#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৯+10+11+12
.
হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটা একটা আবছা অন্ধকার রুমে বিছানায় ফেলে রাখা হয়েছে তুর্বীকে। অনেকক্ষণ যাবত ছটফট করে যাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে কিন্তু কেউ আসছে না।কোথায় আছে সেটাও জানেনা কারণ চোখও বাঁধা। তবুও নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে ও আর বার বার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ওকে ছেড়ে দিতে বলছে সাথে কিডন্যাপার এর চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ভার করে দিচ্ছ। তার সাথে এটাও ভাবছে যে ওকে কে কিডন্যাপ করল? আর কেনই বা করল? ও তো কোন বড় মন্ত্রী বা ব্যবসায়ীর মেয়ে নয়। খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। ওকে ধরে এনে কার কী লাভ? পাচার-টাচার করে দেবেনা তো ওকে? তাহলে তো আশেপাশে আরো মেয়ে থাকতো। অফিস থেকে বেড়িয়ে স্টান্ডের দিকেই যাচ্ছিল ও। কিন্তু তার আগেই একটা গাড়ি এসে ওর পথ আটকায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে কিছু লোক বেড়িয়ে এসে লোকগুলো ওকে গাড়িতে তুলে মুখ, হাত বেঁধে ফেলে। বেশিক্ষণ চেচানোর সুযোগ হয়নি ওর। এরপর ওকে এই রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে পা টাও বেঁধে দিয়েছে। মুখটা খুলে দিল যাতে কোন কিছু হলে বলতে পারে। বাঁধার সময় ও বারবার চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, ওরা কারা? কেন তুলে এনেছে? কী মতলব? কিন্তু তারা কোন উত্তর না দিয়েই বাইরে চলে গিয়ে দরজাটা লক করে দিল। বেশ কিছুক্ষণ অযথাই ছটফট আর চেঁচামেচি করে নিজেই থেমে গেল ও। এখন শুধু অপেক্ষা করছে ওর কিডন্যাপার আসার। কারণ ও শুনেছে লোকগুলোর কাছে কেউ বলেছে ওকে কিডন্যাপ করতে। ওও জানতে চায় যে ওর মত অনাথ একটা মেয়েকে তুলে এনে কার কী লাভ হল? ও মরে গেলেও তো কারো কিছু যায় আসবে না রিখিয়া ছাড়া। এতো পরিশ্রম করে ওর মত ইউসলেস একটা মেয়েকে তুলে আনার মত বোকামি কে করল? সেটা জানার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে ওর। আর তুলে এনেছে ভালো কথা, এভাবে বেঁধে রাখারই বা কী ছিল? কিছু খাবার জিনিস দিয়ে গেলেও তো হতো। বসে বসে খেতে খেতে টাইমপাস করতে পারত। কিন্তু এখন ওকে মূর্তির মত বসে থাকতে হচ্ছে। যেই ওকে কিডন্যাপ করেছে লোকটা মহা কিপটে, সাথে বোকাও। নাহলে এমন গাধার মত কাজ করে? কিডন্যাপার কখন আসবে সেটাও জানে না ও। কতক্ষণ থাকা যায় এভাবে? আসছে না কেন? রিখিয়াও নিশ্চয়ই প্রচন্তরকম টেনশন করছে। এসব ভেবে ভেবেই মেজাজ প্রচন্ডরকম খারাপ হচ্ছে ওর। এদিকে প্রচন্ড খিদেও পেয়েছে ওর। খুবই বিরক্ত লাগছে ওর এখন। কিছু না ভেবেই ও ওভাবেই বিছানায় শুয়ে পরল। অফিসের কাজ করে টায়ার্ড ছিল তারওপর এমন ধকলে ক্লান্তও ছিল। তাই কিডন্যাপারের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পরল ও।
সৌহার্দ্য বাড়ি থেকে সবে বেড়োলো ফার্মহাউজের উদ্দেশ্যে। মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসছে সেই কখন, কিন্তু ওই এখনও পৌছতে পারল না। কাজের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পরেছিল ও। তাই দেরী হল। তুর্বীকে কিছুটা হলেও চিনেছে ও। মেয়েটা ওখানে কী কান্ড ঘটাচ্ছে কে জানে? সকালের পর বিহানের সাথেও দেখা হয়নি ওর। ঐ ছেলে আবার কোথায় কী করছে সেটা বিহানই জানে। এসব ভাবতে ভাবতে ড্রাইভ করে যাচ্ছে।
_______________
রিখিয়া রাস্তা দিয়ে পাগলের মত এদিক ওদিক হাটছে আর বারবার ফোন করে যাচ্ছে তুর্বীর নাম্বারে। কিন্তু তুর্বীর ফোন বন্ধ বলছে। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে রিখিয়ার। রাত পোনে একটা বাজে এখন। তুর্বীর খুব বেশী দেরী হলে এগারোটা বাজে। তাও সেরকম হলে ফোন করে জানায় রিখিয়াকে। কিন্তু আজ ফোন না করায় টেনশন হলেও মনে করেছে ফোন বন্ধ হয়ত। কিন্তু এগারোটার বেশি বাজাতে রিখিয়ার টেনশন বেড়ে যায়। ও তুর্বীর অফিসে ফোন করে জানতে পারে তুর্বী অনেক আগেই বেড়িয়ে গেছে। এবার রিখিয়ার রিতীমত ভয় হচ্ছিল। বারোটা বাজার পর ও আর ফ্লাটে থাকতে পারেনি। ঐ রাতেই বেড়িয়ে গেছে বাইরে। তুর্বীর অফিসের রাস্তা দিয়ে পায়ে হাটতে হাটতে দেখছে ওও। গাড়িতে গেলে খুঁজতে সমস্যা আছে। মাথা খাজ করা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে ওর। ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হল তুর্বীকে খুঁজে পেতে হবে, সেটা যেকোন মূল্যে। মেয়েটা যে বড্ড চঞ্চল, যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়? তুর্বীর চিন্তায় ওর মাথাতেই নেই যে ওর সাথেও খারাপ কিছু হতে পারে। এগোতে এগোতে হঠাৎ করেই তিনজন ছেলে ওর পথ আটকে ধরল। রিখিয়া চমকে উঠল। ও এমনিতে একটু ভীতু টাইপের মেয়ে। তাই ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলল। ওদের মধ্যে একটা ছেলে মুখে বাঁকা টাইপ হাসি ফুটিয়ে বলল,
” কী গো সুন্দরী। এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছ?”
” দ-দেখুন যেতে দিন আমাকে।”
বলে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই ছেলেটা হিট দিয়ে পথ আটকে ধরল। পাশের ছেলেটা দাঁত বেড় করে একটা হাসি দিয়ে বলল,
” এত তাড়া কীসের খুকুমণি? এত রাত করে মেয়েরা একাএকা তো আমাদের জন্যেই বেড়োয়। আর তুমি যেতে চাইছ? এটা কী ঠিক?”
অন্য পাশের ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল,
” উহু একদম না।”
রিখিয়ার এবার কেঁদেই দিয়েছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে ওর। আশেপাশে তাকিয়ে কারো কাছে সাহায্য চাইবে তেমন কাউকেই দেখছে না। সব চলমান গাড়ি। ও চেঁচালৈও কেউ গাড়ি থামাবে কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। রিখিয়া দৌড় দিতে নিলেই একজন ওর হাত ধরে ফেলে বলল,
” আরে মামুণি কোথায় যাচ্ছো? সবে তো এলে এখনই যেতে দেই কীকরে হ্যাঁ?”
রিখিয়া প্রচন্ড ভয় পেয়ে শব্দ করে কেঁদে দিয়ে বলল,
” প্লিজ, হাত ছাড়ুন আমার।”
ছেলেগুলো জোরে হেসে উঠল। হঠাৎ করেই কোথা থেকে ওখানে বিহান এসে হাজির হল। হাফাতে হাফাতে বলল,
” আরে তুমি এখানে? কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে। কোথায় চলে গেছিলে।”
বিহান কি বলছে সেটা রিখিয়া বুঝতে না পারল না। কিন্তু এমন মুহূর্তে অল্প হলেও পরিচিত কাউকে পেয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না ও। বিহানকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করে দিল। ছেলেগুলো একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। বিহানের হঠাৎ করেই কেমন যেন অনুভব হল। এক অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছে রিখিয়া ওর বুকে মাথা রাখাতে। প্রতিনিয়ত বুকে জ্বলতে থাকা যন্ত্রণার আগুনে যেন কেউ শীতল স্পর্শ দিয়ে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই এক হাতে জড়িয়ে ধরল রিখিয়াকে। রিখিয়া তাতে আরও জোরে কেঁদে দিল। বিহান ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
” কিছু বলবেন ভাই? আসলে আমার ওয়াইফ। শহরে নতুন তো রাস্তা চেনেনা। হুট করেই হারিয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না হ্যাঁ?”
