#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- 35 +36+37+38+39
.
খুব ভোরবেলা বাইরের হালকা আলো আর পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো রিখিয়ার। আজ শুক্রবার অফিস নেই। চাইলে আরেকটু ঘুমিয়ে নিতেই পারতো তবে ওর ভোরে ওঠারই অভ্যেস। তাই তাড়াতাড়ি উঠে পরল। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখে ওর বাবা-মা দুজনেই উঠে গেছে। রেজাউল ইসলাম চেয়ারে বসে আছেন। আর জাহানারা মানে রিখিয়ার মা নিচে বসে তসবি ঠিক করছেন। রেজাউল ইসলাম রিখিয়াকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
” কীরে মা? উঠে পরলি যে? আজ তো অফিস নেই আরেকটু ঘুমিয়ে নিতি।”
রিখিয়া রেজাউল ইসলামের পায়ের কাছে বসে ওনার হাটুতে হাত রেখে বললেন,
” আর ঘুম আসছেনা বাবা। অভ্যেস নেই।”
জাহানারা চোখ তুলে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
” তা কেন থাকবে। অভ্যেস তো শুধু সারাদিন খেটে বেড়ানোর। নিজের কপালটা নিজেই পুড়ছিস। যা খুশি কর, আমি কিছু বলবনা। আমার কোন দাম আছে না-কি এই বাড়িতে? একদম নেই।”
রিখিয়া নিজের মায়ের কথাতে তেমন পাত্তা দিলোনা। উনি সারাদিন এরকম বলতেই থাকে। মা তো। সন্তানের জন্যে সবচেয়ে বেশি চিন্তা তারই হয়। আর সেইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা থেকেই এসব কথা আসে। এগুলো ধরে বসে থাকার কোন মানে নেই। ও রেজাউল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চা খাবে বাবা?”
” হ্যাঁ শরীরটা ম্যাচম্যাচ করছে। একটু চা পেলে ভালোই হতো।”
” মা তুমি?”
জাহানারা তজবির দিকে মনোযোগ রেখেই বললেন,
” বাপ-বেটি যখন খাবি তখন আমি আর বাকি থাকব কেন?”
রিখিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। গ্যাস অন করে চায়ের পাত্রে পানি দেওয়ার পরই হঠাৎ তুর্বীর বলা কথাটা কানে বেজে উঠল, ‘ আমার কফি কে বানাবে ইয়ার? তুই জানিস আমার কফি জঘন্য হয়।’ কথাটা মনে রিখিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আচ্ছা তুর্বী এখন নিজে নিজে ভালো কফি বানাতে পারে? সকালে নিজে থেকে ঘুম থেকে উঠতে পারে? কতটা বদলেছে ও? এখন বুঝতে পারছে যে এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। ও ভেবেছিল সমস্যা কী যোগাযোগ তো থাকবেই। কিন্তু মেয়েটা যে এভাবে হারিয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারেনি। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে চা বানানোতে মনোযোগ দিল। চা করে বাবা-মা দুজনকে দিল। নিজেও এক কাপ চা খেয়ে বাইরে হাটতে বেড় হল। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না একদম। হাটতে হাটতে নদীর পারে পৌছে গেল ও। এখানে বেশ ঠান্ডা হাওয়া আছে। এই গরমের মধ্যে এখান দিয়ে হাটতে ভালোই লাগবে। নদীর ওপারের গাছপালা, বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট করে দেখা যাচ্ছে। সকালের আবছা আলোর সাথে হালকা রোদ সব নদীর জলে পরাতে এর নদীর সৌন্দর্য কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে। এপারে বালুর রাস্তা আর অনেকরকমের বড় বড় গাছপালা তো আছেই। রিখিয়া নদীর পার দিয়ে হাটতে হাটতে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছে। হঠাৎ কারো কাশির আওয়াজে পাশে তাকিয়ে দেখে শাফিন ওর পাশ দিয়ে হাটছে। রিখিয়া শাফিনকে দেখে হেসে বলল,
” আপনি কখন এলেন?”
শাফিন মুচকি হেসে বলল,
” যখন তুমি প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত ছিলে।”
” হঠাৎ এদিকে?”
” হাটতে বেড়িয়েছিলাম। তোমাকে দেখে চলে এলাম।”
” ওহ।”
” আঙ্কেল, আন্টির শরীর ঠিক আছে তো?”
” হ্যাঁ, ঠিক আছে!”
দুজনে হাটতে হাটতে এমনি কথা বলছে। কথার মধ্যে শাফিন বলল,
” রিখিয়া, কাউকে ভালোবাসতে?”
রিখিয়া থমকে গেল। কিছুক্ষণ শাফিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” বাসতাম না। এখনও বাসি।”
শাফিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কী ওর এতো বছরের অপেক্ষা সম্পূর্ণই বৃথা? তবুও ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” এটাই আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ? তবে তাকে বিয়ে করে নিচ্ছোনা কেন?”
রিখিয়া মলিন হেসে বলল,
” সে কখনও আমার হবেনা শাফিন ভাই। আমার ভালোবাসাটা একতরফা। সে হয়তো তার জীবনে এখন খুব সুখেই আছে।”
” যে তোমার কখনও হবেই না তারজন্যে অপেক্ষা করার মানে কী?”
” আপনাকে কে বলল আমি ওনার জন্যে অপেক্ষা করছি? আমি ওনার জন্যে বসে নেই শাফিন ভাই।”
শাফিন একটু অধৈর্য হয়ে বলল,
” তাহলে আমাকে বিয়ে করতে কী সমস্যা? কেন এমন করছো? ছেলে হিসেবে আমি খুব খারাপ?”
” সেরকম কিছু না শাফিন ভাই। আপনি আমার সমস্যাটা বুঝবেন না।”
শাফিন রিখিয়ার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
” বুঝতে তো চাইছি রিখিয়া। কিন্তু তুমি বুঝতে দিচ্ছ না। আমি তোমাকে আমায় বিয়ে করার জন্যে জোর করছিনা। আমি শুধু জানতে চাইছি। আমায় বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা কী? এটুকুও কী জানতে পারিনা আমি?”
রিখিয়া কিছু না বলে শুধু ওর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকাল। শাফিন সাথেসাথে হাত ছেড়ে নিয়ে বলল,
” আ’ম সরি! আমি আসলে..”
রিখিয়া কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। কী করবে ও? শাফিনকে হ্যাংলার মতো করে বলতে পারবেনা যে ও ওর বাবা-মার কথা ভেবে বিয়ে করতে চায়না। শাফিন তাহলে ভেবে নিতেই পারে যে ও শাফিনকে ইনডিরেক্টলি ওর ফ্যামেলির দায়িত্ব নিতে বলছে। ও কারো কাছে ছোট হতে পারবেনা।
____________
ডুপ্লেক্স বাড়ির বিশাল বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে বিহান। হাতে মদের গ্লাস।বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে বান্দরবান নামটা প্রথমদিকেই মাথায় চলে আসে। আর যদি বান্দারবান টাই স্হায়ী ঠিকানা হয় তাহলেতো ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে। এটাই সবাই ভাবে। কিন্তু গত দুবছর যাবত বান্দারবানে থেকে বিহান বুঝতে পেরেছে সুন্দর স্হানগুলো বাসস্হান হওয়া উচিত নয়। তাহলে সেই চমৎকার সুন্দর দৃশ্যগুলোকে একপর্যায়ে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। তখন চমকে যাওয়া বা মুগ্ধ হওয়ার মত কিছু পরে থাকেনা। একটানা বহুদিন দেখলে ‘প্যাংগং লেকও’ মানুষের কাছে বিশেষ কিছু বলে মনে হবেন। এরচেয়ে ব্যস্ত শহর বা কম উন্নত গ্রামগুলোতে থাকা ভালো। মাঝেমাঝে এরকম জায়গায় ঘুরতে এসে চমকে যাওয়া যায়, মুগ্ধ হওয়া যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলা যায় ‘ওয়াও, কী সুন্দর! যদি এখানেই থাকতে পারতাম।’ এই যদিটা ‘যদি’ অবধিই সুন্দর, বাস্তবে রুপান্তরিত করতে গেলেই সবটা পানসে হয়ে যায়। তাইতো বান্দারবানের এই সৌন্দর্য বিহানকে এখন আর সেভাবে টানেনা। তখন পেছন থেকে ফরিদ বলল,
“স্যার আসি?”
ফরিদের ডাকে বিহান ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। সোজা হয়ে বসে বলল,
” হ্যাঁ চলে এসো।”
ফরিদ এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। তাকিয়ে দেখে বিহান ড্রিংক করছে। ও শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিহান গ্লাসে আবার মদ ঢালতে ঢালতে বলল,
” খাবে? ঢালবো তোমার জন্যে?”
