#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_২১
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
রাত সাড়ে আটটা। জয়পুর উপজেলা পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সামনের গেইট দিয়ে শাঁ করে একটি প্রাইভেট কার ঢুকে এল। কর্মরত কনস্টেবল পা দিয়ে স্যালুট ঠুকে থেমে যাওয়া গাড়িটির দিকে তাকাতেই পরপর আরও তিন চারটা পুলিশের গাড়ি এসে থামলো কোয়ার্টারের সামনে।
কনস্টেবল দেখলেন সন্ধ্যায় যার এক্সিডেন্টের খবরে তুমুল ঝড় উঠেছিল পুরো শহরে সেই সেনা অফিসার নিজের কাঁচভাঙা প্রাইভেট কার থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে উদ্যত পায়ে হেঁটে ভেতরে চলে যাচ্ছেন। এক হাত বাঁধা গলায় ঝুলানো ব্যান্ডেজের সাথে। উনার থমথমে মুখ, গায়ে রক্তমাখা শার্ট, আর কঠিন চোয়ালের পেশি পরখ করতেই শুকনো ঢোল গলার নিচ বেয়ে নেমে গেল কনস্টেবলের। এত বড় দুঃসাহস দেখালো কে বাবা? তার তো আর নিস্তার নেই আজ।
সিবিও এবং আইপিএস অফিসারের ধ্যান ভাঙলো ভারী দরজা সরিয়ে আগত লম্বা চওড়া ছিপছিপে দেহের পুরুষ অবয়বটিকে দেখে। মনিটরের আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটিতে হালকা আলোর উপস্থিতি দেখে পুরুষ অবয়বটি এবার কথা বলে উঠলো
কতদূর এগোলো তানভীর? কোনো ক্লু পাওয়া গেছে?
আইপিএস অফিসার তানভীরুল হক এবং সিবিও অফিসার শেখ আরিফুল তৈয়মুর হতচকিত একে অপরের দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর আলো করে দিয়ে উৎকন্ঠিত গলায় বলল
কিন্তু স্যার আপনি এখানে? আপনি এত আঘাত পেয়েছেন।
আ’ম ওকে তানভীর। ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা সমস্ত মালবাহী ট্রাকের ডিটেইলস আমার চাই। রাইট নাউ।
আরিফুল তৈয়মুর একটি চেয়ার ঠেলে দিল। কালো রঙের ভারী ফাইল বাড়িয়ে দিয়ে বলল
এখানে সবার ডিটেইলস আছে স্যার। মোট সাতাশটি ট্রাক এ পর্যন্ত যাতায়াত করেছে। এবং যে ট্রাকটি আপনার গাড়িকে ধাক্কা মেরেছে সেই গাড়িটা কিছু আগেই আটক হয়েছে।
ওই ড্রাইভারকে সামনে চাই। যে করেই হোক।
তানভীর আর আরিফুল একে অপরের দিকে চাইলো। ততক্ষণে বাকি পুলিশ অফিসারের এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে।
আরিফ বলে উঠলো,
স্যার আমরা বলছিলাম কি। কেসটা যেহেতু আমাদের হাতে চলে এসেছো সেহেতু আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। You are badly injured. You need proper rest.
