মন নিয়ে কাছাকাছি – পর্ব ১৭

0
353

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৭
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা

কুয়াশা মাখা ভোর। ভেসে আসছে পাহাড়ের নিজস্ব শব্দসুর। পাক-পাখালির কিচিরমিচির কুহুতান। সৈনিক আর সেনা অফিসারদের হাঁক-ডাক, ছোটাছুটি, কাঠপোড়ার গন্ধে রাহার ঘুম ভেঙেছে খানিক আগেই। কম্বলের উম থেকে বেরুতে ইচ্ছে করছে না। তাঁবুর ছোট ঘরটার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো ব্যাগ, বোতল,কিসব যন্ত্রপাতি,ল্যাপটপ ব্যাগ,ক্যামেরা,আরও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। দু’হাতে চোখ ঢলে আঁড়মোড়া ভেঙে উঠার সময় তাঁবুর বাইরে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। কম্বল টেনে নিয়ে ভেতরে চুপটি করে শুয়ে রইলো রাহা।

তানজীব তাঁবুর দরজা সরিয়ে উঁকি দিল। দৌড়াদৌড়ি করে এসে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ভেতরে ঢুকে বোতল খুলে পানি খেল। রাহা কম্বল সরিয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখে আবারও কম্বল মুড়ি দিল। নড়াচড়া টের পেয়ে তানজীব ঘাড় ঘুরালো। পানি খেতে খেতে তাকিয়ে রইলো। রাহা আবারও কম্বল সরালে চোখাচোখি হয়ে যেতেই কম্বল দিয়ে একদম ঢেকে নিল পুরো মাথা। পানি খেয়ে হেসে উঠলো তানজীব।

অনেক ঘুমানো হয়েছে ম্যাডাম । উঠে পড়ুন ।

আচ্ছা।

তানজীব বাইরে চলে গেল। রাহা আড়মোড়া ভেঙে উঠলো। এত মোটা জ্যাকেট পড়া স্বত্বেও কি ঠান্ডা। হাত পা ঠনঠন করছে ঠান্ডায়। মাথার চুল সব সামান্য এলোমেলো। অগোছালো। তাঁবুর দরজা সরিয়ে বেরুলো সে বাইরে। সূর্যের দেখা মিলতে অনেক দেরী। দূরের পাহাড় ঝাপসা। তাঁবুর ছাদে টুপটাপ কুয়াশা পড়ার আওয়াজ। যেন থেমেথেমে শীত বৃষ্টি হচ্ছে। মোহিতকর সন্নিহিত আশপাশ। যেন একটা স্বপ্নের দেশ। গতরাতের মতো আগুন জ্বালিয়ে সৈনিকের দল আগুন পোহাচ্ছে। একসাথে মিলেমিশে খাচ্ছে। হাসছে। কথা বলছে।

গতরাতের মানবীটাকে ওরা স্পষ্ট দেখলো আজ। জ্যাকেটটির ঠিক কলার করতে করতে বোকাসোকা চোখে তাকিয়ে হেঁটে হেঁটে কিছুদূর গেল রাহা। কিন্তু বেশিদূর যাওয়ার আগেই অপরপাশ থেকে গমগমে গলার হাসির আওয়াজ কানে আসতেই রাহা দেখলো তানজীবের সাথে সাথে আরও কয়েকজন ছিপছিপে দেহের লম্বাটে সেনা অফিসার। গায়ে আর্মি পোশাকের উপর লম্বাটে রেনকোটের মতো চাদর। মাথায় বাঁকা করে পড়া অফিসিয়াল ক্যাপ। সবাই সবুজ রঙা শাড়ির উপরে ঢিলে আর্মি জ্যাকেট পরিহিত মেয়েটাকে দেখলো দিনের আলোয়। চোখমুখ তার ফোলা। চোখে এখনো ঘুম লেগে আছে। কেশপাশ এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুখের আশেপাশে। চাহনিতে কেমন শঙ্কা,ভীতি,লাজ,আড়ষ্টতা জড়ানো। চট করে লুকিয়ে পড়লো সে তাঁবুর ভেতর।

তার কান্ড দেখে না চাইতেও হেসে উঠলেন অফিসারেরা। তানজীবও নিঃশব্দ হাসলো।

Is she scared major?

