জল ফরিঙের খোঁজ – পর্ব ৪৪-৪৮

0
233

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- 44 +45+46+47+48
.

দুপুর বারোটা বাজে। সূর্য মাথার ওপর চড়ে আছে। প্রচন্ড গরম পরেছে। তীব্র রোদে সবার নাজেহাল অবস্থা। পার্কের সরু রাস্তা দিয়ে হাটছে সৌহার্দ্য, বিহান আর দোলা। দোলাকে আনার কোন পরিকল্পনা ছিলোনা। কিন্তু সৌহার্দ্য বেড় হওয়ার সময় ওর মা বলল যেখানে যাচ্ছে দোলাকে নিয়ে যেতে। সৌহার্দ্য একটু বিরক্ত হলেও না করেনি। কারণ ও তো জানে দোলার সাথে ওর কোন সম্পর্ক হবেনা। আর সেটা দোলাও জানে। তাই এতো চিন্তার প্রয়োজন নেই। সৌহার্দ্য বারবার ঘড়ি দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিহান একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,

” তুই হঠাৎ আমাদের এই পার্কে কেন নিয়ে এলি বলবি? কিছু করছিসও না, বলছিসও না। শুধু হেটে যাচ্ছিস। এখানে কেন এলাম সেটাতো বল ইয়ার?”

দোলারও একরাশ অস্বস্তি নিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

” এক্সাক্টলি! এখানে আমরা কেন এলাম সেটাই এখনও বললেন না। এই গরমের মধ্যে কড়া রোদে হাটছি।”

কিন্তু সৌহার্দ্য কোন প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে চারপাশে শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। বিহান আর দোলাও বিরক্ত হয়ে আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না।

এদিকে সিনএনজি থেকে নেমে তুর্বী দ্রুত ভারাটা দিয়ে রিখিয়ার হাত ধরে পার্কের ভেতরে হাটা দিল। রিখিয়া বলল,

” তুর তুমি চেঞ্জ নাওনি ড্রাইভারের থেকে।”

তুর্বী হাটতে হাটতে হাফানো কন্ঠে বলল,

” আরে বাদ দে তো।”

” কী হয়েছে তোমার বলবে? কত করে বললাম এই গরমে বেড় হতে হবেনা। কিন্তু তুমি এলেই। সেই ভোরবেলা বেড় হতে হল তোমার জন্যে। আর এটা কোথায় নিয়ে এলে বলবে?”

তুর্বী বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ঘুরে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুই না একটুও বদলাস নি, ট্রাস্ট মি! একটু ধৈর্য্য ধর!”

বলে হাটা শুরু করল। রিখিয়াও আর উপায় না পেয়ে হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে তুর্বীর সাথে হাটতে শুরু করল। হঠাৎ করেই তুর্বী থেমে গেল। হেসে দিয়ে বলল,

” ঐ তো!”

তুর্বী কথা শুনে রিখিয়া তুর্বীর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে সৌহার্দ্যকে দেখে অবাক হল। একটু হেসে তুর্বীকে কিছু বলবে তার আগেই সৌহার্দ্যর পেছনে তাকিয়ে ওর হাসি মিলিয়ে গেল। সৌহার্দ্যর পেছনে বিহান আর দোলা আছে। দুজনেই হেসে হেসে কথা বলছে। দোলাকে চেনেনা রিখিয়া। বিহানকে দেখে থমকে গেলেও তার সাথে ওর মন খচখচ করছে যে বিহানের সাথে মেয়েটা কে? রিখিয়া কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,

” তুমি ওদের সাথে দেখা করতে এসছো?”

তুর্বী কিছু বলল না। রিখিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। সৌহার্দ্যর দৃষ্টি ইতিমধ্যে ওদের ওপর পরে গেছে। সৌহার্দ্য হেসে হাত নাড়িয়ে ওদের এদিকে আসতে বলল। সৌহার্দ্যকে হাত নাড়তে দেখে তুর্বী আবার রিখিয়ার হাত ধরে সৌহার্দ্যদের দিকে এগিয়ে গেল। বিহান এখনও তাকায়নি। ও দোলার সাথে কথা বলছে। তুর্বী এসে বলল,

” হাই!”

তুর্বীর আওয়াজ শুনে বিহান তাকাল। তুর্বীকে এখানে দেখে বেশ অবাক হল ও। কিন্তু ওর পাশে রিখিয়াকে দেখে প্রায় জমে গেল। রিখিয়াও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের ওপর স্হির হয়ে আছে। আজ দুই বছর পর আবার এভাবে একে ওপরের মুখোমুখি হবে সেটা ভাবতে পারেনি। একজন ভালোবেসে দূরে গেছে আরেকজন দূরে গিয়ে ভালোবেসেছে। কিন্তু ভালোবাসাটাতো সত্যি! বুকের ভেতরে তোলপাড় হয়ে গেলেও রিখিয়া মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। কারণ এই দুই বছরে বিহানের প্রতি নিজের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গেছে ও। শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু বিহান পারছেনা। ওর ইচ্ছা করছে একটাবার রিখিয়াকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সেই অধিকার কী ওর আছে? বিহান দ্রুত চোখ এদিকে ওদিক নাড়িয়ে, আসতে চাওয়া অশ্রুকে আটকে ফেলল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘনঘন ঢোক গিলে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে ও। সৌহার্দ্য রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” কেমন আছো রিখিয়া?”

” ভালো,আপনি?”

” এইতো!”

তুর্বী হাসি মুখে এলেও দোলাকে দেখে ওর বেশ রাগ হয়েছে। ওর মনে সাথেসাথেই একটা প্রশ্ন এসছে, ‘এখানেও নিজের হবু বউকে নিয়ে আসতে হবে?’ কিন্তু পরে নিজেই নিজের ভাবনায় বিরক্ত হচ্ছে। ও তো এরকম ছিলোনা? এরকম হিংসুটে অনুভূতি কেন হচ্ছে ওর মধ্যে? দোলা সৌহার্দ্যকে বলল,

” ওও এদের জন্যেই এখানে ওয়েট করছিলেন? আগে বলবেন তো! কে হয় আপনার?”

” আমার পরিচিত, পুরোনো বন্ধু।”

তুর্বী দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। বিয়ে টেকানোর কী শখ! এক্স গার্লফ্রেন্ডকে বন্ধু বলে পরিচয় দিচ্ছে। বাহ! বিহান আর রিখিয়া কিছুই বলছে না। শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, মাঝেমাঝে একে ওপরের দিকে তাকাচ্ছে। সৌহার্দ্য বলল,

” এই রোদের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবেনা। চল দেখি কোথাও বসা যায় কি-না।”

ওরা পাঁচজন মিলেই হাটতে শুরু করল। বিহান আর রিখিয়া দুজনেই যথেষ্ট দূরত্ব রেখে হাটছে। দুজনেই চুপচাপ আর অন্যমনষ্ক। এদিকে দোলা বেশ চঞ্চল আর মিশুক মেয়ে হওয়াতে কথা বলেই যাচ্ছে। যেহেতু সৌহার্দ্যকেই ও ভালোভাবে চেনে তাই ওর সাথেই কথা বলছে। তুর্বী বারবার কপাল কুচকে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। একপর্যায়ে ওর এসব একটু বেশিই ইরিটেটিং লাগল। তাই সৌহার্দ্যর কাছে গিয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বলল,

” সৌহার্দ্য! হবু বউয়ের সাথে প্রেমালামটা পরেও করতে পারবে। আপাতত যেটা করতে এসছি সেটা করি? সময় নেই।”

সৌহার্দ্য একটু অবাক হয়ে তাকাল তুর্বীর দিকে এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গলা ঝেড়ে বলল,

” ঐতো বেঞ্চ পাওয়া গেছে। চলো আমরা একটু বেঞ্চে গিয়ে বেশি, বেশ গরম এখানে।”

সৌহার্দ্য দোলার হাত ধরে একটু আগে আগে গিয়ে ছোট বেঞ্চটায় বসে পরল। যেখানে দুজনই বসা যাবে। তুর্বী বুঝতে পেরেছে যে সৌহার্দ্য এটা কেন করেছে। তবুও ওর ভালোলাগেনি ব্যাপারটা। ও হনহনে পায়ে গিয়ে বড় বেঞ্চটার এই সাইডে বসে পরল। রিখিয়া তুর্বীর পাশে বসল আর বিহান রিখিয়ার পাশে। ওরা দুজন একদম চুপ হয়ে গেছে। দেখা হওয়ার পর থেকে এখনও কেউই মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করেনি। সৌহার্দ্য ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও বলল,

” কী ব্যাপার বিহান, রিখিয়া? তোরা দুজনে এভাবে চুপ হয়ে গেলি কেন? এভাবে হুট করেই সবার দেখা হওয়াতে অবাক হয়েছ দুজন তাইতো?”

রিখিয়া আর বিহান দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্যতো জানে ওদের অতীত। তাহলে এতো নরমালি কথা বলছে কীকরে? যেন কিছুই হয়নি। সৌহার্দ্য বলল,

” দেখো! আমরা জানি আমাদের অতীতের কিছু তিক্ততা আছে। আর তারজন্যেই আমরা চারজন এই দু-বছর আলাদা আলাদা ছিলাম। কিন্তু এটাতো সত্যি একসময় আমরা চারজন খুব ভালো বন্ধুও ছিলাম? তাহলে কবে কী হয়েছিল তার ওপর ডিপেন্ড করে আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট করার কী দরকার?”

