#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৪
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
পৌষ মানেই গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে নতুন ধান তোলার আমেজ। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কৃষক ছুটে মাঠে। কেউ কেউ খেজুর গাছের তলে। ভাপা পিঠার দুম পড়ে যায়। সে এক অন্যরকম অপূর্ব দৃশ্য।
গায়ে শাল জড়িয়ে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁতে ব্রাশ ঘষতে আনমনা হয়ে রাহা তাকিয়েছিল পুকুরের পেছন বাগান বাড়ি পেরোনো কুয়াশা মাখা বিলে। কুয়াশায় মোড়ানো নতুন ধান ভরা ক্ষেতে শিশির ফোঁটা জমে আছে । পুকুরের জলে দিয়ে উড়ে যাওয়া হাওয়া। রান্নাঘরে থেকে ডাক ভেসে এল
যেখানে যাস সেখানে লেগে থাকিস কেন? মেয়েদের এত লেজুড় হতে নেই। তাড়াতাড়ি কর। ব্যাগপ্যাক গোছাবি কখন?
মায়ের হাঁক ডাকে ধ্যান ফিরলো রাহার। পুকুরের হিম শীতল ঠান্ডা জল মুখে নিতেই দাঁতের মাড়ি জমে গেল যেন। চটকরে মুখ দিয়ে রশি থেকে তোয়ালে টেনে নিয়ে মাটির চুলার পাশে দাঁড়ালো সে। জাহানারা বেগমের হার্টের ব্যাথা বেড়েছে। অতিশীঘ্রই উনাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। অধীর আগে থেকেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে বলেছে। শুধু উনাকে নিয়ে যেতে হবে। আর তার গুরুভার পড়েছে রাহার কাঁধে।
সকাল দশটার দিকে ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে সে। রাজিয়া বেগম এটা ওটা এনে দিচ্ছেন। রাহা ব্যাগে ভরছে।
বারান্দায় কোনো চেনা পুরুষের গলার আওয়াজ পেয়ে ভেতর রুম থেকে উঁকি দিতেই ব্লু অফিসিয়াল পোশাকে সুদর্শন যুবকের উপস্থিতি দেখলো। রাজিয়া বেগম আর মাহফুজা বেগমের ছোটাছুটির শেষ নেই। রাহা সেসব দেখে রেগেমেগে বলল
আমাদের বিদায় দেবে? নাকি মেহমান অ্যাপ্যায়ন করতে থাকবে?
আহ ওভাবে বলছিস কেন? মেয়ে তো বড় হয়েছিস নাকি? আশরাফ বলেছে এগারেটার দিকে গাড়ি আসবে। দেখি এদিকে হাত লাগা। ছেলেটা এল খালিমুখে যাবে নাকি?
রাহা কথা শুনলো না। রোস্তমের হাসির আওয়াজ তার ঘরে গিয়েও ঠনঠনে আওয়াজ হচ্ছে। জাহানারা বেগমকে একপলক দেখে আবারও রান্নাঘরে গেল সে।
ওই লোকটা বারবার কেন এখানে আসে বলতে পারো আম্মা?