তারপর রিখিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল,
” আরে কেঁদোনা। এসে গেছিতো আমি।”
বিহানের মুখে বউ শুনে ছেলেগুলো চলে গেল। হঠাৎ করে রিখিয়ার মনে পরল ও কী করছে। মনে পরতেই এক ঝটকায় দূরে সরে গেল। বিহান হাত ভাজ করে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল ওর দিকে। রিখিয়া চোখ মুছে নাক টেনে টেনে বলল,
” আপনি কেন বললেন যে আমি আপনার ওয়াইফ?”
” তো কী করতাম? বাংলা সিনেমার হিরোদের মত ‘ডিসকাও’ ‘ডিসকাও’ করে ফাইট করে আপনাকে বাঁচাতাম? তাতে কী লাভ হত? তুমি তো আর হিরোয়িনদের মত আমার প্রেমে পরতে না। পরলে না হয় ফাইট করা যেত।”
এরপর রিখিয়ার দিকে ঝুকে বলল,
” কী বল? পরতে? প্রেমে? তাহলে বল? ওদের খুঁজে এনে তারপর মেরে দিচ্ছি।”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। বিহান একটা হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
” এই মেয়েটাও না। না ঠিক করে সরি বলতে জানে আর না থ্যাংকস বলতে জানে। এনিওয়ে এত রাতে একা একা বেড়িয়েছ কেন?”
রিখিয়ার মাথায় আবার তুর্বীর চিন্তা নাড়া দিলো। ও আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠল,
” তু-তুর.. সেদিন পুলিশ স্টেশনে যেই মেয়েটা ছিল আমার সাথে। ওকে খুঁজে পাচ্ছিনা। ফোন লাগছেনা। বাড়িও আসেনি।”
বিহান চমকে উঠল। তুর্বী মিসিং? তাহলে কী সৌহার্দ্য নিজের কাজ করে ফেলেছে? বিহান এসব ভাবতে ভাবতেই রিখিয়ার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। বিহান এখন শিওর যে ওর ভাই ই কিছু করেছে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে ও রিখিয়ার কাধে হাত রেখে হাত রেখে বলল,
” আচ্ছা ডোন্ট ক্রাই। চল আমি হেল্প করছি তোমাকে। আমরা গাড়ি স্লো চালিয়ে চারপাশটা দেখছি। দেখি পাই কী না?”
রিখিয়া বলল,
” পুলিশের কাছে যাই চলুন।”
বিহান বিড়বিড়িয়ে বলল, ” তাহলে তো গন্ডগল হয়ে যাবে”। তারপর নিজেকে সামলে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আগে ভালো করে সবটা খুঁজে তো দেখি। হতে পারে রাস্তাতেই কোথাও আটকে গেছে? আগে নিজেরা একটু খুঁজি?”
রিখিয়া সম্মতি দিল। বিহান রিখিয়াকে নিয়ে গাড়িতে তুলল। বিহান গাড়ি চালাচ্ছে আর রিখিয়া চারপাশে খুঁজছে। বিহানও মাঝেমাঝে খোঁজার ভান করছে। কারণ ও তো ভালোভাবে জানে যে তুর্বী কোথায় থাকতে পারে।
_______________
এদিকে দরজার বাইরে পাহারায় থাকা দুজনের মধ্যে একজন বলল,
” বাপড়ে! কী ডেঞ্জারাস মেয়ে। আমরা চারজন মিলে এইটুকু পথ আনতেই ঘাম বেড়িয়ে গেছে।”
অপরজন বলল,
” হ্যাঁ সেই! স্যারকে ফোন করেছিলি?”
” হ্যাঁ স্যার এলে আমরা বাকি টাকাটা নিয়ে আমরা চলে যাবো। জীবনে প্রথম এমন কাজ করলাম ভাই।”
” শুধুমাত্র সৌহার্দ্য স্যার বলেছেন বলে। অনেক বছর তো হল ওনাকে চিনি, মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু করবেনা। এটা শিওর।”
এরমধ্যেই ওখানে চলে এলো সৌহার্দ্য। সৌহার্দ্য আসতেই দুজন সোজা হয়ে দাঁড়াল। সৌহার্দ্য ওদের সামনে এসে দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,
” মেয়েটা কোথায়?”
” ভেতরে আছে স্যার।”
সৌহার্দ্য পকেট থেকে টাকা বেড় করে এগিয়ে দিল ওদের দিকে। টাকাটা নিয়ে ওদের মধ্যে একজন হেসে বলল,
” থ্যাংক ইউ স্যার!”
সৌহার্দ্যও হেসে বলল,
” সরি হ্যাঁ! আমার জন্যে কিডন্যাপিং ও করতে হল।”
” কী যে বলেন স্যার। অাপনার জন্যে এটুকু করতেই পারি।”
ওরা চলে যেতেই সৌহার্দ্য দরজা খুলে ভেতরে এল। ভেতরে ঢুকে চরম অবাক হল ও। কারণ তুর্বী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। চোখ বাধা তাই ঘুমোচ্ছে কি না শিওর হতে হালকা নাড়া দিল সৌহার্দ্য কিন্তু দেখল হ্যাঁ আসলেই ঘুমোচ্ছে। ও শকড হয়ে হাত পা চোখ বাঁধা ঘুমন্ত তুর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এটা মেয়ে নাকি এলিয়েন? এমন মুহূর্তে কেউ এভাবে ঘুমোতে পারে? আনবিলিভএবল! কিন্তু না এই মেয়েকে শান্তির ঘুম ঘুমাতে দিতে তো তুলে আনেনি সৌহার্দ্য। একটা পাকাপোক্ত শিক্ষা দিতেই তুলে এনেছে। তাই পাশের রাখা জগ থেকে হাতে পানি নিয়ে তুর্বীর মুখে ছুড়ে মারল। প্রথমবারে নড়ে উঠলেই ‘উমম’ শব্দ করে ঘুমের ঘোরেই মুখ মুছে নিল ও। সৌহার্দ্য আবারও একই কাজ করল। মুখে পানির ছেটায় চমকে উঠল তুর্বী। চোখ বাঁধা আছে তাই দেখতে পারছেনা কে। ওর সবটা মনে পরতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। আর বুঝতে পারল ওর সেই কিডন্যাপার এসে গেছে। মিনিট দুই চুপচাপই ছিল দুজন। ততক্ষণে তুর্বী ঘুম ভাব কাটিয়ে উঠেছে। সৌহার্দ্য একটু এগিয়ে আসতেই তুর্বী বলল,
” এই যে মিস্টার মিস নাকি মিসেস হোয়াটএভার। আমায় এভাবে তুলে এনেছেন কেন হ্যাঁ? দেখুন আমি কোন বড়লোকের বেটি নই যে কিডন্যাপ করে ব্লাকমেইল করে পরিবার থেকে টাকা নিতে পারবেন। তাই সেই আশায় আমাকে কিডন্যাপ করে থাকলে আপনার জন্যে এক বালতি নো নো এক ড্রাম সমবেদনা।”
সৌহার্দ্য মুচকি হাসল। ও তো মেয়েটার ওপর যত রাগ করতে চায় কিন্তু মেয়েটার কথা শুনলেই সব রাগ এমনিই চলে যায়। কী আছে মেয়েটার কথায়? শুধুই চঞ্চলতা? নাকি চঞ্চলতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক সরল নির্মল মন? কী জানি? হয়ত আছে কিছু একটা।সৌহার্দ্য মুখে একটা কাপড় বেঁধে নিল যাতে ভয়েজ কিছুটা অন্যরকম শোনায় আর তার ওপর দিয়ে পুরো মুখ কাভার করে এমন একটা কালো রঙ এর মাস্ক পরে নিল। যদিও তুর্বীর চোখ এখন বাঁধা, তবুও। সৌহার্দ্য চুপচাপ বিছানায় বসল। সামনে থেকে কোন উত্তর না পেয়ে তুর্বী বলল,
” কী হল? কোথায় গেলেন?”
” আছি, আপনার সামনেই আছি।”
” হ্যাঁ, তো মৌনব্রত পালন না করে তাড়াতাড়ি কাজের কথা বলুন। আর আমার চোখ কেন বেধেছেন? দেখতে এতটাই খারাপ যে মুখ দেখাতে চাইছেন না? কে আপনি?”
” আপনার মোস্ট হেটেড পার্সন। S.R.”
তুর্বী অবাক হয়ে গেল। S.R. ওকে তুলে নিয়ে এসছে? এটা কীকরে হয়? ও কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
” এটা কেমন অসভ্যতা হ্যাঁ? আপনি না সবাইকে এত এত জ্ঞানের বাণী শোনান? আমায় কেন তুলে এনেছেন?”
সৌহার্দ্য তুর্বীর ঘাবড়ে যাওয়াতে বেশ মজা পেল। তাই ওকে আরো ভয় দেখাতে বলল,
” তুমি আমারই শো তে কল করে আমাকেই উইদআউট ডিটার্জেন দিয়ে ধুয়ে দেবে। আমার পেজে আমারই নামে গুনকীর্তন করে কম্পিজশন আকারে পোস্ট করবে। আমার পোস্টে আমাকে বাঁশ দিয়ে প্রাগ্রাফ আকারে কমেন্ট করবে, আর আমি? আমি চুপচাপ সবটা সহ্য করব? এটাই ভাবছিলে তুমি? সিরিয়াসলি?”