তুর্বী একটু সোজা হয়ে বসে বলল,

” এক্সাক্টলি! আর এইজন্যই আমি আর সৌহার্দ্য মিলে ঠিক করেছি আমরা দেখা করে এটলিস্ট আমাদের মধ্যে যে তিক্ততা তৈরী হয়েছিল সেটুকু অন্তত মিটিয়ে নেব। তোমাদের আগে থেকে বললে হয়ত আসতেনা। তাই এভাবে___”

রিখিয়া এবার বুঝতে পারল যে কেন তুর্বী ওকে নিয়ে এসছে এখানে, আর বিহানও। ওরা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে ফেলল। সবকিছুর মধ্যে একটা কথা ঠিক সত্যিই ভেতরকার তিক্ততাগুলো মিটিয়ে নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে আর দেখা বা কথা না হলেও মনে সংশয় আর থাকবেনা। দোলা ওদের কথার কিছুই বুঝছে না। কারণ ও কিছুই জানেনা। কিন্তু বেশ ভালো লাগছে ওর কথাগুলো শুনতে। রিখিয়া আর বিহানও এবার একটু নরমাল হল। একে ওপরের সাথে কথা না বললেও সৌহার্দ্য তুর্বী আর দোলার সাথে কথাবার্তা বলছে। বেশ অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর পরিবেশটা স্বাভাবিক হল। গুমোট ভাবটা কেটে গেল সবার মধ্যে থেকে। হঠাৎ সৌহার্দ্য বলল,

” দোল? তোমার একটা পার্স কেনার ছিল রাইট? পার্কের বাইরের মলটা থেকেই কিনে আনছি চল। পরে সময় পাবোনা।”

সৌহার্দ্যর কথা কিছুই বুঝতে পারল না দোলা। ও কখন পার্স কিনবে বলল? ও কিছু বলবে তার আগেই সৌহার্দ্য বলল,

” আরে একটার বেশি বেজে গেছে। লাঞ্চ করতে হবে পরে আবার চল।”

কথাটা বলে সৌহার্দ্য দোলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। তুর্বী দাঁতে দাঁত চেপে সেদিকে তাকিয়ে রইল। যদিও এটা প্লানের অংশ। কিন্তু ওদের দুজনকে একসাথে দেখে এতো রাগ হয় কেন ওর? হঠাৎ কিছু মনে পরতেই ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” রিখু, তোরা বস। আমি এক্ষুনি আসছি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।”

রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,

” এখন কোথায় যাবে? চল আমিও যাব।”

” আরে তার দরকার নেই। বিহান একা থাকবে নাকি। বস তুই, আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।”

বলে তুর্বী দ্রুত বেড়িয়ে গেল। ওখানে কেবল রিখিয়া আর বিহান রইল। এতক্ষণ নরমার থাকলেও এখন দুজনের মধ্যেই তীব্র অস্বস্তি কাজ করছে। ওরা কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেনা। কিন্তু দুজনেই দুজনকে ফিল করছে। ভালোবাসা আজ দুজনের মধ্যেই আছে। অদ্ভুতভাবে দুজনের্ অনুভূতিটাই আজ গোপন। দুজনেই ভাবছে যে আর সেই অনুভূতি প্রকাশের অধিকার তার নেই। আবার দুজনের মনই বলছে নিজেদের মনের অনুভূতিক‍্য চিৎকার করে প্রকাশ করতে। এই দীর্ঘ দু-বছরের দুজনেই অনেক কথা জমিয়েছে মনের মধ্যে। একজনের মনে অভিমান আর অভিযোগ। আরেকজনের মনে অনুতাপ আর ভালোবাসা। কিক এতো কথা থাকার পরেও দুজনেই আজ নিশ্চুপ, স্তব্ধ। হঠাৎ করেই বিহান কম্পিত কন্ঠে বলে উঠল,

” রিখিয়া?”

রিখিয়া কেঁপে উঠল। সাথেসাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ও জানে চোখ খুলে রাখলেই কেঁদে ফেলবে ও। বিহান সেটা দেখে একটু হাসল। দু-বছর হয়ে গেছে। তবুও কেন এখনও এতো ভালোবাসে মেয়েটা ওকে? ভালোবাসার কোন কারণই দিতে পারেনি ও রিখিয়াকে। দিয়েছে শুধু একবুক কষ্ট, ঘৃণা করার বিশাল কারণ। তবুও এতোটা ভালোবাসা কেন? ও কী এই ভালোবাসার যোগ্য?

#চলবে…#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৫
.

রিখিয়া চোখ খোলার সাহস পাচ্ছেনা। যদি কেঁদে দেয়? যদি নিজেকে সামলাতে না পারে? ও ওপর দিয়ে নিজেকে যতই শক্ত দেখাক। ভেতর ভেতর তো ও আজও বিহানের প্রতি ততোটাই দুর্বল। মানুষ চেষ্টা করে বড়জোর নিজের বাইরেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নিজের মনের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। ও-ও পারবে না। তবুও অনেকটা সাহস নিয়ে চোখ খুলে তাকাল। কিন্তু না, ও কাঁদল না। ওর ভেতরের যন্ত্রণা, কষ্ট, অভিমান কোনটাই অশ্রু হয়ে ঝড়ে পরল না। রিখিয়া একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল,

” কিছু বলবেন?”

বিহান কয়েক মুহূর্ত মৌন রইল। এরপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” কেমন আছো?”

রিখিয়া একটু হাসল। সেই হাসিতে যে তাচ্ছিল্য মিশে ছিল সেটা বিহান স্পষ্ট বুঝেছে। ওর বুকে তীরের মত বিদ্ধ হল রিখিয়ার সেই হাসি। রিখিয়া বলল,

” আমি ভালো আছি। খারাপ থাকার তো কারণ নেই। আপনি কেমন আছেন?”

বিহান নিজের একত্রিত করে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” আছি।”

আবারও অনেকটা সময় নিরবতায় কাটল। হঠাৎই রিখিয়া হন্তদন্ত হয়ে বলল,

” তুর এখনও আসছেনা। আমি গিয়ে দেখছি তুর কোথায় আছে।”

বলে উঠতে নিলেই বিহান বলে উঠল,

” রিখিয়া, তুমিও বুঝতে পেরেছ আর আমিও বুঝতে পেরেছি যে ওরা কেন আমাদের এখানে একা ছেড়ে গেছে।”

রিখিয়া কিছু না বলে বসে পরল। হ্যাঁ ওরা দুজনেই বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। কিন্তু কি-বা করার? ওদের মধ্যে কী আদোও আর কিছু ঠিক হওয়া সম্ভব? বিহান অনেকক্ষণ ইতস্তত করে বলল,

” আমাকে কী সত্যিই ক্ষমা করতে পেরেছিলে রিখিয়া?”

রিখিয়া বিহানের এমন প্রশ্ন শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ওর সেই চাহনীতে কিছু একটা ছিল, সেটা কী তা বিহান বুঝতে পারল না। রিখিয়া ওভাবে তাকিয়ে থেকেই বলল,

” আমি অন্যদের মত মনে আর মুখে আলাদা কথা নিয়ে চলিনা। যেটা মনে থাকে সেটাই মুখে বলি। আমি যখন মুখে বলেছি সেই ঘটনার জন্যে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তারমানে সত্যিই আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।”

অন্যদের বলতে যে রিখিয়া বিহানকেই বুঝিয়েছে সেটা বুঝতে বিহানের সময় লাগেনি। কিন্তু ও কিছুই মনে করল না। হয়তো এটাই ওর প্রাপ্য ছিল। অনেক বড় অন্যায় করেছিল মেয়েটার সাথে ও। তার তুলনায় এই সামান্য দুই একটা কথা কিছুই না। বিহান বলল,

” তাহলে কী আমরা আগের মত বন্ধু হতে পারিনা? আগের মত স্বাভাবিক হতে পারিনা?”

রিখিয়া আবারও শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল বিহানের দিকে। সত্যিই কী আগের মত স্বাভাবিক হতে পারবে ওরা? চাইলেই কী সবটা স্বাভাবিক করা যায়? রিখিয়া অনেকটা খোঁচা মেরেই বিহানকে বলল,

” আগের মত বলতে একসাথে ঘোরা, খাওয়া, সময় কাটানো? কিন্তু এগুলো আপনার স্ত্রী মেনে নেবে? উনি নিশ্চয়ই চাইবেন না তার স্বামী অন্যকোন মেয়ের সাথে ঘোরাফেরা করুক। উনি আপত্তি করবেন না?”

বিহান একটু হাসল। রিখিয়া যে খোঁচা মেরে কথা বলতেও শিখে গেছে সেটা খারাপ লাগল না ওর। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মুচকি হেসে বলল,

” আপত্তি করার মত কেউ নেই আমার জীবনে। আর স্ত্রীর কথা বলছ? সেও নেই।”

রিখিয়া মনে মনে বেশ অবাক হল। বিহান তাহলে এখনও বিয়ে করেনি? কিন্তু ওর সেই মনোভাব প্রকাশ না করে বিদ্রুপ করে বলল,

” ও, বিয়ে করেন নি তাহলে? দুদিও পরপরই গার্লফ্রেন্ড বদলাতে পারলে আর বিয়ের কী প্রয়োজন পরে, তাইনা?”

