুগ্ধ ওর কাজ দেখে। তবে তুর্বীর মধ্যকার সেই চঞ্চলতাটা অনেকটা কমে গেছে। সেই লাফিয়ে, ঝাপিয়ে বেড়ানো মেয়েটা এখন ম্যাচুউরড হয়ে গেছে। প্রেজেন্টেশনের ঝামেলা মিটিয়ে তুর্বী ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে হাটা দিল ও। খিদে পেয়েছে প্রচুর। ক্যান্টিনে এককাপ চা আর একটা টোস ওর্ডার করে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে দেখছে। হঠাৎ মাথায় কেউ টোকা দিল। তুর্বী ভ্রু কুচকে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল একটা ছেলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বী ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবার ম্যাগাজিনে মন দিল। ছেলেটার নাম মিরাজ। তুর্বী আর ওর পোস্ট আলাদা আলাদা হলেও গোটা অফিসে একমাত্র মিরাজের সাথেই একটু ভালো সম্পর্ক তুর্বীর। বাকিদের সাথে তেমন মেশেনা। মিরাজ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

” একটু চমকালে কী হয়? কী জিনিস তুই?”

তুর্বীর কাছে মিরাজের প্রশ্নটা অতি অহেতুক মনে হল। তাই কোন উত্তর না দিয়ে ম্যাগাজিনে চোখ রেখেই বলল,

” কী খাবি ওর্ডার কর।”

” তুই কী ওর্ডার করেছিস?”

” তোর আস্ত মুন্ডুটা। তুইও খাবি? শেয়ার লাগবে?”

” আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? বলনা।”

তুর্বী এবারেও মিরাজের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আরেক কাপ চা আর টোস ওর্ডার করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার চলেও এল। খেতে খেতে মিরাজ বলল,

” আচ্ছা তুর..”

মিরাজকে থামিয়ে দিয়ে তুর্বী বিরক্তি নিয়ে বলল,

” তোকে কতবার বলেছি যে এসব তুর-ফুর বলে ডাকবিনা আমাকে। এসব শর্ট ফর্ম আমার পছন্দ নয়।”

” আচ্ছা সরি ম্যাডাম! ভুলে গেছিলাম, এতো রিঅ্যাক্ট করছিস কেন?”

তুর্বী কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। মিরাজ বুঝতে পারছে তুর্বী একটু রেগে গেছে তাই কথা ঘোরাতে বলল,

” আজতো ফাটিয়ে দিয়েছিস ইয়ার। কী প্রেজেন্টেশন দিলি!”

তুর্বী টোস চিবোতে চিবোতে বলল,

” কেন? সবসময় খারাপ হয়?”

” আরে না। উল্টো বুঝিস কেন? তুই ও না। তোর বর তোকে কীকরে সামলাবে সেটাই ভাবছি। এতো ধৈর্য কার হতে পারে?”

তুর্বী আনমনেই বলল,

” এরচেয়েও বেশি ধৈর্য নিয়ে কেউ আমাকে সামলেছে মিরাজ।”

মিরাজ অবাক হয়ে বলল,

” কী? কে সে?”

” কেউ না। বাদ দে।”

” আচ্ছা। কিন্তু এতো ভালো করে করিস কীকরে বলবি? সেই শুরু থেকে দেখছি। এতো পার্ফেক্টলি এক্সপ্লেইন করিস, ক্লাইন্ডদের ডিমান্ড সম্পর্কে এতো ভালো বুঝিস, ওয়ার্ড সিলেকশন নিয়ে কথা হবেনা। কিন্তু এগুলো এতো প্রপারলি শিখলি কীকরে? নিজে নিজে তো এতো পার্ফেক্টলি শেখা যায় না।”