” ক্ কী করবেন?”
” একটা ছেলে একটা মেয়েকে এরকম নির্জন একটা ফার্মহাউজে কেন নিয়ে আসতে পারে?”
তুর্বী শীতেও একটু ঘামছে এবার। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
” কেন?”
” প্রাকটিক্যালি করে দেখাই?”
তুর্বী এবার একটু জোরে বলর,
” আমি কিন্তু জোরে চেঁচাবো এবার!”
সৌহার্দ্য তুর্বীকে আরও ভয় পাওয়ানোর জন্যে ওর একদম কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” এখানে তুমি গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও কেউ শুনবে না। ফার্মহাউজে যারা আছে সব আমার লোক। ওরা এখানে আমায় আই মিন আমাদের ডিসটার্ব করতে আসবেনা। তোমার এক্সপিরেয়েন্স চাই না রিলেশনশীপের?”
সৌহার্দ্য এত কাছে আসাতে কেমন যেন একটা লাগছে তুর্বীর। সৌহার্দ্যর কথায় তুর্বী যথেষ্ট ভয় পেয়েছে। ও একা একটা মেয়ে কী বা করতে পারবে এখন? যদি সৌহার্দ্য ওর সাথে সত্যিই উল্টোপাল্টা কিছু করে তাহলে এরকম কিছু হবে সেটাও ভাবেই নি। এতদিন যেভাবে জ্বালিয়েছে S.R. কে এর শোধ যে সে গুনে গুনে নেবে সেটাতো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে এভাবে বদলা নেবে?
#চলবে…
( রি-চেইক হয়নি। একটু কষ্ট করে বুঝে নেবেন।)
#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১০
.
সৌহার্দ্যর এতো কাছে আসাতে তুর্বী নিশ্বাস আটকে আসছে। তুর্বীর ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য চার আঙ্গুল দিয়ে তুর্বীর কানের নিচ দিয়ে গলায় স্লাইড করে চুলগুলো সরিয়ে দিল। মৃদু কেঁপে উঠল ও। কখনও কোন ছেলের এত কাছে আসা হয়নি তো! তাই এই সামান্য ছোঁয়াও সহ্য হচ্ছে না। তুর্বী যথেষ্ট শক্ত একটা মেয়ে। কিন্তু এখন ওর ঠিক কী হয়েছে ও নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা। সৌহার্দ্য আবারও একই ভঙ্গিতে বলল,
” ভয় করছে?”
তুর্বী এবার কম্পিত কন্ঠে বলল,
” আমি কিন্তু পুলিশ কেস করব, যদি আপনি আমার সাথে এমন কিছু করার সাহস দেখান।”
সৌহার্দ্য ঠোঁট চেপে হাসল, এরপর বলল,
” তাই? তা ঠিক কী বলবে পুলিশকে?”
” বলব যে আর.জে. SR আমায় কিডন্যাপ করে এনে আমার সাথে বাজে ব্যাবহার করেছে।”
” আচ্ছা! তা তুমি কী S.R. কে দেখেছ?”
তুর্বী না বোধক মাথা নাড়ল। সৌহার্দ্য আবার বলল,
” তাহলে কীকরে পুলিশকে বিশ্বাস করাবে যে তোমাকে S.R ই তোমাকে কিডন্যাপ করেছেন?”
তুর্বী এবার সত্যিই ভাবনায় পরল। এখন যদি S.R.ওর সাথে খারাপ কিছু করেও। ও তো কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারবেনা যে S.R. ই এসব করেছে। কী করবে ও? ও কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
” আপনি খুব শেয়ানা একটা মাল আছেন।”
সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে ফেলল তুর্বীর মুখে দ্বিতীয়বার ‘মাল’ শব্দটা শুনে। কিন্তু কিছু না বলে প্রথমে তুর্বীর পা আর পরে ওর চোখ খুলে দিলো। তুর্বী আবছা অন্ধকারে কালো মাস্ক পরা একটা লোককে দেখে চমকে একটু দূরে সরে গেল। জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে বলল,
” বাপড়ে বাপ! আমাকে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মারবেন না কী? কী ভয়ঙ্কর। এটা কী আপনার রিয়াল ফেস? এই জন্যেই কারো সামনে আসেন না বুঝে গেছি।”
” চুপ স্টুপিড! এরকম কোন মানুষ চেহারা হয়?”
তুর্বী বিড়বিড় করে বলল,
” আপনি যে মানুষ সেটা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।”
সৌহার্দ্য শুনতে পেল তুর্বীর কথা, কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এল। হাত খুলতে খুলতে বলল,
” সবসময় এমন ক্যাঙ্গারু স্টাইলে না লাফালে হয় না?”
” আমার বডি, আমার উইশ। আপনার কী তাতে?”
সৌহার্দ্য হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করল। এমন কেন মেয়েটা? একটু বেশিই চঞ্চল। ওর কী একবারও মনে হচ্ছেনা এখান থেকে পালানো উচিত? তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বলল,
” এইযে মিস্টার? আপনি জানেন আপনি একটা কিপটে, হাড় কিপটে ? একটা মেয়েকে তুলে এনেছেন অথচ কিছু খেতে অবধি দিলেন না এখনও। সেই দুপুরে ক্যানটিনে একটু খেয়েছি। জানেন খিদেতে আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর কথায় এবার আর অবাক হলনা। কারণ ইতিমধ্যে বুঝে গেছে মেয়েটা কেমন। কিন্তু ভাবল যে সত্যিই তো। সেই দুপুরে খেয়েছে এতক্ষণ না খাইয়ে রাখাটা ঠিক হয়নি মোটেই। সৌহার্দ্য ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করে বলল রুমে খাবার দিয়ে যেতে। তুর্বী মনে মনে কিছু একটা ভেবে সৌহার্দ্যর মুখে পরা মাস্কটা টান মেরে খুলতে গেল কিন্তু তার আগেই সৌহার্দ্য তুর্বীর হাত ধরে ফেলল। তুর্বী একটু হকচকিয়ে গেল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বরর,
” তুমি নিজেকে যতটা চালাক ভাবো। এক্চুয়ালি তুমি এতটাও চালাক নও ইউ নো।”
তুর্বী একটানে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাত ভাড মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। সৌহার্দ্য কিছু বলল না। পকেট থেকে ফোন বেড় করে স্ক্রোল করতে লাগল। তুর্বী মনে আড়চোখে এই মুখশধারী ব্যাক্তিকে দেখছে আর ভাবছে যে এখন আপাতত ভীষণ খিদে পাচ্ছে। আগে খেয়ে নিক তারপর ভাববে কীকরে পালানো যায়। এসব ভাবতে ভাবতে দরজায় নক পরল। সৌহার্দ্য উঠে গিয়ে দরজাটা অর্ধেক খুলে খাবারের ট্রে টা নিয়ে দরজা আবার লাগিয়ে দিয়ে তুর্বীর সামনে রেখে বলল,
” নিন আগে খেয়ে নিন ম্যাম। আপনার সাথে অনেক হিসেব এখনও বাকী আছে।”
তুর্বী খেতে নিয়েও থেমে গেল? রিখিয়া টা খেয়েছে তো? ও নেই রিখিয়ার কী অবস্থা হয়েছে এখন? কান্নাকাটি করছে না-কি? তুর্বীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সৌহার্দ্য বলল,
” খাচ্ছোনা কেন?”