বিহান কিছু বলল না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইল। রিখিয়াও মাথা নিচু করে আছে। বিহানকে এতো কড়া কড়া কথা বলার ইচ্ছা ছিলোনা ওর। কিন্তু কেন জানি নিজেকে সামলে রাখতে পারছেনা। ভেতরের সমস্ত ক্ষোভ আর অভিমান সব কড়া কথা হয়ে বেড়িয়ে আসছে।

____________

চেয়ারে হেলান দিয়ে ভ্রু কুচকে বিপরীত পাসে বসে থাকা মানুষদুটির দিকে তাকিয়ে আছে তুর্বী। ওর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও কতটা বিরক্ত। কিন্তু সৌহার্দ্য আর দোলার সেদিকে খেয়াল নেই ওরা নিজের মত করে আলোচনা করছে আর কোল্ডকফি খাচ্ছে। এখানে আরেকটা জলজ্যান্ত মেয়ে বসে আছে সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। পার্ক থেকে বেড়িয়ে ওরা শপিংমলে ঢুকেছিল। সৌহার্দ্য একপ্রকার জোর করেই দোলাকে পার্স কিনে দিয়েছে। দোলা বলেছিল ওর লাগবে না। কিন্তু সৌহার্দ্য বলল, ‘বলে যখন ফেলেছি তখন কিনে দিতে সমস্যা কোথায়?’ তুর্বী শুধু হাত ভাজ করে দেখছিল এদের তামাশা। দোলা মেয়েটা প্রচন্ড বাচাল প্রকৃতির, সৌহার্দ্যর সাথে সারাক্ষণ বকবক করেই চলেছে। আর তুর্বী শুধু হাটছিল ওদের সাথে। নিজেকে এলিয়েন এলিয়েন লাগছিল ওর। আর এখন রেস্টুরেন্টে এসেও দুজনেই বকবক করে যাচ্ছে। তুর্বীর ইচ্ছে করছে দু-জনের মাথাতেই কোল্ড কফি ঢেলে দিতে। কিন্তু সেটা করতে পারছেনা। হঠাৎ সৌহার্দ্যর মনে হল তুর্বী চুপচাপ বসে আছে। আর সেটা শুরু থেকেই। ও একটু অবাক হল। ওর মত মেয়ে এতক্ষণ এতোটা চুপচাপ কীকরে? তুর্বীর মধ্যে বদল ঘটেছে ও জানতো তাই বলে এতোটা?ও তুর্বীর দিকে তাকিয়ে দেখল ও কফিও খাচ্ছেনা। সৌহার্দ্য বলল,

” কী ব্যাপার? চুপচাপ বসে আছো? কফিটাও খাচ্ছোনা যে?”

তুর্বী সোজা হয়ে বসে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল,

” যাক, আপনার মনে আছে তাহলে যে এখানে আমিও আছি?”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে ফেলে বলল,

” মানে?”

তুর্বী টেবিলের ওপর শব্দ করে দুই হাত রেখে বলল,

” মানে, আমি এতোদূর একটা ইম্পর্টেন্ট কাজে এসছি। সেই কাজটা হচ্ছে কি-না সেটা নিয়ে আমি যথেষ্ট চিন্তিত আছি এইমুহূর্তে। আপনাদের এই খোশগল্পে পার্টিসিপেট করার মুড বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই।”

দোলা ভ্রু কুচকে বলল,

” তুমি এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আর ওদেরই বা ওখানে একা রেখে এলাম কেন? ওদের কী রিলেশন ছিল? এখন ঝগড়া হয়েছে?”

তুর্বী আবারও মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

” অনেক লম্বা কাহিনী। রামায়ন ডেডক্রাইব করার সময় এখন নেই। পরে তোমার হবু বরের কাছে পুরোটা শুনে নিও।”

দোলা বোকার মত একবার তুর্বী একবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল। সৌহার্দ্য অবাক হয়ে দেখছে তুর্বীকে। তুর্বীকে সবসময় প্রাণচ্ছল আর চঞ্চল রূপেই দেখেছে ও। কিন্তু এতো গম্ভীর আর রাগী রূপে দেখে ওর ভালো লাগছে না। তুর্বী বুঝতে পারশ যে একটু বেশিই অদ্ভুত ব্যবহার করে ফেলেছে। তাই কথা ঘোরাতে বলল,

” আচ্ছা তোমাদের বিয়েটা কবে?”

দোলা ওদের সম্পর্কে কিছুই জানেনা। আর আপাতত সবাইকে এটাই বলতে হবে যে ওদের বিয়ের কথা চলছে। তাই ও হেসে বলল,

” এখনও ডেট ফিক্সড হয়নি। সবে কথা চলছে বিয়ের। তবে শীঘ্রই হবে।”

তুর্বী মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,

” ও আচ্ছা। কনগ্রাচুলেশনস টু বোথ অফ ইউ।”

সৌহার্দ্য সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। ওর বিয়ের কথা শুনে তুর্বীর রিঅ্যাকশন টা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বরাবরের মত এবারেও ব্যর্থ হল তুর্বীর মনের মধ্যে কী চলছে সেটা বুঝতে। হয়তো নিজের অনুভূতিতে অপ্রকাশিত রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তুর্বীর মধ্যে। তুর্বীর ভেতরে অস্হির লাগছে। সৌহার্দ্যর বিয়ে হয়ে যাবে ব্যাপারটা কেন যেন মানতে পারছেনা ও। কেন পারছেনা সেটা ওও জানেনা। সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। এরকম ওর অনুভূতি এর আগে ওর কোনদিন হয়নি।

___________

রিখিয়া আর বিহান পার্কের সরু রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাটছে। কিন্তু কেউ কিছুই বলছেনা। দুজনেই নিরব। কিছুক্ষণ পর বিহান আড়চোখে রিখিয়াকে দেখলেও রিখিয়া তাকায়নি বিহানের দিকে। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,

” রিখিয়া?”

রিখিয়া একটু হকচকিয়ে গেল হঠাৎ ডাকে। দ্রুতই নিজেকে সামলে বলল,

” হুম?”

বিহান অপরাধী কন্ঠে বলল,

” তুমি কী আমাকে এখনও ক্ষমা করতে পারোনি?”

রিখিয়ার সত্যিই এবার একটু মায়া হল। ছেলেটা দু-বছর নিজের ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে থেকেছে। যাকে ছাড়া ও একদিনও ঠিককরে থাকতে পারতোনা। এরপরও ওর মনে হয় বিহানের ভেতরে সুপ্ত আরও অনেক কষ্ট আছে। আর অনুতাপের চেয়ে বড় শাস্তি হতে পারেনা। আজ ও বিহানের মধ্যে তীব্র অনুতপ্ততা দেখেছে। তাছাড়াও যা হয়েছে সেটাকে তো আর বদলানো যাবেনা। তাই রিখিয়া বলল,

” আমি সত্যিই আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি, অনেক আগেই। প্লিজ এসব নিয়ে ভাববেন না।”

বিহান মুখটা ছোট করে রেখেই বলল,

” তাহলে এভাবে চুপ করে আছো কেন?”

রিখিয়া একটু হেসে বলল,

” আমিতো বরাবরই চুপ থাকি। বকবক করে আমার কানার মাথাতো আপনি খেতেন। কিন্তু সেই আপনি এতো ভদ্র, শান্ত। আবার কথাও কম বলছেন কীকরে?

বিহান একটু হাসল। কিন্তু কিছুই বলল না। রিখিয়া তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। অনেকক্ষণ যাবতই ও সেই ছটফটে, দুষ্টু, হৈ চৈ করে মাতিয়ে রাখা বিহানকে খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছেনা। কেমন শান্ত, স্হির হয়ে গেছে ছেলেটা। সত্যি বলতে রিখিয়া একসময় এরকম শান্ত, স্হির ছেলেদেরই পছন্দ করত। কিন্তু কীকরে যে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের বিহান নামক এই পুরুষের প্রেমে পরে গেল নিজেই জানেনা। কিন্তু আজ বিহানকে ওর মনের মত চরিত্রে দেখেও ওর ভালো লাগছেনা। ওর তো সেই বাদর ছেলেটাকেই পছন্দ। রিখিয়া এবার নিজেই বলল,

” তো? পেন্টিং করা হয় এখনও?”

বিহান মাথা নিচু করে ঠোঁটে বাঁকিয়ে হেসে বলল,

” ঐ গুনটুকুই তো আছে। ওটা ছাড়া আর কী করব?”

রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কৌতূহলী কন্ঠে বলল,

” এখন নেশা করেন?”

বিহান আবার হাসল। হাসতে হাসতে বলল,

” ঐ একটা জিনিসই আছে যেটা কখনও আমায় ছেড়ে যায়না। তাহলে আমি কীকরে ছেড়ে দেই বল?”

রিখিয়া একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলল। সবই বদলেছে। কিন্তু যেটা সত্যি সত্যি বদলানোর দরকার ছিল সেটাই এখনো ধরে রেখেছে এই ছেলে। এবার বিহান বলল,

” এরপর আর কখনও কাউকে ভালোবেসেছিলে?”

কথাটা শুনে রিখিয়ার মুখের হাসি আবার মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে বলল,

” আর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি। বিশ্বাস জিনিসটাই এমন। একবার ভেঙ্গে গেলে আবার সেটা জোড়া লাগানোটা খুব বেশিই কঠিন।”

বিহান লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” আমি হয়তো তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধী তাইনা রিখিয়া?”

রিখিয়া হাতের নখ ঘষতে ঘষতে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,

” না। হয়তো এটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল।”

বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

” তাতে আমার দ্বায়টা তো কমে যাচ্ছেনা।”

রিখিয়ার এবার বিহানের চোখে চোখ রেখে বলল,

” আচ্ছা তাহলে দ্বায়ভার নিতে কী করতে পারবেন আপনি?”

