#ভালোবাসার_অনুভূতি
#লেখিকাঃ_আরভি_আহিয়াদ_তিহু
#পর্বঃ57
সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করার পর ইয়ং যারা আছে তারা সবাই ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।বাড়ির বড়রা সবাই নিজেদের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেছে।
মেঘ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নিচে নামলো।কাজ করে অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে তাই ওর উঠতে একটু দেরি হয়ে গেলো।মেঘ নিচে নেমে দেখলো ড্রইংরুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে।’ও’ সবাইকে দেখেও,না দেখার ভান করে ডাইনিংয়ের দিকে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই সাঈফা এসে মেঘকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে জোড় করে সোফায় বসিয়ে দিলো।তারপর নিজেও মেঘের পাশে ধপ করে বসে পড়লো।মেঘ মুখ তুলে একবার সবার দিকে তাকালো।দেখলো আহান ওকে দেখে মুখটা কালো করে বসে আছে।আর আহির মিহির মুখটা পেচার মতো করে রেখেছে।ওদের দেখে মনে হচ্ছে কেউ ওদের করলার জুস খাইয়ে দিয়েছে।মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে দাড়িয়ে বললো
“সাঈফু আমার খুব খিদে পেয়েছে।ব্রেকফাষ্ট টা করে আসি তারপর তোদের সাথে আড্ডা দেবো।”
মেঘের কথা শেষ হতেই সাঈফা আবার ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বললো
“আপি প্লিজ যেওনা।এতো গুলো দিন পর তোমাকে দেখলাম।কতো কথা জমে আছে জানো?সেগুলো সব আজকে বলবো।”
মেঘ একটু ইতস্তত করে বললো
“আচ্ছা আপাততো আমি যাচ্ছি।পরে নাহয় তোদের সব কথা শুনবো।”
মেঘের কথা শুনে সাড়িকা অভিমানি কন্ঠে বললো
“আপি তুমি আমাদের আর আগের মতো ভালোবাসো না তাইনা?”
মেঘ মৃদ্যু হেসে বললো
“কে বলেছে আমি তোদের ভালোবাসি না।আমি তো তোদের নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।”
সাড়িকা তাছিল্য হেসে বললো
“হ্যা সেই জন্যই তো লাষ্ট দুই বছরে একটা বারও আমাদের খোজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করোনি।নিজের সিম কার্ড টা অবদি চেইঞ্জ করে ফেলেছো।”
সাড়িকার কথা শুনে মেঘ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহান পিঞ্চ করে বললো
“আরে সাড়িকা বুঝতে পারছিস না উনি ওনার নিউ হাসবেন্ট কে পেয়ে বাকি সবাইকে ভুলে গেছে।ওনাকে এখন এসব বলে লাভ নেই।কিছু কিছু সার্থপর মানুষ থাকে যাদের লাইফে নতুন কেউ আসলে তারা পুরনো মানুষ গুলোকে ভুলে যায়।”
আহানের কথা শুনে মেঘের বুকটা ভার হয়ে আসলো।কিন্তু বাকিরা সবাই আহানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।সাঈফা অবাক কন্ঠে আহানকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“ভাইয়া কি বলছো এসব?আপির নিউ হাসবেন্ট মানে?”
সাঈফাকে এমন অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করতে দেখে আহান ভ্রু কুচকে বললো
“নিউ হাসবেন্ট মানে যার সাথে ওনার বিয়ে হয়েছে তার কথা বলছি।”
আহানের কথা শুনে সবাই বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সাড়িকা অসহায় কন্ঠে বললো
“কি সব বলছো ভাইয়া?তোমার মাথা ঠিক আছে?”