তুর্বী আনমনেই বলল,
” রিখুটা কী করছে কে জানে? খেয়েছে কী-না সেটাও জানিনা। সব আপনার জন্যে।”
সৌহার্দ্য মনে মনে বেশ অবাক হল। ও এতদিন ভাবত যে ওর আর বিহানের মত বন্ডিং কারো কখনও হতেই পারেনা। কিন্তু তুর্বী আর রিখিয়ার বন্ডিং দেখে সেই ধারণা ভেঙ্গে গেছে সৌহার্দ্যর। ও একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” তুমি এখানে না খেয়ে থাকলে কী ওর খাওয়া হয়ে যাবে? বরং তুমি এখন না খেলে আমার হাত থেকে পালানোর উপায় বা শক্তি কোনটাই পাবে না।”
তুর্বী একটা মুখ ভেংচি দিয়ে খেতে শুরু করল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বেডে হেলান দিয়ে ফোন দেখতে লাগল। কিন্তু মূলত ও ফোন দেখার বদলে তুর্বীকেই দেখছে। তুর্বীর সেদিকে খেয়াল নেই। ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে তাই ওর পুরো মনোযোগ খাওয়াতেই। সৌহার্দ্যর কী হয়েছে ও নিজেই জানেনা। কখনও কোন মেয়ের দিকে এভাবে তাকায়নি। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই দেখছে। তাও এমন একটা মেয়েকে যে ওর চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত জগতে বসবাস করে।
_______________
বিহান রিলাক্স মুডে গাড়ি চালাচ্ছে। রিখিয়া এদিক ওদিক তুর্বীকে খুঁজছে। বিহানও মাঝেমাঝে রিখিয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে খোঁজার ভান করছে। রিখিয়া কয়েকবার পুলিশে যাওয়ার কথা বলেছে কিন্তু বিহান ওকে এটা ওটা বুঝিয়ে কনভেন্স করে নিয়েছে। এমনভাবে বুঝিয়েছে যে রিখিয়াও মানতে বাধ্য হয়েছে।হঠাৎ রিখিয়া শব্দ করে কেঁদে দিল। বিহান পুরো হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গাড়ি ব্রেক করে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” হেই, কাঁদছো কেন তুমি? লিসেন, কিচ্ছু হবেনা তুর্বীর খুঁজে পেয়ে যাবো ওকে আমরা।”
রিখিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
” আপনি বুঝতে পারছেন না। তুর খুব চঞ্চল। জানিনা কী করে বসে আছে মেয়েটা।”
বিহান রিখিয়ায় কাঁধে হাত রাখল। এতে রিখিয়া আরও জোরে কেঁদে উঠল। বিহান মনে মনে বলল, ‘ব্রো, এটা কাকে তুলে নিয়ে গেলি তুই? তার বান্ধবী তো এখন আমার মাথা খাচ্ছে।’ লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” আচ্ছা, কেঁদোনা। আমি বলছি তো খুঁজে পেয়ে যাবো।”
রিখিয়া অধৈর্য হয়ে বিহানের দুই হাত ধরে বলল,
” প্লিজ, খুঁজে দিন ওকে। প্লিজ! ”
বিহান হাতের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল,
” তুর্বীর কোন ক্ষতি হবেনা, আমি কথা দিচ্ছি।”
কিছুক্ষণ পর রিখিয়ার খেয়াল হল যে ও বিহানের হাত ধরে আছে। তাড়াতাড়ি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল ও। খোলা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে একটু সরে বসল। কখনও কোন ছেলের এভাবে কাছে যায়নি ও। তাই এমন অনুভূতি। বিহান রিখিয়ার অস্বস্তি বুঝতে পেরে ওকে নরমাল করতে বলল,
” রাতে খেয়েছ কিছু?”
রিখিয়া মাথা নেড়ে না বলল। বিহান একটু ভেবে বলল,
” চলো আগে কিছু খেয়ে নি হ্যাঁ?”
রিখিয়া ভাঙা গলায় বলল,
” আমি এখন খাবো না।”
” দেখ আমার এখন ভীষণ খিদে পেয়েছে। তুমি খাবেনা তারমানে এটা নয় যে আমিও খাবোনা।”
” আপনি গিয়ে খেয়ে নিন না। আমি খাবোনা।”
” আজব। আমার সাথে একটা মেয়ে আছে। সে খাবেনা অথচ আমি খাবো? আমাকে দেখে কী এতোটা ম্যানারলেস মনে হয়?”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে তাকাল। বিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” কী আর করার। একজনের উপকার করতে এসে এখন সারারাত না খেয়ে কাটিয়ে দিতে হবে। একেই বলে কপাল!”
রিখিয়া এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
” আজব লোকতো আপনি? এরকম সময়েও মজা করছেন?”
বিহান ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
” আরেহ! আমিতো তোমাকে হেল্প করছি। আর তুমি আমাকেই কথা শোনাচ্ছ? ভালাই কা জামানাই নেহি রাহা। ঠিকাছে, কী আর করার? না খেয়েই থাকতে হবে।”
রিখিয়া এবার ভাবল ঠিকই তো। না খেয়ে কতক্ষণ খুঁজবে ছেলেটা? অনেক্ষণ তো হলো। রিখিয়া ইতস্তত করে বলল,
” আচ্ছা চলুন। কিন্তু এখন তো বেশ রাত হয়েছে। এতো রাতে কোন রেস্টুরেন্ট খোলা আছে?”
“সামনে রেলওয়ে স্টেশন আছে। ওখানে কিছু খাবারের দোকান সারারত খোলা থাকে চল ওখানে যাওয়া যাক?”
রিখিয়া মাথা নাড়ল। বিহান গাড়ি স্টার্ট করে স্টেশন অবধি গেল। ওখানে গিয়ে দুজনেই গাড়ি থেকে নামল। বাইরে এখন বেশ ঠান্ডা। চারপাশে ছোটখাটো অনেক দোকান।ওখানে একটা দোকানে বিহান দুজনের জন্যে পরোটা আর ডিম ভাজা দিতে বলল। এরপর দুজনে বেঞ্চে বসল। বিহান কিছু একটা ভেবে বলল,
” তুমি একটু বসো আমি একটা কল করে আসছি।”
রিখিয়া মাথা নাড়ল। বিহান একটু দূরে গিয়ে সৌহার্দ্যর নাম্বারে কল দিল। ওপাশ থেকে সৌহার্দ্য ফোন তুলে বলল,
” হ্যাঁ বল।”
” তোর ভয়েজের কী হল? এনিওয়ে ব্রো, তুর্বী তোর কাছে নাকি?”
সৌহার্দ্য একপলক তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ কেন বলত?”
বিহান একটা শ্বাস ফেলে রিখিয়ার কথা খুলে বলল। সব শুনে সৌহার্দ্য বলল,
” এক কাজ কর। আজ রাতটা ওকে তোর কাছেই রাখ। দেখিস যাতে প্রবলেম না হয়।”
” তা কতক্ষণ রাখবি ওকে তোর কাছে? আর কী করছিস বলত ওর সাথে?”
” যতক্ষণ না আমাকে জ্বালানোর ভুত নামছে মাথা থেকে। আর বিশেষ কিছু করছি না। সবে প্রাইমারি ডোস দিয়েছি। অারেকটু খানি টাইট দেওয়া বাকি আছে।”
বিহান হেসে বলল,
” ওকে। দেখ টাইট দিতে গিয়ে নিজেই টায় টায় ফিস হয়ে যেওনা।”
” চুপ কর আর ওই মেয়েটার খেয়াল রাখ।”
বিহান ফোন রেখে রিখিয়ার কাছে গিয়ে দেখে রিখিয়া ঠান্ডায় কাঁপছে। দুইহাতের বাহু জড়িয়ে বসে আছে। তাড়াহুড়োয় গরম পোশাকও নিয়ে আসেনি মেয়েটা। বিহানের কী হল নিজেই জানেনা। ও ওর জ্যাকেট খুলে রিখিয়ার গায়ে জড়িয়ে দিল। রিখিয়া চমকে উঠল। কাঁপা গলায় কিছু বলার আগেই বলল,
” পরে নেও নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আমার গায়ে ফুল হাতা গেঞ্জি আছেই। প্রবলেম হবেনা।”
এরমধ্যেই খাবার চলে এল। বিহান তাড়াতাড়ি হাত ঘসে খেতে শুরু করে দিল। রিখিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। রিখিয়ার খুব অস্বস্তি লাগছে বিহানের আশেপাশে থেকে। কিন্তু আপাতত ওর আর কিছু করারও নেই। তবে বিহান সম্পর্কে নতুন একটা ধারণা জন্ম নিল ওর। সেটা হল, ” ছেলেটা ভালোবাসার যোগ্য হোক, চাই না হোক ঘৃণার যোগ্য না।”
#চলবে..
[ এই রাতটা চারজনেই লাইফেরই টার্নিং পয়েন্ট। অনেককিছু বদলাবে এই রাতের পর। কালকের পর থেকেই গল্পটার মূল কাহিনি শুরু হবে। এডমিশনের এপ্লাই করা, এক্সাম, সব নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় ছোট হয়ে গেছে। যাই হোক হ্যাপি রিডিং।]
#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১১
.
রিখিয়া একরাশ অস্বস্তি নিয়ে জ্যাকেটটা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল। প্রায় মধ্যরাত এখন। প্রচন্ড ঠান্ডা পরেছে। লোকজনের তেমন ভীর না থাকলেও স্টেশন ফাঁকা নয়। বিহান বা রিখিয়া কেউ কিছুই বলছেনা। রিখিয়া এখনও খাওয়া শুরু করেনি। বিহান খেতে খেতে বলল,
” শীতের রাতে গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজা। আহা!”
এরপর রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” একি! তুমি খাচ্ছো না কেন? ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।”
রিখিয়ার বেশ বিরক্ত হলো। তুর্বীর টেনশনে ওর মাথা ছিড়ে যাচ্ছে আর এই ছেলে খাওয়া নিয়ে পরেছে। রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” আমার কতটা চিন্তা হচ্ছে আপনি বুঝতে পারছেন? আমার বান্ধবীকে পাওয়া যাচ্ছেনা। বুঝতে পারছেন আপনি?”
” আরে ডোন্ট ওয়ারি শী ইজ ইন সেফ হ্যান্ড”
বিহান আনমনে বলে ফেলল কথাটা। রিখিয়ার বিহানের কথাটা ঠিকভাবে ধরতে পারল না। তাই জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,
” কিছু বললেন?”