রিখিয়ার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারল না বিহান। কীকরে দেবে? যদি রিখিয়া বিবাহিত হয়? তাহলে ও নিজের মনের ভালোবাসাটা প্রকাশ করলে মেয়েটা আরও কষ্ট পাবে। তখন আর মনকে মানাতে পারবেনা রিখিয়া। এতে ওর মানসিক অবস্থা খারাপ হওয়ার সাথে সাথে বৈবাহিক জীবনেও খারাপ প্রভাব পরবে। দ্বিতীয়বার আর ওকে আঘাত করতে পারবে না বিহান। আর এখন তো একদমই না। খুব বেশি ভালোবাসে মেয়েটাকে ও। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে রিখিয়া বিয়ে করেনি। কথাটা ভাবতেই বিহান দ্রুত রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুমি বিয়ে করেছো রিখিয়া?”

রিখিয়া বিহানের এমন প্রশ্নে অবাক হল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই না বোধক মাথা নাড়ল। বিহানের চোখমুখ উজ্জ্বল হল। ও কিছু বলতে নেবে তার আগেই রিখিয়া বলল,

” তবে বিয়ে ঠিক হয়েছে। তেরো তারিখে। কার্ডও চলে আসবে কাল পরশু। আপনাকে আর সৌহার্দ্যকে কার্ড পাঠিয়ে দেব। চলে আসবেন।”

কিছুক্ষণ আগে যে উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখা দিয়েছিল ঘনকালো মেঘে তা নিমেষেই ঢেকে গেল। বিহানের হৃদয় আবারও গুড়িয়ে গেল। ও অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে রইল রিখিয়ার দিকে। ওদের সাথেই এমনটা কেন হয়? যখনই একটু সুখের খোঁজে বেড় হয়। অনেক কষ্টে সেই সুখটা চোখে পরলেও, ছুঁতে গেলেই সেটা উড়ে যায়। অনেক দূরে চলে যায়। ঠিক জল-ফড়িঙের মত। যেটা ওরা খুঁজেই যায় কিন্তু হাতে ধরা দেয়না।

#চলবে….#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৬
.

রাতের অন্ধকার আকাশে ঘনকালো মেঘ যমে আকাশকে আরও অন্ধকার করে দিয়েছে। হালকা শো শো বাতাস বইছে। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাতে বৃষ্টি নামবে। জৈষ্ঠ্য মাসের তীব্র গরমে আজ সারাটাদিন পার হয়েছে। সকলের অবস্থাই আজ নাজেহাল। তাই বোধহয় প্রকৃতি একটু সদয় হয়ে বৃষ্টি ঝড়িয়ে সবাইকে সিগ্ধ শীতলতা দেবে। ছাদের এককোণে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বিহান আর সৌহার্দ্য। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে, দুজনের মনই খারাপ হয়ে আছে। গোমড়া মুখ করে বসে আছে দুজনেই। বিহান মদের বোতলে চুমুকের পর চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সৌহার্দ্য এতক্ষণ বারণ করেনি ঠিকই। কিন্তু এখন বেশি হয়ে যাচ্ছে তাই হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” বিহান, এবার থাম। অনেক হয়েছে।”

বিহান ঠোঁট বাকিয়ে গা দুলিয়ে হাসল। কিন্তু কিছুই না বলে আবারও বোতলে চুমুক দিতে গেলে সৌহার্দ্য হাত ধরে ফেলে বলল,

” বিহান প্লিজ। ইটস টু মাচ।”

বিহান বোতলট সাইডে রেখে দিয়ে মাতাল কন্ঠে বলল,

” আমি সত্যিই খুব খারাপ তাইনা ব্রো? তুই-ই দেখ আমার বাবা-মা আমার মুখও দেখতে চায়না। যেই মামু আমাকে বুকে জড়িয়ে বড় করেছে, মানুষ করেছে। সেই মামু আমাকে সহ্য করতেই পারেনা। জীবনে একটা মেয়ে এলো যে আমাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে। ইনফ্যাক্ট আমি ওকে এতোটা কষ্ট দেওয়ার পরেও ও এখনো আমায় ভালোবাসে। ও মুখে না বললেও আমি বুঝি সেটা। আজ ওর চোখের ভাষা অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারি আমি। কিন্তু আমি আমার দোষে সেই ভালোবাসাটাও হারিয়ে ফেললাম। কদিন পর ও অন্যকারো হয়ে যাবে। আমার রিখিয়া অন্যকারো হয়ে যাবে। তুই-ই বল সবাই আমার থেকে দূরে কেন চলে যায়। সবাই ভূল আমি ঠিক এটাতো হতে পারেনা তাইনা? আমি মানুষটাই খারাপ। তাই আমার সাথে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব হয়না। জঘন্য মানুষ আমি।”

এরপর পিটপিটে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল। সৌহার্দ্য বিহানেল কাঁধে হাত রেখে বলল,

” তুই যখন নিখোঁজ হয়ে গেছিলি। তখন তোর মামু প্রায় আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করত তোর কোন খোঁজ পেয়েছি কি-না। ফুপা-ফুপির সাথে আমি কথা বলতাম না। কিন্তু ওনারাও তোর খোঁজ করতো। তোর প্রতি রাগ, অভিমানে তোকে দূরে সরিয়ে রাখলেও আজও তোকে ওনারা ততটাই ভালোবাসে।”

বিহান টলমলে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল,

” একটু বিশ্বাস করতে পারল না?”

বিহানের এমন অসহায় গলা সৌহার্দ্যকে আহত করল। বিহান ড্রাংক তাই এভাবে বলছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ও ওর পরিবারের প্রতি ক্ষোভ বা দুর্বলতা কোনটাই প্রকাশ করেনা বহুবছর যাবত। ও বিহানের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে ওকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

” পরিস্থিতি একটা হলেও। তার প্রভাব সবার ওপর একরকম পরেনা। ওনাদের দিক দিয়ে ভাবলে এরকম করাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক না। ব্যাপারটাই এভাবে সাজানো ছিল।”

বিহান কিছুই বলল না। সৌহার্দ্য জানে ও পুরোপুরি ঠিক বলছে না। দোষ হোক বা ভুল বিহানের বাবা-মারও কম নেই। কিন্তু বিহানের সামনে এসব বললে ওর মনে পরিবারের প্রতি ক্ষোভ আরও বাড়বে। বিহান ভাঙা গলায় বলল,

” ব্রো, তুই জানতি তাইনা রিখিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”

সৌহার্দ্য গম্বীর স্বরে বলল,

” হুম জানতাম।”

” তবুও কেন নিয়ে গেলি ওর কাছে? আমিতো নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। মনকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম ও সুখে আছে, ভালো আছে। কিন্তু আজ রিখিয়াকে দেখে আমার সবটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ওর আমার প্রতি আজও এতোটা ভালোবাসা দেখে আমি অস্হির হয়ে উঠেছি। আমি এখন আর নিজেকে সামলাতে পারছিনা। আমার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে।”

সৌহার্দ্য দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে বলল,

” ওকে বললি না কেন তোর ভালোবাসার কথা? হয়তো সব ঠিক হতোনা।”

বিহান চোখ বুজে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” ঠিক হতোনা ব্রো। আমি চিনি ওকে। ওর কাছে থেকে যতটা না চিনেছি, ওর থেকে দূরে গিয়ে আর ভালোকরে চিনেছি। বিয়ের আর বারোদিন আছে। ও নিজের কথা কখন-ই ভাবেনা। ও ওর দুই পরিবারের সম্মানের জন্যে, ওর হবু বরের, তার পরিবারের সম্মানের জন্যে আর পেছন ঘুরে তাকাবেনা। কিছুতেই না। কিন্তু আমি যদি এখন ওকে গিয়ে বলি আমি ওকে ভালোবাসি। তাহলে ওর মনে সারাজীবন আক্ষেপ থেকে যাবে যে নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েও তাকে গ্রহন করতে পারেনি। গুমরে গুমরে মরবে ও। তারচেয়ে আমার ভালোবাসাটা ওর অজানাই থাক। আমি সারাজীবন আড়াল থেকেই ওকে ভালোবেসে যাব।”

সৌহার্দ্য গম্ভীর মুখে বসে রইল। বিহানের কথাগুলো যে খুব ভুল তা-না। সবটা ঠিক করার একটা সুযোগ এলো কিন্তু বড্ড দেরী করে। বিহান হেসে বলল,

” একটা সময় ছিল যখন ও আমায় নিজের ভালোবাসার কথা বলতে এসে ভাঙা মন নিয়ে ফিরে গেছিল। আর আজ আমি ওকে নিজের মনের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। একেই বলে রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার।”

সৌহার্দ্য রাগী গলায় বলল,

” ফালতু বকিসনা তো। কীসের রিভেঞ্জ? এই দু-বছরের যন্ত্রণা, কষ্ট, ছটফটানি কী কম ছিল? যে প্রকৃতিকে আরও রিভেঞ্জ নিতে হবে?”

বিহান কিছু না বলে সৌহার্দ্য কোলে শুয়ে পরল। চোখ বন্ধ করে ফেলল। সৌহার্দ্য বিহানের মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে মনে মনে ভাবছে যে, কী করা যায়? কী করলে রিখিয়া-বিহান নিজের ভালোবাসাও ফিরে পাবে। আর দুই পরিবারের সম্মানও বাঁচবে। তুর্বীর সাথে আলোচনা করতে হবে এই বিষয়ে। বিহান বলল,

” তুর্বীকে তো আজও ততোটাই ভালোবাসিস। তাহলে আবার একটা চেষ্টা কেন করছিস না?”