নো নিড টু এবাউট দ্যাট তৈয়মুর। ইউ জাস্ট ফোকাস অন ইয়োর ওয়ার্ক। আই ওয়ান্ট অল ইনফরমেশন অন দ্য কালপ্রিট।
সবাই হাল ছেড়ে দিল। মেজর স্যার যাবেন না তারা বুঝে গিয়েছেন।
পাথরকঠিন, নিস্পৃহ, নিস্তব্ধ মুখে ডানহাতে ধরে রাখা ফাইলের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মেজর আসামীর মুখোমুখি হওয়ার। এই কেস সলভ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই গ্রাম ছাড়বেন না। উনি তৌহিদ তাহমিদের সন্তান ঠিক তবে উনার মতোই অতটা সরল নন। এর শেষ দেখে ছাড়বেন উনি। কার হাত রয়েছে এর পেছনে? যদিও সিক্সথ সেন্স অনেক আগেই বুঝে গিয়েছে। এবার প্রমাণ হাতে আসার অপেক্ষা।
ক্রিংক্রিং শব্দে মাথার ঝিমিয়ে থাকা ব্যাথারা টনটনিয়ে উঠলো। ফোন তুলে কানে দিয়ে ওয়্যাররুমের বাইরে গেল তানজীব। ওপাশ থেকে অধীরের গলা ভেসে এল
শোন না দোস্ত, রাহাকে কি করব এখন? ওকে এভাবে রেখে চলে গিয়েছিস কেন? কিছুই তো বলিসনি।
চলে যেতে চাইলে গাড়িতে তুলে দে। এটা জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কেন?
অধীর কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। শান্ত গলায় বলল
চলে যেতে বলব মানে?
চলে যেতে বলবি। যেখানে যেতে চাচ্ছে। ওকে কে আটকাচ্ছে? নাকি আমি ধরে রেখেছি? আমি না আমার উপর জোরাজুরি করাটা পছন্দ করি, না আমি কারো উপর জোর করাটা পছন্দ করি। আমি কাজে আছি। রাখ।
ফোনটা কেটে গেল পিকপিক শব্দে। নিঃশ্বাস চেপে দাঁতে দাঁত চেপে ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দে গর্জে উঠলো মেজর। আরিফুল তৈয়মুর ছুটে এল। একটু পা নড়ে উঠতেই তার হাতের বাহু ধরে ফেলে বলল
স্যার আর ইউ ওকে?
একটু জিরোলো তানজীব। মোলায়েম গলায় বলল
পানি দিন।
এই পানি আনো জলদি। স্যার আপনি আগে বসুন। প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। এটা কোনো জটিল কেস নয়। ওরা ধরা দিতে বাধ্য। ওখানে এক্সপার্ট টিমের মেম্বাররা কাজ করছে। তারা আমাদের পয়ন্ট টু পয়ন্ট আপডেট দিচ্ছে। বসুন।
চুপচাপ শান্ত হয়ে মেজর চেয়ারে বসলেন। সেনানি জীবনের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আর পক্বতা এ কথায় সায় দিল না। ষড়যন্ত্রকারী এতটাও বাচ্চা নয় যে এত সহজে কেস সলভ করা যাবে। যখন মেজরের সাথে পাল্লা দিচ্ছে তখন নিশ্চয়ই আটঘাট বেঁধে নেমেছে।
তার দূরদর্শিতা আর বিচক্ষণতা দেখে চমকালো সবাই তখন যখন শুনলো ড্রাইভারটি মারা গিয়েছে অন্য এক ক্রিমিনালের হাতে।
সবাই মেজরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো ফোনের ওপাশ থেকে আগত বার্তা শুনে।
এখন কি হবে স্যার? যে ড্রাইভারটিকে ওই গাড়িতে পাওয়া গেছে ওটা যে আসল নয়। যে আপনার গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে সে তো মার্ডার্ড হয়ে গেছে অলরেডি ।
সবাই ভেবেছে নিশ্চয়ই মেজর স্যার তাদের বোকামির জন্য ভীষণ ক্রুদ্ধ হবেন। রেগে যাবেন। উনার পাথরকঠিন মুখাবয়বে তা স্পষ্ট কিন্তু উনি সবাইকে চমকে দিয়ে ভীষণ শান্ত গলায় বললেন
ওকে ফাইন। কালপ্রিটদের আমি চিনি। তাদের জব্দ করার রাস্তাও আমার জানা।
থ্যাংকস অল অফ ইউ। বাই ফর নাউ।
কিন্তু স্যার…
কারো কথা না শুনে মেজর বেরিয়ে গেলেন গাড়ি নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য।
সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো ভীষণ লজ্জায়। মেজর স্যারের তাদের উপর বিশ্বাস হালকা হয়ে গেল আজ। তবে তারা হাল ছাড়লো না । ক্রিমিনালদের কোনো না কোনো ক্লু অবশ্যই পাওয়া যাবে নিহত ড্রাইভারের শরীরে, ফোনকলে, অথবা বাড়িতে। কিন্তু মেজর স্যার কাদের চেনার কথা বললেন?