” না। তাড়াতাড়ি খাও। আবার খুঁজতে হবে তো নাকি?”
রিখিয়া এবার রাগী কন্ঠে বলল,
” আমরা পুলিশ স্টেশনে কেন যাচ্ছিনা?”
” তোমার বান্ধবী বাচ্চা নয়, এডাল্ট একটা মেয়ে। আর কয় ঘন্টা হয়েছে ও নিখোঁজ? লজিক দিয়ে কথা বলো ভাই! এখন কথা না বারিয়ে চুপচাপ খাও।”
রিখিয়া মুখ গোমড়া করে খেতে শুরু করল। বিহান আড়চোখে একবার তাকাল রিখিয়ার দিকে তারপর গলা ঝেড়ে বলল,
” আচ্ছা, আমিতো আছি। ঠিক পেয়ে যাবো চিন্তা করোনা।”
রিখিয়া উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। খাওয়া শেষ করে ওরা ওখানেই বসল কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে। এরমধ্যেও রিখিয়া কয়েকবার তুর্বীকে কল করে ফেলেছে। কিন্তু ফোন বন্ধ। রিখিয়া কিছু না বলে চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ পর বিহান খেয়াল করল রিখিয়ার চোখ ছলছল করছে। বিহান রিখিয়ার কাঁধে হাত রাখতেই রিখিয়া কেঁদে দিল। কেন জানিনা বিহনের রিখিয়ার কান্না একেবারেই সহ্য হচ্ছেনা। মেয়েটার সাথে এই নিয়ে মোট চারবার দেখা হল। এই অল্প সময়ে ওর হাসি বা কান্নায় তো বিহানের কিছু যায় আসার কথা না। তাহলে কেন এমন হচ্ছে? এই অনুভূতি কেন? ও রিখিয়ার দিকে ঘুরে বসে আলতো হাতে ওর চোখ মুখে দিল। রিখিয়া রিতীমত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। বিহান ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে বলল,
” এভাবে কাঁদলে একটু পর স্টেশনের সবাই এসে আমাকে বেঁধে পেটাবে। ভাববে তোমার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করেছি। তোমার বোকামির জন্যে একবার সারারাত লকাপে কাটিয়েছি। এবার কী মার খাওয়াবে?”
রিখিয়া মুখ ফুলিয়ে একপলক বিহানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। সেদিন না হয় একটা ভুল করেছিল, তাই বলে এভাবে লজ্জা দিতে হবে? বিহান বাঁকা হেসে রিখিয়ার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
” জানো? লজ্জা পেলে তোমার গাল দুটো পুরো লাল লাল হয়ে যায়? টমেটো টাইপ।”
রিখিয়া চোখ বড় বড় করে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান হেসে চোখ টিপ মারল। এতে তো রিখিয়ার একেবারে বিষম খাওয়ার যোগার। কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওর একটু হাসি পেল। হাসতে নিয়েও নিজেকে কন্ট্রোল করে নিল। বিহান সেটা খেয়াল করে বলল,
” আ-আ-আ স্মাইল, স্মাইল। এটা ঠিক না, তুমি হাসছিলে। হাসো প্লিজ। আরে স্মাইল না!”
রিখিয়া এবার আর হাসি আটকে রাখতে পারল না। মুখের ওপর হাত রেখে হেসে দিল। বিহানও হাসল। রিখিয়া হাত নামিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
” আপনি সত্যিই পাগল।”
” ব্রো ও সেটাই বলে।”
” ব্রো কে?”
” আমার ভাই, বন্ধু, গার্ডিয়ান সব।”
রিখিয়া অবাক হল কারণ ও আন্দাজ করতে পেরেছে কার কথা বলছে । বাবা-মা কে ছেড়ে সমবয়সী একজনকে গার্ডিয়ান বলছে? কেন? কিছু একটা ভেবে শিউর হতে বলল,
” সেদিন থানায় আপনার সাথে যেই ছেলেটা ছিল সে?”
” হুম।”
রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,
” খুব ভালোবাসেন তাকে?”
” বাসতে বাদ্ধ। কারণ ও আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে।”
” আপনার বাবা-মা?”
বিহান চুপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” চল, এগোনো যাক?”
বিহান যে রিখিয়ার কথা এড়িয়ে গেল সেটা রিখিয়া বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কী করবে? কারো ব্যাক্তিগত জীবণ নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখানোর মত ম্যানারলেস ও নয়। আর হওয়া ঠিকও না।
________________
সৌহার্দ্য ওয়াসরুমে গেছে। তুর্বীর মনে হল এটাই বেস্ট টাইম পালানোর। এতক্ষণ তো সৌহার্দ্য পুরো চোখে চোখে রেখেছে ওকে। ওকে ছেড়ে দেওয়ার শর্ত একটাই যা করেছে তার জন্যে সরি বলতে হবে, আর প্রমিস করতে হবে ওকে আর এরকম জ্বালাবে না। কিন্তু তুর্বী কী এত সহজে মেনে নেওয়ার মেয়ে? ওর একটাই কথা ও রাজি হবেনা। এই S.R. এর ভয়ে তো একেবারেই না। গায়ের জোরে একবার পালাতে গিয়েছিল কিন্তু সৌহার্দ্য সাথে পেরে ওঠে নি। তাই এখন এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়না ও। তুর্বী ধীরপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে টি-টেবিলের ওপর থেকে ছুরিটা নিয়ে নিল সেফটির জন্যে। দরজার কাছে গিয়ে দেখল দরজাটা লক করা। কয়েকবার ঠেলে, ধাক্কা দিয়েও কোন লাভ হল না। ও দরজার একটা লাথি মেরে বলল,
” দূর! লক করে রেখে গেছে।”
প্রচন্ড রাগ লাগছে ওর। রাগে ছুরিটা দিয়ে দরজায় অকারণেই আঘাত করল কয়েকবার।
” শুধু শুধু আমার দরজার বারোটা কেন বাজাচ্ছো?”
তুর্বী চমকে পেছনে তাকালো। তাকিয়ে দেখে সৌহার্দ্য দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আছে। মাস্ক পরে থাকায় চেহারার এক্সপ্রেশন দেখতে পাচ্ছেনা। সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে আসতেই তুর্বী ছুরিটা সৌহার্দ্যর দিকে তাক করে বলল,
” দেখুন। আমাকে যেতে দিন হ্যাঁ? নইলে কিন্তু…”
সৌহার্দ্য দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
” না হলে?”
” ছুরি চালিয়ে দেব কিন্তু।”
” এটা ছাড়া আর কিছু পারো?”
তুর্বী কিছু বলল না কিন্তু ছুরিটা আরো এগিয়ে ধরল। তুর্বীর ছুরিকে তোয়াক্কা না করে সৌহার্দ্য এগোতে এগোতে বলল,
” তোমার কী সত্যি মনে হয় তোমার এসব সিলি ট্রিক্ট কোন কাজের?”
বলে তুর্বীর হাত ধরে ছুড়িটা নিয়ে ওকে টেনে এনে আবার বেডে বসিয়ে দিল। তুর্বী একরাশ বিরক্তি নিয়ে পা উঠিয়ে বসে বলল,
” আপনি আমায় ছাড়বেন কী না? সেটা বলুন আগে।”
সৌহার্দ্য আলসেমি ঝেড়ে তুর্বীর পাশে বসে বলল,
” আগে আমি যা বলেছি তা মেনে নাও। ছেড়ে দেব।”
” কখনই না।”
” তাহলে এভাবেই থাকো।”
বলে সৌহার্দ্য আবার ফোন স্ক্রোলিং এ মনোযোগ দিল। তুর্বী চোখ মুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আড়চোখে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে, গলাটা একটু ঝেড়ে বলল,
” তা খোমাটা একটু দেখালে কী হয় ?”
সৌহার্দ্য অবাক কন্ঠে বলল,
” ‘খোমা’ কী জিনিস?”
” আরে মুখ, মানে চেহারা।”
সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে বলল,
” সেটা সোজাভাবে বললেও হত। এসব কী ভাষা?”
” আপনি যে এত মূর্খ একটা মানুষ তা জানতাম না।’
সৌহার্দ্য একটা হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করল। ফোনটা সাইডে রেখে বলল,
” এমনিতে তো আমার ফেসবুক পেজে, কমেন্টে বড় বড় করে লিখতে আমাকে সামনে পেলে এই করবে, সেই করবে। এখন তো সামনেই আছি। বল কী করবে?”
তুর্বী গাল ফুলিয়ে হাত ভাজ করে বলল,
” তখন কী জানতাম নাকি যে আপনি এত ডেঞ্জারাস একটা মাল।”
সৌহার্দ্য রাগী গলায় বলল,
” আবার এসব ভাষা!”
তুর্বী আরো রেগে গিয়ে বলর,
” একশবার বলব। কী করবেন আপনি?”
সৌহার্দ্য গেঞ্জির হাতা ফোল্ড করে তুর্বীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর দিকে ঝুকে বলল,
” দেখতে চাও কী করব?”
