#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৮
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
রাতের আকাশ ফুঁড়ে চন্দ্রসুধার বর্ষণে উদ্দীপিত, শ্বৈলপ্রান্ত। কুজ্ঝটিকায় আচ্ছন্ন আশপাশ। নির্জনতায় গা ছমছমে আভাস। ঘরটা দোতলায়।
দেয়ালগুলোতে টাঙানো কতগুলো পুরোনো পেইন্টিং। মাথার উপর যান্ত্রিক ফ্যানটাও পুরোনো জং ধরা । জানালাটা বিশাল। ফিনফিন করে শীত ঢুকে পড়ছে ভেতরে।
বেলী, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, জারবেরা ফুলে আচ্ছাদিত বিছানা। টিকটিক টিকটিক করে চলতে থাকা যান্ত্রিক ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রাহা আবারও দীর্ঘ কেশযুক্ত মস্তক ফেলে রাখলো ফুলেল পরিশোধিত বিছানার চাদরে। শাড়ির আঁচল গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। মাথার ঘন কেশপাশের সাথে লেপ্টে রয়েছে পুষ্পপত্র।
দুচোখের তারা নিবদ্ধ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে টিকটক করে চলতে থাকা যান্ত্রিক দেয়াল ঘড়িটার দিকে। তৃতীয় বারের মতো আরও একবার গড়াগড়ি খেতেই ঠকঠক করে দরজায় ঠোকা পড়লো সাথে গুরুভার গলার সুনাদ আওয়াজে ফাঁকা ঘর কেঁপে উঠলো।
মন ব্যাঙাচি তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠলো রাহার। মস্তিস্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। বুকের ভেতর কে যেন বিরতিহীন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। পাশ থেকে ওড়না টেনে ঘোমটা টানতেই আলতার শিশির পড়ে গেল মেঝেতে। ত্রস্ত পায়ে সে হেঁটে গেল দরজার কাছে। নাক অব্দি ঘোমটা টানা মুখে নিস্পন্দ নিস্প্রভ হয়ে থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে বহুক্ষণ। দরজার ওপাশ থেকে হাস্কি গলার আওয়াজটি কিছুক্ষণ পর পর ভেসে আসছে। আর বুকের ভেতর নিদারুণ বয়ে চলা দুন্দুভি বেজে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। খট করে দরজা খুলে দিল সে।
ফুঁস করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল তানজীব।
পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেল। এত অপেক্ষা কেন করান ম্যাডাম?
আমাকেও করিয়েছেন।
প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে?
রাহা দু পা পিছু গেল।
একদম। ছাড় দেব কেন?
যথাস্তু । এখন ভেতরে আসতে পারি ম্যাডাম?
রাহা ঘোমটার আড়ালে মাথা দুলালো।
আসাই যায়।
আচ্ছা।
এক পা বাড়ালো তানজীব। রাহা বরঞ্চ তিন পা পিছিয়ে গেল। তা দেখে তানজীব হাসলো নিঃশব্দে। দৃষ্টি রাহার দিকে নিবদ্ধ রেখে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল
দেরী করার জন্য সরি।
আমি জানি আমার অপেক্ষা কখনো ফুরোবে না। আমি তাই সরিটা নিচ্ছিনা।
তানজীব ঘড়ি খুলতে গিয়ে থেমে গেল। এক পা এক পা করে হেঁটে রাহার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথাটা নিচু করে ফিসফিস করে বলল
গত চৌদ্দ বছরে আমি আপনাকে একবারও তো ভুলিনি ম্যাডাম। এই যে এত বছর পর সাক্ষাৎ। অপেক্ষা আমি করিনি?
রাহা দু পা পিছিয়ে গেল আরও।
তার কারণও আপনি। কেন দূরত্ব রেখেছেন? যোগাযোগ রাখা যেত।
তানজীব তার সাথে সাথে সমান তালে এগিয়ে গেল।
হুহ, আমার দোষ।
উহু, আপনার দোষ নেই। দোষটা ভাগ্যের।
তাহলে এত দূরে সরা কেন? কি সমস্যা?