সৌহার্দ্য একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

“ওকে নিয়ে আমি আর কোন আশা বা স্বপ্ন সাজাবোনা। দ্বিতীয়বার একই ধাক্কা নিতে পারবনা আমি। যদি কিছু ঠিক করতেই হয় ওকে নিজে থেকে আসতে হবে আমার কাছে। ওকে নিজে থেকে বলতে ও কী চায়। এইবার আমি নিজে থেকে এক পাও এগোবো না।”

বিহান সৌহার্দ্যর কোল জড়িয়ে ধরল আর মনে মনে প্রার্থনা করল এবার যাতে তুর্বী নিজে থেকে এগোয়। ওর ভাইটা কোনদিন অন্যকাউকে মানতে পারবেনা সেটা ও বুঝে গেছে। এখন সবটাই তুর্বীর হাতে।

____________

রিখিয়া বিছানা গোছাচ্ছে। আর তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আসার পর থেকেই রিখিয়া ওর সাথে একটাও কথা বলেনি। সৌহার্দ্য, দোলা আর তুর্বী, ওরা তিনজন রেস্টুরেন্টে থেকে বেড়িয়ে পার্কে এসে দেখে ওর পার্কের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে যে কিছুই ঠিক হয়নি সেটা সৌহার্দ্য আর তুর্বী দুজনেই বুঝতে পেরেছিল। যদিও এটাই এক্সপেক্টেড। কারণ একদিনে সবটা ঠিক হওয়ার কথাও না। তারপর ওরা একসঙ্গে লাঞ্চ করে ফিরে এসছে। খুব বেশি কাজ না হলেও প্রথম স্টেপ কম্প্লিট হয়েছে ওদের। তুর্বী অসহায় কন্ঠে বলল,

” এমন করছিস কেন? তুই খুশি হোস নি ওদের সাথে দেখা হয়ে সবটা ঠিক হওয়াতে?”

রিখিয়া এবার বালিশ ছুড়ে রেখে বলল,

” হ্যাঁ হয়েছি। কিন্তু আমাকে একবার জানাবেনা তুমি?”

” সরি ইয়ার। আমি ভেবেছিলাম আগে থেকে বললে তুই যাবিনা।”

” ওও। তাই মিথ্যে বলে নিয়ে গেছে।”

” সরি!”

নিচু কন্ঠে বলে মাথা নিচু করে ফেলল তুর্বী। রিখিয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। রিখিয়া শুয়ে পরল। তারপর তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

” মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে না থেকে শুয়ে পরো।”

তুর্বীও রিখিয়ার পাশে শুয়ে পরল। পাশাপাশি টানটান হয়ে শুয়ে আছে দুজন। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ছিল। এরপর তুর্বী ইতস্তত কন্ঠে বলল,

” বলছিলাম যে, বিহানের সাথে কথা বলে কী বুঝলি?”

রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,

” কী বুঝবো?”

তুর্বী একটু অবাক হয়ে বলল,

” এতক্ষণ কথা বলেও তোর কিছুই মনে হয়নি?”

রিখিয়া একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,

” কী বলছ বলোতো?”

তুর্বী এবার আর কোনরকভ ভনিতা করতে না পেরে সরাসরিই বলল,

” মানে, ওর মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করিস নি তুই?”

রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” হুম। অনেকটা বদলে গেছে। আগের মত নেই। বেশ শান্ত আর ভদ্র হয়ে গেছে।”

তুর্বী রিখিয়ার দিকে ঘুরে শুয়ে বলল,

” তুই জানিস ও এখন আর কোন মেয়ের সাথেও তেমন মেশেনা। আই মিন ওভাবে মেশেনা।”

রিখিয়া একটু অবাক হল। অবাক হয়েই তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুমি কীকরে জানলে?”

” বান্দরবান গিয়ে যখন দেখেছিলাম তখন খোঁজ নিয়েছিলাম।”

রিখিয়া ছোট স্বরে বলল,

” ওহ।”

তুর্বী উৎসাহি কন্ঠে বলল,

” তোর কী মনে হয়? ওর এই বদলের কারণ কী? এতো বদলে গেল কেন?”

রিখিয়া নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল,

” আমি কীকরে জানবো? তোমার সামনেই তো ছিল জিজ্ঞেস করে নিতে।”

” কিন্তু তবুও! তোর একটা আইডিয়া আছেনা?”

” না নেই। এবার আমার কথা ছেড়ে নিজের কথা বল। বিয়ে কেন করছনা এখনও?”

বিয়ের কথা শুনে তুর্বী মুখটা মলিন করে ফেলল। তারপর বলল,

” আমার কথা বাদ দে তো। আমার ভাইটাকে এখন সেটেল করে দিতে পারলেই আমার শান্তি। মা মারা যাওয়ার পর ওর সব দায়িত্ব তো আমার কাধেই।”

রিখিয়া নরম কন্ঠে বলল,

” আন্টি কীভাবে মারা গেল?”

” ন্যাচরাল ডেথ। দেড় বছর আগেই মারা গেছেন। যেমনই হোক। সৎ মা হলেও মা বলেতো ডাকতাম।”

তুর্বীর কথা শুনে রিখিয়া একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” তুর তুমি যদি এখনো ভেবে থাকো সৌহার্দ্য নিজে এসে আবার সব শুরু করতে চাইবে তো ভুলে যাও। দুই-বছর আগে যা হয়েছে তারপরেও এই আশা করোনা। তুমি যদি কিছু চাও তো এবার তোমাকে নিজে থেকেই এগোতে হবে।”

তুর্বী কয়েকসেকেন্ড নিরব রইল। সৌহার্দ্য আর দোলার একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো ভাবলে কষ্ট হয় ওর। এখনো হচ্ছে। ও দ্রুত নিজেকে সামলে বলল,

” আমি কিছু চাইনা। আর তাছাড়াও ওর বিয়ের কথা চলছে। দোলা মেয়েটা ভালোই। আমার চেয়ে বেটার অপশন।”

” হয়েছে! কথা না বলে চুপচাপ ঘুমাও এখন।”

তুর্বী রিখিয়ার ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল। রিখিয়া আর কিছু বলল না ভাবনায় মত্ত হয়ে গেল। সত্যিই বিহানের এই বদলের কারণ কী? শুধুই কী সৌহার্দ্যর থেকে দূরে থাকা? লোকটা নিজেকে এতো বদলে ফেলল কেনো? রিখিয়াকে ভাবতে দেখে তুর্বী মনে মনে খুশি হল। ও তো এটাই চেয়েছিল। ও চেয়েছিল রিখিয়া এ বিষয়ে ভাবুক। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রিখিয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোনের রিংটনে। রিখিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল এটা শাফিনের ফোন। ও কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করল। তুর্বী ভাবছে শাফিন ছেলেটা এতো ভালো না হলেও হত। খারাপ হলে এই বিয়েটা ভাঙতে ওর গিল্টি ফিল হতোনা। কিন্তু এখন তো হচ্ছে। তবে শাফিন যখন ফোন করল তখন রিখিয়ার চোখেমুখে তুর্বী সেই খুশিটা দেখেনি যে খুশিটা বিহান ফোন করলে থাকত। বরং দেখেই বোঝা যাচ্ছে রিখিয়া বাধ্য হয়ে ফোন ধরেছে। জোর করে কথা বলছে। এভাবে সংসার করবে কীকরে? যদি বিহান রিখিয়াকে ভালো না বাসতো তাহলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু যখন একে ওপরকে ভালোবাসে তখন এই বিচ্ছেদ ঠিক হবেনা। আর মনে একজনকে রেখে অন্যজনের সাথে সংসার করাটা খুব যন্ত্রণার। বিশেষ করে একটা মেয়ের জন্যে। রিখিয়াকে ও সেই যন্ত্রণা দিতে চায়না। মেয়েটা এমনিতেও অনেক কষ্ট পেয়েছে। ওকে সবটা ঠিক করতেই হবে। যেভাবেই হোক।

#চলবে…

[ রি-চেইক করা হয়নি। রাতে ‘বর্ষণের সেই রাতে- ২’ আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করছি। এমনিতে যেসময় দেই পেলে ওরকম সময়ই পাবেন। জেগে থাকতে চাইলে জাগতে পারেন। ]#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৭
.

মাঠের পাশের পুকুরপারে সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে আছে সৌহার্দ্য আর তুর্বী। দুজনেই গভীর ভাবনায় মগ্ন। তুর্বী ভ্রু কুচকে রেখে ছোট ছোট চাকার টুকরো ছুড়ে মারছে পুকুরে আর একমনে ভেবে চলেছে। আর সৌহার্দ্য দুই হাত পেছনের দিকে রেখে পেছন দিকে হেলান দিয়ে সামনের সিঁড়ির দিকে দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে। তুর্বী একটা লম্বা হাই তুলে বলল,

” কিছু ভেবে পেলে?”

সৌহার্দ্য হতাশ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,

” উমহুম। কিছুই মাথায় আসছে না।”

তখনই পাশে রেখে দেওয়া সৌহার্দ্যর ফোন বেজে উঠল। তুর্বী তাকিয়ে স্ক্রিনে দোলা নামটা স্পষ্ট দেখতে পেল। ওর মেজাজ আবার বিগড়ে গেল। সারাদিনই কী সৌহার্দ্যর পেছনে লেগে থাকে না-কি? এখন কত ইম্পর্টেন্ট বিষয়ে ডিসকাস করছে ওরা, আর এই মেয়ে এখন প্রেমালাপ করতে ফোন করছে। সৌহার্দ্য ফোনটা রিসিভ করে বলল যে, পরে কথা বলবে। এরপর ফোন রাখতেই তুর্বী কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,

” তা মাথায় আসবে কেন?এখনতো সারাদিন মাথায় হবু বউ এর চিন্তা ঘুরে বেড়ায় তাই না? অন্যদের নিয়ে ভাবার মত সময় আছে নাকি? আর তাছাড়াও তোমার মাথায় আবার কবে কোন প্লান এসছে? আগেও গাধা ছিলে এখনো গাধাই আছো। ”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে বলল,

” আমি গাধা?”