আহান বিরক্তির স্বরে বললো
“আজব তোরা সবাই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?মেঘনা যার সাথে এখন থাকে আমি তার কথা বলছি।”
সাঈফা মুখ বাকিয়ে বললো
“আপি কারো সাথে থাকতে যাবে কোন দুঃখে?আপি তো একাই একটা ফ্লাটে থাকে।”
সাঈফার কথা শুনে আহান অবাক কন্ঠে মৃদ্যু চিল্লিয়ে বললো
“হোয়াট?একা একটা ফ্লাটে থাকে মানে?ওর হাসবেন্ট তাহলে কোথায় থাকে?”
আহানের কথাটা শেষ হতেই হিয়ান ধমক দিয়ে বললো
“কি তখন থেকে হাসবেন্ট হাসবেন্ট করে যাচ্ছিস?মেঘের হাসবেন্ট আসবে কোথা থেকে?’ও’ তো দুই বছর ধরে একাই একটা ফ্লাটে থাকে।”
হিয়ানের কথা শুনে আহানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।কি হচ্ছে এসব ‘ও’ কিছুই বুঝতে পারছে না।সব কিছু ওর মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।মেঘ এখনো বিয়ে করেনি তাহলে ওকে ছেড়ে ছিলো কেনো?আর কালকে রাতেই বা কেনো বলেছিলো ওর হাসবেন্ট অপছন্দ করে এমন কোনো কাজ ‘ও’ একদম করতে চায় না।কথাটা ভাবতে ভাবতে আহান মেঘের দিকে তাকালো।দেখলো মেঘ বসা থেকে উঠে উপরে চলে যাচ্ছে।আহান মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো
“তোমাকে আমি ছাড়বো না মেঘ।আমাকে মিথ্যা বলার ফল তুমি হারে হারে টের পাবে।একবার সব সত্যিটা জানতে পারি তারপর দেখবে আমি তোমার কি অবস্থা করি।”
___________________________
ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে মেঘ।ওর চোখ থেকে অঝর ধারায় পানি পড়ে যাচ্ছে।এতো গুলো কাছের মানুষ থাকতেও ওর কষ্ট টা দেখার মতো কেউ নেই।বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে আর বলতে শেষ বারের মতো তোমরা আমাকে একটু আদর করে দাও।হয়তো কখনো তোমাদের কারো সাথে আর আমার দেখা হবে না।কিন্তু ‘ও’ চাইলেও এখন কাউকে কিচ্ছু বলতে পারবে না।কারন তাহলে ওর এতো দিনের কষ্ট সব বিফলে চলে যাবে।হঠাৎ পিছন থেকে মেঘের কাধে কেউ হাত রাখলো।মেঘ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে দেখলো হিয়ান দাড়িয়ে আছে।হিয়ান কে দেখে মেঘ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেদে দিলো।কাদতে কাদতে বললো
“আমার সাথে এসব কেনো হলো ভাইয়া?আমি তো কখনো কারো ক্ষতি করিনি তাহলে আল্লাহ কেনো আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন।”
হিয়ান সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে।মেঘের প্রশ্নের অ্যান্সার তো ওর নিজেরও জানা নেই।হিয়ানের চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানিয়ে গরিয়ে পড়লো।আর চোখের সামনে ভাষতে লাগলো দুই বছর আগের কথা।
___________ফ্লাসব্যাক_________
আহান যেদিন আবির আর জেড়িন কে পুলিশে দিয়ে এসে সবটা ক্লিয়ার করে বলেছিলো।আবির আর জেড়িনের পরিবার সেদিনই সিলেট ফিরে গিয়ে ছিলেন।যাওয়ার আগে ওনারা আহানদের সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমাও চেয়েছেন।
সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।দুই সপ্তাহের মধ্যে মেঘ আর সাঈফা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠে।মোনা খান আর মিড়া রহমানের ট্রিট মেন্টেই ওরা সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো।তাই ওদের আলাদা করে আর হসপিটালে নিয়ে গিয়ে কোনো টেষ্ট করানো হয়নি।
সাঈফা যতোদিন অসুস্থ ছিলো মিহির ওর অনেক কেয়ার করেছে।সাঈফা কথা না শুনলে কখনো কখনো সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে কথা শুনিয়েছে।আবার কখনো বকে ধমক দিয়ে কথা শুনিয়েছে।মিহিরের কেয়ারিং দেখে ওর প্রতি সাঈফার যে রাগ ছিলো সেটা আস্তে আস্তে কমে গেছে।
আর আহান সে তো মেঘ যতোদিন অসুস্থ ছিলো ততোদিন তার অন্য দিকে কোনো খেয়ালই ছিলো না।সব কিছু ভুলে গিয়ে সারাদিন শুধু মেঘের দেখা শোনা করেছে।মেঘকে খাবার খাওয়ানো থেকে শুরু করে ঔষধ খাওয়ানো পর্যন্ত সব কিছু আহান একা হাতে করেছে।বাকিরা মেঘের কেয়ার করবে কি আহানের কান্ড দেখেই হেসে গড়াগড়ি খেতো।কারন আহান মেঘকে এমন ভাবে ট্রিট করতো যেনো মেঘ ছয় মাসের ছোট একটা বাচ্চা।
প্রায় দুই সপ্তাহ পর মেঘ সুস্থ হয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসে।বাড়িতে আসার পর দুই দিন সব কিছু নরমাল ছিলো।কিন্তু তারপর থেকে হঠাৎ করেই মেঘের মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হতে থাকে।মাঝে মাঝে আচৎমকা ব্যাথ্যা শুরু হতো আবার এমনি এমনি কমেও যেতো।মেঘ ভেবেছিলো হয়তো মাথায় আঘাত লাগার কারনে এমন টা হচ্ছে তাই ‘ও’ ব্যাপ্যারটা তেমন একটা পাএা দেয়নি।এভাবে কেটে গেলো আরো পনেরো দিন।এর মধ্যে মেঘের অনেক বার মাথা ব্যাথ্যা উঠেছে।কিন্তু সবাই টেনশন করবে তাই ‘ও’ কাউকে কিচ্ছু বলেনি।আহান রোজ ওকে দশ পনেরো বার করে ফোন দিতো।’ও’ ঠিকঠাক মতো খাবার খেয়েছে কিনা,ঔষধ খেয়েছে কিনা,ঘুমিয়েছে কিনা সেই সব খোজ নিতো।
দীর্ঘ এক মাস পর মেঘ আজকে ভার্ষিটি তে আসলো।প্রথম দুটি ক্লাস করে মেঘ,দিশা,রিজা অফ পিরিয়ডে ক্যান্টিনে চলে আসলো।সেখানে কিছুক্ষন থাকার পর মেঘের মাথায় আবার যন্ত্রণা না শুরু হয়।তবে এই বার আগের থেকেও আরো বেশি করে ব্যাথ্যা শুধু হয়ে গিয়েছিলো।মেঘ ব্যাথ্যা সহ্য করতে না পেরে মাথা চেপে ধরে ফুপিয়ে কেদে দেয়।মেঘকে এভাবে কাদতে দেখে দিশা আর রিজা মিলে ওকে ধরে ভার্ষিটির পাশের একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে আসে।সেখানে আসার পর ডাক্তার মেঘের প্রভলেম গুলো শুনে ওকে কিছু টেষ্ট করতে বলে।মেঘ টেষ্ট গুলো করে বাড়িতে চলে আসে।টেষ্টের রিপোর্ট কালকে ছাড়া পাওয়া যাবে না।রিজা আর দিশা মেঘকে বাসায় পৌছে দিয়ে ওরা নিজেদের বাড়িতে চলে যায়।