বুঝে নিতে হয়।
তানজীব মাথা দুলালো। ওড়নার উপরেই ছুঁয়ে দিল রাহার কপোল। প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
হুম, বুঝে নিলাম।
রাহা আরও দুপা সরে গেল। পিছু করে দাঁড়িয়ে বলল
নাহ বুঝেননি। আপনি রাগের মাথায় ওইদিন আমার ঘোড়াটা ভেঙে ফেলেছেন। আমি দেখেছি ব্যাগে। আপনি জানেন আমি ওটাকে কত যত্নে রেখেছিলাম। আর আপনি ভেঙে ফেলেছেন।
তানজীব জিভে কামড় দিল।
কি করে ওটা দেখে ফেলেছ তুমি? আমি তো..
ব্যাগে দেখেছি। আপনার সবকিছু আজ থেকে আমার।
তানজীব নিঃশব্দে বিড়াল পায়ে গিয়ে রাহার পেছনে দাঁড়ালো। শাড়ির ভাঁজে উদরে হাত গলিয়ে, একটানে তার দিকে ফিরিয়ে নিল সে রাহাকে । রাহার দুহাত গিয়ে ঠেকলো তার বুকের উপর। শ্বাস ভারী হয়ে এল তার। বুকের ভেতর কিছু একটা লাফাচ্ছে। তানজীব অন্য হাত দিয়ে তার ঘোমটা তুলে অর্ধেক অংশ তার মাথার উপর নিল। নাকের উপর করপুট ছুঁয়ে নিজের ধারালো গালের একপাশ দিয়ে চেপে ধরলো রাহার নরম গালের একপাশ। ধারালো দাঁড়ি গুলো গালে ঢেবে যেতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল রাহা। শিরশিরিয়ে উঠলো সারা দেহ। দম প্রায় বন্ধ হয়ে এল।
শক্ত করে ধরলো সে তানজীবের পাঞ্জাবি। তানজীব কানে ওষ্ঠ করপুট গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল
সেন্সলেস হয়ে গেলে আমি ফেঁসে যাব ম্যাডাম।
অতি অনুরক্তির প্রভাবে রাহা নেতিয়ে পড়তে পড়তে তানজীব নিজেই আগলে ধরলো তাকে দুহাত দিয়ে। রাহা দুহাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে নিতেই হেসে উঠলো তানজীব। ছোট ছোট করে ছাঁটা অসিতবরণ চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে রাখলো রাহা। কতক্ষণ ওভাবে একে অপরের সাথে মিশে থাকলো তার হিসেব নেই।
স্ব শরীরে এই প্রথম এত কাছে আসা। মন কবে কাছাকাছি চলে এসে বাঁধা পড়েছে তার হিসেব করতে বহু পুরোনো খাতার হিসেব মিলাতে বসতে হবে।
দীর্ঘসময় পার হতেই তানজীব দুহাতের বাঁধনে ধরে শক্ত করে ধরে তুলে নিল কোমল নারীদেহ। সারা মুখে, ওষ্ঠ অধরে, গলদেশের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে দিল উষ্ণ আর্দ্র বলিষ্ঠ ঠোঁটের প্রলম্বিত চুম্বন। ওড়নাটা খসে মেঝেতে পড়ে গেল।
পাঁজাখোলা করে কোমল নারীশরীর তুলে নিয়ে ফুলেল সুরভিত শয়নস্থানে রেখে দিল তানজীব। মুঠোয় মুঠোয় ফুলের পাপড়ি তুলে নিল চাদরের উপর থেকে। রাহার মুখের উপর ছিটিয়ে দিতেই রাহা টেনে নিল তার পাঞ্জাবির কলার। কোমল পেলব ঠোঁট গেঁথে দিল ধারালো গালের একপাশে। নাকের সাথে নাক ঠেকিয়ে জোরে শ্বাস নিল সে । তানজীব চেয়ে রইলো তার কেঁপে উঠা নাকের ডগা, আর ঠোঁটের কোণায়। রাহা কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠলো…
এত মায়া কেন বাড়ালেন মেজর? আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার কষ্ট হবে ভীষণ।
আমি সবসময় আছি ম্যাডাম। আপনার সাথে।
রোদ্দুর হয়ে, বৃষ্টি হয়ে,বদনাম হয়ে, ডাকনাম হয়ে।
সবসময়।
কাল থেকে তো আর দেখব না আপনাকে। আর কবে দেখব? বাকি দিনগুলো কিভাবে যাবে আমি জানিনা। আপনি থাকলে আমার ভয় হতো না।
আপনাকে ভীতু মানায় না ম্যাডাম। একটুও না। আমি ফিরে আসি। তারপর আপনাকে ঘরে তুলব। আমাদের ছোট্ট একটি সংসার হবে প্রাণো।
রাহার চোখের কোণায় জ্বলজ্বল করছে টলমলে পানি।
যদি কেউ মেনে না নেয়? আপনার বাড়ির কেউ। আপনার চাচা জেঠুরা। ওরা….