” হ্যাঁ গাধাই। বুদ্ধি থাকলে এতক্ষণে অন্তত একটা প্লান বলতে পারতে।”

” আহা! তোমার মাথাতো বুদ্ধিতে ভরপুর আছে তাইনা? তাহলে তুমিই বল কোন প্লান।”

তুর্বী এবার একটু হকচকিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে শুরু করল। সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে বলল,

” কী মিস বুদ্ধিমতি? দেখাও তোমার বুদ্ধি।”

তুর্বী নিজের ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

” হ্যাঁ বলছিতো, এতো তাড়াহুড়োর কী আছে? বলছি, বলছি।”

সৌহার্দ্য এবার নিজেও একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে। আপনি কী ভেবেছেন। মুখেই বড় বড় বুলি শুধু। কীকরে‍ যে এই মেয়ের প্রেমে পরলাম কে জানে?”

তুর্বী সৌহার্দ্য দিকে ঘুরে রাগী কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ এখনতো এসব মনে হবেই। ওমন সুন্দরী হবু বউ আছে। তার এতো গুন। ওসব দেখার পর এখনতো আমার সবকিছুই খারাপ লাগবে। নরমাল।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। তুর্বীর কথায় আজ ও জেলাসির গন্ধ পাচ্ছে।তাহলে কী তুর্বী ওকে___ না, ও আগে থেকে আর কিচ্ছু ভাববে না এবার। যদি তুর্বীর মনে কিছু থেকে থাকে সেটা তুর্বীকেই বলতে হবে। তুর্বী নিজে থেকে বললেও সৌহার্দ্য কতটা ওকে আগের মত এক্সেপ্ট করতে পারবে সেটাও ভাবার বিষয়। সৌহার্দ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” তাতে তোমার কী সমস্যা? ইউ ডোন্ট কেয়ার রাইট?”

তুর্বী ঝাঝালো কন্ঠে বলল,

” ইয়েস, আই ডোন্ট কেয়ার।”

” তাহলে এসব অবান্তর কথা বন্ধ করো।”

তখন তুর্বী কিছু একটা চিন্তা করে নরম গলায় বলল,

” আমরা নিজেদের মধ্যে অযথাই ঝগড়া কেন করছি? আমরা বিহান আর রিখুর প্যাচ আপ করার প্লান করতে এসে নিজেরাই ঝগড়া করছি।”

সৌহার্দ্যর এবার ঠান্ডা হল। তারপর বলল,

” এভাবে শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।”

তুর্বী মন খারাপ করে বলল,

” আর মাত্র দশদিন বাকি আছে বিয়ের। অামাদের এরমধ্যেই কিছু করতে হবে। আচ্ছা শাফিনের সাথে কথা বললে কেমন হয়।”

” শাফিন কে গিয়ে কী বলব? আগে তো এই দুজনকে রাজি করাতে হবে না? এরাতো বেঁকে বসে আছে। এদের ঠিক না করতে পারলে কোনকিছু করেই লাভ নেই।”

” হুম, সেটাও ঠিক।”

সৌহার্দ্য একটু ভেবে বলল,

” আমার মনে হয় রিখিয়ার জানা উচিত যে বিহান ওর জন্যে কী ফিল করে। কিন্তু সেটা আমাদের মুখে নয় স্বয়ং বিহানের মুখে।”

তুর্বী আরও বেশি চিন্তিত হয়ে বলল,

” কিন্তু সেটা কীকরে সম্ভব? তোমার কথা শুনে যা বুঝেছি। রিখিয়ার বিয়ের কথা শোনার পর ও কখনই কিছু বলবে না নিজে থেকে রিখিয়াকে।”

সৌহার্দ্য কিছু না বলে ভাবতে শুরু করল। তুর্বীও আবার ভাবনায় মগ্ন হল। ভাবনার মাঝেই হুট করে তুর্বী বলে উঠল,

” আমার একটা প্লান আছে।”

সৌহার্দ্য সোজা হয়ে বসে বলল,

” কী প্লান?”

” আমি তোমাকে টেক্সট করে দেব কী করতে হবে। এখন আমাকে উঠতে হবে। অনেকটা পথ যেতে হবে আমায়।”

” আচ্ছা। চল আগে কিছু খেয়ে নেবে।”

তুর্বী কিছু বলার আগেই আবার সৌহার্দ্য ফোন বেজে উঠল। এবারেও দোলাই ফোন করেছে। তুর্বীর কেন জানি এবার রাগের চেয়েও বেশি খারাপ লাগল। ও অনেকটাই অভিমানী গলাতেই বলল,

” এখন আমার খিদে নেই, আর সময়ও নেই। আসছি।”

বলে সৌহার্দ্যকে কিছু বলতে না দিয়েই তুর্বী চলে গেল। কেন জানিনা হঠাৎই কান্না পেল ওর। কান্না আটকানোর জন্যেই এই দ্রুত প্রস্হান। সৌহার্দ্যর পাশে দোলা নামটাই এখন সহ্য হয়না তুর্বীর। এটাই কী তবে প্রেম? প্রেম নামক রোগ কী তবে তুর্বীকেও গ্রাস করল?

___________

সৌহার্দ্য আর বিহান মিলে অনেকদিন পর আজ জমিয়ে রান্না করেছে। আজ প্রায় দুবছর পর দুই ভাই মিলে আবার রান্না করল। কিন্তু এখন আর আগের মত রান্নাঘর লন্ডভন্ড হয়না। ওরা এখন গুছিয়ে রান্না করতে শিখে গেছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আজ সৌহার্দ্য নিজেই বিহানকে বলল,

” ড্রিংক করবি না আজ?”

বিহান একটু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল,

” কী ব্যাপার বলতো? আজ তুই নিজে থেকে আমাকে ড্রিংক করতে বলছিস?

সৌহার্দ্য জানে একমাত্র ড্রিংক করলেই বিহান নিজের ভেতরকার সব কথা উগলে দেয়। না হলে ওর মুখ ফোটেনা সহজে। সৌহার্দ্য ব্যাপারটা সামলাতে বলল,

” আসলে, তুইতো আর আমার কথা শুনবিনা। তাই বললাম।”

বিহান ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” হুম, চল ছাদে চল।”

” না, আজ ছাদে না তোর পেন্টিং রুমে বস গল্প করব। তোর পেন্টিং এর এক্সপ্লেনেশনগুলো শুনবো।”

” ওকে ফাইন।”

পেন্টিং করার রুমটাতে গিয়ে দুজনেই ফ্লোরে হেলান দিয়ে বসল। সৌহার্দ্য আগেই সব পেন্টিং এর কাপড় সরিয়ে দিয়েছে। এরপর বিহান ড্রিংক করতে করতে বিহানকে একেকটা পেন্টিং এক্সপ্লেইন করছে। সৌহার্দ্য যখন দেখল বিহানের নেশা হয়ে গেছে ও বিহানের চোখের আড়ালেই তুর্বীকে ফোন করল। এরপর রিখিয়ার পেন্টিংটাকে উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,

” আর এটা?”

বিহান মাতাল দৃষ্টিতে তাকাল ছবিটার দিকে। তারপর একটু হাসল। যে হাসিতে ভালোবাসা, কষ্ট, নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য সব মিশে ছিল। তুর্বী এতক্ষণ সৌহার্দ্যর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ও দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে কানে নিলো। তুর্বীর পাশেই রিখিয়া বসে নিজের অফিসের কিছু কাজ করছে। তুর্বী চুপচাপ বিহানের বলা কথাগুলো শুনছে। তুর্বীকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,

” কার ফোন যে এভাবে চুপ করে শুনছোই শুধু কিছু বলছোনা?”

তুর্বী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” আর বলিস না। হোল্ডে থাকতে বলে কোথায় যেন গেছে। আমারও ওয়াসরুম যেতে হবে। এই শোননা তুই ফোনটা একটু কানে ধরে রাখ। লাইনে আসলে বলবি আমি ওয়াসরুম গেছি, ওয়েট করতে।”

বলে ফোনটা লাউডে দিয়ে তুর্বী বাইরে চলে গেল। রিখিয়া বলল,

” আরে কে আছে সেটাতো বলে যাও?”