তুর্বী একটু পিছিয়ে তুতলিয়ে বলল,
” নাহ! আমি কিছুই বলিনি। আর বলবও না।”
” বেটার।”
বলে সৌহার্দ্য আবার ফোনটা হাতে নিল। তুর্বী নিজের ওপরই বিরক্ত হচ্ছে। ও এই লোকটাকে হুটহাট ভয় কেন পেয়ে যাচ্ছে? না পেয়েও তো উপায় নেই। ও এখানে একা আছে। লোকটা চাইলেই যা খুশি করতে পারে ওর সাথে। তাই একটু সাবধান হতে হবে। সৌহার্দ্য বলল,
” এই ফার্মহাউজের ছাদটা খুব সুন্দর। যাবে?”
তুর্বী চোখ ছোট ছোট করে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্যর ব্যবহারে বেশ অবাকই হচ্ছে। ও মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” বাহবা! আপনি কেমন কিডন্যাপার বলুনতো? যাকে কিডন্যাপ করেছেন তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখার বদলে ছাদের সৌন্দর্য দেখাতে চাইছেন? মতলব কী হ্যাঁ?”
সৌহার্দ্য নিজেই অবাক হয়ে গেল। ঠিকই তো! ও কেন করছে এসব? ও তো তুর্বীকে ভয় দেখিয়ে একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিল যাতে ওকে অন্তত আর বিরক্ত না করে। কিন্তু ও এসব কেন করছে, তার উত্তর ও নিজেই জানেনা। কিন্তু কেন যেন তুর্বীর উপস্থিতি সৌহার্দ্যর খুব ভালো লাগছে। সৌহার্দ গলা ঝেড়ে বলল,
” আমি তোমার মত অভদ্র নই। অন্যের সাথে ভালো ব্যবহার করতে জানি। এবার বল যাবে?”
তুর্বী কিছু একটা ভেবে বলল,
” আচ্ছা। চলুন। এখানে বসে বসে বোর হওয়ার চেয়ে বেটার।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর হাত ধরল। তুর্বী অবাক হয়ে বলল,
” আরে? কী হচ্ছে কী?”
” তোমাকে দিয়ে কোন বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে দরজা খুললেই মিলখা সিং হয়ে দৌড় লাগাবে।”
তুর্বী একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তুর্বীর হাত ধরে নিয়ে গেল ছাদে। তুর্বীও চুপচাপ গেল সৌহার্দ্যর সাথে। ও এমনিতেও পালানোর চেষ্টা করত না। কারণ ওর কেন জানি মনে হচ্ছে সৌহার্দ্য ওকে সকালবেলা এমনিই যেতে দেবে।
ছাদের একপাশে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। দুজনেই চুপচাপ আছে। তুর্বীর বারবার পাশের ব্যাক্তির মুখটা দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে তো মুখ দেখাতেই অনিচ্ছুক। নিরবতা ভেঙ্গে সৌহার্দ্য বলল,
” তোমাকে তুলে নিয়ে আসাতে তুমি তোমার বান্ধবীর চিন্তার কথা বললে। ফ্যামিলির কথা বললে না? তোমার বাবা-মা কোথায় থাকেন?”
তুর্বী খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” যেখানে আছে ভালোই আছে হয়ত।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে ফেলল। তুর্বী কথার মানে বুঝতে না পেরে ও বলল,
” মানে? তুমি জানোনা তারা কোথায়?”
” আমাকে কবে ছাড়ছেন?”
সৌহার্দ্যর কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কথাটা বলল তুর্বী। সৌহার্দ্য অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” আমাকে এভাবে জ্বালিয়ে তোমার কী লাভ সেটা বল? ডোন্ট ইউ থিংক এটা ওয়েস্ট অফ টাইম?”
তুর্বী নড়েচড়ে বসে বলল,
” একদমই না। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর কেন দেবেন না। কেমন আর.জে. আপনি হ্যাঁ?”
সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বলল,
” আমি আর.জে. ওপরওয়ালা তো নই যে সব জানবো। হ্যাঁ আমি অনেকের সমস্যার সমাধান করে দেই এটা ঠিক কথা। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমি সব জানতা। আমি কোনোদিন সেটা দাবীও করিনি। তাহলে? আর ধর যদি তুমি আমাকে সবার সামনে অপমান করে, বা এটা ওটা বলে সবার সামনে ছোট করেও দিলে। এতে তোমার কী লাভ হবে? তোমার কী সব প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে? বরং তোমার সময়গুলো নষ্ট হবে। ঠিক নয় কী? এভাবে অকারণেই নিজের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করার কী বোকামো নয়?”
তুর্বী ‘থ’ মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। সত্যিই তো! এভাবে তো ভেবে দেখে নি কখনও। তারমানে এতদিন এই S.R. এর পেছনে শুধু শুধুই সময় নষ্ট করেছে? একেবারে টোটালি লস হয়ে গেল? দূর! আগে কেন মাথায় এলোনা এসব? নিজের কাজের জন্যে নিজেরই এখন ভীষণরকম আফসোস হচ্ছে তুর্বীর। আর এদিকে সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে ভাবছে যে যাক, ওর কথাগুলো কাজে দিয়েছে হয়ত। কখনও কখনও যাকে শক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। এবার হয়ত মেয়েটাকে পিছু ছাড়াতে পারবে। এই মেয়েটার কাছ থেকে ছাড়া পাবে ভেবেই সৌহার্দ্যর বেশ শান্তি লাগছে।
______________
এদিকে বিহান এটা ওটা বলছে আর ড্রাইভ করছে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও কোন রেসপন্স না পেয়ে বিহান পাশে তাকিয়ে দেখল রিখিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। বিহান কিছু বলবে তার আগেই রিখিয়ার মাথা ঢলে পরল ওর ওপর। ও একহাতে রিখিয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে ভাবল যে এখন যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন আর খোঁজার নাটক করার দরকার নেই, বরং একটা জায়গায় গাড়ি নামিয়ে রেস্ট করা যাক। বিহান গাড়িটা একটা ব্রিজের সামনে চায়ের দোকানের পাশে রাখল। দোকানটা এখন বন্ধ। চারপাশটাও অনেকটা নিরব। বিহান নিজের সিটটা একটু এলিয়ে নিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে রিখিয়ার মাথাটা নিজের বুকে রাখল। কয়েক ঘন্টা আগে রিখিয়া ওর বুকে মাথা রাখায় যেই প্রশান্তি পেয়েছিল, সেই শান্তি আবার অনুভব করতে চায় ও। পরম তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল ও। ঘুমের ঘোরে শীতের মধ্যে একটু উষ্ণতা পেয়ে বিহানকে আকড়ে ধরে ওর বুকে গুটিয়ে গেল রিখিয়া। কিছুক্ষণ পর বিহান চোখ খুলে তাকাল। রিখিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কত পবিত্র, কতটা নিষ্পাপ লাগছে এই মুখটা? ঘুমন্ত সুন্দরী! আনমনেই একটু হাসলো বিহান। রিখিয়ার মুখের ওপর পরা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো। নিজের অজান্তেই রিখিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়েও থমকে গেল। কী করছিল কী ও? কী হচ্ছে কী ওর সাথে? না এসব অবান্তর অনুভূতি নিজের মনে জায়গা দিতে পারেনা ও। একদম পারেনা। ও তো জানে এসব মেয়েদের ছলনা, সব ছলনা। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিল ও। কিন্তু অজানা কারণেই রিখিয়াকে নিজের বুক থেকে সরালোনা।বিড়বিড় করে বলল, ” না, এভাবে দুর্বল হওয়া আমায় মানায় না। এরা ভালোবাসতে জানেনা। শুধু ছলনা করতে জানে। নিজের স্বার্থের জন্যে অন্যকারো পুরো জীবনটা নষ্ট করে দিতেও এদের বিবেকে বাঁধে না। এই মেয়েও তাই করছে, নিজের মায়ার আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। কিন্তু আমি দুর্বল হবোনা, নেভার!” বলে সিটে হেলান দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলল ও। বুকের মধ্যে তীব্র উথালপাতাল হচ্ছে। অদ্ভুতভাবে সেই তান্ডব থামাতে রিখিয়াকেই নিজের বুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বিহান।
#চলবে…
#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতোয়াল
#পর্ব- ১২
.
তুর্বী ছাদে পা ঝুলিয়ে চুপচাপ বসে আছে আর মাঝেমাঝে সৌহার্দ্যকে আড়চোখে দেখছে। আর সৌহার্দ্যও একমনে ফোন স্ক্রোল করছে। রাত সাড়ে তিনটা বাজে। ভোর হয়ে যাবে ঘন্টা দুই এর মধ্যেই। তুর্বী গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে যে সত্যিই ও এতদিন ধরে যা করছিল তার কোন মানে আছে কী না। অনেকটা সময় পর সৌহার্দ্য বলল,
” তো কী ঠিক করলে? আমাকে বিরক্ত করবে আর?”