____________
তানজীবকে ফিরতে দেখে সবার প্রাণ ফিরে এল যেন। তার কাজে সবাই ভীষণ রেগে থাকলে কারো চোখেমুখে সেটা স্পষ্ট নয়। বরঞ্চ ভারী অভিমানে তলিয়ে গেল বয়স্ক মানুষগুলো। এতগুলো বছর বুকে আগলে মানুষ করার পরেও যে ছেলে তাদের বিশ্বাসের উপর এতটা আঘাত করে বসে সেখানে আর কিছু বলার নেই। এই মুহূর্তে তো কিছু বলাও যাবেনা। এত অসুস্থ তার উপর একরোখা জেদ তার। যা মনে হবে তাই করবে। কোনো পিছুটান আছে তার? ওই দুটো মানুষের মৃত্যুর সেই করুণ পরিণতি এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। কোথায় এর শেষ তারা জানেনা। শত্রুপক্ষের মেয়েকে ঘরে তোলা আর জেনেশুনে বিষপান সেই একই কথা। তার শারিরীক অবস্থার কথা ভেবে তার সামনে কেউ কিচ্ছুটি বলল না। বরঞ্চ সে নিজেই সবার মুখ পরিদর্শন করতে ব্যস্ত। কোনো ঘাপলা তো আছেই এরমধ্যে। এত বড় সত্যি জেনেও সবাই এত চুপচাপ।
সে এসেছে শুনে রাহা চলে এল সেখানে। মিনার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই তানজীবের চোখাচোখি হলো। যেন চোখ পড়ায় অনেক বড় ভুল করেছে ফেলেছে তানজীব এমন ভাবে চোখ ফিরিয়ে নিল দ্রুত। রাহার চোখমুখ ফোলা। আজকের মতো অসহায়, অবলা নিজেকে আর কখনো মনে হয়নি তার। এতক্ষণ সবাই তাকে কথা শোনাচ্ছিল এখন কেউ কেন বলছেনা তাকে তারা বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছেনা। কেন সবাই চুপ? ছেলের সামনে এখন ভং ধরার মানে কি? এ কোন ঝামেলায় ফেঁসে গেল সে? এসময় যার তার ভীষণ দরকার উনিও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বুকফাটা আর্তনাদে তার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই আশরাফ আর বড় জেঠুর উপস্থিতিতে সেখানেই যেন আটকে গেল সে। আলাভোলা চোখে আশরাফ তাকালো সবার দিকে। অধীরের কাছ থেকে চুপিসারে তানজীবের খোঁজ নিয়ে বলল
যেটা বলেছেন সেটা সত্যি?
অধীর তাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। অধীরের মুখ থেকে সবটা শুনে বাকহারা হয়ে পড়লো আশরাফ। বিশ্বাস হচ্ছে না তার বোন রাহা এমন কাজ করতে পারে। আজমল কবিরের তর্জন-গর্জনে কেঁপে উঠলো হাসপাতালের করিডোর। রাহাকে বললেন
মানইজ্জত সব ডুবিয়েই ছাড়লি না? তোর বাপ শুনলে হার্ট অ্যাটাক করবে। ছিঃ ছিঃ। তোর পছন্দ এত খারাপ। এত জঘন্য!