মেঘ বাসায় এসে এতোদিন যে মেডিসিন গুলো খেতো সেখান থেকে একটা পেইন কিলার আর শ্লিপিং পিলস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরের দিন মেঘ ভার্ষিটি গিয়ে প্রথম ক্লাস টা করে সোজা সেই ক্লিনিকে রিপোর্ট আনতে চলে যায়।দিশা আর রিজাও ওর সাথে আসতে চেয়ে ছিলো কিন্তু ‘ও’ ওদের ক্লাস মিস হবে বলে নিয়ে আসেনি।মেঘ রিপোর্ট গুলো পেয়ে যখন ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ওই গুলো দেখায়।রিপোর্ট গুলো দেখে ডাক্তার বলে ওর মাথায় আগে থেকেই নাকি ছোট্ট একটা টিউমার ছিলো।মাথায় আঘাত লাগার কারনে ওটাতে এখন ইনফেকশন হয়েছে।যার কারনে মেঘের হঠাৎ করে এমন মাথা ব্যাথ্যা শুরু হয়েছে।আর যদি এটার ঠিকঠাক মতো ট্রিটমেন্ট করানো না হয় তাহলে মেঘের ক্যান্সার অবদি হতে পারে।এসব বলে মেঘকে উনি ভালো একজন নিউরোলজিস্টের কাছে যাওয়ার জন্য সাজেশন দেয়।
এসব শোনার পর মেঘের আর কোথাও যাওয়ার শক্তি ছিলো না। ‘ও’ কোনো রকম নিজেকে সামলে বাড়িতে চলে আসে।বাড়িতে এসে রুম আটকে হাউমাউ করে কেদে দেয়।ওর মস্তিষ্ক একদম শূন্য হয়ে যায়।কি করবে,কাকে বলবে,কোথায় যাবে কিচ্ছু বুঝতে পারে না।কাদতে কাদতে মাথায় প্রেশার পরে ওর আবার মাথা ব্যাথ্যা শুরু হয়ে যায়।আস্তে আস্তে ওর চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসে।আর ‘ও’ সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকে।
___________________________
মেঘের যখন হুশ ফেরে তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে।’ও’ কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে ফ্রেস হয়ে নিচে যায়।নিচে গিয়ে দেখে মিহির,মিড়া রহমান,আজম রহমান কেউই এখনো ফিরে আসেনি।মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে পড়ে।একজন সার্ভেন্ট এসে ওকে খাবার দিয়ে যায়।’ও’ কোনো কথা না বলে কোনো রকম একটু খানি খেয়ে উপরে চলে আসে।এসব শোনার পর মেঘের গলা দিয়ে কিছুতেই খাবার নামছে না।’ও’ উপরে এসে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে হাতে নিলো,উদ্দ্যেশ্য সবাইকে সবটা জানাবে।কিন্তু ফোনটা ওপেন করতেই মেঘ দেখলো দেড়শো প্লাস মেসেজ আর আশি প্লাস মিসড কল সব গুলো আহানের।নিশ্চয়ই সারাদিন ফোন করে ওকে পায়নি তাই এখন পাগলের মতো করছে।মেঘ ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলো।’ও’ নিজের জন্য যতোটা না ভয় পাচ্ছে তার থেকে বেশি ভয় পাচ্ছে আহানের জন্য।ওর কিছু হয়ে গেলে ছেলেটা পাগল হয়ে যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মেঘ শুনতে পেলো কেউ বারবার বাসার কলিং বেল টিপে যাচ্ছে।মেঘ বুঝতে পারছে না এভাবে পাগলের মতো কে কলিংবেল বাজাচ্ছে।’ও’ চোখের পানি মুছে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে দরজা খুলে রুম থেকে বের হতে যাবে তার আগেই কোথা থেকে আহান দ্রুত পায়ে এসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আকষ্মিক ঘটনায় মেঘ হতবম্ভ হয়ে গেলো।আহান মেঘকে জড়িয়ে ধরে ব্যাস্ত গলায় বললো