ফরিদ একটু ইতস্তত করে বলল,
” না। আজ নেব না। আমিতো ঐ মাসে এক দু পেক মারি।”
বিহান একটু হাসল। বিহান হঠাৎই এরকম কারণ ছাড়াই হেসে ওঠে। ওর এই হাসির মানে বুঝে উঠতে পারেনা ফরিদ। হাসি থামিয়ে বিহান বলল,
” আচ্ছা যারা নিয়মিত ড্রিংক করে তারা খুব খারাপ হয়?”
” জি স্যার অব্ না স্যার।”
বিহান আবারও হাসল। ফরিদ পরেছে মহা যন্ত্রণায়। এই লোকটাকে আস্ত একটা ধাঁধা মনে হয় ওর। যেই ধাঁধার সমাধান ও দেড় বছরের করতে পারেনি। বিহান বলল,
” আমাকে ভয় পেয়ে বলতে হবেনা। ওনেস্টলি বল। খারাপ হয়?”
ফরিদ মিনমিনে গলায় বলল,
” জানিনা স্যার। এবিষয়ে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই।”
” এটা বলতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। যাই হোক, নিয়মিত নেশা করার একটা সুবিধা কী জানো?”
ফরিদ কৌতূহল নিয়ে বলল,
” কী স্যার?”
বিহান কিছু বলল না। ফরিদও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিহান সম্পূর্ণ প্রসঙ্গটাই পাল্টে ফেলে বলল,
” প্রেমের অভিজ্ঞতা আছে?”
ফরিদ একটু লাজুক হেসে বলল,
” জি। গার্লফ্রেন্ড আছে।”
” বউ বানানোর ইচ্ছা আছে?”
” ইচ্ছেতো আছে স্যার।”
বিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” সময় থাকতে আগলে রেখো।”
ফরিদ কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। বিহান বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আচ্ছা ফরিদ, তোমার কাছে কী বান্দারবান স্পেশাল কিছু মনে হয়? লাইক এতো দূর থেকে, এতো অর্থ খরচ করে মানুষ দেখতে আসে। সেরকম বিশেষ কিছু?”
ফরিদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” হয়তো কিছু বিশেষ আছে। তাই সবাই ছুটে আসে। এমনি এমনিতো আর এতো টাকা নষ্ট করে আসবেনা। কিন্তু আমার কাছেতো তেমন বিশেষ কিছুই মনে হয়না।”
” এর কারণ জানো?”
” জি-না। আপনি বলুন!”
” না থাক! আমার দেওয়া লজিক তোমার পছন্দ নাও হতে পারে। এটা বরং তুমি ভাবো। মস্তিষ্কচর্চা হবে। বুঝলে?”
” জি বুঝেছি।”
বিহান গ্লাসে আরো একটা চুমুক দিয়ে বলল,
” তুমি কেন এসছিলে সেটা বল।”
ফরিদ এবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,
” সিলেট থেকে একটা কম্পানির টিম আসছে বান্দারবানে।”
” ভালো কথাতো। আমি কী করব?”
” ওনারা এই বাংলোর নিচের ফ্লোরটা এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া নিতে চান।”
বিহান গ্লাসটা রেখে ফরিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কয়টা রুম লাগবে বলেছে?”
” চারটা। মোট আটজন থাকবে।”
” টাকার ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছ?”
” জি। ওনারা রাজি।”
বিহান চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথায় ওপর দিয়ে হাত রেখে বলল,
” তাহলে দিয়ে দাও।”
” আচ্ছা।”
বিহান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” হঠাৎ সিলেট থেকে এখানে আসছে যে?”
” প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও ট্রেনিং থাকে। এবার বান্দারবান পরেছে।”
” হোটেল ছেড়ে এখানে কেন?”
” তা ঠিক জানিনা।”
বিহান উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বলল,
” বাদ দাও! লংড্রাইভে যাবে?”
ফরিদও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” লংড্রাইভে? এখন?”
বিহান আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
” বড্ড অসময় তাইনা?”
” জি।”
” সবকিছুই সময় মেনে করতে হবে এটা কোথায় লেখা আছে? চল!”
বলে চাবি নিয়ে বিহান বেড়িয়ে গেল। ফরিদ বিহানের যাওয়ার দিকে বোকার মত তাকিয়ে থেকে নিজেও পেছন পেছন গেল। ফরিদ বুঝতে পারে বিহান এসব কাজের মধ্যে কাউকে একটা খোঁজে। কিন্তু সেটা কে তা জানেনা। কে আছে যে বিহানের এই আড্ডা, লংড্রাইভ, খোলা মাঠে বসে থাকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত?
#চলবে…
[ ইচ্ছে করেই আজ একটু ছোট লিখেছি। এরচেয়ে বড় করতে গেলে পর্বের প্যাটার্ন অগোছালো হয়ে যেতো। লেখা দুপুরের দিকে কম্প্লিট হয়ে গেছিল। কিন্তু এদিকে কারেন্ট আর নেটওয়ার্ক ছিলোনা ইফতারের আগে এসেছে। তাই এখন দিতে হল।]#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৬
.
শব্দহীন রুমটাতে শুধু ল্যাপটপের কিবোর্ড প্রেস করার আওয়াজটাই আসছে। তুর্বীর সমস্ত মনোযোগ ল্যাপটপের স্ক্রিনে। যেনো এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তুর্বী আগেও ওর কাজ নিয়ে সিরিয়াস ছিল কিন্তু এখন প্রচন্ড বেশিই সিরিয়াস হয়ে গেছে। মাত্র দুবছরে এতো বড় পোস্টে প্রমশন সেটারই প্রমাণ। তখন মিরাজ দরজায় নক করে বলল,
” আসব ম্যাডাম?”
তুর্বী ওর পুরো মনোযোগ ল্যাপটপের স্ক্রিনে রেখেই বলল
” চলে আয়।”
মিরাজ ভেতরে এসে দেখে তুর্বী খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। এইমুহূর্তে ওকে জ্বালানো মানেই নিজের জন্যে একটা ফ্রি ধমক বরাদ্দ করা। কাজের সময় ডিস্টার্বেন্স তুর্বী মোটেও পছন্দ করেনা। তাই মিরাজ চেয়ার টেনে বসে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ দেখছে। তুর্বীর এটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। ও ওর মত কাজ করে যাচ্ছে যেন রুমে কেউ নেই। মেয়েটার এরকম অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য মিরাজকে বরাবরই বেশ ভাবায়। সৃষ্টিকর্তা যেন বিশেষ কিছু গুন দিয়ে রেখেছে ওর মধ্যে। যার কারণে ও নিজেকে সবার থেকে এতোটা আলাদা করে তুলতে পারে। প্রায় কুড়ি মিনিট পর তুর্বী ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে মিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কিছু বলবি?”
মিরাজ সোজা হয়ে বসে বলল,
” বলছিলাম যে আজ তো আর আমাদের তেমন বিশেষ কোন কাজ নেই। অফিসে আজ শুধুশুধুই বসে আছি।”
” হ্যাঁ তো!”
তুর্বীর এরকম ভাবে ‘ হ্যাঁ তো’ বলাতে আরও দমে গেল মিরাজ। যেটুকু সাহস করেছিল সেটুকুও শেষ হয়ে গেল। এই মেয়ে কখন না জানি আবার ধমকে বসে। অথচ আজ অবধি তুর্বী কাউকেই বকা বা ধমক দেয়নি। এমনকি ওর জুনিয়রদেরও না। তবুও অদ্ভুত কারণেই সবাই ওকে একটু ভয় পায়। হয়ত এটা ওর এরকম এটিটিউট এর জন্যেই। তুর্বী একগাদা বিরক্তি নিয়ে বলল,
” কোষ্ঠকাঠিন্যের মত সবসময় অর্ধেক বলে আটকে থাকার তোর এই রোগটা ঠিক কতটা বিরক্তিকর তুই জানিস। ক্লিয়ারকাট কথা বল।”
মিরাজ একটুখানি গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
” যেহেতু কোন কাজ নেই চল আজ চলে যাই।”
তুর্বী ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল,
” কেন গার্লফ্রেন্ডের সাথে মিট করবি না-কি? করলে যা। আমাকে টানছিস কেন?”
” ধূর তোর গার্লফ্রেন্ড! আমি গার্লফ্রেন্ডের কথা বলছিনা। আমি তোর কথা বলছি। চল আজ একটু ঘুরে আসি। রাস্তা দিয়ে হাটাহাটি করব। এই অফিসের একগাদা কাজ করতে করতে বোর হয়ে গেছি। আর তুইও গম্ভীর মুডে বসে থাকিস। জাস্ট নেওয়া যায়না এসব।”
তুর্বীর হঠাৎই রিখিয়াকে মনে পরল। ছুটি পেলেই দুজন ঘুরতে বেড়িয়ে যেত। ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়া, সিনেমা দেখা কত কী করত। ওসব ভাবা বাদ দিয়ে তুর্বী মিরাজের দিকে একটু গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায়। মিরাজ অনেকটা হকচকিয়ে গিয়েই বলল,
” আরে আমিতো জাস্ট এমনিই বলছিলাম ইয়ার! ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি। তোর ইচ্ছে হলে যাবি না হলে যাবিনা। এতে কার কী করার থাকতে পারে বল? তোকে জোর করবে কার ঘাড়ে কটা মাথা শুনি?”