তানজীব ছোট্ট করে আওয়াজ করলো।

Maybe.

রাহার কথা বলে হাসতে হাসতে অফিসারেরা অন্য পথ ধরলো। তানজীব তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে বলল

মেই আই কাম ইন?

ইয়েস।

তানজীব তাঁবুর দরজা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

গুড মর্নিং ম্যাডাম।

হুহ।

কি হুহ?

রাহা চোখ তুলে তাকালো। আবার নামিয়ে নিল। বলল

ওয়াশরুম যাব না? চুলও আঁচড়াতে হবে। দেখুন এলোমেলো হয়ে গেছে।

তানজীব সত্যিই সত্যিই তাকালো। রাহা লজ্জিত হয়ে ফিরে গিয়ে বলল

ওভাবে দেখতে বলিনি।

তানজীব নিঃশব্দে হাসলো।

দক্ষিণে ক্যাম্পের অফিস, ওয়াশরুম। চলো।

উহু। কেউ থাকলে যাব না।

কেউ নেই ম্যাডাম। এটা ক্যাম্প। সবকিছু ক্লিন এন্ড অর্গানাইজড। ওকে? এসো।

____________

রাহা ফ্রেশ হয়ে চলে এল তানজীবের সাথে । হাত মুখ মুছে তাঁবুর বাইরে এসে দেখলো তানজীব তক্তার মতো কাঠের উপর উপর বসে সফেদা আর কমলার খোসা ছাড়াচ্ছে। সাথে কলা পাউরুটি রয়েছে পাশে। রাহা চুপিসারে গিয়ে তার পাশে বসলো।

এগুলো খেয়ে নাও প্রাণো। আমরা বেরোবো।

রাহা পাশে বসেই জিজ্ঞেস করল মিনমিন করে

কোথায় যাব?

তানজীব তার দিকে তাকালো। কুটিল হেসে বলল

ম্যাডাম কোথায় যেতে চায়?

রাহা নতবদনে হেসে বলল

আমি কি জানি? আপনি যেখানে নিয়ে যান।

এত কনফিডেন্স আমাকে নিয়ে? কতদিনই বা চেনো?

অনেক বছর।

চৌদ্দ বছরে অনেককিছু বদলে যেতে পারে।

রাহা নিচের দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটের কোণা মোচড়াতে মোচড়াতে বলল

বদলেছে তো। ছোটবেলায় আপনি আমার সাথে কথাও বলতেন না। এখন খুব বলেন। তখন আপনাকে আমি ভয় পেতাম। এখন ভয় হয় না।

কি হয়?

রাহা মাথাটা নামিয়ে একদম হাঁটুতে গুঁজলো। মুখ লুকোলো।

তার কান্ড দেখে তানজীব হেসে উঠলো। বলল

ওহ। লজ্জা হয়?

রাহা মাথা তুললো না। তানজীব তাড়া দিয়ে বলল

ওকে ওকে লজ্জা পরে পেলেও চলবে। এখন খেয়ে নিন আপাতত।

______________________

চাদর খুলে রাহাকে ভাঁজ করতে দিল তানজীব। পিঠে আর্মি ডাফল ব্যাগটা তুলে কোমরে গ্লক সেভেনটিন গুঁজে বলল

তোমার আর কিছু আছে টেন্টের ভেতর? নিয়ে নাও।

রাহা শুকোতে দেওয়া চাদরটা টেনে নিয়ে ভাঁজ করতে করতে বলল

আর কিছু নেই। আমি কিছু ছাড়াই এসেছি।

গুড।

চলো। গাড়ি আছে ওখানে।

বলেই শক্ত ধরে রাহার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল তানজীব। তাঁবুর এরিয়া পার হতেই বিশাল প্রান্তরে দেখা মিলল সারি সারি সোজা দাঁড়ানো শতাধিক সৈনিক। যেন তারা এক-একটা পাথুরে মূর্তি। চোখের পলক পড়েনা এমন।
তারা তখন কমান্ডারের আদেশে সকালের কার্যসিদ্ধি করছে। দু সারি করে চার সারি দাঁড়িয়ে। মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে অফিসারদের আগমনে পা ঠুকে কপালের পাশে হাত ঠেকিয়ে কূর্নিশ জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সবাই। অফিসারদের পেছনে সবার চোখ গেল মেজর স্যারের দিকে। নিজের সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন কালকের সেই ম্যাডামটিকে।