আমরা কি করে জানব? তোর আব্বা জানে।
সবার হাবভাব এমন যেন চোর চুরি করেছে। আর গৃহস্থ দেখে ফেলায় লুকোনো চেষ্টায় আছে।
ভাবি তুমি কিছু বলো? তোমরা কি আমাকে না জানিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছ? আমি অত রংঢং পছন্দ করিনা।
অন্তরা হাত মুছতে মুছতে বলল
এমা রেগে যাচ্ছিস কেন? ঢাকা যাচ্ছিস যাহ। বেরোনোর আগে এত চিল্লাচিল্লি করা ভালো নয়। তোর থেকে কেউ কিছু লুকোচ্ছে না।
তাই যেন হয়।
রোস্তম অনেকটা সময় পর উঠলো কথা শেষ করে। রাহা দোতলার বারান্দার কাঠের রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল। রোস্তম গাড়িতে উঠার সময় রাহাকে দেখতে পেয়ে চোখ সরু করে তাকালো। তারপর নিষ্পাপ একটা হাসি দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো রাহা। রোস্তম শিকদারের মতো সুদর্শন পুরুষকে আবেগী মেয়েরা ভাবতে পছন্দ করে, ভেবে আনন্দ পায়, এমন একজন জীবনসঙ্গী চাই। কিন্তু এই লোকটা রাহার কাছে চক্ষুশূল। লোকটা যে অন্যায় তার সাথে করেছে তার ক্ষমা হয় না। আর যে বাসনা নিয়ে তিনি এই বাড়িতে ঘনঘন আসা শুরু করেছেন তা কখনোই ফলপ্রসূ হবে না।
আঙুলের ফাঁকের সিগারেটের শেষ অংশটা ফেলে খুকখুক করে কেশে উঠে আমজাদ কবির মেয়েকে দেখলেন কেমন নিস্পৃহ দৃষ্টিতে রোস্তমের ছুটে চলা গাড়িটির দিকে চেয়ে আছে।
মেয়ে কাশির শব্দ শুনলো ঠিকই কিন্তু ঘাড় ঘুরালো না অতি অভিমানে। অনেক সময় সন্তানেরা বাবাদের সিদ্ধান্তকে ভুল মনে করে। কিন্তু মা বাবা সবসময় যে সন্তানের ভালো চায় তা সন্তানেরা বুঝতে চায় না।
এইতো গত কয়েকদিন আগে রোস্তমের বাবা রুহুল শিকদার আমেরিকা থেকে চিকিৎসা শেষে ফিরেছেন। ছোট ছেলের পছন্দের পাত্রী আছে জেনে তিনি খোঁজখবর নিয়েছেন। সবদিক থেকে পজিটিভ ইঙ্গিত পেয়েছেন। তাই সম্মুখে স্বপরিবার মিলে মেয়েটাকে একবার দেখার ইচ্ছে। আমজাদ কবির তা শুনে যদিও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। মেয়ে এটা কখনোই মানবে না। এই বাড়িতে উনারা আসবেন শুনলে নটখট শুরু করবে সেটা তিনি নিশ্চিত। তাই জাহানারা বেগমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার দরুণ দারুণ এক সুযোগ হলো। উনাদেরও আর এখানে আসতে হলো না। রাহাও জানতে পারলো না। যদি পাকাপোক্ত কথাবার্তা হয় তাহলে মেয়ে শুনলেও সমস্যা নেই। বিয়ে করবে না করবে না বললে তো হবে না। মেয়ে যখন হয়েছে তখন পরের বাড়ি যেতে হবে। রোস্তম দেখতে যেমন, স্বভাব চরিত্রও তেমন। শিকদার বংশের ছেলে। তাদের যৌথ পরিবার। আমজাদ কবির খোঁজ খবর নিয়েছেন ভালো করে। খারাপ রিপোর্ট পাননি তিনি। মনে মনে নিশ্চিন্ত হলেন বেশ। উনার যোগ্য মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র পাওয়া গিয়েছে এটা ভেবে মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট তিনি। তবে বেশিরভাগ সময় মেয়ের মনমরা হয়ে থাকার বিষয়টা উনাকে বেশ ভাবাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। মেয়ের মনের ভেতর কি চলছে তা বুঝতে পারছেন না উনি।
বাবার উপস্থিতি দেখে রাহা এবার ঘাড় ঘুরালো।
কিছু বলবে আব্বা?
ছাইরঙা শাল গায়ে ভালো করে জড়িয়ে চোখের পাওয়ারি চশমা ঠিক করলেন উনি। গলা পরিষ্কার করে বললেন
যদি বেশিদিন থাকতে হয় তাহলে ওখানে বাসা নিয়ে নেব একটা। জামাই যদিও বললো ওদের বাড়িতে উঠতে কিন্তু তা তো হয় না। যদি বেশিদিন থাকতে হয় তাহলে তোর মায়েদেরকেও নিয়ে যাব। শীতটা ঢাকায় কাটিয়ে দেবে আর কি।
তাহলে ঘরে যে ধান উঠবে।
লোক দিয়ে দেব। করিমকে সব বুঝিয়ে দেব। ওরা মা ছেলে মিলে সব ঠিকঠাক করে নেবে। ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না।
তাহলে ঠিক আছে। আমার ওখানে একা থাকতে ভালো লাগবে না।
মেয়ের কথায় হাসলেন চেয়ারম্যান সাহেব। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
আচ্ছা তাইলে ওদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। বেশিদিন থাকতে হবেনা একা।
রাহা এবার খুশি হয়ে মাথা দুলালো। যাওয়ার আগে পা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল
উনি কেন এসেছিলেন?