তুর্বী আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছে মিরাজের দিকে। মিরাজ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” তোকে কে যেতে বলেছে বল? আমি শুধুই আমার কথা বলছিলাম। এইযে চলে যাচ্ছি। টাটা।”
তুর্বী এবার ফিক করে হেসে দিল। মিরাজ বোকার মত তাকিয়ে আছে। তুর্বী হাসি মুখেই ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল,
” চল। দেখি কোথায় নিয়ে যাস।”
মিরাজ বিশ্বজয় করা এক হাসি দিয়ে বলল,
” তুই সত্যি যাবি?”
” কানে শুনতে পাস না?”
” কিছুক্ষণ আগে ডাউট ছিল। এখন ক্লিয়ার হয়ে গেছি। চল! চল!”
তুর্বী আবারও হাসল ছেলেটার পাগলামী দেখে। ছেলেটার এরকম পাগলামো স্বভাব আর মিশুক হওয়ার জন্যেই অফিসের একমাত্র ওর সাথেই তুর্বীর একটা বন্ডিং তৈরী হয়েছে। তুর্বীকে এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড় হতে দেখে সবাই মোটামুটি একটা ঝটকা খেল। কারণ এই মেয়েকে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড় হতে দেখা আর হ্যালির ধুমকেতু দেখা অনেকটাই একরকমই।
সিলেটের পাহাড়ি ঢালু রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাটছে তুর্বী আর মিরাজ। বৃষ্টিভেজা রাস্তা, ভেজা সবুজ প্রকৃতি, দূরে দেখতে পাওয়া পাহাড়, আকাশের মেঘ সবমিলিয়ে প্রকৃতি আজ বেশ সুন্দর করেই সেজেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তুর্বীর কপালের মুক্ত ছোট চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। মিরাজ বলল,
” কি? ভালো লাগছে তো? তুইতো বেড় হতেই চাস না।”
তুর্বী চারপাশে আরেকবার তাকাল। সত্যিই খুব ভালোলাগছে ওর। কিন্তু সেই ভালোলাগাটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
” হুম ঠিক আছে।”
হঠাৎ করে মিরাজ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” ওই, বুটভাজা খাবি? ঐ দেখ যাচ্ছে।”
তুর্বী হালকা চমকে উঠল। সৌহার্দ্যর সঙ্গে যখন ঘুরতে যেত। তখন বুটভাজা দেখে তুর্বী এভাবেই চেঁচিয়ে উঠত। সৌহার্দ্য কিনে দিত ঠিকই কিন্তু বাচ্চা বলে টিজও করত। কিন্তু তুর্বী খাওয়ার সময় ঠিকই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখত। তুর্বী বিরক্ত হয়ে বলল,
” হ্যাঁ তাতে এভাবে চেঁচানোর কী আছে? খেলে খা।”
” তুই খাবিনা?”
” আমি এসব খাইনা।”
মিরাজ আর কিছু বলল না। বুটভাজা কিনে ওখানেরই নিচু একটা দালানের ওপর পা ঝুলিয়ে বসল দুজন। মিরাজ বলল,
” পরশু ট্রেনিং এ যাচ্ছি জানিসতো।”
তুর্বী বাইরে দেখতে দেখতে বলল,
” হু, বস বলল তো। বান্দরবান যাচ্ছি তাই তো?”
মিরাজ একটু উৎসাহি হয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ভালোই হবে। এবার বান্দরবানও ঘোরা হয়ে যাবে।”
কিন্তু তুর্বীর মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। যেনো সবটাই স্বাভাবিক। মিরাজ শুধু ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই মেয়েটাকে নিয়ে ও সত্যিই পারেনা। এতো অদ্ভুত কেন?
_____________
ব্যাংককে রাত বারোটা ছাব্বিশ বাছে। প্রায় ফাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সৌহার্দ্য। কোথায় যাচ্ছেনা। এমনিই চালাচ্ছে। মাঝেমাঝেই এরকম করে। একা একাই রাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে। বিহানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে। লং ড্রাইভে যাওয়া, খোলা মাঠে আড্ডা দেওয়া। কীভাবে বিহান আধমাতাল হয়ে পরে থাকত। ভুলভাল বকতো। নিজের মনের সব অভিযোগ, অভিমান, কষ্ট সৌহার্দ্যর কাছে প্রকাশ করত। অনেক কষ্টে ওকে সামলে ধরে এনে গাড়িতে তুলে বাড়ি আনতে হত। সবটা ভাবলে আনমনেই হেসে ওঠে সৌহার্দ্য। খুব মিস করে নিজের ভাইটাকে। বিহানও নিশ্চয়ই করে! কিন্তু কোথায় ছেলেটা। এতো অভিমান! হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছেলেটাকে এভাবে একা ফেলে চলে আসাটা ওর জীবনের বড় ভুলগুলোর মধ্যে একটা ছিলো। কী করত? বাবাকে কথা দিয়েছিল, তারওপর বিহানের ওপর রেগেও ছিল। কিন্তু ছেলেটা যে অভিমানে এভাবে গুটিয়ে যাবে সেটা কে জানতো? বিহান যে সুইসাইড করবেনা সেটা জানে সৌহার্দ্য। কারণ যেই বিহানকে ও ছেড়ে এসছে সে সাত বছর আগের বিহান নয়। পরিচ্ছন্ন, যত্ন করে বানানো একটা বিশাল গ্রাউন্ডের একপাশে গিয়ে বসল সৌহার্দ্য। কিছুই ভালো লাগেনা এখন আর। সৌহার্দ্য আনমনেই বলে উঠল,
” কোথায় আছিস বিহান?”
তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। এমন সময় ফোন বেজে ওঠাতে ভ্রু কুচকে ফোনটা বেড় করে দেখে ওর মা মিসেস নাহার ফোন করেছেন। হঠাৎ এইসময় ওনার কল দেখে একটু অবাক হল সৌহার্দ্য। রিসিভ করে ও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মিসেস নাহার কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন,
” সৌহার্দ্য…তোর বাবা..”
বলে আবারও কেঁদে উঠলেন। সৌহার্দ্য খানিকটা ঘাবড়ে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
” মা কাঁদছো কেন? কী হয়েছে বাবার?”
কিন্তু উনা কেঁদেই যাচ্ছেন। সৌহার্দ্য অধৈর্য হয়ে বলল,
” মা তোমার পাশে কে আছে তাকে ফোনটা দাও।”
তখন ওপাশ থেকে নুসরাত বলে উঠল,
” হ্যালো ভাই!”
” আপু! মা কাঁদছে কেনো? কী হয়েছে বাবার?”
নুসরাত ভাঙা গলায় বলল,
” বাবার হার্টঅ্যাটাক হয়েছিল। আমরা এনে হসপিটালে ভর্তি করেছি। তুই টেনশন করবি তাই তোকে আগে জানাই নি।”
সৌহার্দ্য শান্ত গলায় বলল,
” এখন কেমন আছেন?”
” একটু ভালো। তবে ডক্টর ফলেচে অবস্থা বেশি ভালো নয়। তোকে দেখতে চাইছে বারবার। প্লিজ ভাই এবার চলে আয় দেশে।”
” কিন্তু আপু..”
” কোন কিন্তু না। অনেক তো হল। আর জেদ করিস না ভাই, প্লিজ!”
নুসরাতের কাছ থেকে ফোন নিয়ে মিসেস নাহার বললেন,
” তোকে আসতে হবেনা। তুই ওখানেই থাক। থাক তোর জেদ নিয়ে। মরে যাক তোর বাবা। আমিও বাঁচবোনা আর বেশিদিন। আমরা মরে গেলেও আসবিনা বলে দিলাম।”
সৌহার্দ্য আহত গলায় বলল,
” মা..”
” কী মা হ্যাঁ? কী মা? কবে কী হয়েছে সেই নিয়ে এখনও জেদ ধরে বসে আছে। কে হই আমরা? আমাদের কোন মূল্যই নেই তোর কাছে। কী চাস তুই আমরা মরে যাই?”
বলেই কেঁদে দিলেন উনি। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর গম্ভীর স্বরে বলল,
” নেক্সট ফ্লাইটেই আমি আসছি। বাবার খেয়াল রেখো।”
মিসেস নাহার উচ্ছসিত কন্ঠে বললেন,
” সত্যি?”