তাদের পেছনে সারির মধ্যে দিয়ে যেতে দুপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকালো রাহা । যারা তাকে বন্দুক দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছিল তাদের দিকে চোখ বড় বড় তাকালো। চোখ রাঙালো। এখন ওভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? কালকে তো তাকে ভয় দেখাচ্ছিল।
ম্যাডামের চোখ রাঙানো দেখে সৈনিকগুলো মিটমিট করে হাসলো।

________________

পাহাড়ের সরু পথে গিয়ে আলাদা হয়ে গেল ওদের পথ। বাকিরা অন্য পথে চলে গিয়েছে। এবার তারা দুজন। চলতে চলতে রাহার মনে হলো পথটা ভারী সুন্দর। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা। একটু সমতলে পৌঁছুতেই রাহার হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে ছুটলো সেই আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে চা বাগানের ভেতরে। তার জীবনে এমন সুখকর স্মৃতি কি আর আছে? আজকের দিনটা স্মৃতিবন্দী হোক।
স্মৃতিবন্দী হোক ওই দূরে তার নিজের একটা মানুষ দাঁড়িয়ে তার পাগলামি দেখছে। কিছুদিন আগেও তাকে দেখা যেত না, ভাবা যেত না, ছোঁয়া যেত না। অথচ আজ সে তার কত কাছে। জীবনের মোড় কখন যে পাল্টে যায়।

রাহা হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেল। হাতে তালু ছিলে গিয়েছে। জ্বালা করছে। হাত ঝেড়ে দাঁড়াতে গিয়ে তানজীব তাকে দেখলো। এগিয়ে এসে বলল

পড়ে গিয়েছিলে? কেন দৌড়াদৌড়ি করছ?

ওই না এমনি।

চলো। বেশি ব্যাথা পেয়েছ?

রাহা মাথা নাড়লো দু’পাশে। তানজীব তার হাত তুলে ছিলে যাওয়া অংশ দেখিয়ে বলল

তাহলে এসব?

রাহা হাত সরিয়ে নিয়ে বলল

ওসব সামান্য।

তানজীব চোখমুখ শক্ত করে তাকালো। হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় আঁড়চোখে দেখলো রাহা হাতটা ঝাড়ছে। সে চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল

জ্বালা করছে সেটা লুকচ্ছ কেন? আশ্চর্য!

রাহা হতাশ হয়ে বলল

আপনি এমন বকাঝকা করেন কেন সবসময়? এসব তো সামান্য। আমি একজন যোদ্ধার সঙ্গী।

কথাটা শুনে ঝট করে তাকালো তানজীব। পাশের একটি ঢিবিতে বসালো রাহাকে। পিঠের ব্যাগ সামনে এনে বসলো রাহার মুখোমুখি। মলম বের করতে করতে বলল

সব ঔষধ এখানে আছে। জ্বালা করছে বললে তো হয়। শুধু শুধু জ্বালাও প্রাণো।

আপনাকে না জ্বালিয়ে কাকে জ্বালাবো তাহলে?

তানজীব মলম মালিশ করতে করতে চোখ তুলে তাকালো। বলল

পা দেখাও। কোথায় লেগেছে।

না না পায়ে লাগেনি।

মিথ্যে বলবে না। পছন্দ না আমার।

রাহা পা বের করে দিল। সামান্য ছিলে গিয়েছে। তানজীব মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল

তোমাকে আমি শান্ত ভেবেছিলাম।

আমি আসলেই শান্ত।

আমার মাথা।

আপনার মাথা অনেক গরম।

তানজীব তার দিকে তাকালো। তারপর হেসে উঠলো।

রাহাও হাসলো। গালে দুহাত রেখে তানজীবের দিকে তাকিয়ে বলল

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

জানিনা।
তুমি কেন এ অবেলায় এলে প্রাণো? আমি কোনো সিদ্ধান্তঃ নিতে পারছিনা।

রাহার হাসি হাসি মুখটা নিভে গেল।

তানজীব মলম কৌটা রেখে দিয়ে রাহার দিকে তাকালো। বিষন্নতায় ঢাকা মুখটা দেখে খারাপ লাগলো তার।