“মেঘ পরী তুমি কোথায় চলে গেছিলে?জানো আমি তোমাকে কতোবার ফোন করেছি?ফোনটা ধরোনি কেনো?টেনশনে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছিলো।ভেবে ছিলাম তোমার আবার কিছু একটা হয়ে গেছে।তাই সব কাজ ফেলে এখানে চলে এসেছি।”
মেঘ স্টাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে।’ও’ সামান্য একটু ফোন ধরেনি তাই আহান এমন পাগলের মতো করছে,যদি সত্যিটা জানতে পারে তাহলে ওর কি অবস্থা হবে।মেঘের হাত পা কাপছে।’ও’ একবার ভাবছে সবটা আহান কে বলে দিবে কিন্তু পরক্ষনেই আবার নিজের মনকে শক্ত করে নিলো।নাহ যাই হয়ে যাক আহান কে এসব কথা কিছুতেই বলা যাবে না।
__________________________
পরের দিন সকালে ভার্ষিটি যাওয়ার নাম করে মেঘ ভালো একজন নিউরোলজিস্টের সাথে দেখা করতে গেলো।ওনার চেম্বারে গিয়ে ওনাকে আগের দিনের রিপোর্ট গুলো দেখালো।উনি প্রথমে ভিষন অবাক হয়েছিলো এটা দেখে যে এই টুকু একটা বাচ্চা মেয়ে নিজের রিপোর্ট নিজেই নিয়ে এসেছে।পরে উনি সব রিপোর্ট গুলো ভালো করে দেখে মেঘকে আরো কিছু টেষ্ট দিলেন।মেঘ টেষ্ট গুলো করিয়ে ভার্ষিটিতে চলে গেলো।সেখান থেকে ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে আসলো।প্রতিদিনের মতোই সবার সাথে স্বাভাবিক ব্যাবহার করলেও মেঘ ভিতরে ভিতরে ভিষন ভয় পেতে লাগলো।বারবার আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো যাতে রিপোর্ট গুলো ভুল আসে।কিন্তুু সেটা আর হলো না।পরের দিন আবার রিপোর্ট গুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারলো টিউমার টা খুব বাজে ভাবে ইনফেকশন করেছে।ইমিডিয়েট ওটার ট্রিটমেন্ট শুরু না করলে যা তা কিছু হয়ে যেতে পারে।আর ট্রিটমেন্ট করলেও মেঘের পুরোপুরি সুস্থ চান্স খুবই কম।যেকোনো সময় ‘ও’ ব্রেন ষ্টোক করে মারা যেতে পারে অথবা মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে।
___________________________
সেদিনের পর থেকে মেঘ ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে।হঠাৎ করেই একদম চুপচাপ হয়ে যায়।সবার সাথে কথা বলা কমিয়ে দেয়।আহান কে ইগনোর করতে শুরু করে।আহান দিনে দশ বার ফোন দিলে ‘ও’ একবার সেটা রিসিভ করে।আর রিসিভ করে এটা সেটা অযুহাত দেখিয়ে ফোনটা কেটে দেয়।একদিকে মেঘের এমন ব্যাবহার সহ্য করতে না পেরে আহান পাগলের মতো বিহেব করতে শুধু করে।অন্যদিকে মেঘের ট্রিটমেন্ট শুরু না করার জন্য ওর শারিরীক কন্ডিশন আরো খারাপ হতে থাকে।’ও’ ভার্ষিটিতে যাওয়া কমিয়ে দেয়।কারন একে তো শরীর খারাপ তার উপর আহান রোজ ভার্ষিটির গেটের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকে ওর সাথে একবার কথা বলার জন্য।আর ‘ও’ বারবার আহান কে ইগনোর করে চলে আসে।