সৌহার্দ্য উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে দিল। এরপর ওর এসিসটেন্টকে ফোন করে বলল বাংলাদেশের নেক্সট ফ্লাইটের টিকিট কেটে রাখতে। সবকিছু ঠিক করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। অবশেষে দুবছর পর দেশে ফিরতে চলেছে ও। ওখানে গিয়ে কী তুর্বীর সাথে আবার দেখা হবে। ও আছে এখনও ওই শহরে? নিশ্চয়ই আছে। কোথায় আর যাবে? কীকরে মুখোমুখি হবে ওর? কী জানি কী আছে ওর ভাগ্যে।
#চলবে…#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৭
.
আকাশে ঘনকালো মেঘ করেছে। আজ সারাদিনই থেকে থেকে বৃষ্টি পরছে। মেঘের জন্যে চারপাশটাও অন্ধকারে ছেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর মেঘ ডাকছে। বৃষ্টিমুখর পরিবেশটা যেন বান্দরবানের সৌন্দর্যকে একটা নতুন রূপ দেয়। এখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে। বিহান ওর রুমের বিশাল থাই গ্লাসটা খুলে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে বৃষ্টি দেখছে। হালকা বৃষ্টির ছিটা খানিকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওকে। তাতে ওর বিশেষ কিছু যায় আসছেনা। ও ওর ভাবনায় মগ্ন। বিহানের ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোনের রিংটনে। এসময় ডিসটার্ব করাতে বেশ বিরক্ত হলো বিহান। ফরিদের নামটা স্ক্রিনে দেখে বিরক্তি মোটেও কমলো না। রিসিভ করে বিরক্তিমাখা কন্ঠেই বলল,
” হ্যাঁ বল?”
ওপাশ থেকে ফরিদ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
” স্যার, নিচের ফ্লোরে যেই কম্পানির আটজনকে ভাড়া দিয়েছি তাদের এমডি দেখা করতে চাইছে আপনার সাথে।”
” আমার সাথে কেন?”
” জানিনা, বললেন কথা বলবে।”
বিহান ভ্রু কুচকে ফেলে বলল,
” উনি আসবেন না আমাকে যেতে হবে?”
ফরিদ ইতস্তত করে বলল,
” আপনি এলে ভালো হয়।”
” আচ্ছা রাখছি।”
বিহান ফোনটা রেখে আবার বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিল। সিগারেটটা শেষ করে তারপর যাবে দেখা করতে। নতুন কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া পরিচিত হতে ভালো লাগেনা ওর। কিন্তু আপাতত যেতে হবে। কেউ কথা বলতে চাইছে আর ও যদি না যায় তাহলে লোকটাকে অসম্মান করা হবে। সেটা ঠিক হবেনা। সিগারেট শেষ করে লম্বা শ্বাস ফেলে ও নিচে চলে গেল । নিচে করিডরে রেখে দেওয়া লম্বা চেয়ারে সেই কম্পানির এমডি বসে আজিজুল বসে আছেন। বিহানকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বিহানও ওনার সাথে হ্যান্ডশেক করে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করে নিল। আজিজুল বললেন,
” আসলে এবার আমি চাইছিলাম একটু প্রাকৃতিক পরিবেশে নরমালি থেকে এবারের ট্রেনিং সাড়তে। তাই এই বাংলোতে আসা।”
বিহানও হেসে বলল,
” ভালো করেছেন। মাঝেমাঝে প্রকৃতির স্বাদ নেওয়া ভালো।”
” হ্যাঁ একদম। আমার সাথে আমার সাতজন এম্প্লয়ী এসছে। দেখা হয়ে যাবে তোমার ওদের সাথে। বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট তাই তুমি বললাম। কিছু মনে করো না।”
বিহান হেসে বলল,
” না কিছু মনে করব কেন? অবশ্যই ডাকতে পারেন!”
দুজনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করল। বিহানের প্রথমদিকে বিরক্ত লাগলেও পরে বেশ ভালো লাগলো লোকটাকে। বেশ মিশুক টাইপ মনে হল। কত তাড়াতাড়ি মিশে গেল ওর সাথে। আজিজুলের সাথে কথা বলে বিহান ফরিদকে নিয়ে চলে আসার সময় সিড়ির কাছ দিয়ে কারো সাথে ধাক্কা লাগল। বিহান না দেখেই ‘সরি’ বলে চলে যেতে নিলে কেউ অবাক কন্ঠে ‘বিহান’ বলে ডেকে উঠল। বিহান বেশ অবাক হল এখানে ওর নাম ধরে কেউ ডাকাতে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টিতেও অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। মিরাজও ছিল তুর্বীর সাথে। তুর্বীকে দাঁড়াতে দেকে ওও দাঁড়িয়ে গেছে। বিহান একটু এগিয়ে এসে বলল,
” তুমি? এখানে?”
তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আমি এখানে ট্রেনিং এ এসছি। কিন্তু তুমি এখানে কীকরে?”
” এটা আমারই বাংলো। কিন্তু তুমি ট্রেনিং এ এসছো মানে তুমি এখন সিলেটে থাকছ?”
” হুম। কিন্তু তুমি বান্দরবান শিফট কবে করলে?”
” দু-বছর আগেই। তুমি সিলেট থাকো। আর রিখিয়া? ও কেমন আছে?”.
তুর্বী এবার হাত ভাজ করে চোখ ছোট করে বলল,
” ও কেমন আছে সেটা জেনে তুমি কী করবে? ওর প্রতি তোমার এই ইন্টারেস্টের কোন কারণ আছে কী? তোমার তো ভালো থাকার কথা। তা বিয়ে করে ফেলেছো? না-কি এখনও জামাকাপড়ের মত গার্লফ্রেন্ডস্ বদল করা, বেডরুমে নিয়ে আসা। এসব চালিয়ে যাচ্ছো?”
ফরিদ বড়সর ঝটকা খেল শেষের কথাটা শুনে। বিহানের গার্লফ্রেন্ড? তাও বেডরুমে? কীভাবে সম্ভব? এই দেড়বছরে কোন মেয়ের ধারেকাছে ঠিকভাবে যেতে দেখেনি বিহানকে। বেডরুম তো অনেক দূরের কথা। এই মেয়ে কী বলছে? তুর্বীর এটিটিউটের এরকম পরিবর্তন থেকে বিহান অনেকটা শকড। তুর্বী মানেই ওর চোখে একটা হাসিখুশি প্রাণচ্ছল মেয়ের ছবি ভাসত। কিন্তু এটা কোন তুর্বী? দুই বছরে এতোটা বদলে গেছে মেয়েটা? বিহান শান্ত গলায় বলল,
” সবকিছুর কারণ থাকতে হয়?”
তুর্বী কোন উত্তর দিলো না। বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকাল। বিহানের আচরণে অনেক পরিবর্তন চোখে পরছে ওর। এটা দুবছর আগের সেই বিহান নয়। কথায় কথায় ফ্লার্ট করা, মজা করা, দুষ্টুমি করা সেই বিহান কোথাও একটা মিসিং আছে। বিহান বলল,
“ও কোথায় আছে এখন?”
” ওর গ্রামের বাড়িতে হয়তো।”
” যোগাযোগ নেই তোমার সাথে?”
” যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম চলে যাওয়ার পর কিছুদিন। পারিনি। হয়তো আমার মত খারাপ একটা মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়নি।”
বিহানের কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলেই তুর্বী বলে উঠল,
” সৌহার্দ্য ফেরেনি?”
বিহান থেমে গেল তুর্বীর প্রশ্ন শুনে। পেছন ফিরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” ওর কথা মনে আছে তোমার?
তুর্বী মাথা নিচু করে ফেলল। বিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” ও ওর কথা রেখেছে। যোগাযোগ করেনি আমার সাথে আর। হয়তো ফেরেনি এখনও দেশে। আবার ফিরতেও পারে। জানিনা।”
তুর্বী কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই বিহান বলল,
” বদলে গেছ অনেক।”
” তুমিও।”
কথাটা বলে তুর্বী একটা মলিন হাসি দিল।
বিহান আর কথা না বাড়িয়ে ওপরে চলে গেল। ফরিদও পেছন পেছন গেল। তুর্বী নিজের কাজে যেতে নিলে মিরাজ বলল,
” কে ইনি? তোর পরিচিত কেউ?”
কিন্তু তুর্বী কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল। এখন মন মেজাজ একদম ভালো নেই ওর। কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়না।
____________
সৌহার্দ্য দু-দিন আগে ফিরেছে দেশে। সৌহার্দ্যর ফিরে আসাতে বাড়ির সবাই খুব খুশি হয়েছে।শফিক রায়হানকে বাড়ি আনা হয়েছে মোটামুটি সুস্থ উনি এখন। কিন্তু অফিসে যেতে পারবেন না। তাই আজ সৌহার্দ্যকেই অফিস যেতে হবে। কিন্তু ওর ভেতরটা কেমন করছে। দু-বছর পর আবার তুর্বীর সম্মুখীন কীকরে হবে? দূরে থেকে নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এখন সামনে গেলে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তো? এসব ভেবে ভেবেই সকাল থেকে অস্হির হয়ে যাচ্ছিল ও। কিন্তু অফিসে গিয়ে এতবড় ধাক্কা খাবে ভাবতে পারেনি। অফিস গিয়ে তুর্বীকে পায়নি ও আর। খুব অবাক হয়েছে ব্যাপারটাতে। আরো অবাক হয়েছে এম্প্লয়ীদের লিস্ট চেক করে কোথায় তুর্বীর নাম না পাওয়াতে। ও দ্রুত ম্যানেজারকে ডাকল। ম্যানেজার আসতেই সৌহার্দ্য জিজ্ঞেস করল,
” তুর্বী ইসলামের কথা মনে আছে আপনার?”