তারপর একপলক চেয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল ফুঁস করে। রাহার নরম হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল

আমি সমাজের তথাকথিত নিয়ম মানিনা প্রাণো। তাই আমি অসামাজিক। আমি অবাধ্য। আমি স্বজনের আশ্রয়ে বড় হয়ে উঠা অনাথ মানুষটি। আমার সাথে পথ চলতে গেলে তোমাকেও অসামাজিক হতে হবে প্রাণো। তুমি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। এই যে ছুটে এলে আগাপাশতলা না ভেবে আমার মান ভাঙাতে। পারিবারিক বিধিনিষেধ, রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করে এটা ভেবেই হয়ত গতরাতে বারবার তোমার দুচোখ
জলে ভাসছিল। আফসোসে, অনুতাপে। কিন্তু আমি তো কভু তোমার আফসোস অনুতাপ হতে চাই নি। আমি বরাবরের মতো চেয়েছি যে দিনশেষে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক, আমার জন্য ক্যালেন্ডারের কালো কালির দাগ আঁকুক, তার দুহাতের রাঙানো মেহেদীর মাঝে আমার নাম থাকুক, তার দু চোখের তারায় আমায় রাখুক। আমি তার সবটা জুড়ে থাকি। সেটা তুমি ছিলে প্রাণো। কিন্তু তোমার চোখে যেখানে আমি আমার শান্তি দেখব সেখানে অনুতাপ, ক্লেশ, আফসোস দেখতে পারব না।

কেন বলছেন এসব?

প্রাণো প্রাণো! বুঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। তুমি আমাকে বলো আমার সাথে পথ চলতে হলে তোমাকে কোন কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আমাকে বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকতে হয় সীমান্তের পাড়ে। ভিআইপি প্রটেকশন কোর্স শেষে আমাকে শান্তিরক্ষা মিশনে যেতে হবে। তখন তোমাকে কিভাবে আমি আগলে রাখব? তুমি আর দশটা মেয়ের মতো স্বামী, সংসার, পরিবার, ভালো থাকা ডিজার্ভ করো প্রাণো। আমি সেসবের কিছু দিতে পারব না তোমায়। সবার আগে আমার কাছে দেশের কাজ আগে। আমি সেসব রেখে তোমার কথা ভাবতে পারব না প্রাণো। তোমার পরিবারও নিশ্চয়ই চাইবে না এমন একটা ছেলের হাত তুমি ধরো যে তোমার কাছেই থাকবে না। যার নিজের একটা পরিবার নেই। যে পরের বাড়িতে বড় হয়েছে। আর তারা তোমাকে পছন্দ করেনা। তোমাকে আমি কার কাছে সুরক্ষিত রেখে যাব?

আমি নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে জানি মেজর।

কিন্তু তারপরও..
দিনশেষে তুমি একা বোধ করবে। কখনো না কখনো তোমার আফসোস হবেই। তোমার আসাটা উচিত হয়নি প্রাণো। বড্ড অবেলায় এলে তুমি।

ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। রাহাও দাঁড়িয়ে পড়লো।

ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল সে। মেজর ভুল কিছু বলেনি। সব তিক্ত সত্য কথা বলেছে। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল

ঠিক আছে।

তানজীব ফিরলো না তার দিকে। ভাবলো, সবটা ঠিক ঠিক মেনে নিল মেয়েটা? কেন তার জন্য সবকিছুর বিপরীতে যেতে পারেনা প্রাণো? এতটুকু ত্যাগ করতে পারেনা? তারা তো দেশকে ভালোবেসে জীবন বাজি রাখে। প্রাণো তারজন্য এটুকু পারবে না? প্রগাঢ় অভিমানে অটল মানুষটার বুক ভার হলো।

তাহলে চিঠি পাঠাবেন তো মেজর?