__________
আজকে মেঘ ভার্ষিটিতে এসেছিলো কিছু নোটস নেওয়ার জন্য।কয়েকটা ক্লাস করার পর নোটস গুলো নিয়ে মেঘ ভার্ষিটির গেট দিয়ে ভয়ে ভয়ে বের হতে থাকে।কারন যদি আহানের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে আহান এখানে পাবলিক প্লেসে বসে নিশ্চিত একটা সিনক্রিয়েট করবে।
মেঘ গেট থেকে বের হয়ে খুব সাবধানে আশেপাশে তাকালো।দেখলো আহান কেনো আহানের ছায়াটাও কোথাও নেই।আহান কে না দেখে মেঘ ভীষন অবাক হলো।পরে ভাবলো হয়তো কাজে আটকে গেছে তাই আসতে পারেনি।একদিকে ওর ভালোই হয়েছে।আহানের অসহায় কন্ঠের প্রশ্ন গুলোর থেকে রেহাই পেয়ে গেলো।এসব ভাবতে ভাবতে মেঘ একটা রিকশায় উঠে বাড়ির উদ্দ্যেশে রওনা দিলো।
_______________
মেঘ বাড়িতে এসে এমন কিছু দেখতে পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি।’ও’ ড্রইংরুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো মোনা খান,আহাদ খান,আহান সহ অভির বাবা-মা,হিয়ানের বাবা-মা,সাড়িকা,সাঈফা আর ওদের বাবা-মা,আহির,মিহির,দিশা,রিজা সবাই ওদের বাসার বিশাল ড্রইংরুমে বসে আছে।মেঘ কে বাসার মধ্যে ঢুকতে দেখে সবাই এক সাথে চিল্লিয়ে বললো
“সারপ্রাইজ!”
মেঘ অবাক হয়ে প্রশ্নবোধক চাহনিতে মিরা রহমানের দিকে তাকাতেই উনি এসে জানালেন আজকে ঘরোয়া ভাবে আহান আর ওর এ্যানগেজমেন্ট।আর খুব তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ের ডেটও ফিক্সড করা হবে।এসব শুনে মেঘের মাথায় বাজ পড়লো।আর যাই হোক ‘ও’ কিছুতেই আহান কে বিয়ে করে আহানের লাইফ টা নষ্ট করে দিতে পারবে না।
মিরা রহমান এসে মেঘের হাত ধরে ওকে রেডি করানোর জন্য উপরে নিয়ে যেতে লাগলেন।এমন সময় মেঘ ঝাড়া দিয়ে ওনার হাত টা সরিয়ে চিল্লিয়ে বললো
“আমি কোথাও যাবো না।আর এখানে কোনো এ্যানগেজমেন্ট হবে না।”
মেঘের কথা শুনে সবাই অবাক চোখে ওর দিকে তাকালো।মিরা রহমান বললেন
“মানে?”
মেঘ ঝাড়ি মেরে বললো
“বুঝতে পারছো না?বাংলাতেই তো বললাম।তোমরা কাকে জিঙ্গেস করে এ্যানগেজমেন্ট টা ঠিক করেছো?কোনো কিছু করার আগে কাউকে কিছু জিঙ্গেস করার প্রোয়জন মনে করোনা তাইনা?নিজেদের যা মনে তাই করো সব সময়।”
মেঘের কথা বলার ধরন দেখে ওখানে উপস্থিত সবাই চারশো চল্লিশ বোল্টের শকড খেলো।মেঘ কখনো কারো সাথে আগে এমন বিহেব করেনা।মিড়া রহমান কিছু বলতে যাবেন তার আহান বললো
“মামনির কোনো দোষ নেই মেঘ।এই সব কিছু ওনারা আমার কথায় করেছেন।তুমি যা বলার আমাকে বলো।”
আহানের কথা শেষ হতেই মেঘ বললো
“আমার কাউকে কিছু বলার নেই।আমি এ্যানগেজমেন্ট করতে চাই না ব্যাস।”
কথাটা বলে মেঘ সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে তার আগেই আহান এসে মেঘের হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো
“কিছু বলার নেই মানে কি?আমরা দুজন দুজনকে যখন ভালোবাসি তাহলে এ্যানগেজমেন্ট টা করতে সমস্যা কোথায়?”