” জি স্যার।”
” উনি নেই কেন?”
” স্যার উনিতো জব ছেড়ে দিয়েছেন।”
সৌহার্দ্য হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” কবে?”
” স্যার প্রায় দুবছর হবে।”
সৌহার্দ্য কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,
” উনি বর্তমানে কোথায় আছে জানেন?”
” না স্যার।”
ম্যানেজারকে বিদায় দিয়ে সৌহার্দ্য মাথা চেপে ধরে বসল। তুর্বী আর এখানে নেই? ঐ ঘটনার পরেই চলে গেছে মেয়েটা। কিন্তু কোথায়? সৌহার্দ্য দ্রুত রিখিয়া যেই ব্যাংকে চাকরি করতো সেখানে ফোন করল। আর ওনাদের থেকে ইনফরমেশন নিয়ে জানতে পারল যে রিখিয়াও জব ছেড়ে দিয়েছে। কী হচ্ছেটা কী? কী হয়েছিল সৌহার্দ্য বিদেশ চলে যাওয়ার পর? এদিকে বিহাটারও খোঁজ নেই। ওর অবর্তমানে এখানে সবকিছু এভাবে বদলে গেছে? তাও এভাবে?
সন্ধ্যার অনেক পর বাড়ি ফিরল সৌহার্দ্য। ফ্রেশ হয়ে অনেকটা মনমরা হয়ে এসে ড্রয়িরুমে সোফায় বসল। নুসরাতের ছেলে ‘মীর’ অস্পষ্ট স্বরে ‘মামা’ বলে নুসরাতের কোল থেকে হাত বাড়িয়ে দিল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে ভাগ্নেকে কোলে তুলে নিলো। শফিক রায়হান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
” বিহানের কোন খোঁজ পেয়েছ?”
সৌহার্দ্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
” তুমি আবার ওকে নিয়ে কবে থেকে ভাবছ?”
” ও তোমার ভাই হওয়ার আগে আমার ভাগ্নে। ওকে শাসন করতাম ঠিকই কিন্তু ভালোও কম বাসিনি একসময়। তোমার সন্তান হওয়ার পর সে যদি এরকম জঘন্য একটা কাজ করে তুমি মেনে নেবে? খুন করলেও বিবেচনা করতাম। কিন্তু একটা ধর্ষককে কীকরে ক্ষমা করি?”
সৌহার্দ্য বলল,
” বাবা প্লিজ! অসুস্থ তুমি। আমি এসব নিয়ে তর্ক করতে চাইনা।”
শফিক রায়হান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” বয়স তো অনেক হল। এবার বিয়েটা করে ফেলো। তোমার বিয়ে দেখে অন্তত মরতে দাও।”
সৌহার্দ্য মীরের সাথে খেলতে খেলতেই বলল;
” পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা বিয়ে করেনি। তারা কী বেঁচে নেই? আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। নতুন কিছু বল।”
এবার মিসেস নাহার বললেন,
” আচ্ছা বিয়ে না করলি। মেয়েটার সাথে কথা বল। কয়েকটা দিন বন্ধুর মতো মেশ। এরপর যদি তোর ইচ্ছে না হয় বিয়ে করতে আমরা জোর করব না। বাবা-মায়ের এটুকু আবদার রাখ?”
সৌহার্দ্য একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আচ্ছা।”
নুসরাত হেসে বলল,
” যাক একটু হলেও সুমতি হয়েছে।”
শফিক রায়হান গম্ভীর স্বরে বললেন,
” তোমার করিম কাকার মেয়ের বিয়ে সামনের শুক্রবার। আমাদের যেতে হবে। অনেক দূরে গ্রামে বাড়ি। তাই দুদিন আগেই চলে যেতে হবে। এতোদিন পর দেশে এসছো। তোমাকেও যেতে হবে কিন্তু।”
সৌহার্দ্যর কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই এখন। কিন্তু এখন না ও করতে পারবেনা। তাই মাথা নেড়ে মীরকে কোলে নিয়েই ওপরে চলে গেল। এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না।
#চলবে…
[‘আপু ওদের আবার দেখা কবে হবে?’ ‘চারজন আবার একসাথে কবে হবে?’ ‘আপু ওদের এক করে দাও প্লিজ!’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলছেন অনেকে। হ্যাঁ আমি বুঝতে পারছি চারজনের এমন ছন্নছাড়া জীবন দেখে আপনাদেরও কষ্ট হচ্ছে। আমি নিজেও একজন পাঠক। এবং অধৈর্য পাঠক। বই পড়ার সময় ধৈর্য্য ধরতে না পেরে শেষ পাতায় চলে যাই আসল ঘটনা জানতে। তাই বুঝতে পারছি আপনাদের ব্যাপারটা। আমি চাইলে একপার্টেই চারজনের দেখা করিয়ে মিলও করিয়ে দিতে পারি। অসম্ভব কিছুই না। সাময়িকভাবে সবার ভালো হলেও। কিন্তু সেটা কতটা যুক্তিপূর্ণ হবে? খাপছাড়া হয়ে যাবেনা? এভাবে চারপ্রান্তের চারজনকে হুট করেই একজায়গায় নিয়ে আসা?
আমি এটা একটু অন্যভাবে সাজাতে চাইছি যাতে এন্ডিংটাও আপনাদের সেটিসফাইট করে আর উপন্যাসটাও অতি অবাস্তব বা খাপছাড়া মনে না হয়। ততদিন কষ্ট করে হলেও একটু ধৈর্য্য রাখুন। আর সবাইকে ঈদ মোবারক। অনেক ভালো ঈদ কাটুক সবার।]#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৮
.
নিজের রুমে বিছানার ওপর হাটু গুটিয়ে বসে কোলে একটা বালিশ নিয়ে সেটাকে খামচে ধরে বসে আছে রিখিয়া। যেকোন মুহূর্তে কেঁদে দেবে এমন অবস্থা। পাশের রুম থেকে রায়হানের চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আজকে আবার এসছে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। আজ একা আসেনি সাথে নিজের বউ নিলুকে নিয়ে এসছে। বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে আজ। কথার মাঝে জোরে জোরে কেশে উঠলেন রেজাউল ইসলাম। রিখিয়ার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হলোনা। বালিশটা কোল থেকে ছুড়ে ফেলে রেখে উঠে দরজা খুলে গেল বসার ঘরে। ওকে দেখে সবাই থেমে গেল। রিখিয়া এগিয়ে গিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কী শুরু করেছ তুমি? বাবা-মার সাথে চেঁচামেচি করছ কেন? বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার। ওনাদের বলছ কেন?”
রায়হান কিছু বলবে তার আগেই নিলু বলল,
” দেখ রিখিয়া আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলেনা। তোমার সত্যিই মনে হয় সারাজীবন এভাবে একা কাটিয়ে দিতে পারবে?”
রায়হান তেজী গলায় বলল,
” সেটাই বোঝাও এই মেয়েকে। আমি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
” এতো ভাবতে কে বলে তোমাদের? আর তাছাড়াও তোমরা আবার আমাকে নিয়ে কবে থেকে ভাবতে শুরু করে দিলে বলোতো? স্বার্থ ছাড়াতো তো তোমরা কিছু করোনা। আমার বিয়ে দিয়ে তোমাদের কী স্বার্থসিদ্ধি হবে?”
রায়হান রেগে বলল,
” খুব বেশি কথা শিখে গেছিস আজকাল। তোকে তো আমি..!”
বলে রিখিয়া মারতে নিলেই রেজাউল ইসলাম ধমক দিয়ে বলল,
” খবরদার! আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললে আমি কিন্তু তোমাকে পুলিশে দেব।”
রায়হান অবাক কন্ঠে বলল,
” বাবা!”
রেজাউল ইসলাম ঝাঝালো কন্ঠে বললেন,
” বেড় হও এখান থেকে। বেড় হও!”
নিলু এবার নিজের আসল রং দেখিয়ে দিয়ে বলল,
” কথা এতো পেঁচাচ্ছেন কেন বাবা? সোজা কথা বলে দিন না যে এই মেয়ের রোজগারে আপনার ঘর চলে। দু-বেলা ভালোমন্দ গিলতে পারেন। এমন সোনার ডিম পাড়া হাস কেই বা ছাড়তে চায়?”