চট করে তানজীব ঘাড় ঘুরালো। একদম চোখাচোখি তাকালো। বলল,

চিঠি? কিভাবে পাঠাব? কার কাছে?

রাহা হাসলো। বলল

ওই ডাকপিয়নের কাছে। আমি তার ঘরেই থাকব। আপনি পাঠাতে পারেন। আমি চিঠি পাব। লিখবেন তো চিঠি?

তানজীবের কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। উদ্দেশ্যহীন কোনদিকে তাকিয়ে রইলো সে। রাহা চেঁচিয়ে বলল

এখন চুপ করে আছেন কেন? লিখবেন চিঠি ?

উত্তর না পেয়ে রাহা হনহনিয়ে চলে গেল। এবড়োখেবড়ো হাঁটা শুরু করলো। জোরে। উঁচুনিচু ঢালু পথে এভাবে হাঁটতে দেখে তানজীব ডাক দিল

প্রাণো পড়ে যাবে তুমি।

আপনি নিজের চরকায় তেল দিন। আমার চিন্তা করার অনেক মানুষ আছে।

তানজীব তাকে অনুসরণ করে হেঁটে গেল। রাহা জোরে হেঁটে যেতে যেতে একসময় শাড়ির সাথে পা লেগে উল্টে পড়ে গেল। তানজীব চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিল। তাকে ধরে বলল

বারণ করেছিলাম। কেন কথা শুনোনা? কেন অবাধ্যের মতো আচরণ করছ?

অবাধ্য শুধু আপনি হতে পারেন? আমি কেন নই? ছাড়ুন।

ব্যাথায়, অন্যদিকে মেজরের কঠিন কথা গুলোর আঘাতে মুষড়ে পড়ে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো রাহা।

আপনার সাথে আমার দেখা হওয়া, কথা হওয়া,ওই পুরোনো জমিদার বাড়িতে অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়া, প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে আপনাকে মনে পড়া, আপনাকে একবার দেখব বলে গোটা গোটা চৌদ্দটা বছর অপেক্ষা, প্রতীক্ষা সবকিছু তাহলে মিথ্যে? আপনি একবার বলুন এসব মিথ্যে? আমি চলে যাব। আমাকে কখনো দেখতে পাবেন না আপনি। বলুন সব মিথ্যে।
এখন মুখে কথা নেই কেন? কেন লিখলেন আপনি আমাকে চিঠি? যার কারণে আমাকে ছুটে আসতে হলো এখানে? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন আপনি আমাকে চান না। বলুন। আমি কথা দিচ্ছি কখনো আপনার পিছু নেব না।

তুমি ব্যাথা পেয়েছ এখন..

এটা আমার উত্তর নয় মেজর। কেন পালায় পালায় করছেন? একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সবটা। কিন্তু আপনি আমাকে রেখে ওই দূরদেশে চলে গেলে আর কখনো পাবেন না। দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। আমাকে ভেসে যেতে হবে সময়ের স্রোতে। আমি আপনাকে ভাবার অধিকারটুকু হারিয়ে ফেললে সব অনুভূতিরাই মিথ্যে হয়ে যাবে মেজর।

মেঘের মতো অটল, অবিচল মানুষটার চোখের কোণা কি কভু ভিজে উঠেনা? বুক কেঁপে উঠেনা?

একটা মানুষ তাকে নিয়ে এত ভাবে ভাবতেই আনন্দ হলো মেজরের। কড়াপড়া দু’হাতের বাঁধনে তিনি আগলে ধরলেন মানবীর মুখ। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিলেন গালের সাথে লেপ্টে থাকা নোনাজল। ডহর চোখদুটো দিয়ে গভীর চোখে চেয়ে ফিসফিস করে ভারী চাপা গলায় বললেন,

যদি মনে হয় তুমি এই অসামাজিক, অবাধ্য মানুষটার সাথে চলতে পারবে দ্বিধাহীন, অভিযোগহীন।
তবে এসো, ধরো হাত।
কেটে যাক বিষণ্ণ মেঘরাত।
আসুক সোনালি প্রভাত।