তুর্বী চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে মুচকি একটা হাসি দিল। যেই হাসির কারণ মিরাজ জানেনা। তুর্বী মুখে সেই হাসি ধরে রেখেই উঠে ওর কেবিনে চলে গেল। মিরাজ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুর্বীর যাওয়ার দিকে। মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? কেমন জেনো! হ্যাঁ তুর্বী আগেও যেমন আলাদা ছিল, এখনো আলাদাই আছে। কিন্তু দুটো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। তুর্বী ওর কেবিনে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ রেখেই আঙ্গুল দিয়ে কলম ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের ভাবনায় মগ্ন। ওকে এতো সুন্দরভাবে কাজ তো সৌহার্দ্যই শিখিয়েছে। ঐ কয়েকমাস নিজের হাতে খুব যত্ন করে হাতে কলমে প্রপারলি কাজ শিখিয়েছে সৌহার্দ্য ওকে। ওর আজকের এই সফলতার পেছনে সৌহার্দ্যর ভূমিকা অনেকটা জুড়ে। রিখিয়া চলে যাওয়ার পর তুর্বী মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পরেছিল। ফোন করেও পাচ্ছিল না রিখিয়াকে। তারওপর সৌহার্দ্যকেও মিস করছিল ও। হ্যাঁ মিস করছিল সৌহার্দ্যর প্রতিটা কেয়ার, ভালোবাসা, কথা। একা জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল। তাই ওই জবটা ছেড়ে সিলেট চলে এসছিল। ভেবেছিল নতুন পরিবেশে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে। কিন্তু লাগেনি। জীবনটাও অন্যরকম হয়ে গেছিল। বারবার নিজেকে একটাই প্রশ্ন করত সবকিছুর জন্যে কী ওই দায়ী? সৌহার্দ্যকে কী মেনে নেওয়া যেত না? কিন্তু কীকরে? ওর জন্যেই কী রিখিয়া আজ নেই ওর সাথে? কিন্তু দিনশেষে কোন উত্তরই মেলাতে পারতো না। ধীরে ধীরে বুঝে গেল যে দুনিয়া ছেলেমানুষী মেনে নেয়না। দু-একদিন দেখতে খুব কিউট লাগে। কিন্তু একপর্যায়ে সবাই ছেলেমানুষীর ওপর বিরক্ত হয়ে যায়। এখন তুর্বীর মধ্যকার সেই ছেলেমানুষীটাও আর নেই। তবে কারো জন্যে ও নিজেকে বদলায় নি। ও বদলেছে কারণ ওর ছেলেমানুষী করার কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। এখন ওর ফোকাস শুধু ওর ক্যারিয়ারে। কিন্তু এমন কোন রাত নেই যখন ওর সৌহার্দ্যকে মনে না পরে। বড্ড মনে পরে। ভালোবাসে কি-না জানেনা তবে এটা সত্যিই যে খুব মিস করে সৌহার্দ্যকে। আর রিখিয়ার কথাতো সবসময়ই মনে পরে। ঘুম থেকে ওঠার সময়, খাওয়ার সময়, কফি করার সময়, প্রতি মুহূর্তে রিখিয়ার স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়। ওরা দুজন কেমন আছে, কীভাবে আছে এটুকুও জানেনা ও। চোখ মেলে হাতে পরে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকাল ও। যেটা রিখিয়া ওকে দিয়েছিল। গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুর্বী। চোখ কখন ভিজে উঠেছে নিজেই জানেনা। কিছু করার নেই এখন আর। কিছুই বেঁচে নেই আর। পরে আছে দীর্ঘশ্বাস, শুধুই দীর্ঘশ্বাস!

___________

সূর্য ঢুবতে চলেছে। রুম অন্ধকার হয়ে আসছে বলে লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রুমটা বড্ড অগোছালো। জানালার পর্দা একটা গুটিয়ে রাখা, আরেকটা ঝুলছে। ফ্লোরে অনেক জায়গা ছিটে ছিটে বিভিন্ন রঙ পরে আছে। বিশাল টেবিলে অনেক রকম রঙের টিউব রাখা। অনেক রঙের ছিটে ছিটে অংশ পরে টেবিলেও লেগেছে। কিন্তু এতোকিছুতে পাত্তা না দিয়ে একমনে পেন্টিং করে চলেছে বিহান। ও বারবার ঘড়ি দেখছে আর কারও আসার অপেক্ষা করছে। বেশ অনেকটা সময় পর কলিংবেল বেজে উঠল। বিহান যেন এটারই অপেক্ষা করছিল। তুলিটা প্লেটের ওপর রেখে রুমাল দিয়ে হাত মুছে নিয়ে দরজা খুলতে গেল ও। দরজাটা খুলে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে দেখতে পেয়ে হাসল বিহান। হেসে বলল,

” ফরিদ, ভেতরে এসো।”

ফরিদ নামক ছেলেটি বিহানের বয়সীই হবে। শ্যামলা টাইপ, ছিপছিপে শরীরের একজন। ও উত্তরে মুচকি হেসে ভেতরে এলো। ভেতরে এসে সারারুমে চোখ বুলিয়ে নিল। প্রায় দশ বারোটা পেন্টিং আছে রুমে। বিহান হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

” কয়টা নিতে বলেছে?”

ফরিদ দেখতে দেখতে বলল,

” দুইটা লাগবে আপাতত।”

বিহান ভালোভাবে বেছে নিয়ে দুইটা পেন্টিং আলাদা করে রাখল। কিন্তু ফরিদের দৃষ্টি সাইডে রাখা ঐ বিশাল পেন্টিং এর দিকে। এতো সুন্দর পেন্টিংটা যে বিহান কেন বিক্রি করতে চায়না সেটাই বুঝে উঠতে পারেনা ফরিদ। এই নিয়ে কত বড় বড় ক্লাইন্টের পছন্দ হয়েছে পেন্টিং টা কিন্তু বিহান এটা বিক্রি করেনি। কী এমন আছে এই পেন্টিং এ? ফরিদ এসব ভাবতে ভাবতেই বিহান বলল,

” কখন আসবেন ওনারা?”