নিজের পুত্রবধুর মুখে এরকম কথা শুনে ব্যথিত হলেন রেজাউল ইসলাম। সত্যিই কী তাই? নিজের স্বার্থে সে ব্যবহার করছে নিজের মেয়েকে? নিলু বলল,
” তাই বলছি। নিজের মেয়ের জীবনটা আর নষ্ট করবেন না। পারলে__”
নিলুকে থামিয়ে দিয়ে রিখিয়া বলল,
” ভাবি প্লিজ থামো। তোমাদের মুখে এসব মানায় না। ঠিকভাবে তো খবরও নাও না এই মানুষ দুটো বেঁচে আছে কি-না মরে গেছে। আর এখন এসব বলছ? লজ্জা করছেনা একটুও?”
রায়হান একটু অপমানিত বোধ করল। ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে রেড়িয়ে গেল বাড়ি থেকে। নিলুও পেছন পেছন চলে গেলো। রিখিয়া ওখানে রাখা চেয়ারে বসে পরল। বিরক্ত লাগছে ওর কাছে সবকিছূ এখন। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে রিখিয়ার বাবা বলল,
” একটা কথা বলব, মা?”
” বিয়ে করতে বলবে এইতো?”
শান্ত গলায় কথাটা বলল রিখিয়া। জাহানারা এতোদিন চেঁচামেচি করলেও এবার নরম কন্ঠে বলল,
” দেখ তোকে জোর করব না। কিন্তু নিলু একটা কথাতো সত্যি বলেছে। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। করিম ভাইর মেয়েটা তোর কত ছোট ওরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কাল। লোকেতো এবার খারাপ বলবে। এমনিতেই অনেকে অনেক কথা বলে।”
রেজাউল ইসলামও বললেন,
” আমাদের অপরাধবোধ আর বাড়াস না মা। সবকিছুর জন্যে নিজেদের দায়ী মনে হয়। আমাদের নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমরা ঠিক চালিয়ে নেব। তবুও এই ভার থেকে আমাদের মুক্তি দে।”
রিখিয়া মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে বেড়িয়ে গেল। রেজাউল ইসলাম দুবার ডাকলেও কোন সাড়া দেয়নি রিখিয়া। কী করা উচিত এখন ওর? কোন দিকে যাবে? ভাগ্য বারবার ওর সাথেই এরকম কেন করে? এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে ওকেই কেন পরতে হলো? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের বড় মাচাটার ওপর বসে পরল। উদাস দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। এই নদীরও লক্ষ্য আছে; সমুদ্র। পাহাড় থেকে নেমে সে নিরন্তর ছুটে চলে নিজের গন্তব্যে পৌছানোর জন্যে। কিন্তু ওর জীবনের লক্ষ্য কী? ওয গন্তব্য কোথায়? কী আছে ওর ভাগ্যে? হঠাৎ শাফিন এসে বসল ওর পাশে। শাফিনকে দেখে দ্রুত চোখ মুছে নিল। শাফিন একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল,
” আর কত লুকাবে নিজেকে? এতোটাও চাপা হওয়া ঠিক নয় রিখিয়া। অতিরিক্ত সবকিছুই খারাপ। ভালো জিনিসটার সাথেও যখন ‘অতিরিক্ত’ শব্দটা যুক্ত হয় সেটাও খারাপ হয়ে যায়। তো এটাই ছিল আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ?”
রিখিয়া কোন উত্তর দিলোনা। মাথা নিচু করে বসে রইল। ও বুঝতে পেরেছে আজ শাফিন বাইরে থেকে সবটাই শুনে ফেলেছে। শাফিন বলল,
” রিখিয়া বিয়ে কিন্তু শুধু দুটো মানুষের বন্ধন হয়না। দুটো পরিবারেরও হয়। তোমার আমার বিয়ে হলে তোমার বাবা-মা শুধু তোমার দায়িত্ব না, আমারও দায়িত্বও হয়ে যাবে। আর এতে ছোট হওয়ার কিচ্ছু নেই। এটা তোমার অধিকার। ওনাদের অধিকার থাকবে আমার ওপর।”
রিখিয়া একটু অবাক হয়ে তাকাল শাফিনের দিকে। শাফিন বলল,
” তবুও তোমাকে জোর করব না। সবটাই তোমার ইচ্ছা। আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো।”
কথাগুলো বলে শাফিন উঠে চলে গেল। রিখিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাফিনের যাওয়ার দিকে।
_____________
আকাশে মেঘ করেছে তাই সূর্য দেখা যাচ্ছেনা। কিছু পাখি কিচিরমিচির শব্দ করছে। বান্দরবানের পাহাড়ি রাস্তা, পাহাড়, মেঘলা আকাশ, সবুজ প্রকৃতি সবটাই দেখা যায় এই বাংলোর করিডরের বারান্দা থেকে। তুর্বী কফি খেতে খেতে দেখছে সবটা। তবে ওর দৃষ্টি আপাতত সামনের মাঠের বেঞ্চে বসে থাকা বিহানের ওপর। কেমন উদাসীনভাবে বসে ফোন দেখছে। এই দুদিন গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে বিহানকে। ছেলেটার মধ্যে অনেকটা বদল লক্ষ্য করেছে তুর্বী। শুধু ড্রিংক আর স্মোক করা ছাড়েনি। আর সবটাই বদলে গেছে। আর আজ সকালে ফরিদের কাছ থেকে অদ্ভূত কথা জানতে পেরেছে ও। গত দেড় বছরে না-কি বিহান অপ্রয়োজনে কোন মেয়ের কাছেও যায়নি। ভাবা যায় এই বিহানই একসময়ের প্লে বয় ছিল? আরেকটু খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে, নেশার কথা বাদ দিলে বিহান এখন অনেকটা সেরকমই যেরকম রিখিয়া বিহানকে দেখতে চাইত। ফরিদের মুখে এটাও শুনেছে বিহানের রুমে একটা মেয়ের পেন্টিং আছে যেটা ও খুব যত্নে রাখে। কাউকে বিক্রি করেনা। ওই পেন্টিং যদি রিখিয়ার হয় তারমানে তো___ এখন অনেক কিছু ঘুরছে ওর মাথায়। হঠাৎ মাথায় কেউ টোকা মারতেই তুর্বী পেছনে না তাকিয়েই রাগী কন্ঠে বলল,
” মিরাজ, সবসময় ভালোলাগেনা।”
মিরাজ হেসে দিয়ে রেলিং এ ভর দিয়ে বলল,
” এতো সিরিয়াসলি কী ভাবছিস?”
তুর্বী বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আচ্ছা? কিছু মানুষকে কী সেকেন্ড চান্স দেওয়া যায়? যদি সে নিজেকে বদলাতে পারে?”
মিরাজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” উমম। গভীর প্রশ্ন। তবে একটা কথা কী জানিস? জীবন একটাই। তাই যদি কাউকে আরেকটা সুযোগ দেওয়াতে আমাদের ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাহলে একটা চান্স নিতে সমস্যা কোথায়?”
তুর্বী কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে কিছু ভেবে হেসে দিয়ে বলল,
” জীবনে প্রথম একটা কাজের কথা বললি। তবে তার আগে আমাকে আরেকটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।”
কথাটা বলে তুর্বী চলে গেল। মিরাজ ওর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না। এটা নতুন কিছু না। মাঝেমাঝেই এমন হয়। এই মেয়ের কথা ওর মাথার অনেকটা ওপর দিয়ে যায়।
পরেরদিন সকালে, বিহান বিছানায় হেলান দিয়ে বসে গেমস খেলছে। তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরো মনোযোগ ফোনে নেই। দরজায় কেউ নক করতেই ও ভাবল ফরিদ এসছে। ও ভ্রু কুচকে খেলতে খেলতেই দরজাটা খুলে দিয়ে বলল,
” এতো সকাল সকাল যে?”
কিন্তু একটা মেয়েলী কাশির আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। বিহান একটু অবাক হয়ে বলল,
” তুমি?”
” হুম। আসলে আজ ট্রেনিং অফ আছে। আর সবাই যে যার মত ঘুরছে। আপাতত আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম তোমার সাথে এসে গল্প করি।”
বিহান একটু হেসে বলল,
” হঠাৎ আমার মত একটা খারাপ ছেলের সাথে গল্প করার ইচ্ছে হল যে?”
” চলে যাবো?”
” না, না। এসো, ভেতরে এসো।”
তুর্বী ভেতরে এসে সোফায় বসল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। অনেক পেন্টিং আছে। কিছু কিছু পেন্টিং কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিহান ওর দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল,
” কী খাবে? চা না-কি কফি?”
