তুমি হাতটা শুধু ধরো – পর্ব ৩৩

0
487

#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো
#পর্বঃ৩৩(বোনাস)
#Jhorna_Islam

রুশের কাছে দায়ানের অতীত শুনে সোহা নিরবে অশ্রু বিস’র্জন দিয়ে চলেছে।হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কথাগুলো শুনেই ভিতরটা কষ্টের দা’বানলে ধাউ ধাউ করে পুরছে। আর দায়ান সেতো সব সহ্য করেছে।

রুশ সোহার দিকে তাকিয়ে কিছু বলেনা।কাদছে যখন কাদুক।রুশের চোখ দিয়েও পানি পরছে।অনেক চেষ্টা করছে আঁটকে রাখার জন্য তাও বে’হা’য়া অশ্রু বেরিয়েই আসছে চোখের কোণ বেয়ে।

নাক ছিচ’কে রুশ আবার বলতে শুরু করে,,,,, দায়ান তখন নিজের বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দা’য়ী করে চলেছে।সে কি পা’গ’লামি। কোনো ভাবেই দায়ানকে শান্ত করতে পারছিলাম না।

ঢাকায় দায়ানদের কোনো আত্নীয় স্বজন নেই।ওর নানা বাড়ির কেউ ছিলো না।দায়ানের নানা নানির একটা মাত্র মেয়েছিলো আন্টি। তারাও অনেক বছর আগেই মারা যান। তাই দায়ানের নানা বাড়ির কোনো লোক ছিলো না।

আপন বলতে দায়ানের একটা চাচাই ছিলো।আমি আর চাচা মিলে দায়ানকে কোনো ভাবেই সামলাতে পারছিলাম না।ও বার বার সু’ইসা’ইড করার চেষ্টা করতে ছিলো।নিজেকে ওনাদের খু/নী ভেবে।

আমি আর চাচা অনেক বুঝালাম।তোকে কি ম’রার জন্য ওনারা নিজে ম’রে বাঁচিয়ে রেখে গেছে? নিজেকে সামলা শ’ক্ত হো। কি বলে গেছে আংকেল আন্টি,,, বলেছে নিজের খেয়াল রাখতি।ভালো থাকতি।আর তুই ম’রতে চাস?

দায়ান তখন শান্ত হয়ে গিয়েছিলো। হয়তো মাথা থেকে সু’ই’সাইড এর ভূ’ত টা নেমেছে।তবে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো।

আর সারাক্ষণ বির বির করতো,,আমার কেউ রইলো না রে,,পৃথিবীতে আমার কেউ রইলোনা আমি একা হয়ে গেলাম।আপন বলতে কেউ নাই।খাওয়া,ঘুম বাদ দিয়ে এসবই বলতো সারাক্ষণ।

দায়ানের জন্য খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম।এভাবে চলতে থাকলে ছেলেটা আর এমনিতেই বাঁচবে না।

পরোক্ষনেই আমার তিশার কথা মাথায় আসলো।হয়তো মেয়েটা দায়ানকে একটু স্বাভাবিক করতে পারবে।তিশাকে ফোন লাগালাম।সব খুলে বললাম।ভেবেছিলাম দায়ানের ব্যাপারে তিশা যানে না। পরে দেখি সবই নাকি জানে।খুবই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম শুনে।তাও এতো দুশ্চিন্তার মধ্যে মাথায় নিলাম না ব্যাপারটা।

বললাম দায়ানের বাড়ি আসতে। মুখে মুখে না করে দিলো আসতে পারবেনা।

বললাম দায়ানের অবস্থা ভালো না।এমন চলতে থাকলে বাঁচানো যাবে না। তাও নানান বাহানা দিতে থাকলো।

অনেক অনুরোধ করে বোঝানোর পর রাজি হলো আসতে।
আমি বুঝতেই পারিনি তিশা কে আনা যে আমার কতোটা ভুল হয়ে গেছে। ভালো করতে গিয়ে আরো খারাপ করে দিলাম।তিশা এ বাড়িতে আসলো তো ঠিকই।তবে দায়ানকে সাপোর্ট দিতে না।একে বারে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে।

দায়ান তিশাকে দেখে হয়তো একটু ভরসা পেয়েছিলো।ভেবেছিলো মেয়েটা তো তাকে পা’গলের মতো ভালোবাসে।এখন তিশাই তার স’ম্বল।

কিন্ত তিশা দায়ানকে আর আমাকে ভু’ল প্রমান করে,,,যা নয় তাই বলতে থাকলো।আমি অনেক বাঁধা দিয়েও আটকাতে পারিনি।

দায়ানের মতো একটা এ’তিম লোকের সাথে নাকি সে থাকবেনা।বাবা মা মেনে নেবে না।দায়ান নাকি এখন সংসারের কিছুই বুঝবেনা।বুঝবে কি করে এখন তো তার কেউ নেই।সে একটা এ’তিম ছেলের সাথে কিছুতেই থাকবেনা।এখন তো ভবিষ্যতের ও ঠিক নেই দায়ানের।বিজনেসম্যান রসা’তলে যাবে।আরো নানান কথা বলে দায়ানকে ক্ষত বিক্ষত করেছে।