কে?
ওই পুলিশ অফিসার…
ওহ হ্যা। একটা কাজে। কিছু কথা ছিল। আমার থানায় যাওয়ার কথা ছিল। ও বারণ করে দিয়েছে। বলল এদিকে একটা কাজে আসছে তাই দেখা করে যাবে।
ওহহ।
হ্যা।
সেদিন আশরাফের সাথে ঢাকায় চলে এল রাহা। যেদিন হসপিটালে ভর্তি করালো জাহানারা বেগমকে ওইদিন সে নোরার সাথে রায়হান ভিলায় ছিল। নোরাহ একা বাসায় উঠতে দেয়নি তাকে। কিন্তু যেটা ভেবেছিল ঠিক সেটাই হলো। জাহানারা বেগমকে অনেকগুলো দিন হসপিটালে রাখতে হবে চিকিৎসার জন্য । তাই ওদের স্বপরিবার হসপিটালের পাশেই বাসা নিল থাকার জন্য। তাদের বাসার পাশের বাসাটাই ইলেকট্রিসিটির কাজ চলছে। কয়েকদিনের মধ্যে ভাড়া দেওয়া হবে। রাহাদের বাসাটার দোতলার বারান্দা থেকে ওই বাড়িটার বারান্দা দেখা যায়। অবসর পেলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে বারান্দায় বসে কবিতা পড়ে
যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে
সে যেন আজ রানীর মত
ব্যক্তিগত রাজ্যপাটে
পা ছড়িয়ে সবার কাছে
বসতে পারে
বলতে পারে মনের কথা
চোখের তারায়
হাত ইশারায়
ঐ যে দেখ দুঃখী প্রেমিক
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
ভিক্ষে দিলে ভিক্ষে নেবে
ছিন্ন বাসে শীর্ন দেহে
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
কিন্তু শোন প্রজাবৃন্দ
দুঃসময়ে সেই তো ছিলো
বুকের কাছে হৃদয় মাঝে
আজকে তারে দেখলে শুধু
ইচ্ছে করে
চোখের পাতায় অধর রাখি
যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে চিনিয়েছিলো
দুষ্টু গ্রহ অরুন্ধতী
বৃষ্টি ভেজা চতুর্দশী
জোৎস্না রাতের উজ্জ্বলতা
ভোরের বকুল শুভ্র মালা
নগর নাগর ভদ্র ইতর
রাজার বাড়ি
সেই তো আবার বুঝিয়েছিলো
যাওগো চলে আমায় ছেড়ে
যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে
তারপর হঠাৎ করে একদিন তাদের বাসাটাতে কয়েকজন মহিলা আর পুরুষের একসাথে আগমন। রাহা কিছুই বুঝলো না। শুধু দেখলো মা ভাবি আর বেড়াতে আসা নোরার ছোটাছুটি। সবার আচরণে যতটা না অবাক হলো তার চাইতে দ্বিগুণ অবাক হলো সে বোনের আচরণে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল
আপা তুইও?
নোরাহ কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিল
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর। যাকে ছুঁতে চাইছিস সে কখনোই তোর কাছে আসবে না। অলিক কল্পনা বন্ধ কর। যতই এক্সপেকটেশন কমাবি ততই ভালো থাকবি।
উনি আমাকে চিঠি লিখেছিল আপা। একটা না সাত সাতটা।
নোরাহ অবাকান্বিত স্বরে বলল
কি বলছিস?
হ্যা। রোস্তম শিকদার পৌঁছুতে দেয়নি।
আব্বাও এর সাথে জড়িত। উনি এজন্যই আমার সাথে অমন করে কথা বলেছিল। আমি বুঝতে পারিনি।
নোরাহ বিস্মিত হয়ে বলল
আব্বাও?