” চলে আসবেন। বেশি সময় নেবেন না।”

বিহান মাথা নাড়ল। প্রায় আধ ঘন্টা পর দুজন লোক এলো ফ্লাটে। ওনারা এসে বিহানের সাথে প্রথমে সৌজন্যমূলক আলাপ করলেন। এরপর বিহান ওনাদের ওর সিলেক্ট করে রাখা দুটো পেন্টিং দেখালেন। ওনাদের বেশ পছন্দ হল। কিন্তু হঠাৎ ঐ বড় পেন্টিং চোখ পরতেই দুজনের চোখ আটকে গেল। দুজনের মধ্যে কালো সুট পরা লোকটা বলল,

” ওয়াও! পেন্টিং টা জাস্ট অসাধারণ। মিস্টার বিহান আপনি ওটা কেন বিক্রি করছেন না? আমরা কিনতে চাই।”

বিহান মুচকি হেসে বলল,

” সরি। কিন্তু এটা বিক্রির জন্যে না।”

” প্লিজ ভেবে দেখুন। আমরা বেশ ভালো এমাউন্ট দিতে রাজি আছি।”

” সারা দুনিয়া আমার নামে লিখে দিলেও এই পেন্টিংটা আমি কাউকে দিতে পারব না।”

ওনারা অনেক বুঝিয়েও বিহানকে রাজি করাতে পারেন নি। ও ঐ ছবিটা বিক্রি করতে পারবেনা। অবশেষে ঐ দুটো পেন্টিং নিয়েই ওনারা চেক সাইন করলেন। ওনাদের জন্যে হালকা খাবারের ব্যস্ততা করেছে। খাওয়াদাওয়া করে ওনারা চলে যাওয়ার পর ফরিদ বিহানের পাশে বসে বলল,

” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” করে ফেল।”

” ঐ পেন্টিংটায় এমন কী আছে যে আপনি এতো টাকা অফার পেয়েও ওটা বিক্রি করেন না।”

বিহান পেন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” জানিনা কিন্তু এর কাছে সবকিছুই মূল্যহীন।”

” এই মেয়েটা কী আছে আদোও?”

” আছে।”

” ভালোবাসেন মেয়েটাকে?”

” হয়তো বেসে ফেলেছি। জানিনা ঠিক। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও মন থেকে সরাতে পারিনা।”

” এখন কোথায় উনি?”

বিহান স্হির কন্ঠে বলল,

” জানিনা।”

” আমি শুধু ভাবছি যে একটা মেয়ে মনের ভেতর কতোটা গেঁথে থাকলে এরকম নিখুঁত ছবি আঁকা যায়!”

বিহান পেন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে বলল,

” আচ্ছা ফরিদ, কেউ দূরে চলে গেলেই কী মনে বেশি করে গেঁথে যায়?”

ফরিদ ছোট মুখ করে বলল,

” জানিনা। যায় বোধ হয়।”

বিহান কিছু বলল না। ফরিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” আজ তাহলে আসি?”

বিহান সম্মতি দিল। ফরিদ চলে যাওয়ার পর বিহান স্নান করে নিল। গায়ে হালকা রং লেগে ছিল। স্নান করে বেড় হয়ে চুল মুছতে মুছতে পেন্টিংটার কাছে আবার গেল। রিখিয়ার পেন্টিং এটা। রিখিয়াকে বিহান একদিন বলেছিল, জীবনে কোন মেয়ের ছবি আঁকলে রিখিয়ার ছবিই আঁকবে। ও তাই করেছে। একটু একটু করে যত্ন করে এঁকেছে মেয়েটার ছবি। দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত। ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোট্ট শ্বাস ফেলল ও। আজ ওর মনে হয়, সেদিন যদি রিখিয়াকে আটকাতো তাহলে হয়তো আজ ও ভালোবাসতে পারতো ওকে। এখন হয়তো বেসেও ফেলেছে। কিন্তু কী লাভ? এতোদিনে নিশ্চয়ই রিখিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী সংসার নিয়ে ভালো আছে হয়ত। ওকেও হয়তো ভুলে গেছে। যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আর সৌহার্দ্য? ও কী ফিরেছে দেশে? সৌহার্দ্য খোঁজে ওকে? কেন খুঁজবে? ওতো খুব খারাপ একটা মানুষ। সত্যিই খারাপ। একটা মেয়ের মন ভেঙ্গেছে, নিজের ভাইয়ের বিশ্বাস ভেঙেছে। ক্ষমার অযোগ্য ও। কিন্তু ও তো সৌহার্দ্যকে খুব ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে নিজের ভাইকে। একটাবার দেখার জন্যে মন ছটফট করে। কিন্তু ও কারো জীবনে ফিরবেনা। ও একটা অভিশাপ। ওর সাথে থাকলে কেউ ভালো থাকবেনা, কেউ না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here