এই মুখ সামলে কথা বল। পছন্দ খারাপ মানে কি বুঝাতে চাইছিস? মেরে সোজা করে দেব শালা।
সাজ্জাদ শেখাওয়াতের চোখ রাঙানিতে আজমল কবির আরও গর্জে উঠলেন। রাহা পিছিয়ে গেল ভয়ে। তানজীব সেসব তোয়াক্কা না করে রাহার প্রতিক্রিয়া দেখতে ব্যস্ত। এত ভয় পেলে কে বলেছে ওইদিন হ্যা বলতে? কে বলেছে বিয়ের পিড়িতে বসতে? ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলো সে। কাউকে বুঝতে দিল না অবশ্য। এমনকি রাহাকেও না।
দুপক্ষের কথা কাটাকাটি এমনকি হাতাহাতিও লেগে যাওয়ার দশা। আশরাফ, অধীর আর রাহান মিলে সামলালো দুজনকে। হাসপাতালে কেউ কিছু বলতে পারলো না মেজর পরিবার আছে বলে। তবে আশেপাশে এসে জড়ো হলো পুরো হসপিটালের নার্স, ডাক্তার আর অনেকগুলো পেশেন্টের আত্নীয়স্বজন যারা পেশেন্টের সাথে এসেছে। দুপক্ষের দু বয়স্ক লোকের এমন গালাগালি আর হাতাহাতি দেখে সবাই বিস্মিত।
মিনা তানজীবকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিল বেঞ্চিতে। শান্তভাবে বুঝিয়ে বলল
ভাইয়া ওরা ক্ষেপে গেছে রাহার উপর। তুমি তো অবুঝ নও। রাহাকে বুঝো। ও ভয় পাচ্ছে তাই অমনটা বলেছে। ওকে রেখে যেওনা।
কোনো কথা না বলে চুপচাপ ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল তানজীব। ওদিকে একে অপরের গলাবাজিতে অস্থির হয়ে পড়লো সবাই।
ঝামেলার সমাপ্তি ঘটলো তখন যখন আশরাফ আমজাদ কবিরের সাথে কথা বলা শেষ করে এসে জানালো রাহাকে বাড়ি ফিরতে বারণ করেছেন তিনি। মেয়ের এমন হঠকারিতায় ভীষণ আঘাত পেয়েছেন তিনি। ভেঙে পড়েছেন এবার। এত এত যুদ্ধ তাহলে কেন? ওই ছেলে তার কাছে সব হয়ে গেল?
ঘোষনা করে দিলেন উনি, উনার শুধু দুসন্তান। আর একজন মরে গেছে। কবির বাড়ির দরজা তার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ। ভুলেও যেন আর সেদিকে পা না বাড়ায় রাহা। ভাইয়ের মুখে এমন কটুক্তি শুনে মাটির নিচে অর্ধেক গেঁড়ে গেল রাহা। আশরাফ কথাগুলো বলার সময় একবারও বোনের দিকে তাকায়নি। তার আদরের বোন এমন কাজ করেছে সেটা ভাবতেও তার লজ্জা লাগছে।
তারা চলে যাওয়ার সময় রাহা ভাইয়ের হাত ধরে বলল
ভাইয়া এভাবে যেও না। জেঠু তুমিও…
আজমল কবির কষে চড় বসালেন রাহার গালে। বললেন
ওই মুখে জেঠু ডাকবিনা। আমার মেয়ে নেই বলে কত আদর যত্নে বড় করেছি তোদের। ওই মুখে একদম জেঠু ডাকবিনা হারামজাদি।
এতক্ষণ চুপ করে থাকা তানজীবের চাপা রাগের রুদ্ধ গর্জন বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। রাহাকে টেনে তার পেছনে নিয়ে গিয়ে আজমল কবিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেমে থেমে হুমকিমেশানো গলায় বলল
ওর গায়ে হাত তুলছেন কোন সাহসে? অনেক সহ্য করেছি। বেরিয়ে যান এক্ষুণি।
বাপের মতো সেয়ানা হয়েছ? সেয়ানাগিরি তো আজ বের হয়ে যেত। তোমাকে আর তোমার এই চাচা জেঠাকে আমি দেখে নেব।
সেলিম সাহেব বললেন,
এই যাহ যাহ। কি করবি কর। কু** বাচ্চাদের জেলে ভরে দেব বেশি বাড়াবাড়ি করলে।
রাহান ধমক দিল।
চুপ করো আব্বা। মুখের ভাষার একি অবস্থা!