__________________
গোটা গোটা সাত আটমাস পর আবারও বোনকে দেখার তাড়নায় ভিআইপি প্রটেকশন কোর্সে যাওয়ার পূর্বে শেখাওয়াত বাড়িতে ছুটে এসেছিল তানজীব। বোনটাকে না দেখে শান্তি পাচ্ছিলো না সে। এই গোটা পৃথিবীতে রক্তের বলতে মিনির যে শুধু ভাইটা আছে। ফোনের ওপাশে আকুতিভরা গলায় ভাই ডাকা বোনের ইচ্ছে সম্পর্কে ভাই সদা সর্বদা সতর্ক। সে চেষ্টায় থাকে সুযোগ পেলেই বোনের কাছে ফিরে আসার। পদোন্নতির পর থেকে দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে গেছে আরও। একটু অবসর পেলেই সেনা অফিসার বোনের হাসিমাখা ছবিটা দেখে। মা বাবার পুরোনো ছবিটা দেখে। একটু হাসে। মাঝেমধ্যে মনে হয় মা যেন এসে মাথায় হাত বুলায়। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেয়। আর উনার সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যায়। চোখ বন্ধ হতে না হতেই সে মায়ের অভিমানী গলার যেন শুনতে পান উনি।
বাড়িটা তো হয়েই এল। অত বড় বাড়ি কি ফেলে রাখার জন্য তুলেছ? না হওয়া বউটাকে এবার বউ করে নাও বাবা। আর কতদিন এভাবে চলবে? আমরা নেই কি হয়েছে আমাদের বাড়িঘর আলো করার জন্য তুমি তো আছ।
ঘুম ছুটলেই তানজীব ভাবে, মায়ের সহজ সরল ভাবনার মতো যদি সহজ সরল হতো পৃথিবীর সব নিয়মকানুন। এত যুদ্ধ বিগ্রহ কলহ দূরত্ব না থাকতো!
কঠিন হলেও সত্য, সহজ সরল মানুষটাকেই বাঁচতে দিল না এই নির্মম পৃথিবী। আজকে তাদের জীবনটা নইলে অন্যরকম হতো। মাথার নিচে শক্ত মাটি না হয়ে মায়ের নরম কোলে মাথা রাখতে পারতো। দিনশেষে বাবার শাসনের সাথে আদর ভালোবাসা। সবার কপালে সুখ থাকেনা। সুখ সয় না।
সে বাড়ি ফেরার সাথে শেখাওয়াত বাড়িটা মেতে উঠলো আনন্দে। মিনির ও ভাইকে পেয়ে আনন্দের শেষ নেই। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও অপেক্ষা করছিল তার ফেরার। তার দু বন্ধুর বিয়ে করে কিছু দিনের মধ্যে বাচ্চা আসবে ঘরে। আর সে এভাবে কতদিন থাকবে?
বিবাহ যোগ্য বাড়ির ছোট মেয়েটি আর তার মধ্যকার সম্পর্ক জুড়ে দেওয়ার জন্য তাদের যত আয়োজন। খাওয়ার টেবিলে খেতে খেতে শুরুতেই কোনো কিছু আঁচ করতে পারলো না তানজীব। নিজের বোনতুল্য মেয়েটাকে কি করে তারা বিয়ে করতে বলতে পারে? কিন্তু পরে তাদের সব আকার ইঙ্গিত বুঝেও চুপ করে থেকেছে সে। ভেতরে ফুঁসে ফুঁসে উঠছিল ক্রোধের আগুনে।
কিন্তু তার কোনো উত্তর না পেয়ে সরাসরি বললে তানজীবেরও কিছু বলার সুযোগ হলো। সে ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে দিয়ে উঠে পড়লো। বলল
এই কারণে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছ আমাকে? এসব মতলব ছিল?
তার এমন প্রতিক্রিয়ায় সবাই হতভম্ব। এমনটা কেউ ভাবেনি। মনোয়ারা বেগম বললেন
এসব কেমন কথা? সানজু কোন দিক দিয়ে খারাপ তানজীব?
সানজু? ওকে আমি বরাবরের মতো মিনির মতো করে চেয়েছি। এমন ভাবনা তোমরা মাথায় আনলে কি করে?
সেলিম সাহেব বললেন
শান্ত হ তুই। এমন রাগ দেখাচ্ছিস কেন? তোর মা বাপ থাকলে কি তোকে বিয়ে করানোর চিন্তা করতো না? একটু বুঝার চেষ্টা কর। ও বাড়ির মেয়ে বাড়িতে থাকবে। অন্য মেয়ে তোকে বুঝবে অতটা? তোর যা পেশা তাতে…
আমার কাউকে চাই না। সানজুকে আমি বিয়ে করতে পারব না। তোমরা যা করার করো।
কেন করবি না? যথার্থ কারণ দেখানো ছাড়া এখান থেকে একপাও নড়বি না তুই। আমার বড় হসনি এখনো। তোকে শাসন করার অধিকার আমার আছে।
আই রিপিট এগেইন এই বিয়ে আমি করব না। সানজুকে আমি কখনো ওই চোখে দেখিনি। ও আমার বোন ছিল। থাকবে। সম্পর্কের সমীকরণ বুঝো তোমরা? সম্পর্ক জুড়ে দিচ্ছ নাকি ভেঙে দিচ্ছ? এই ছিল তোমাদের মনে?