কিন্তু তুর্বী আর দাঁড়ায় নি। রিখিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এরপর ফোনটা থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে ও কানে দিল ফোনটা, ভালোভাবে শোনার জন্যে। ওপাশ থেকে বিহানের গলা পেয়ে ও চমকে উঠল। বিহান বলছে,

” জানিস ব্রো। ওকে প্রথম একটা মলে দেখেছিলাম। লিফ্টের মধ্যে একটা মেয়ের সাথে ক্লোজ অবস্থাতেই আমাকে প্রথম দেখেছিল ও। লজ্জায় আর বিরক্তিবোধে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর এই ব্যাপারটাই ইন্টারেস্টিং লেগেছিল আমার। লিফ্টের বাইরে যখন ওকে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলাম তখন ভয়ে ভয়ে সরলভাবে ওর সব বলে দেওয়া, ইনোসেন্স দেখে অবাক হয়েছিলাম। এরপর যখন টাকার জন্যে ঘড়ি কিনতে না পেরে গোমড়া মুখে ফিরে যাচ্ছিল, সেটা নিতে পারিনি আমি। তাইতো ওকে ঘড়িটা পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। এরপর বারবার দেখা হয়েছে ওর সাথে। আমিও নানাভাবে ওরসাথে মজা করতাম। কেন জানিনা ওকে জ্বালাতে আমার অদ্ভুতরকম ভালো লাগতো। একটু একটু করে ওকে অন্যরকমভাবে আবিষ্কার করছিলাম। কিন্তু সেইদিন পার্টিতে ওর সম্মান বাঁচাতে গিয়ে যখন আমাকেই এরকম অসম্মানের শিকার হতে হয় শুধুমাত্র ওর একটু ভুল বোঝার কারণে। তখন আমার মাথায় শুধু মায়ার কথাই এসছিল। বারবার সেই দিনটা, সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছিল। সেই অপমান, সেই তিরস্কার, সকলের সেই ঘৃণাভরা দৃষ্টি সবকিছুই মাথায় ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল সেসব আবার ফিরে এসছে। মায়ার জায়গায় রিখিয়াকে কল্পনা করছিলাম আমি। ঐ মুহূর্তে আমার মাথা বিগড়ে গেছিল। তখন মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরছিল। প্রতিশোধ!”

রিখিয়ার চোখ ছলছল করছে বিহানের কথা শুনে। স‍ৌহার্দ্য আড়চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে যে রিখিয়া লাইনে আছে কি-না। রিখিয়া ভাবছে যে মায়া কে? কার জন্যে বিহানকে অপমানিত হতে হয়েছিল? সকলের ঘৃণার পাত্র হতে হয়েছিল? কী করেছিল মায়া? বিহান আবার বলতে শুরু করল,

” এরপর ওর সাথে মেলামেশা আর বন্ধুত্বের শুরুটা নাটক ছিল ঠিকই। কিন্তু প্রথমবার যখন গাড়িতে ওকে আমার বুকে নিয়েছিলাম মনে হয়েছিল আমার সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে গেছে। ওর সংস্পর্শে এসে আস্তে আস্তে আমার ভেতরকার শূণ্যতা দূর হয়ে গেছিল। শুরুটা অভিনয় দিয়ে হলেও একপর্যায়ে আমি ওকে সত্যিই নিজের বন্ধু ভাবতাম। আর সেই বৃষ্টির রাতে যখন ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওরকম অনুভূতি তার আগে আমার কক্ষণো হয়নি। ওকে যখন ঠিককরে চিনতে শুরু করলাম তখন বুঝেছি যে আমি কতবড় ভুল করছি। তাইতো আমি চেয়েছিলাম আমার উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার আগেই, ও আমাকে ভালোবাসার আগেই সব সত্যি বলে দিতে। কিন্তু দেরী হয়ে গেছিল। ততোদিনে ঐ বোকা মেয়েটা আমার মত একটা অযোগ্য, বাজে, ইউসলেস ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিল। হয়তো আমিও বেসেছিলাম কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি। তাইতো ও যাতে আর কষ্ট না পায় তাই সরে এসছিলাম। কিন্তু সরে গিয়ে বুঝতে পেরেছি আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। যত দিন যাচ্ছিল ওর স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে, আমার রাত জাগার কারণ হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও সরাতে পারিনি মন থেকে। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আস্তে আস্তে সেই অনুভূতির নাম খুঁজে পেলাম। বুঝতে পারলাম যে ঐ বোকা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু আজ এসব কথার কোন অর্থই নেই। আর দশদিন। এরপর ও অন্যকারো হয়ে যাবে। কিন্তু ও যারই হোক। আই লাভ হার। আই লাভ অর আ লট। কিন্তু আফসোস হচ্ছে। যদি একটা বার বলতে পারতাম, তোমার ভালোবাসা ব্যর্থ হয়নি রিখিয়া। আমিও ভালোবাসি তোমাকে। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”

রিখিয়া চোখ বন্ধ করে কেঁদে দিল। ওর হাত থেকে ফোনটা পরে গেল। সমস্ত শরীর কাঁপছে ওর। কী বলল বিহান এটা? কেন বলল? এখনই কেন বলল? একসময় এই তিনটে শব্দ ওর সমস্ত সুখের চাবিকাঠি ছিল। কিন্তু আজ যে এই তিনটে শব্দই ওকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিল। নিয়ত এতো নিষ্ঠুর কেন?

#চলবে…

[ রি-চেইক করা হয়নি]#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৮
.

বিহান নিজের পেন্টিং করার রুমটায় একা একা বসে পেন্টিং করছে। কী আঁকছে নিজেও জানেনা, বোর্ডের ওপর রং চালিয়ে যাচ্ছে শুধু। আজ বুকের ভেতর ভীষণ ভার হয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। কাঁদতে পারলে হয়তো খুব ভালো হতো কিন্তু আজ কান্নাও বিহানের সঙ্গ দিতে নারাজ। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর নাক টানছে একটু পরপর। চোখ, নাক সব লাল হয়ে গেছে। কিন্তু এই আঘাতগুলো হয়তো ওর পাওয়ানাই ছিল। ওরই দোষ আছে সবক্ষেত্রে। না হলে ওর সাথেই বারবার এমন কেন হবে? ওকেই কেন সবাই ঘৃণা করবে? সকালবেলায় সৌহার্দ্য চলে যাওয়ার পরে বিহানের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসছিল। ফোনটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে রিখিয়ায় গলা শুনে চমকে গেছিল বিহান। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বিহান নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কেমন আছো?”

রিখিয়া রাগী গলায় বলল,

” আপনার মত মানুষ যার জীবনে থাকে সে কখনও ভালো থাকতে পারে? কী চান কী আপনি?”

বিহান অবাক হয়ে গেল। এভাবে কথা কেন বলছে ওর সাথে রিখিয়া? ওর জানামতে ওতো এখন তেমন কিছুই করেনি। ও কিছু বলার আগেই রিখিয়া বলল,

” ভালোবাসেন আমাকে তাইনা?”

রিখিয়ার কথা শুনে বিহান চমকে উঠল। রিখিয়া কীকরে জানলো এই কথা? ওতো বলেনি? তাহলে কী সৌহার্দ্য বলে দিয়েছে? ও ইতস্তত করে বলল,

” এসব তোমাকে__”

কথাটা শেষ করার আগেই রিখিয়া একটু আওয়াজ করেই বলল,

” আমি জানতে চেয়েছি ভালোবাসেন কী-না?”

বিহান কিছুক্ষণ নিরব থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্পষ্ট ভাষায় বলল,

” হ্যাঁ ভালোবাসি।”

রিখিয়া একটু হাসল। যাকে বলে তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপর বলল,

” তা এবার কীসের প্রতিশোধ নিতে চান আপনি? সেদিন গিয়ে কিছু করেছিলাম না-কি?”

বিহান চুপ করে আছে। কোনো উত্তর নেই ওর কাছে। তাছাড়াও ও জানে ও এসবই ডিসার্ব করে। রিখিয়া চেঁচিয়ে বলল,

” কী হল বলুন? এবার কোন প্রতিশোধের খেলায় নেমেছেন আপনি? কেন জানালেন এসব আমাকে? নিজেকেতো সামলে নিয়েছিলাম আমি। মেনে নিয়েছিলাম সব। তাহলে কেন এভাবে আবার আমাকে ভেঙ্গে দিলেন? কেন শোনালেন কাল এসব?”

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল রিখিয়া। বিহান অবাক হল খানিকটা। কী বলছে রিখিয়া? কাল কী শুনেছে ও? তাহলে কী ও যখন নেশার ঘোরে কথাগুলো বলছিল তখনই শুনেছে? কিন্তু কীভাবে? সৌহার্দ্য শুনিয়েছে? বিহান বলল,

” রিখিয়া এটা সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি___”

রিখিয়া ওকে থামিয়ে বলল,

” প্লিজ। আপনার সো কলড ভালোবাসার কথা আমি আর শুনতে চাইনা। কয়েকমাস আমার সাথে থাকলেন, তারপর মাঝে দুটো বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজ আপনার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন? যখন আমার বিয়ের মাত্র ন-দিন বাকি। এসবের মানে কী ধরে নেব আমি?”