শে’ষে দায়ান সহ্য করতে না পেরে তিশাকে থা’প্পড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

নিজে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।যাওয়ার আগে আমাকে বলে যায় যেনো ডাকাডাকি না করি।নিজের নাকি কোনো ক্ষতি করবে না।আমি সব কিছু নিরব দর্শক হয়ে শুধু দেখছিলাম।

কোথাও না কোথাও নিজেকেই দোষী মনে হতো।আমিই জোর করেছিলাম দায়ান কে রিলেশনে জড়াতে।আমিই তিশা কে এখানে আসতে বলেছিলাম।

তারপর দুইদিন দায়ান রুমে বন্দি ছিলো।দুই দিন পর আশ্চর্য জনক ভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায়। হয়তো এই দুইদিন নিজেকে সময় নিয়ে বুঝিয়ে ছে।পৃথিবীতে একলাই বাস করতে হবে।নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে নেই কারো কাছে।নিজের ভিতরেই দুঃখ গুলোকে মাটি চাপা দিয়েছে। মন খুলে কাদার জন্য একটা আশ্রয় বা কোল পায়নি আমার ভাইটা। আমি ওর সাথে চোখ মেলাতে পারতাম না নিজেকে অপরাধী মনে হতো।

দায়ান হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো।আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো,,,তুই নিজেকে দোষী ভাবিস না ভাই।আমি তর উপর একটুও রে’গে নেই।দায়ানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়েছিলাম।কিন্তু সে নির্বাক।এক ফোটা পানিও বের হয়নি চোখ থেকে।

সেই থেকে হাসতে ভুলে গেছে। নিজের যত্ন নিতে ভুলে গেছে।বাঁচার মতো বাঁচতে ভুলে গেছে। কেমন যেনো হয়ে গেছে। রা’গী হয়ে গেছে।

চুপ করো ভাইয়া চুপ করো।আমি আর নিতে পারছি না ভাইয়া।বলেই কান চেপে কাঁদতে থাকে। আমি পারছি না নিতে।

রুশ সোহাকে কিছু সময় দেয় নিজেকে সামলে নিতে।

তারপর বলে,,,,আমি এতো বছর পর ঐদিন দায়ানকে হাসতে দেখলাম।তাও প্রান খুলে হাসতে।সেটা তোর জন্য সম্ভব হয়েছে বোন।তুই পেরেছিস আমার বন্ধু কে হাসাতে।

ঐদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম একমাত্র তুইই পারবি ওরে,,আগের মতো হাসাতে।ভালোভাবে বাচতে শিখাতে।

সোহা মুখ তুলে রুশের দিকে তাকায়। রুশ চোখের ইশারায় বোঝায় হ্যা।

তোর জন্য দায়ানের চোখে যে ভালোবাসা দেখেছি। সেটা আমি তিশার জন্য ছিটেফোঁটা ও দায়ানের চোখে দেখিনি।ঐদিন তোকে না পেয়ে প্রায় কেঁদেই দিতে ছিলো বেচা’রা।

বন্ধু টা আমার ভালোবাসার কা’ঙাল বোন।তুই একটু ভালোবাসা দে,দেখবি সুখ তর পায়ের কাছে এনে হা’জির করবে।তুই ধোঁকা দিয়ে দূরে চলে যাস না।তাহলে হয়তো আমার বন্ধু টা আর বাচবেই না রে।

সোহা এবার বলে উঠে,,,, এসব কথা আর একদম বলবানা রুশ ভাইয়া। আমি ওনাকে অনেক ভালোবাসি।অনেক কষ্ট পেয়েছেন উনি।আর না এবার উনি প্রাণ খুলে বাঁচবেন। আমি উনার পাশে সবসময় থাকবো।কখনো ছাড়বোনা উনাকে।

রুশ এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,,আমি এবার আসি।আমার কাজ শেষ। এবার তর বরটাকে তুই সামলে নে।

বলেই রুশ বিদায় নিয়ে চলে যায়। সোহা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে। দায়ানের এতো কষ্ট ছিলো।ভাবতেই বুক ফেটে আর্তনাদ বের হয়।

———————————————-

সারাদিন সোহা রুমেই কেঁদে কেটে পার করে দেয়।রুম থেকে নিজেও বের হয় নি।কতো ভাবনা চিন্তা করেছে,,,সে নিজেও জানে না।

খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। দুজনের মধ্যে কেউই রুম থেকে বের হয়নি।আর খাওয়া ও হয়নি।

এখনো সোহা বসে হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।

ঘড়ির কাটা যখন ঢংঢং করে রাত আটটার জানান দেয়।তখন সোহার ধ্যান ভাঙে।উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে। লোকটাকে যে করেই হোক খাওয়াতে হবে। নয়তো অসুস্থ হয়ে পরবে। বু’কে ব্যাথা করবে।ভাবতে ভাবতে সোহা রান্না ঘরে গিয়ে ঝটপট খাবার তৈরি করে। প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে দায়ানের রুমের দিকে যেতে থাকে।