আহানের কথা শুনে মেঘ না বোঝার ভান করে বললো
“দুজন দুজনকে ভালোবাসি মানে?আপনি আমাকে ভালো বাসতেই পারেন বাট আমি আপনা কে ভালোবাসি না।”
মেঘের কথা শুনে আহান ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেলো।তারপর আহত কন্ঠে বললো
“মেঘ তুমিতো আমাকে বলেছিলে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো।তাহলে এখন এসব কেনো বলছো?”
মেঘ ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বললো
“তখন আবেগের বশে ভালোবাসি কথাটা বলে ফেলেছি।বাট এখন বুঝতে পারছি ওটা ভালোবাসা না ক্ষনিকের মোহ ছিলো।জানেনই তো এই বয়সে এরকম একটু আধটু হয়েই থাকে।”
মেঘের কথা শুনে সবাই স্তব্দ হয়ে গেলো।আহান কি বলবে আর ভাষা খুজে পেলো না।মেঘ বললো
“আমার যা বলার বলে দিয়েছি এইবার ড্রামা শেষ হয়ে গেলে আপনারা সবাই আসতে পারেন।”
কথাটা বলে মেঘ সিড়ি বেয়ে হনহন করে উপরে চলে গেলো।আর বাকিরা সবাই মেঘের যাওয়ার দিকে স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইলো।মেঘের এমন পরিবর্তন দেখে সবাই রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।আহান আর এক মুহূর্তও ওখানে দাড়ালো না টলতে টলতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো।
_____
মেঘ উপরে এসে রুমের দরজা আটকে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সেখানে গিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলো।’ও’ কতো কষ্টে আহান কে ওই কথা গুলো বলেছে সেটা একমাএ ওই জানে।মেঘ কাদতে কাদতে বললো
“আপনি তো সব সময় আমাকে নিঃসার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছেন।তাহলে আমি কিভাবে এতোটা সার্থপর হবো বলুন?কিভাবে আপনাকে আমার অনিশ্চিত জিবনটার সাথে বেধে আপনার জিবনটাকে নষ্ট করবো?আমি জানি,আপনি সত্যিটা জানতে পারলে আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না।তাই আজকে এভাবে আপনাকে হার্ট করতে বাধ্য হলাম।আই অ্যাম সরি!ভেরি সরি!”
_________________________
আজকে প্রায় দুই দিন আহান বাড়িতে ফেরেনি।ওর ফোনটাও বন্ধ বলছে।সেদিন এখান থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে কেউ কিচ্ছু জানে না।সবাই টেনশনে মরে যাচ্ছে।আর মেঘ এমন একটা ভান করছে যেনো আহান মরে গেলেও ওর কিছু যায় আসে না।কিন্তু ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে সহ্য করতে।এদিকে যখনই কোনো টেনশন করে তখনই ওর মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হয়।তার উপর বাসার সবাই ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
মেঘ ভার্ষিটির নাম করে বেরিয়েছে আহান কে খুজতে যাওয়ার জন্যে।ভাবছে একবার আহানের ফার্ম হাউজে গিয়ে দেখবে সেখানে আহান আছে কিনা।মেঘ ওদের বাসার গেটের বাইরে রিকশার জন্য দাড়িয়ে ছিলো ঠিক তখনই একটা কালো গাড়ি এসে একদম ওর সামনে থামলো।আর ‘ও’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির এক পাশের দরজা খুলে এক জোড়া হাত এসে ওকে টান দিয়ে গাড়ির ভিতরে তুলে নিলো।তারপর দরজাটা আটকে দিয়ে ওর মুখে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে ওকে অঙ্গান করে ফেললো।ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো যে মেঘ একটা চিৎকার দেওয়ারও সুযোগ পেলো না।
#চলবে,,,,,