তুর্বী দাঁত দিয়ে নখ করে কাটতে কাটতে বলল,
” একটা কথা ভাবলাম বুঝলেন?”
সৌহার্দ্য একটু হাসলো। ও জানে তুর্বী কী বলবে। তবুও গলা একটু ঝেড়ে বলল,
” কী কথা?”
তুর্বী একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
” যেহেতু আপনি একটা ইউসলেস আর.জে। আর আমার প্রবলেম সলভ আপনি করতে পারবেন না। তাই আমি ডিসাইড করেছি যে আপনার পেছনে আমি আর আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করব না। এমনিতেও আপনি কোন কাজের না। ”
সৌহার্দ্য শুধু শুনছে এই মেয়ের কথা। ওকে পুরো ইউসলেস বানিয়ে দিল! তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল,
” কিন্তু তার মানে এটা ভববেন না যে আমি আপনার ভয়ে বা আপনার কথায় এমন করছি। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই করছি। বুঝলেন?”
সৌহার্দ্য এই কথায় ঠিক কী রিয়াকশন দেবে বুঝে উঠতে পারছেনা। মেয়েটা ভাঙবে তবু মচকাবে না টাইপ। তাই চুপ করেই রইল। তুর্বী আবার বলল,
” সো, বুঝতেই পারছেন আমি ঠিক করেই নিয়েছি যে আপনাকে আর জ্বালাবো না।”
হঠাৎ করেই সৌহার্দ্যর ভেতরে কেমন একটা করে উঠল। তুর্বী ওকে আর জ্বালাবে না?
আর মেসেজ করবে না? আর কখনও তুর্বীর এসব উদ্ভট কথাবার্তা শুনতে পাবেনা? ওর চঞ্চলতা দেখতে পাবেনা? কিন্তু ও তো এটাই চাইত। এইজন্যই তো তুর্বীকে এখানে তুলে নিয়ে এসছিল ওকে আর বিরক্ত না করে সেই ব্যবস্থা করতে। কিন্তু এখন যখন তুর্বী নিজেই বলছে ওকে আর জ্বালাবে না। তখন ওর এত কষ্ট, এত খারাপলাগা তৈরী কেন হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে ও? ওর এসব ভাবনার মাঝেই তুর্বী বলল,
” কী ব্যপার? চুপ করে গেলেন কেন?”
” অব্ না মানে তো তুমি আমাকে আর মেসেজ করে, পোস্ট করে বা শো-তে কল করে জ্বালাবেনা তো?”
” উমহুম। কেন জ্বালাবো। যেহেতু কোন লাভই হবেনা।”
কথাটা শুনে সৌহার্দ্য চুপ করে রইল। ওর তো এখন খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু ও খুশি হতে পারছেনা একদমই। ওর মন খারাপ হওয়ার কারণ ওর নিজেরই অজানা। যেজন্য এতকিছু করল, জীবনে যেটা করবে বলে ভাবেওনি সেই কিডন্যাপিং ও করল তাও একটা মেয়েকে, সেটাই তো হচ্ছে। তাহলে ওর এরকম লাগার কারণ কী? তুর্বী তুরি বাজিয়ে বলল,
” হ্যালো মিস্টার? বললাম তো আর কিছু করব না। এবার তো ছাড়বেন না কী?”
সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্হির গলায় বলল,
” হুম কিন্তু সকাল হোক। তারপর যেও।”
তুর্বী আয়েশ করে পা দুটো তুলে গুটিয়ে বসে বলব,
” হ্যাঁ সকাল হলেই যাবো। এখন আমার ফোনটা দেওয়া যাবে? রিখু কে একটা ফোন করতাম মেয়েটা কী করছে কে জানে!”
সৌহার্দ্য নিজের পকেট থেকে তুর্বীর ফোনটা বের করে তুর্বীর দিকে দিল। তুর্বী ফোনটা নিয়ে সুইচড অন করে সোজা রিখিয়াকে ফোন করল। কিন্তু ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। তুর্বী অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
” ফোন তুলছেনা। এটা কী হল? কী করছে ও?”
সৌহার্দ্য স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
” দেখো হয়ত ঘুমোচ্ছে।”
” আমি বাড়িতে নেই আর ও ঘুমোবে? আর ফোনের আওয়াজে তো ওঠা উচিত?”
” আরে ওও তো একটা মানুষ। হয়ত তোমাকে নিয়ে টেনশন করতে করতে ঘুমিয়ে পরেছে। ফোন সাইলেন্ট হয়ত। তুমি একটা টেক্সট করে দাও।”
” ইয়া।”
তুর্বী রিখিয়ার ফোনে একটা মেসেজ করে দিয়ে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা হাই তুলল। সৌহার্দ্য চুপচাপ আকাশ দেখছে। তুর্বীর খুব ঘুম পাচ্ছে বেশ অনেক্ষণ যাবতই, কিন্তু সেটা সৌহার্দ্যকে বলে নি। সৌহার্দ্যও বুঝতে পারেনি কারণ ওর চোখ মুখ স্বাভাবিক ছিল। বেশ অনেকটা সময় পর তুর্বী ঢলে পরে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য দ্রুত ধরে ফেলল। ব্যাপারটায় হকচকিয়ে গেল ও, বিড়বিড় করে বলল,
” পাগল নাকি এই মেয়ে? এমন কেউ করে? ঘুম পাচ্ছে আমাকে বললে কী হত? এক্ষুনি তো ছাদ থেকে পরত।”
তুর্বীকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রেখে কিছু একটা ভাবল সৌহার্দ্য। কিছুক্ষণ ভেবে তুর্বীর মাথাটা নিজের কোলের ওপর রেখে দিলো। তুর্বী সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। তুর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হেসে ফেলল সৌহার্দ্য। এই ঘুমন্ত দেখলে কে বলবে এই মেয়ে এত ছটফটে, এত চঞ্চল। আচ্ছা? কাল অবধি মেয়েটার ওপর ও বিরক্ত ছিল, খুব বেশিই বিরক্ত ছিল। কিন্তু আজকের এই রাতটাতে কী এমন করল ওই মেয়ে যে কাল থেকে ওর সংস্পর্শে থাকতে পারবেনা বলে ওর এত ফাঁকা লাগছে। এর উত্তর কী আদোও খুঁজে পাবে সৌহার্দ্য।
_______________
চোখে আলো অনুভব করে বিহানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভ্রু কুচকে উঠতে যাবে তখনই নিজের বুকের ওপর ভারী কিছু অনুভব করল। চোখ খুলে তাকিয়ে নিজের বুকের ওপর রিখিয়াকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চমকে গেছিল। পরে আস্তে আস্তে কাল রাতের কথা মনে পরতে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল ও। এই মেয়ে যখন জানবে অন্য একটা ছেলের বুকে এতক্ষণ লেপটে শুয়ে ছিলো তখন লজ্জায় মাথাই তুলতে পারবেনা। এসব ভাবতে ভাবতেই রিখিয়ারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ আস্তে আস্তে খুলে হাত দিয়ে চোখ কচলে নিল। হঠাৎ ওর মাথায় নাড়া দিয়ে উঠল যে ও কোথায় শুয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মাথা তুলে বিহানকে দেখে চমকে উঠল। একপ্রকার ছিটকে দূরে সরে গেল। অবাক হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল ও। সবটা বুঝতে পারলেও বিহানের এত কাছে কীকরে গেল সেটা বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ করেই কিছু একটা ভেবে তাড়াতাড়ি নিজের দিকে তাকিয়ে চেক করে নিল। পোশাক, ওড়না সব ঠিক আছে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। এরপর বিহানের দিকে তাকিয়ে দেখে বিহান হাত ভাজ করে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রিখিয়ার একটা ঢোক গিলল। বিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ভ্রু নাচালো। রিখিয়া ইতস্তত করে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। বিহান বলল,
” রক্ষক হয়ে সারারাত তোমাকে পাহারা দিলাম আমি। সকালে উঠে তুমি আমাকেই ভক্ষক ভাবছ? কেসটা কী হল?”
রিখিয়া একটু লজ্জা পেল। ও সত্যিই ভয় পেয়েছিল নিজেকে বিহানের এতো কাছে দেখে। আজকাল আপন কারো ওপরই বিশ্বাস রাখা যায় না। সেখানে বিহান তো ওর চেনা কেউ না। তাই বিহান ওর ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিতে পারে সেটা ভাবা অন্যায় কিছু না। রিখিয়া আরো একবার নিজের দিকে তাকাল। বিহান শক্ত স্হির কন্ঠে বলল,
” সব ঠিক আছে দেখে খারাপ লাগছে? একটু এলোমেলো থাকলে কান্নাকাটি আর মেলোড্রামা করে আমায় ফাঁসানো যেত তাইনা?”
রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” মানে?”
বিহানের হুস এল ও কী বলছে। না, এখন এসব বললে তো হবেনা। ও নিজেকে সামলে মুচকি হেসে বলল,
” আরে মজা করছিলাম আমি।”
” ওহ। না ম্ মানে আমি আপনার বুকে..”