ভাষা শেখাতে আসিস না আমাকে। ওকে বল ওই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে।
রাহান কিছু বলার আগেই তানজীব কাঠকাঠ গলায় বলল
যেদিন স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে সেদিন বলো। ও আজ যাবেনা ওই বাড়িতে।
সেলিম সাহেব রাগের মাথায় এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। বললেন
মানার প্রশ্নেই আসেনা। এই মেয়েকে দেখলেই আমার ভাইয়ের খু*নীর চেহারা ভেসে উঠে। তুই সংসার কি করে করবি এই মেয়ের সাথে? এত শাপ নিয়ে কেউ সংসার করতে পারেনা।
রাহান এদের মুখ বন্ধ করতে বল।
মিনা চেঁচিয়ে উঠলো এবার।
তোমরা কি চুপ করবে একটু? এত অশান্তি আর ভালো লাগছেনা। ভাইয়ার এখন রেস্ট দরকার। কত রক্ত ঝড়েছে আজ। তোমরা মানুষ? কিসের শাপের কথা বলছ?
সবাই চুপচাপ চলে গেল এবার। সবাই চলে যেতেই রাহা বেঞ্চিতে বসে পড়লো।
হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ভেঙে পড়লো কান্নায়। তানজীব আঁড়চোখে তাকালো তার দিকে। আজ কি উদ্দেশ্য নিয়ে এল আর কি হয়ে গেল। পকেটে হাত রাখতেই পকেটের তলায় পড়ে থাকা গোলাপের পাপড়ি ছাড়া কিছু উঠে এল না। ফুলটা বোধহয় কোথাও পড়ে গিয়েছিল?
রাহার বিরতিহীন ফোঁপানির শব্দে আবারও মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো তার। তাকে এত কাঁদানোর উদ্দেশ্য তো তার ছিল না। তাহলে ও এইভাবে কাঁদছে কেন? আশ্চর্য!
সে দ্রুত প্রশ্ন করলো,
যাওয়া হচ্ছে নাকি আমাকে চলে যেতে হবে একা?
আনসার মি।
রাহার কান্না থেমে গেল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলো সে। চুপচাপ দাঁড়ালো ঠিক কিন্তু তাকালো না, জবাব দিল না। তানজীব তার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল। হাতের মুঠোয় থাকা হাতটা জোরে চেপে দিয়ে বুঝাতে চাইলো তার উপর রেগে থাকা যাবেনা। কথা বলা বন্ধ করা যাবেনা। সারাদিনের ক্লান্তি, অবসন্নতা, চিন্তা,একের পর এক ঘটনা, সারাদিনের অভুক্ত পেটে খিদের তাড়নায় গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো রাহা। ঘুমের ভেতরও তার চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল তা পুরোটা পথ পরখ করেছে তানজীব।
নিজ বাড়িতে ফিরতেই রমিজ মিয়া আর উনার স্ত্রী ছুটে এল। তানজীবকে নামতে দেখে তিনি আবেগি হয়ে পড়লেন। দুশ্চিন্তা নিয়ে বলল
বাবু আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া জানাইছি। আল্লাহ বাঁচাইছে। কে তোমারে বলছে ওই গেরামে যাইতে? তুমি জানোনা ওই গেরামটা ভালো না। তোমার মেলা শত্রু আছে ওইখানে। কেন গেলা বাবু? কি অবস্থা হলো তোমার। আল্লাহ কত রক্ত ঝড়ছে। হাত কি ভাঙছে। মাথায় কি বেশি লাগছে?