তুর্বী যেন এই প্রশ্নটা শোনারই অপেক্ষা করছিল। দ্রুত বলে দিল,
” কফি।”
” তুমি বস। আমি এখনি আসছি।”
তুর্বী মাথা নাড়ল বিহান চলে গেল কিচেনে। তুর্বী সাথেসাথেই উঠে সবগুলো পেন্টিং থেকে কাপড় সরিয়ে চেক করতে শুরু করে দিল। কিন্তু কোথাও কোন মেয়ের পেন্টিং নেই। যখন তখন বিহান চলে আসতে পারে। তাড়াতাড়ি করতে হবে। কিন্তু একটাতেও এমন পেন্টিং পেলোনা যেখানে কোন মেয়ে আছে। কোথাও না পেয়ে ও হতাশ হয়ে বসতে যাবে তখনই ওর চোখ গেল সরাসরি দূরে রেখে দেওয়া বড় পেন্টিংটার দিকে, যেটা লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা। ও দ্রুত সেখানে গিয়ে লাল রঙের কাপড়টা সরাতেই রিখিয়ার হাসিমুখের একটা পেন্টিং বেড়িয়ে এলো। তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতো নিখুঁত পেন্টিং? মনে চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে না গেলে এতো নিখুঁত ছবি হয়না। ওর মনে হচ্ছে রিখিয়াই দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখে সামান্য জল জমলো ওর। বিহানের আসার আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছে, পেন্টিংটা ঢেকে, দ্রুত এসে সোফায় বসে পরল। বিহান ওর দিকে কফি এগিয়ে দিতেই বলল,
” থ্যাংকস।”
” ইউ আর ওয়েলকাম।”
বলে বিহানও বসল ওর পাশে। বিহান বলল,
” তো সিনিয়র আর্কিটেক্ট তুর্বী ইসলাম। স্বপ্ন সত্যি হলো তাহলে?”
তুর্বী হেসে বলল,
” তোমার স্বপ্নও তো সত্যি হয়েছে।”
” তা হয়েছে।”
” তো আজ আমায় বান্দরবানের কিছুটা ঘুরিয়ে দেখাও যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”
” আপত্তি থাকবে কেন? এগারোটার দিকে চল তাহলে?”
” আচ্ছা!”
কিছুক্ষণ গল্প করার পর কথায় কথায় তুর্বী বলল,
” রিখায়াকে মিস কর?”
প্রশ্নটা শুনে বিহান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” কী লাভ? এতোদিন হয়তো ও স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছে। আমার মত একটা ছেলের ভাবনায় কী যায় আসে?”
তুর্বী কোন জবাব দিলোনা। তবে মনে মনে বলল, আমি জানি তুই ভালো নেই রিখু। আমার মন বলছে তুই ভালো নেই। তোকে যে যতই ভালোবাসুক তুই ভালো থাকবিনা। কারণ তোকে একমাত্র বিহানই ভালো রাখতে পারবে। আজ আমি ওর চোখে তোর জন্য সেই ভালোবাসা দেখেছি যেই ভালোবাসার স্বপ্ন তুই একসময় দেখতি। দুজন দুজনকে এতোটা ভালোবেসেও এতো কষ্ট পাবি সেটা হয়না। এবার আমি সেটাই করব যেটা আমার করা উচিত। তোদের আবার এক করব আমি। যেভাবেই হোক।
#চলবে…#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৯
.
গ্রামগঞ্জে বিয়ে ব্যাপারটাই অন্যরকম হয়। নতুন পুরোনো সবরকম নিয়ম মেনেই বিয়ে হয়। প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানেই একটা বাঙালিয়ানা ব্যাপার থাকে। যেটা সত্যি মন ভালো করার মত। করিমের মেয়ের বিয়ে খুব ভালোভাবেই কোনরকম ঝামেলা ছাড়া মিটে গেল। সৌহার্দ্য খুব ব্যস্ত ছিল সারাদিন। যতই হোক আত্মীয়র বাড়ির অনুষ্ঠান। আর ও একটা জোয়ান ছেলে। হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাটা ওকে মানায় না। ব্যাপারটা ভালোও দেখায় না। এখনও খানিকটা ব্যস্ত আছে কিন্তু কিছুটা অন্যমনস্ক। কাল থেকে তিনবার দেখা হয়েছে রিখিয়ার সাথে ওর। গতরাতে হলুদের সময় এসেছিল রিখিয়া। প্রথমে সৌহার্দ্য খেয়াল করেনি। কারণ রিখিয়া এসেই কনের ঘরে চলে গেছিল ওকে সাজাতে। কনেকে স্টেজে আনার সময়ই সৌহার্দ্য খেয়াল করে ওকে। রিখিয়া তখনও দেখেনি সৌহার্দ্যকে। কিন্তু পরে চোখে পরেছে। কিন্তু ব্যস্ততা আর এতো মানুষজনের কারণে কথা বলতে পারেনি কেউই। দুজন দুজনকে মাঝেমাঝে দেখে গেছে শুধু। ভীর কমার আগেই রিখিয়াকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে, তাই আর কথা হয়নি। সকালেও একবার এসছিল। কিন্তু তখনও বাড়ির অবস্থা একইরকম ছিল আর সৌহার্দ্যও অনেক ব্যস্ত ছিল। এরপর দুপুরে খাওয়া দাওয়ার সময় তো কথা বলা অসম্ভব ছিল। তাই তখনও আর কথা হয়নি। কিন্তু সৌহার্দ্যর রিখিয়ার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। ও জানতে চায় যে ও ব্যাংকক যাওয়ার পর কী হয়েছিল। আর ওপরদিকে রিখিয়াও করিমদের বাড়ির উঠোনেই হাটছে। সৌহার্দ্যকে দেখে রিখিয়ার মন অস্হির হয়ে উঠেছিল। ওর চোখ বারবার বিহানকে খুঁজছিল। সৌহার্দ্য এসছে কিন্তু বিহান আসেনি? কেন? হয়তো সাথে ফ্যামলি এসছে বলে। ও যতটুকু জানতো বিহানের সাথে ওর ফ্যামিলির সম্পর্ক ভালো নয়। তাই হয়তো আসেনি। খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওর যে; বিহান কেমন আছে, কীভাবে আছে। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওর মা বারবার ফোন করছে। যেতে হবে ওকে এখন। দূরে থাকা সৌহার্দ্যর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য ডাকে থেমে গেল। রিখিয়া পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল সৌহার্দ্য আসছে। সৌহার্দ্য দ্রুতপদে এসে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।”
রিখিয়া বলল,
” আমারও।”
” কখন কথা বলা যাবে?”
” কাল সকালে আটটার দিকে সামনে নদীর পারের ঐ বড় মাচাটার সামনে আসতে পারবেন? আমিও চলে আসব।”
” অবশ্যই পারব।”
রিখিয়া একবার ঘড়ি দেখে বলল,
” রাত হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি এখন। কাল কথা হবে।”
সৌহার্দ্য সম্মতি দিল। রিখিয়া চলে গেল ওখান থেকে। সৌহার্দ্য রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দ্রুত নিজের কাজে মন দিল।
সকালে সৌহার্দ্য বড় মাচাটার ওপর বসে বারবার ঘড়ি দেখছে আর রিখিয়ার আসার অপেক্ষা করছে। নদীর পার থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়া, পাখির ডাক, মুগ্ধ করা গ্রামীণ পরিবেশ সবকিছু উপভোগ করার মত হলেও আপাতত সৌহার্দ্যর ইন্টারেস্ট শুধু রিখিয়ার আসা নিয়ে। মনের মধ্যে এতো প্রশ্ন ওকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই রিখিয়া চলে এলো। হালকা হাফানো কন্ঠে বলল,
” সরি, আসলে সব গুছিয়ে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেলো।”
সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল,
” সমস্যা নেই, বসো।”
রিখিয়াও মাচাটার ওপর বসল। সৌহার্দ্য হালকা গলা ঝেড়ে বলল,
” কেমন আছো?”
রিখিয়া মলিন হেসে বলল,
” এইতো আছি। আপনি?”
” চলে যাচ্ছে।”
কথাটা বলে ছোট্ট শ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। এরপর বলল,
” হঠাৎ সব ছেড়ে গ্রামে ফিরে এলে যে?”
রিখিয়ার কষ্ট হলেও মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল,
” বাবা অসুস্থ ছিল। মায়েরও শরীর ঠিক নেই। এখানে দরকার ছিল আমাকে।”
” শুধু কী এটাই কারণ?”
রিখিয়া কোন উত্তর দিলোনা। শুধু মাথা নিচু করে বসে রইল। হঠাৎ করেই কেমন গলাটা ধরে আসতে চাইছে ওর। সৌহার্দ্য আবার বলল,
” তুর আই মিন তুর্বীর সাথে যোগাযোগ হয় তোমার?”
রিখিয়া অসহায় দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল। সৌহার্দ্যর বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। ও উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
” আমি যাওয়ার পর কী হয়েছিল রিখিয়া?”