বিহান শব্দ করে হেসে বলল,
” এইজন্য মুখের এই দশা? আসলে শেষরাতে ঘুমানোর আগে তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমালাম যাতে তোমাকে কেউ কিডন্যাপ করতে না পারে। বুঝলে?”
বলে বিহান আবার হেসে দিল। রিখিয়া কিছুক্ষণ অদ্ভুতভাবে বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও হেসে দিল। হঠাৎ তুর্বীর কথা মনে পরতেই ও তাড়াতাড়ি ফোন বের করল। দেখল যে তুর্বীর বেশ কয়েকটা মিসড কল, আর ওর ফোন সাইলেন্ট হয়ে আছে। নিউ মেসেজ দেখে সেটা চেক করে দেখল তুর্বী জানিয়েছে ও ঠিক আছে। রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুর ফোন করেছিল। মেসেজে জানিয়েছে ও ঠিক আছে।”
বিহান বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘ বাপড়ে একরাতেই মেয়েটাকে সোজা করে দিল? ব্রো তো আমার চেয়েও ফাস্ট!” রিখিয়া বিহানকে হালকা ধাক্কা মেরে বলল,
” আপনি শুনছেন আমি কী বলছি?”
” অব্ হ্যাঁ তুমি কল কর এখন। সকাল হয়ে গেছে তো।”
রিখিয়া মাথা ঝাকিয়ে তাড়াতাড়ি তুর্বীকে ফোন করল।
এদিকে ফোনের আওয়াজে হুস এলো সৌহার্দ্যর। কখন সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। তুর্বীর ঘুমন্ত মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল ও। কী হয়েছে ওর নিজেই জানেনা। শুধু জানে অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে। ভীষণ অদ্ভুত কিছু। সৌহার্দ্য ফোন তুলে দেখে ‘রিখু’ নামে সেভ করা কারো ফোন। ও বুঝতে পারল এটা রিখিয়া। ও তুর্বীকে ডাকবে তার আগেই তুর্বী ভ্রু কুচকে বিরক্তিমিশ্রিত কন্ঠে বলল,
” রিখু ইয়ার এলার্ম টা অফ কর না। কান ফেটে যাচ্ছে।”
বলে উল্টোদিকে ঘুরে সৌহার্দ্যর কোল হাতে জড়িয়ে ধরল। সৌহার্দ্য মুখে আবারও হাসি ফুটল। পাশে রাখা মাস্ক টা আবার মুখে পরে নিয়ে ও এবার আলতো কন্ঠে ডাকল,
” তুর্বী? তুর্বী?”
তুর্বী ঘুম কন্ঠে বলল,
” হুমম।”
সৌহার্দ্য বুঝল এই মেয়েকে এভাবে ডেকে কোন লাভ হবে না। তাই এবার একটু জোরেই ডাকল। তুর্বী হকচকিয়ে উঠে বসে বলল,
” ক-কে? কী? কোথায়? কী হয়েছে?”
” রিখিয়ার ফোন এসছে। ধরো।”
সৌহার্দ্যকে দেখে তুর্বী অবাক কন্ঠে বলল,
” এই কালা মাস্ক আবার কে? এই কে আপনি?”
সৌহার্দ্য তো আকাশ থেকে পরল। এই মেয়ে ঠিক কী পদার্থ দিয়ে তৈরী সেটাই বুঝতে পারছেনা সৌহার্দ্য। তুর্বীর এবার আস্তে আস্তে সবটা মনে পরল। ও ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” ওহ আপনি? সরি ভুলে গেছিলাম।”
সৌহার্দ্য কিছু না বলে তুর্বীর হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। দেখল রিখিয়া কল করেই যাচ্ছে। তুর্বী রিসিভ করে বলল,
” হ্যাঁ বল।”
” বল মানে? কোথায় তুমি? এরকম কেউ করে? জানো কত টেনশনে ছিলাম? হাউ ক্যান ইউ বি সো কেয়ারলেস তুর!”
” আরে ইয়ার আগে শ্বাস নে, লম্বা করে। তারপর আবার কনটিনিউ কর।”
” শাট আপ। কোথায় আছ?”
“আমি তো.. আছি, ঠিক আছি। এসে বলছি। তুই কোথায়?”
” আমিও এসেই বলছি সব। তাড়াতাড়ি এসো।”
এতক্ষণ বিহান হাত ভাজ করে সিটে হেলান দিয়ে দেখছিল রিখিয়াকে। ফোন রেখে রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” থ্যাংকস আমাকে হেল্প করার জন্যে। তুর ঠিক আছে আসছে বাড়িতে। আমি তাহলে আসি হ্যাঁ?”
বিহান মাথা দুলিয়ে বলল,
” নো। আগে এখন ব্রেকফাস্ট করব। আমার সকাল সকাল খাওয়ার অভ্যাস। আর আমার একা খেতে একদমই ভালো লাগেনা। সো আগে ব্রেকফাস্ট করব। এরপর তোমাকে তোমার বাড়িতে ড্রপ করে দেব।”
রিখিয়া ইতস্তত করে বলল,
” কিন্তু…”
” নো মোর কিন্তু, চলো।”
বলে গাড়ি স্টার্ট করল। রিখিয়াও আর কিছুই বলল না। এরপর দুজনেই একসাথে ব্রেকফাস্ট করার পর। বিহান রিখিয়ার বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘোরালো। রিখিয়ার বাসার সামনে গাড়ি থামতেই রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কাল রাত থেকে অনেক সাহায্য করেছেন। ধন্যবাদ।”
রিখায়া গাড়ি থেকে নামতে গেলেই বিহান বলল,
” ওয়েট, ওয়েট! শুকনো থ্যাংকস আমি নেব না।”
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
” মানে?”
” মানে, গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচালাম। সারারাত তোমাকে পাহারা দিলাম। তোমার বন্ধুকে খুঁজতে সাহায্য করলাম তার বদলে আমি তো কিছু পাই নাকি?”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” কী চাই আপনার?”
” একদিন কফি খাই একসাথে? এটা জাস্ট আমার অফার। বাকিটা তোমার হাতে।”
রিখিয়া কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে বলল,
” ভেবে দেখব।”
বিহান ঠোঁট কামড়ে হেসে পকেট থেকে ওর কার্ড বের করে দিয়ে বলল,
” এটা আমার কার্ড। যদি মনে হয় যে আমার সাথে কফি খাওয়া যায় তো কল করো।”
রিখিয়া কার্ডটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল। ওর মুখে যে মুচকি হাসি ফুটে উঠেছে সেটা রিখিয়া নিজেও জানেনা। বিহান রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। ও জানে রিখিয়া ফোন করবে, আর আসবেও। আসতেতো ওকে হবেই।
_________________
তুর্বী বেডে পা ঝুলিয়ে বসে কফি খাচ্ছে। একটু আগেই ব্রেকফাস্ট করেছে। সৌহার্দ্য অফার করার আগেই তুর্বী খাবার চেয়ে নিয়েছে। যাতে সৌহার্দ্য একটুও অবাক হয়নি। এই মেয়েকে দেখে অবাক হতে হতে এখন আর অবাক হতে পারছেনা ও। শুধু দেখে যাচ্ছে। কফি শেষ করে তুর্বী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” তো মিস্টার S.R. যাই এখন?”
সৌহার্দ্য বলল,
” আমার ড্রাইভার দিয়ে আসবে বাড়ি অবধি গাড়ি করে।”
” ওকে চলুন। দেখিয়ে দিন কোন গাড়িতে যাবো, কাদের সাথে যাবো।”
বলে হাটা দিল, সৌহার্দ্যও ওর পেছন পেছন গেল। ড্রাইভারকে বলে দেওয়ার পর তুর্বী গাড়িতে উঠতে নিয়েও থেমে গেল। পেছন ঘুরে বলল,
” চলেই তো যাচ্ছি মুখটা দেখান না?”
সৌহার্দ্য একটু এগিয়ে বলল,
” এর পরের বার যখন দেখা হবে। দেখাব। প্রমিস!”
” হুরর। আর দেখা হলেও কী চিনব? যাই হোক বাই!”
সৌহার্দ্য কিছু বলল না। তুর্বী গাড়িতে ওঠার পর সৌহার্দ্য ড্রাইভারকে বলতেই সে গাড়ি স্টার্ট করল। তুর্বী মাথা বের করে আরেকবার বাই বলল। সৌহার্দ্য এবারও রেসপন্স করল না। গাড়িটা চলে যেতেই ছোট্ট শ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। চলে গেল মেয়েটা! আবার কখনও দেখা হবে? আবার তুর্বীর এই চঞ্চলতা দেখতে পারবে? কী জানি? ভাগ্যে কী আছে কেউ জানেনা। দেখা যাক নিয়তি তার চাকা কোনদিকে ঘোরায়।
#চলবে…
[ S.R-তুর্বীর কাহিনী তো শেষ হল। এবার দেখা যাক সৌহার্দ্য-তুর্বীর কাহিনী কী হয়? 😉
আর বিহান-রিখিয়াকে নিয়ে আপাতত কিছু না বলাই শ্রেয়। 😑]