বলতে বলতেই উনার চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো না। আমেনা বিবি শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজলেন। এই ছেলেটা না থাকলে আজ উনাদের পথে বসতে হতো। তার এমন দশায় যেন নিজেদের ভেতরটা কাঁপে।
পরক্ষণে গাড়ির অপর সিটে মেয়েমানুষটিকে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলো তারা।
এইডা কে বাবু? ওমা!
তানজীব গাড়ির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বোতল খুঁজে নিল। শরীরটা ঠিকঠাক থাকলে ঘুম থেকে জাগাতে হতো না রাহাকে। বোতল খুলে দেওয়ার জন্য বাড়িয়ে দিয়ে বলল
বৌমা। আজ থেকে আপনাদের সাথে থাকবে। রান্না বান্না করা আছে?
তারা বিস্ময় চেপে মাথা দুলালো দ্রুত। পরে প্রশ্ন করবেন এই ভেবে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আবারও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন
এ কোন হতভাগী?
পানির ছিঁটে পড়ায় চমকে চোখ খুললো রাহা। গাড়ি থেকে নেমে রমিজ মিয়া আর আমেনা বিবিকে দেখে একটু অবাক চোখে চাইলো। তানজীব চলে গেল সোজা। আমেনা বিবি বললেন
আসো আসো বউ। আমারে চাচী ডাকে তোমার জামাই। তোমারে কোথায় যেন দেখছি!
রাহা একটা জবাবও দিল না। বাড়িটা তার চেনা। পাশের বিল্ডিংয়ে ভাড়াটে ছিল তারা কিছুদিন। তবে বাড়ির ভেতরটা আজ দেখলো। ভারী সুন্দর। বোঝা যায় অনেক স্থূল মনের মানুষের মাধুরী মিশে রয়েছে। রাহার ভাবতেই অবাক লাগলো এটা তার শ্বশুর বাড়ি। একটা শ্বাশুড়ি নেই, শ্বশুর নেই। মেজর চলে গেলে সে একা থাকবে? আর এরা কারা?
ফেরার সময় রাহার জন্য অনেক কেনাকাটা করেছিল তানজীব। বিয়ের সময় কিছু দিতে পারেনি তাই বেশ কেনাকাটা করেছে সে। শাড়ি থেকে শুরু করে কসমেটিকস যা যা লিস্ট করে দিয়েছে মিনি। লাগেজ থেকে আমেনা বেগমের সাহায্য শাড়ি বের করে দিল সে। বলল যাতে রাহাকে ফ্রেশ হয়ে এটা পড়তে বলে। তারপর খাওয়াদাওয়া করে নেয়। সে আর একবারও রাহার সামনে যায়নি ।
আমেনা বেগম শাড়ি দিতে গেল। ভাবলো বউটা কথা বলবে। চুপচাপ শাড়িটা নিল সে। কথা বললো না কোনো। তাই তিনি তানজীবকে গিয়ে বললেন
বউ কথা বলতে জানেনা আব্বা?
তানজীব চমকালো এমন প্রশ্নে। পরে বলল
আরেহ না। কথা বলতে জানবে না কেন? জানে।
ওহ। তুমি কি বকাটকা দিছোনি? চোখমুখ দেইখা তো ওটা মনে হইতেছে।
অনেক কিছু হয়েছে। আপনাদের পরে বলব। আপাতত ওকে কিছু খাইয়ে দিন। ঘুমিয়ে পড়ুক।
তুমি খাবানা? ওই বাড়ি থেকে ফোন আসতেছে। তোমার ঔষধ ঠিকমতো।
ওসব চিন্তা করবেন না। আমি খেয়ে নেব।
আগে ওকে খেতে বলুন। খাবেনা বললে বলবেন কাল সকালে আমি চলে যাব।
আমেনা বিবি হাসলেন এমন কথায়।
চলে যাবা বললে খাইবো?