রুমের পাশে এসে অনেক সাহস যোগিয়ে দরজায় টোকা দওয়ার জন্য হাত দেয়।টোকা দেওয়ার আগেই বুঝতে পারে,,,দরজাটা খুলাই আছে ভিড়ানো।

আস্তে করে ঘরের ভিতর ঢুকে টেবিলের উপর খাবার রাখে।

ঘরটাতে তেমন আলো নেই বারান্দা দিয়ে বাইরে থেকে ল্যাম্প পোস্টের আবছা আলো আসছে। দায়ান খাটের সাইডে বসে হাঁটুর উপর কুনুই ঠেকিয়ে,,হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে।

সোহা আস্তে করে দায়ানের পাশে দাঁড়ায়। দায়ানের কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও বারবার সরিয়ে নেয়।কেমন জড়তা কাজ করছে। এক পর্যায়ে সাহস যোগাতে না পেরে চলে আসতে পা বাড়ায়।

ঠিক তখনই পিছন থেকে সোহার হাতটা আকড়ে ধরে দায়ান।সোহা কিছুটা কেঁপে ওঠে। পিছনে ঘুরে দায়ানের দিকে তাকায়।

দায়ান ততক্ষণে সোহাকে কাছে টেনে নিয়ে আসে।পা’গলি আমার না এখানে অনেক কষ্ট হচ্ছে গো।বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে।বলেই সোহার কোমড়ে দুই হাত পেচিয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।

পা’গলি আমার সাথে কেনো এমন হলো? কি দোষ ছিলো আমার।কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো বাবা মা? আমাকে কেনো তাদের সাথে নিলো না।বলো না? আমার তো কেউ নেই গো।আমি একা বড্ড একা। আমার সব শেষ। বলেই কাদতে লাগে।

সোহা দায়ানের মাথাটা নিজের বুকের সাথে ঝাপটে ধরে রাখে।একটু কাঁদুক কেঁদে হালকা হোক। মনের ভিতরের চাপা কষ্ট টা দূর করুক। এতোদিন হয়তো এরকম একটা ভরসার কাউকে খুজতে ছিলো নিজের কষ্ট দূর করার জন্য। সোহা ও নিরবে কাঁদতে লাগলো।

প্রায় অনেকক্ষন হয়ে গেলো দায়ান একই ভাবে কেঁদে চলেছে।থামাথামির নাম নেই। আর এক কথা বারবার বলে চলেছে,,আমার কেউ নেই।আমি বড্ড একা।

আর কাঁদে না গো।মাথা ব্যাথা করবে।কে বলেছে আপনার কেউ নাই? আমি আছি না? আমিকি আপনার কেউ হইনা? আমি সব সময় আপনার সাথে আছি।কখনো ছেড়ে যাবো না।আমাদের ও পরিবার হবে। সব হবে। আমরা অনেকগুলা বেবি নিবো।বেবি দিয়ে বাড়ি ভরে ফেলবো ওকে?

দায়ান এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সোহা বলে আমার কিন্তু কষ্ট হচ্ছে।

সোহার কষ্ট হচ্ছে শুনে দায়ান নিজের কান্না থামিয়ে দেয়। মুখ তুলে সোহার দিকে তাকায়।
সোহা মুচকি হেসে দায়ানের মুখ মুছে দেয় ওড়না দিয়ে। তারপর কপালে একটা চুমু খায়।

আজকেই প্রথম আর আজকেই শে’ষ। আর যেনো কাদতে না দেখি ঠিক আছে? হাত মুখ ধুয়ে আসেন খাবেন।
দায়ান প্রথমে খেতে চায়নি সোহা জোর করে দায়ানকে খাইয়ে দেয়।এক প্লেট থেকে নিজেও খেয়ে নেয়।
সোহা হাত ধুয়ে দায়ানের মুখটা মুছিয়ে দিয়ে,,রান্না ঘরে প্লেট রেখে আসে।

দায়ানকে শুয়ে পরতে বলে,,হাটা দেয়।দায়ান সোহাকে আঁটকে দেয়।

আজ যেওনা প্লিজ।
সোহা দায়ানের কথাতে পাত্তা না দিয়ে,,ঘুরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে। দায়ান এখনো বসে থেকে সোহাকে দেখছে।

সোহা শুয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দায়ানকে চোখের ইশারায় কাছে আসতে বলে।দায়ান সোহার ইশারা পেয়ে এক মূহুর্ত ও দেরি করে না।সোহার বুকে ঝাঁপিয়ে পরতে।

‘”জান আজ যদি আমি একটু অবাধ্য হই তুমি কি রা’গ করবা?”

সোহা কোনো কথা না বলে,,,দায়ানকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে।
আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে।আজ থেকে আপনাকে আমি নিজের প্রান থাকতে কখনো ছেড়ে যাবো না।সুখে দুঃখে সব সময় আমায় পাশে পাবেন।

#চলবে,,,,,

বিঃদ্রঃ আজ কিন্তু দুই লাইন হলেও আপনাদের থেকে সুন্দর ম’ন্তব্য আশা করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here