আমরা তোর কাছে কিছু চাইতে পারিনা?
আশ্রয়ের বদলৌতে?
রাহান বলল
বন্ধু কি বলছিস এসব?
তুই চুপ থাক। বলো আশ্রয় দিয়েছ, বড় করেছ তাই প্রতিদান চাইছো? মণি তুমিও কি এটা চাও? এটা আদৌ সম্ভব বলো?
খানসা বেগম হা করে চেয়ে থাকলেন। উনি যে ভেতরে ভেতরে কতটা খুশি ছিলেন এ নিয়ে যে ছেলেটা এবার তার মেয়ের জামাই হয়ে যাবে। নিজের ছেলে হয়ে যাবে। মণি থেকে ডাকটা মা’তে রূপান্তর হবে।
কি যেন ভেবে উনি মাথা দুলিয়ে ফেললেন। ঝনঝন করে টেবিলের উপর থেকে গ্লাসটা নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল তানজীব। মিনি কেঁপে উঠলো।
মিনি তুইও?
ভাইয়ের রক্তগরম গলার স্বর, আর শক্ত চওড়া কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটতে দেখে মিনা ভয়ে ভয়ে দুপাশে মাথা নাড়লো। বলল
না। আমি কিছু জানতাম না। আজ জানলাম। সত্যি।
সেলিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন
জিনিস ভাঙছিস কেন? কার বাড়িতে দাঁড়িয়ে গলাবাজি করছিস তুই? এসব তোর বাপের?
হ্যা আমার…
রক্ত চোখে জেঠুর দিকে চেয়ে রইলো তানজীব।
আমার বাপ তো মরে গেছে….
হু হু করে কেঁদে উঠলো মিনা।
মরে গেছে, আর তোমাদের হাতে দিয়ে গেছে। ভুলে গিয়েছি এই বাড়ি আমার বাপের নয়, অন্যের বাপের জিনিস ভেঙে আমি লজ্জিত। মাফ করো।
সেলিম সাহেব মনে মনে কষে নিজেই নিজেকে দু চারটা লাতি দিলেন। মুখ ফস্কে কি বেরিয়ে গেল।
রাহান তাকে কাঁধ ধরে বলল
তানজীব শান্ত হ। দেখ..
রাহানের হাত নামিয়ে দিল সে। শান্ত স্বরে বলল
মিনিকে দেখে রাখিস।
কোথায় যাচ্ছিস তুই?
ঘরের দিকে পা বাড়াতেই পা থামিয়ে দিল সে।
এ বাড়িতে থাকব না।
হ্যা থাকবে কেন? বাড়ি তোলা হয়েছে। এখন সেখানে যাবে। গেলে যাক। আটকাচ্ছে কে? বড় হয়েছে, বাড়ি গাড়ি হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন আমাদের কি দরকার? যাক যেখানে ইচ্ছে। কে আমরা? খবরদার ওকে কেউ আটকাবে না।
তানজীব কানে না তুলে ঘরে চলে গেল। পুরো ঘর খালি করে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। মিনা দরজার সাথে লেগে কেঁদে কেঁদে দেখছিল ভাইয়ের ব্যাগ গোছানো।
তানজীবের বুকের ভেতরটা তখন জ্বলছিল। গর্জে বলল
আমার মাথা খারাপ করবিনা মিনি। খবরদার। আরেকবার যদি কাঁদিস খোদার কছম আমাকে আর পাবি না।
মিনার কান্না সেখানে থেমে গিয়েছে আর বোবা কান্নায় ভাঙা ভাঙা গলায় সে জানতে চাইলো
তুমি প্রাণোর কেন খোঁজ রাখোনা তাহলে?