রিখিয়া নাক টেনে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” আমি ওখান থেকে চলে আসার দিনই হঠাৎ বাবা ব্রেন স্ট্রোক করে। আমরা দিশেহারা হয়ে গেছিলাম। সব মিলিয়ে তুরের সাথে আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি আমার। কিন্তু পরে ফোন করেও ওকে পাইনি। আমি ফ্রি হয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা ওর খোঁজ করতে। কিন্তু জানতে পারি ও জব ছেড়ে চলে গেছে। এরপর আর কোন খোঁজ পাইনি ওর।”
বলতে বলতে রিখিয়া প্রায় কেঁদে দিয়েছে। সৌহার্দ্যর নিশ্বাস ভারী লাগছে। কোথায় আছে ওর তুর? কীভাবে আছে? যে মেয়েটা কথা বলতে না পারলে অস্হির হয়ে যেত সে এভাবে একা কীকরে আছে? তার রিখিয়াকে ছাড়া? রিখিয়াতো তুরের প্রাণ ছিল। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ছিল। রিখিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” বিহান কেমন আছে?”
সৌহার্দ্য অতি গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” জানিনা।”
সৌহার্দ্যর কথা শুনে চমকে উঠল রিখিয়া। জানিনা? জানিনা মানে কী? কী বলছে এসব সৌহার্দ্য? বিহানের খবর সৌহার্দ্য জানবেনা সেটা কীকরে হয়? ও কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
” মানে?”
সৌহার্দ্য রিখিয়াকে সবটা বলল। ওর বিহানকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া। বিহানের বাবা-মার ওকে মারা। এরপর বিহানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। সব শুনে রিখিয়া দুহাতে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। সবকিছুর জন্যে ওর এখন নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সবটা ওর জন্যে হয়েছে। সেদিনের ভুল বুঝে মারা ঐ একটা চড় আর ঐ ব্লান্ডারের পরিণতি এমন হবে কে জানতো? সৌহার্দ্য রিখিয়ার মনে অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
” নিজেকে এভাবে ব্লেম করোনা। তোমার দোষ ছিলোনা বরং তুমি নিজেই একজন ভুক্তভোগী। দোষ আমার ছিল। বিহান অন্যায় করেছিল ঠিকই কিন্তু আমার ওকে এভাবে ছেড়ে যাওয়া ঠিক হয়নি।”
রিখিয়া কিছু ভাবতে পারছেনা এখন আর। বিহানের কথাই মনে পরছে শুধু। ও জানে সৌহার্দ্য বিহানের কাছে কী ছিল। নিজের ভাইকে ছেড়ে কীভাবে আছে ছেলেটা। সৌহার্দ্য বেশ অবাক হচ্ছে। এখনও এতো ভালোবাসা? যদিও ওও তো তুর্বীকে এখনও ততটাই ভালোবাসে। রিখিয়া উঠে চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য বলল,
” রিখিয়া, বিয়ে করেছ?”
রিখিয়া ঘুরে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিল। যার অর্থ বুঝতে সৌহার্দ্যর সময় লাগল না। সৌহার্দ্য হেসে বলল,
” আজ ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। ভালো থেকো।”
” আপনিও ভালো থাকবেন।”
বলে রিখিয়া চলে গেল। ওর মন এখন আরও অস্হির। বিহানের চিন্তাই এখন ওর মাথায় ঘুরছে শুধু। সৌহার্দ্য রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, একটা ভুলের জন্যে মেয়েটা এখনও কষ্ট পাচ্ছে। এতোটা কষ্ট ও ডিসার্ব করেনা। যদি একটা সুযোগ পেত বিহানকে রিখিয়ার জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার। এর চেয়ে ভালো কিছুই হতোনা। ও ওর ভালোবাসাকে পায়নি ঠিকই কিন্তু অন্যকেউতো পেত। কিন্তু সেটা কী সম্ভব? বিহান কী এখনও ভালোবাসতে পেরেছে রিখিয়াকে?
___________
একটা বড় পাথরের ওপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বিহান আর তুর্বী। কেউ কিছুই বলছেনা আপাতত। ওদের দৃষ্টি এখন সামনের কিছুটা দূরের নাফাখুম ঝর্নার দিকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঝর্ণাগুলোর মধ্যে নাফাখুম অন্যতম। সাঙ্গু নদীতে এর অবস্থান। বান্দবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রিতে পাহাড় আর বনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত সাঙ্গু নদী। নৌকা করেই এসছে দুজন এখানে। তুর্বী বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” দারুণ কিন্তু তাইনা? এরকম ঝর্ণা আগে কখনও দেখিনি আমি। বেশ ইন্টারেস্টিং! কী যেন নাম এটার নাপা.__নাকি নাফা__
বিহান হেসে বলল,
” নাফাখুম। এটাকে রেমাক্রি জলপ্রপাতও বলে।”
” ও আচ্ছা। বাট বেশ সুন্দর। এসব দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃতি নিজের মধ্যে কত রহস্য আর সৌন্দর্য ধারণ করে রাখে।”
” হুম। তবে আমার কাছে এসব এখন স্বাভাবিক লাগে। দুবছর যাবত প্রায়ই দেখি।”
তুর্বী হেসে বলল,
” থ্যাংকস হ্যাঁ? এভাবে সময় করে ফাঁকে ফাঁকে ঘুরতে আনার জন্যে।”
বিহান মুচকি একটু হেসে বলল,
” কাল সিলেট ব্যাক করছ রাইট?”
” হ্যাঁ। যেতে হবে।”
বিহান আর কিছু বলল না। তুর্বী আড়চোখে তাকাল বিহানের দিকে। ও ইচ্ছে করেই বিহানের সাথে এতো সময় কাটাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করছে যে সত্যিই বিহান কতটা বদলেছে। রিখিয়াকে ভালো রাখতে পারবে কি-না। কিন্তু এখন ও নিশ্চিত যে বিহানই পারবে রিখিয়াকে সবচেয়ে ভালো রাখতে। ও একটু গলা ঝেড়ে বলল,
” যদি তোমার কাছে সুযোগ আসে রিখিয়াকে আবার ফিরে পাওয়ার? ওকে ভালোবাসার? কী করবে?”
বিহান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” ও আর ফিরবেনা আমার কাছে।”
বলে বিহান হাটা দিল। তুর্বী তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। ও জানে এখন ও কী করবে। একয়েকদিনে ও এটাও বুঝেছে যে বিহান সৌহার্দ্যকেও ভীষণভাবে মিস করে। তাই এবার শুধু রিখিয়া না, পারলে দুই ভাইয়ের সম্পর্কটাও ঠিক করার একটা চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সৌহার্দ্য কী ফিরেছে আদোও? না ফিরলে কী করবে ও? ভাবনা থেকে বেড়িয়ে নিজেও বিহানের পেছন পেছন হাটা শুরু করল।
সিলেটে নিজের ফ্লাটে জামাকাপড় গোছাচ্ছে তুর্বী। মিরাজ রুমে এসে দেখে তুর্বী জামাকাপড় গোছাচ্ছে। মিরাজ ব্যাগটা রেখে আগে ওখানে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেল। তারপর হাফানো কন্ঠে বলল,
” তোর মতলব কী বলত? বান্দরবান থেকে ফিরেই কিছু নিয়ে ভেবে চলেছিস। অফিস থেকে আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি। তারওপর বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এলি। তুই! ছুটি নিয়েছিস! তাও এতোগুলো দিনের? কী হয়েছে বলবি?”
তুর্বী লাগেজ গোছাতে গোছাতেই বলল,
” এবার একটু শ্বাস নে বাপ। বড্ড বেশি কথা বলিস। আর হঠাৎ এখানে এলি কেন?”
” তো কী করব? এরকম উদ্ভট কান্ড করে বেড়ালে টেনশন হয়না? কী চলছে তোর মাথায়?”
তুর্বী হেসে বলল,
” তুই বুঝবিবা। কমপ্লান খেয়ে বড় হ আগে। তারপর বলব।”
মিরাজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
” রাখ তোর কমপ্লান, বেশিপ্লান। আগে বল কী করতে চাইছিস তুই? কোথায় যাচ্ছিস? তাও এতোদিনের জন্যে? বস এতোদিনের ছুটি দিল?”
” দুই বছরে এখনও কোন ছুটি নেইনি। তারওপর এখন বিশেষ কোন কাজ নেই। মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে লম্বা ছুটি এপ্রুভ করে নিয়েছে।”
মিরাজ মুখ ফুলিয়ে বলল,
” মিস করব তো ইয়ার।”
তুর্বী মিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমিও।”
” কোথায় যাচ্ছিস সেটাতো বল?”
” আপাতত ঢাকা।”
মিরাজ অবাক হয়ে বলল,
” ঢাকা?”
তুর্বী লাগেজের চেইন আটকাতে আটকাতে বলল,
” হুম। যেখান থেকে গল্পটা শুরু হয়েছিল আবার সেখানেই যেতে হবে। আবার সেখান নতুন করে সবটা শুরু করতে হবে। তাই আমার ঢাকা ফেরাটা এখন খুব প্রয়োজন।”
#চলবে…