রাহা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

তাকে শান্ত করাতে করাতে তন্মধ্যে ক্রিং ক্রিং মেসেজ টোন বেজে উঠতেই পকেট থেকে ফোন বের করলো তানজীব । দেখলো দু বন্ধুর দুটো মেসেজ। মেসেজ দুটো দেখতেই ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো মেজরের।

___________

বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে বলে নোরাহ,মিনা, অধীর আর রাহান ছুটে এসেছিল ডিরেক্ট গাড়িতে চড়ে চট্টগ্রামে। তখন প্রায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা চারপাশটা। সহকর্মীর পরামর্শে একটা পুরোনো বাড়িতে উঠেছিল সবাই।
মিনা আর নোরাকে পেয়ে রাহার গুমোট ভাবটা কেটে গেল। অনেক কেনাকাটা করে নিয়ে এসেছে তারা।
দুজনেই মনের মাধুরী মিশিয়ে রাহাকে শাড়ি পড়ালো। সাজালো। হাসালো। কাঁদালো। লজ্জা দিল। কত আকাশপাতাল ভাবলো তাকে নিয়ে।

তারপর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, দু বন্ধুকে সাক্ষী রেখে মেজর বিয়ে পড়েছিল ঠিক মাগরিবের পরপর। রাহা কেঁদে কেঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে ভাবছিল একটা সাইন, তিনটে কবুলেই এত এত দূরত্ব ঘুচে গেল তার আর মেজরের?

ঘোমটার আড়ালে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠা মেয়েটিকে দেখে তানজীবের মায়ের কথা মনে পড়লো। মা নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি আজ। মায়ের না হওয়া বৌমা আজ বউ হয়ে গেল তার।

_____________

তাদের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হলো বিস্তর। অধীর ব্যবস্থা করে রেখেছে। সব অর্ডার দেওয়া আছে। তা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
নোরাহ আর মিনির সাথে সাথে হাত মিলিয়ে রাহাও বাকি কাজ সেড়ে নিল। তারা তিনবন্ধু আর তানজীবের সহকর্মীরা বসে আলাপ আলোচনা করলো দেশে বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। হাসি ঠাট্টা করলো মেজরের হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে। দেখলে বুঝায় যায় না মানুষটা ভেতরে ভেতরে এতটা পজেসিভ হতে পারে প্রিয় মানুষকে নিয়ে। রাহা আড়ালে কান পেতে শুনছিল তানজীবের গলা। আজ সবটা অন্যরকম অন্যরকম অন্যরকম লাগছে তার। একপলকে কতটা কাছের হয়ে গেল ওই মানুষটা তার।

নোরাহ আর মিনি ফুল যা আনলো তা দিয়ে তাদের ঘরটি সাজানো শুরু করলো। রাহা হাঁটতে হাঁটতে সে ঘরে ঢুকে পড়ে বলল

তোমরা কি করছ এখানে?

মিনি বলল

হায়হায় তুই এখানে কেন? তোর এ ঘরে আসা মানা এখন। যাহ যাহ।

রাহা লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেতে যেতে সামনাসামনি পড়ে গেল তানজীবের। একদম ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে মোড়ানো মানুষটা তার একান্ত ভাবতেই সুখ সুখ লাগলো। ভারী গলাটির কথায় সম্বিৎ ফিরলো,

এত ছোটাছুটি কেন? পায়ে না ব্যাথা?

রাহা লজ্জিত হয়ে বলল

ওরা..

কি ওরা?

রাহান আর অধীর উঁকি দিয়ে তাদের দেখলো। ফিসফিস করে বলল

শালা মেজর তলে তলে বহুদূর।

বলেই ফিক ফিক করে হাসলো দুজন। গলায় খুকখুক করে আওয়াজ করে বলল

মেজর কি চলে?

রাহা তাদের দেখে লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে পড়লো।

তানজীব তাদের দিকে ফিরে বলল

তোদের মাথা চলে শালা।

হেসে একে অপরের উপর ঢলে পড়লো দু বন্ধু। তাদের কান্ড দেখে তানজীবও হাসলো।

চলবে……
ইয়ে মানে কালকের পর্বে বাকিটুকু🙈🙈🙈🙈

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here