একথা শুনে তানজীবের হাত থেমে গেল। মিনির দিকে তেড়ে এসে বলল
সে আরেক নিমকহারাম। দোহাই লাগে ওই নাম নিস না। পথ ছেড়ে দে। আমি যাব।
তুমি কোথায় যাবে? সাতদিনের ছুটিতে এসেছ না?
আমাদের নিজের বাড়ি আছে মিনি। এখানে আশ্রয়ে থাকি আমরা। সেজন্যই তো সবাই প্রতিদান চাইছে। ওদের বলে দিস আমার কিছু করার নেই। আমাকে যেন মাফ করে। এত বছর আশ্রয় দেয়ার জন্য চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আমি।
ঘরের বাইরে দাঁড়ানো সকলে একথা শুনে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে।
নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে গিয়ে ছেলেটাকে কত কষ্ট দিয়ে ফেলল তারা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেলিম সাহেব পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললেন
কোথায় যাচ্ছিস তুই?
যেদিকে দুচোখ যায়। অস্ত্র তুলতে জানি। ভয় নেই।
তুই খাবি কোথায়?
না খেয়ে বাঁচতে শিখেছি। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছি ঠিক, কিন্তু সেই চামচ কাঁটাতে পরিণত হয়েছিল চৌদ্দ বছর আগে। এখন সেই কাঁটা গিলতে ও শিখে গেছি। আমার পথ ছাড়ো।
তুই যাবি না তানজীব।
আমাকে যেতেই হবে।
আমাদের আপন ভাবিসনি তাহলে কোনোদিন।
পর কখনো আপন হয় না সেটা তোমরাই আজ দেখিয়ে দিলে আঙুল দিয়ে।
সাজ্জাদ সাহেব বলে উঠলেন
তানজীব কার সাথে বেয়াদবি করছিস? ভুলে যাস না, তোর বাপ কখনো বড় গলায় কথা বলেনি তোর জেঠুর সাথে।
তোমরা বাধ্য করেছ আমাকে।
তানজীব এগিয়ে গেল। সেলিম সাহেব হাত ধরে আটকালেন। তানজীব হাত সরিয়ে নিতেই তিনি বললেন
যাচ্ছিস যাহ । একটা কথা মনে রাখিস তবে, আমি মরলে তুই আমার মরা মুখ দেখতে আসবি না। খাট তুলতে আসবি না। যাহ।
তানজীব বেরিয়ে গেল। তাকে বেরিয়ে যেতেই হতো। যাকে বোনের চোখে দেখে এসেছে এতকাল তাকে কিছুতেই সে ওচোখে দেখতে পারেনা সে। তার আজন্ম এক দুঃখবিলাসী আছে। ওর দুঃখ গিলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
নিজ বাড়িতে উঠেছে সে । ভোর হতে হতেই সেনানিবাসে ফিরবে । আর কবে ফিরবে জানেনা। ভিআইপি প্রোটেকশন কোর্সের প্রস্তুতির জন্য তাকে দেশ ছাড়তে হবে।। বাড়িটার কাজ হলো কয়েকদিন আগে। কিছুদিনের মধ্যে ভাড়াটিয়ারা উঠবে। দোতলার একটি ঘরের কোণায় তার ঠাঁই হলো। এই ঘরটা গোছানো। এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা আছে। বাড়িটার দেখাশোনা করা তৌহিদ তাহমিদের বিশ্বস্ত খাদিম রমিজ মিয়া বাড়িটির যাবতীয় দেখাশোনা করেন। এই ঘরে থাকেন।
কুয়াশামাখা সন্ধ্যায় বারান্দায় লোহার চেয়ার পেতে বসতেই কখন যে ছাইরঙা এসট্রে ভর্তি হয়েছিল আধাজ্বলন্ত সিগারেটের শেষাংশে। ধোঁয়ার গন্ধ উড়ে গিয়ে দূষিত করলো পাশাপাশি বিল্ডিংয়ের বারান্দা। বইয়ে মুখ গুঁজে রাখা মেয়েটি খুকখুক করে কেশে উঠেছিল কয়েকবার। আর মাঝেমধ্যে চোখ তুলে দেখছিল কালো চাদর গায়ে এই শীত সন্ধ্যায় ধোঁয়া উড়ানো এক শ্যাম পুরুষের মাথার কালো কুচকুচে চুল ভর্তি মাথার পেছন দিক।
চলবে….
সবার মন্তব্য চাই