তানজীব মাথা দুলালো।
খাবার নিয়ে যাওয়ার পর রাহা চুপচাপ খেল। আমেনা বিবি তার আচরণে আরেকদফা চমকালো। এমা বউটা এবারও কিছু বললো না?
তিনি তানজীবের কাছে আবারও গেলেন। সে বারান্দার চেয়ারে বসা ছিল।
আব্বা বউ সত্যি কথা বলতে জানেনা।
তানজীব এসট্রে ঠেলে দিয়ে বলল
কে বলল?
আমার লগে কোনো কথা বলেনাই। কোনো সাড়াশব্দ নাই। এ কেমন বউ?
তানজীব উনাকে বুঝিয়ে কূল পেল না। বুঝে পেল না প্রাণোর একটু কথা বললে কি হয়? মেয়েটা তার চাইতেও বেশি জেদী।
খাওয়া দাওয়া শেষে পেটে ঔষধ পরার পরপর পুরো শরীর ব্যাথায় টনটন করতে লাগলো তানজীবের। মাথায় আরও ব্যাথা। ভোঁ ভোঁ শব্দ। মাথা ঝিমঝিম করছে পাওয়ারি ঔষধের গরমে। রাহা গুটিসুটি মেরে এককোণায় শোয়া। গায়ের সাথে খয়েরী রঙা শাড়িটা জড়ানো। কিছুক্ষণ পরপর ফোঁপানির শব্দ নিরিবিলি ফাঁকা ঘরে আওয়াজ তুলছে। তানজীব পাশে গিয়ে পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লো। বলল
হাত পা ছোড়াছুড়ির অভ্যাস থাকলে সাবধান। নইলে তুলকালাম ঘটবে।
রাহা ফোঁপানি বন্ধ করলো।
আমি হাত পা ছুঁড়ি না।
আওয়াজ বেরোলো এতক্ষণে।
রাহা আরেকবার নাক টানলো। তানজীব বালিশ নিচু করে শুতে গিয়ে হাতের ব্যাথায় কাতর স্বরে আওয়াজ করে উঠলো। খানিকটা ইচ্ছে করে।
রাহা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। তানজীব গা এলিয়ে বলল
ওভাবে দেখার কি আছে? আপনার জন্যই তো এই দশা।
রাহা গরম চোখে চাইলো। তানজীব অনেকক্ষণ পর একটু হাসলো। বলল
এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। এত সমস্যা হলে থাকার দরকার নেই। দরজা সবসময় খোলা।
রাহার রক্তগরম হয়ে এল এবার। একদম তেড়ে গিয়ে বলল
একদম ফালতু কথা বলবেন না। আমি কি কি করেছি তা একবারও ভেবেছেন? আপনার এককথায় রাজী হয়েছি। তারপরও উল্টো রাগ দেখান কাকে? আমাকে চেতালে ভালো হবে না।
তানজীব ভুরু উঁচিয়ে বলল
আচ্ছা? চেতালে কি হবে?
দাঁতে দাঁত চেপে রাখলো রাহা। তানজীব আরও আয়েশ করে শুয়ে বলল
সাহস থাকলে কিছু করে দেখান দেখি। কাছে আসেন। ঝগড়া মুখোমুখি হওয়া ভালো।
রাহা এল না। ফিরে গিয়ে বলল
সবসময় আমি ভুল করি। আমি। শুরু থেকেই আমাকে ভুল বুঝেছেন। এখনো। অথচ আমি কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেটা একবারও ভাবেননি। আপনার কাছে আপনার ইচ্ছে আর জেদটাই সব।
কি আশ্চর্য! চার পাঁচ মাস পর দেখা হলো। আমার সাথে আসতে বললাম। আসব না বললে রাগ হবেনা?