তানজীব বিরক্ত হলো বেশ। দু’হাত দিয়ে রাহার মুখ একদম চেপে ধরে বলল
আমার এই অনিশ্চিত আথান্তর জীবনের সাথে আপনাকে জড়িয়ে ফেলার জন্য সরি ম্যাডাম। না হওয়া বউটার দুঃখ কমিয়ে দিলাম আর কি। ওসব কথা বলতে চাচ্ছিনা প্লিজ…….
রাহা বাঁকা হয়ে গিয়ে মুখ লুকোতে চাইলো। বলল
জানালা দিয়ে শীত ঢুকছে। বন্ধ করে দিয়ে আসি।
তানজীব বাঁধা দিল। হাতের মুঠো করে ফুলের পাপড়ি এনে ছিটিয়ে দিল রাহার মুখে। রাহা চোখ খিঁচে বন্ধ করলো বন্ধ চোখের পাতায় পাপড়ি পড়ায়। নড়েচড়ে বলল…..
চোখ খুলতে পারব না তো।
তানজীব ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল
চোখ খুলতে হবে কেন?
ঠোঁটের উপর এসে পড়া পাপড়ি সরিয়ে দিতে রাহা হাত বাড়ানোর প্রস্তুতি নিতেই কড়াপড়া আঙুল আলিঙ্গনে জড়ালো তার আঙুলের সাথে।
মুখের উপর তপ্ত শ্বাসের আঁচড়ে, জঠরে বলিষ্ঠ হাতের বিচরণে গায়ে কাঁপুনি ধরলো তার।
অধরোষ্ঠে আটঁকে যাওয়া ফুলের পাপড়ি সরিয়ে নিল মেজর নিজের ওষ্ঠ দ্বারা। শুঁষে নিল সমস্ত কুন্ঠা আর জড়ত্ব। দূরত্ব কমিয়ে নিল, ঘুচিয়ে নিল পুরোপুরি।
প্রাণপুরুষের উষ্ণ ছোঁয়ায় থেকে থেকে কেঁপে নারী কোমলাঙ্গ। এক রহস্যময় রজনী কাটলো বিবশ গভীর নিস্পন্দ রাত্রিরে পুরোনে জংলী বাড়ির একটা ছোট্টঘরে।
এই স্বপ্ন স্বপ্ন ঘোর লাগা মুহূর্তগুলোর সমাপ্তি ঘটলো এয়ারপোর্টে। সন্ধ্যায় হাড়কাঁপানো শীতের মাঝে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে রাহা অধীর, রাহান, নোরাহ,মিনাদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখলো অনেকগুলো সেনা অফিসারদের মাঝে অফিসিয়াল আর্মি পোশাকে আবৃত মেজর যাওয়ার সময় মায়াভরা চাহনিতে তার দিকে কয়েকপল তাকিয়ে আবারও পুরোদমে হেঁটে চলে গেলেন। আর একবারও তাকালেন না। কোনো কথা বলে গেলেন না।
একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেই রাহার মনে পড়লো মেজর তাকে বলেনি কবে ফিরবে। অন্য চিন্তা, অভিমান, অনুরাগকে ঠাঁই না দিয়ে রাহার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো গত দুদিনের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া মানুষটার জন্য। তিনি যেপ্রান্তেই থাকুক না কেন যেন সুস্থ থাকেন। দ্রুত ফিরে আসেন প্রাণোর কাছে। অপেক্ষা যেন খুব দীর্ঘ না হয়। এখন তিনি প্রাণোর না হওয়া বর নন। প্রাণোর স্বামী।
চলবে
কমেন্ট চাই