বিহান অসহায় কন্ঠে বলল,

” রিখিয়া এইজন্যই আমি তোমাকে কিছুই জানাতে চাইনি। কিন্তু হয়তো কাল ব্রো__ জানিনা কী হয়েছে, কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না। ট্রাস্ট মি।”

রিখিয়া আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

” ট্রাস্ট ইউ? কীকরে করি বলুনতো? আসলে আপনার মনের প্রতিশোধের ইচ্ছাটা এখনো শেষ হয়নি। যখন শুনেছেন যে আমার বিয়ে হচ্ছে। আমি নতুন জীবন শুরু করছি। ভালো থাকছি। তখন আপনার সেটা সহ্য হয়নি। তাই আবার নতুন করে এই নাটক শুরু করেছেন তাইনা? যাতে আমাকে আবারও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া যায়, শেষ করে দেওয়া যায়। আপনার মত মানুষ এরচেয়ে ভালো কী ভাবতে পারে। এক থাপ্পড়ের আর কত দাম নেবেন আমার কাছ থেকে? ইউ নো হোয়াট, এইজন্যই আপনার কাছে কিচ্ছু নেই। না পরিবার আছে, আর না ভালোবাসা আছে। আর নিজের ভাইকেও তো কাছে রাখার ক্ষমতা আপনার নেই। ছেড়ে চলে গেছিল। শুধুমাত্র একজন ভালো মানুষ বলেই আজও আপনার সাথে আছেন। না হলে আপনার মত মানুষের সাথে থাকা যায়না। একদম না।”

কথাগুলো বলে রিখিয়া ফোন রেখে দিল। আর এরপরেই শব্দ করে কেঁদে ফেলল। বিহানকে এসব বলতে চায়নি ও। কিন্তু আজ ওর ভেতরে জমানো অভিমানগুলো রাগ হয়ে বেড়িয়ে এলো। কেন করল বিহান এরকম? কেন ওর জীবনটাকে এতো জটিল করে দিল। যদি ভালোবেসেই থাকে তাহলে সেই অনুভূতিগুলো আগে কেন বুঝলোনা? আর যখন বুঝলো, এতো দেরী করে কেন বুঝল? কেন?
বিহান অনুভূতিহীন ভাবে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নিয়ে ওভাবেই বসে ছিল কিছুক্ষণ। ওকে দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা ও অনুভূতি এখন কেমন। শুধু গলাটা কাঁপছিল ভীষনভাবে। এরপর সোজা পেন্টিং করার রুমটাতে চলে আসে আর উল্টোপাল্টা রং করতে শুরু করে। হঠাৎ করেই বিহান রঙের টিউবগুলো একটার পর একটা খুলে খুলে বোর্ডের ওপর ছুড়ে মারতে শুরু করল। সব টিউব খালি হয়ে যাওয়ার পর ও তুলি দিয়ে বোর্ডে লেগে থাকা রংগুলো মিশিয়ে দিতে শুরু করল। কী করছে সেটা ও নিজেও জানেনা। কিন্তু নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে ওর, এখন ভীষণ ব্যস্ত।

_____________

সারাদিনের বৃষ্টি আর বজ্রপাতের পরেও আকাশ এখনও মেঘলা। মনে হচ্ছে বিকেলে আবার বৃষ্টি হবে। তুর্বী জানালা ধরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশের দিকে। ওর অজান্তেই ওর ভাবনায় এখন সৌহার্দ্যর বসবাস চলছে। ও না চাইতেও বারবার সৌহার্দ্যর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে পরছে। ওদের সেই উদ্দেশ্যহীন, কমিটমেন্ট ছাড়া সম্পর্ক। হঠাৎ হঠাৎ একে ওপরের কাছে চলে আসা। খুনশুটিময় কিছু মুহূর্ত। এরপর সৌহার্দ্যর ওকে বিয়ের কথা বলা। বিয়ের কথা মনে পরতেই ওর মনে পরল সৌহার্দ্য আর দোলার বিয়ের কথা চলছে। আচ্ছা সৌহার্দ্য তো ওকে ভালোবাসতো তাহলে অন্যকাউকে কীকরে বিয়ে করছে? তবে কী আজ আর সেই ভালোবাসা নেই? নিজের এরকম চিন্তাতে নিজেই অবাক হল তুর্বী? ও এসব চিন্তা কেন করছে? সৌহার্দ্য বিয়ে করতেই পারে। সারাজীবন একটা মেয়ের স্মৃতি আকড়ে বসে থাকবে না-কি? কিন্তু ব্যাপারটায় হঠাৎ ওর এতো খারাপ কেন লাগছে। কেন মানতে পারছেনা সৌহার্দ্যর বিয়ে হয়ে যাবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে রিখিয়া এসে দাঁড়াল ওর পাশে। তুর্বী না তাকিয়েও বুঝতে পারল যে রিখিয়া এসছে। তাই সামনে তাকিয়ে থেকেই বলল,

” এখনো রেগে আছিস আমার ওপর?”

রিখিয়াও রিক্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থেকে বলল,

” না, রেগে থাকব কেন?”

” কাল রাত থেকে আর কথা বলিস নি আমার সাথে, তাই বললাম।”

রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” মন ভালো ছিলোনা। আর তাছাড়াও কালকে সবটা প্লানিং করে করেছিলে তাইনা?”

তুর্বী মাথা নিচু করে বলল,

” হুমম।”

রিখিয়া উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে

” কী লাভ হল এসব করে?”

তুর্বী ভ্রু কুচকে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” রিখু, বিহান ভালোবাসে তোকে। আর তুই নিজের কানে শুনেছিস যে কতটা ভালোবাসে।”

রিখিয়া সামনে তাকিয়ে থেকেই হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” এসব কথার কোন মানে হয় এখন তুর?”

তুর্বী রিখিয়ার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,

” তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে হয়ে যায়নি ওকে? বিহান লাভস ইউ, রিখু। প্লিজ ভেবে দেখ।”

রিখিয়া হাত ছাড়িয়ে বলল,

” এতো ভাবাভাবির তো কিছু নেই। আমার সাথে এতোগুলো মাস কাটিয়ে ওনার আমার প্রতি কোন অনুভূতি জন্মালো না। ওনার মনে হল উনি আমাকে ভালোবাসেন না। অথচ দূরে গিয়ে দুই বছর পর ওনার মনে হল উনি আমাকে ভালোবাসেন? কাল তো আবার এটাও বলতে পারে যে ওনার ভুল মনে হয়েছিল।”

তুর্বী একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” রিখু অনেকসময় আমরা যেটা কাছে থেকে বুঝতে পারিনা সেটা দূরে গিয়ে বুঝতে পারি। বিহানের ক্ষেত্রে হয়তো এটাই হয়েছে।”

রিখিয়া আবারও একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তারপর বলল,

” তো? কী দাঁড়াল? ওনার যখন মনে হবে আমাকে ভালোবাসেনা তখন আমাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। আবার পরে যখন মনে হবে ভালোবাসেন তখন আমাকে কাছে টেনে নেবেন। আর আমি? আমি সেটাও এক্সেপ্ট করে নেব? আমি কী পুতুল?”

তুর্বী চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” ব্যাপারটা সেরকম হলে সবার আগে আমি তোকে আটকাতাম। কারণ আমার কাছে তোর সেল্ফ-রেস্পেক্ট সবার আগে। কিন্তু বিহান কী তোকে একবারও বলেছে যে ফিরে এসো? বা আমি তোমাকে ভালোবাসি? বরং ও নিজে থেকে বলবেনা বলেই আমরা প্লান করে ওকে দিয়ে অন্যভাবে তোকে বলিয়েছি। ও তখন ড্রাংক ছিল রিখু।”

রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকাল তুর্বীর দিকে। বিহান মাতাল অবস্থায় বলেছিল সেসব? তুর্বী বলল,

” আর ও তোর সাথে যা করেছিল তার শাস্তিও কম পায়নি ও। সৌহার্দ্য ওর কাছে কী তুই জানিস না? সেই ভাই ওকে ছেড়ে চলে গেছিল। ওর বাবা এসে মেরেছিল ওকে। সকলের থেকে দূরে গিয়ে বান্দরবান একা কাটিয়েছিল এই দুই বছর। দিন-রাত গুমরে মরেছে ও। রিখিয়া ও নিজে থেকেই তোর কাছে এসে স্বীকার করেছিল সবটা। ও যদি স্বীকার না করত? তাহলে তুই জানতে পারতি ওর প্লান? তুইতো ভাবতি যে তুই-ই নিজে থেকে বেশি এগিয়ে গেছিস, দোষটা তোর। কিন্তু তোকে সেরকম ভাবনায় রাখেনি। বরং সবটা স্বীকার করে নিজে থেকে সরে গেছিল। হ্যাঁ ও যা করেছিল তা অন্যায় ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওর অপরাধের যথেষ্ট শাস্তি ও পেয়ে গেছে। ও এখন বদলে গেছে রিখিয়া।”

রিখিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বীতো ঠিকই বলেছে। অথচ সকালে ফোন করে কত কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে বিহানকে ও। একটা ভুলের শাস্তি কতদিন ভোগা যায়? ও কিছু একটা ভেবে বলল,

” মায়া কে তুর?”

তুর কপাল ভাজ করে ফেলে বলল,

” মায়া? চিনিনা তো! কেন?”

রিখিয়া কালকে বিহানের বলা কথাগুলো সব বলল তুর্বীকে। কথাগুলো শুনে তুর্বী একটু ভাবুক হয়ে বলল,

” এর উত্তর তো সৌহার্দ্য-ই আমাদের দিতে পারবে।”

রিখিয়া কিছু বলল না। ওর এখন বিহানের সাথে করা ব্যবহারের জন্যে মন খারাপ হচ্ছে। এভাবে না বললেও হত। সত্যিই তো বিহান ওকে একবারও বলেনি ওর কাছে ফিরে যেতে। ওকে ভালোবাসতে। বরং নিজের ভালোবাসাটা নিজের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিল। আর ও আজ সকালে কীসব বলে দিয়েছে। কিন্তু ও-ই কী করত ঐ মুহূর্তে ওর মাথা ঠিক ছিলোনা। বিহানের সাথে কথা বলতে হবে ওকে এ ব্যাপারে। ওর কথায় হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা।

আর তুর্বী এখন রিখিয়ার বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। মায়া কে ছিল? কী এমন করেছিল মায়া যার জন্যে বিহান ওরকম হয়ে গেছিল? হতে পারে এর খোলাশা হলে রিখিয়ার মনে বিহানের প্রতি থাকা অবশিষ্ট ক্ষোভটুকুও আর থাকবেনা। তারজন্যে ওকে আগে এই মায়া নামক রহস্যের সমাধান করতে হবে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here