রাহা এবার চুপ হয়ে গেল। চার পাঁচ মাস কথাটা কানে বাজতেই মনে পড়লো এই দিনটার কথা ভেবে সে এতগুলো প্রহর গুনেছে। ধোঁয়াশা পাহাড়ি এলাকার অমন সন্ধ্যায় কিংবা রাতের মতো স্বপ্ন স্বপ্ন ঘোরে নয়, একদম চোখমেলে তাকিয়ে সে দেখবে মেজরকে। কতশত গল্পগুজব করবে। চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বলবে। প্রথমত খুব কাছে গিয়ে আগে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। অথচ পরিস্থিতি সবটা এলোমেলো করে দিল। এত কাছাকাছি থেকেও দূরত্ব রেখে চলতে হচ্ছে। দোষ তো উনার। রাহার মনের অবস্থা কি হতে পারে সেটা কি উনি বুঝেন না?
প্রাণো শোনো!
রাহা চমকালো এবার। নামটা কতই না ভালোবেসে ডাকে। সে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনা।
এদিকে এসো। এই প্রাণো!
রাহা ঘাড় ঘুরালো এবার। পুরোপুরি ফিরে বলল
কি হয়েছে?
এদিকে এসো না। হাতটা বাঁধা নইলে..
রাগে তার চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। রাহা ভয়ে পেয়ে একটু কাছে গেল। বলল
কি হয়েছে? কথায় কথায় রাগ ঝাড়বেন না।
তানজীব সে কথার জবাব দিল না।
ব্যান্ডেজ দেখিয়ে বলল
এটা খুলে দাও আস্তে আস্তে। হাতে কিছু হয়নি। বুকের জন্য হাত বেঁধে দিয়েছে ।
মাথা খারাপ! হাত নড়াচড়া করলে বুকের ক্ষতি হবে। মাথা নষ্ট।
খুলে দাও বলছি।
মেজর! উফফ!
রাহা আবারও ফিরে শুলো।
তানজীব বলল
তাহলে আমি খুলছি।
রাহা দ্রুত তার হাতটা ধরলো। বলল
বাড়াবাড়ি করবেন না মেজর। এসব কেমন আবদার?
তাহলে দূরে থাকছো কেন?
রাহা চক্ষু শীতল হলো একটু। তার বালিশে মাথা রেখে বলল
এখন ঠিক আছে।
তানজীব হাসলো একটুখানি।
বলল
আরেকটা আবদার।
রাহা মাথা উঁচু করে বলল
কি?
আরেকটু আসতে হবে।
রাহা কপাল কুঁচকালো।
আসো না। না আসলে বলব কি করে।
রাহা মাথা তুললো। ওর মুখের কান রেখে বলল
কি?
দুজনেই কিছুক্ষণ থেমে রইলো একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসায়। মেয়েলি মিষ্টি সুবাসের ঘ্রাণে চোখ বন্ধ করে নিল মেজর। প্রবল দাবদাহে রাহার কানে চুম্বন করে বলল
আই মিসড ইউ ম্যাডাম।
রাহা কেঁপে উঠলো কানে হাত চেপে।
তানজীব ডান হাতটা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো তাকে। জানতে চাইলো,
ডোন্ট ইউ?
রাহা ফুঁপিয়ে উঠে মাথা দুলালো। তানজীব হাসলো। বলল
আরেকটা আবদার।
রাহা প্রশ্ন করলো।
আবার কি?
ডান হাতটা দিয়ে রাহার মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিল সে। কানের পেছনে হাত গলিয়ে টেনে এনে গালের পাশে গভীর চুম্বন খেল। সারামুখে অসংখ্য চুম্বনচিহ্ন আঁকলো। প্রাণপুরুষের এমন বলিষ্ঠ রুক্ষ শুষ্ক ঠোঁটের গূঢ় প্রলেপ রাহার অপেক্ষা নামক অসুখের একমাত্র আরোগ্য। কিছু আবদার তোলা থাকলো, কিছু আবদার ঠোঁটের স্পর্শে বলা হলো।
চলবে,
রিচেক করা হয়নি