#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
শ্যামকালো ঘর্মাক্ত চেহারাটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবির নিচে দেহ আচ্ছাদিত সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটাসহ সাদা পাতলা পাঞ্জাবি পিঠে লেপ্টে রয়েছে। কপালের কাছটায় পড়ে রয়েছে কয়েকটা ভেজা অবহেলিত চুল। মাংসল কব্জিতে সিলভার রঙের ঘড়িটি রোদের আলো পড়ায় ঝকঝকে দেখাচ্ছে।
বিশিষ্ট তরুণ সমাজসেবক আজমীর রায়হানের দ্বিতীয় পুত্র অধীর রায়হান পিতৃকুলের রেস্টুরেন্ট ব্যবসার দেখাশোনা করেন সমাজসেবা আর রাজনৈতিক কাজকর্মের পাশাপাশি । শহরের অলি গলিতে ছোটবড় রেস্টুরেন্টগুলো ওনাদের। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা আর ও কয়েকটি জেলায় কাপড়ের দোকান রয়েছে। সেগুলো ও তারই তত্ত্বাবধানে চলছে বর্তমানে । নিজ কাজ করার পর সময় বের করে সেগুলো দেখাশোনা করেন অধীর রায়হান। মা জননী তার সমাজসেবা তথা রাজনৈতিক কাজকর্ম বেশ অপছন্দ করেন বিধায় ইদানীং তিনি খেয়াল করেছেন ব্যবসার দেখাশোনা শুরু করে মাকে আপাততপক্ষে চুপ করা্ দরকার। এতে যেমন পিতৃব্যবসার মঙ্গল বয়ে আনবে অন্যদিকে মায়ের দুশ্চিন্তা তথা ঘরে যেতে না যেতেই মায়ের খ্যাটখ্যাটানি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
অধীর ভাই ম্যানাজার সাহেব হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছে। কোনো সমস্যা না। সব ঠিকঠাক।
দূর থেকে হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে ডেকে বলল অধীরকে।
ঠিক আছে। চলে আয়। বাড়িতে কয়েকটা পায়েসের বাটি পাঠিয়ে দে। আম্মা খেতে চাইলো। তোর যা লাগে নিয়ে বাড়ি চলে যাহ। সন্ধ্যে সন্ধ্যে চলে আসিস। আমার মার্কেটের দিকে যেতে হবে।
মার্কেটে কেন ভাই?
অধীর ধৈর্য হারা গলায় বলল
এত প্রশ্ন করিস কেন? যেটা বলছি সেটা কর। আমি তোর কথার জবাব দেওয়ার জন্য বসে আছি শালা ?
বজ্রগম্ভীর স্বরে কথাটা বলে চোখগরম করে চাইলো সে। যেন এটুকু বলতেই মহাবিরক্ত হয়ে উঠেছে সে।
সুড়সুড় করে হাঁটা ধরলো রবিন নামের অল্পবয়সী ছেলেটি। অধীর ভাই হুটহাট রেগে যায় কেন কিছুই বুঝে পায় না সে।
ফোনের দোকানে ভীড়। কোলাহল। কয়েকজন দোকানি তাকে দেখে ডাকা শুরু করলো
আরেহ, অধীর ভাই যে! কি খবর ভাই? এদিকে আসেন। ও অধীর ভাই!
অধীর হাত দেখিয়ে শান্ত হতে বলে ফোন কানে দিয়ে অন্যপথে বারংবার হাঁটতে লাগলো।
পরপর কয়েকবার রিং হতে হতে হতে ফোন কেটে গেল। তারপর কয়েক মিনিট অনবরত ফোনকল যাওয়া ফোনটির অপরপ্রান্ত থেকে রিনরিনে গলার স্বরটি ভেসে এল।
আসসালামু আলাইকুম। সরি লেট হওয়ায়। রাহা ফোন ধরছিল না। ওর নাকি লজ্জা করে আপনার সাথে কথা বলতে। আমি কাপড় শুকোতে গিয়েছিলাম ছাদে।
ওয়ালাইকুমুস সালাম। কিন্তু এত লজ্জা পেলে কি করে চলবে রাহার? পাশে আছে?
নোরাহ সারাহ’র দিকে ফিরে তাকালো। ইশারায় বলল
তোর সাথে মেবি কথা বলতে চাই।
সারাহ দূরে পিছিয়ে গেল।
এই না না। আমি কথা বলব না। তোর বরের সাথে আমার কিসের কথা?
কি ফিসফিস করছেন দুজন?
নোহা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
সরি। ওকে বলছিলাম কথা বলতে।
হ্যা ফোনটা দিন। এত লজ্জা পেলে চলবে না।
নোরাহ হেসে বলল
থাক বাদ দিন। ও কথা বলবে না। দূরে চলে গেছে।
আচ্ছা আমি ফোনের শোরুমে আছি। কোন ফোনটা পাঠাবো? নইলে রাহাকে বলতে বলুন। কুইকলি বলুন।
নোরাহ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো এত তাড়া হলে কে বলল আসতে? কালকে যে ছবি পাঠিয়েছিল শাড়ি পড়ে তারপর তো কিছুই বলল না। কেমন মানুষ!
নোরাহ চুপ করে থাকলো আলতো অভিমানে।
লাগবে না বলেছিলাম আপনাকে। আমার এখন ফোন চাই না। যেটা আছে সেটাই যথেষ্ট।
আপনি কি বলবেন কোন ফোনটা নিতে চান?
ঠান্ডা গলায় কাঠ কাঠ আদেশী সুর।
নোরা চুপ থাকবেন না। নোরাহ!
বললাম তো ফোন চাই না আমার। আচ্ছা আমি আপনার সাথে গিয়ে কিনব। প্রমিজ।
পাক্কা?
একদম।
তারপর দু’পক্ষের আর কেউ কথা বলল না। অনেক্ক্ষণ পর নোরা মিনমিন করে বলল,
নেতা সাহেব যে পরিমাণ ব্যস্ত থাকেন !
ওপাশ থেকে দরাজ গলায় হাসি বের হয়ে এল। ততক্ষণে অধীর রিকশায় চেপে বসেছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে।
আম্মা আজকে সকালে ও একথা বলছিলেন। তোর বউ দুদিন ও থাকবে না।
নোরা হেসে উঠলো।
ঠিকই বলেছে।
আমি ভয় পাচ্ছিনা ম্যাডাম। দুদিন থাকবেন কি থাকবেন না সেটা পরের কথা। আমি আপনাকে দুদন্ড ও চোখের আড়াল হতে দিচ্ছি না। আমার সাধনার বউ।
ফোনটা সাথে সাথেই কেন যেন কেটে গেল। নোরাহ কি লজ্জা পেল?
সারাহ পেট চেপে হাসতে হাসতে বলল
বউ পাগল জামাই। হি হি।
নোরাহ তাকে হাতের ভেজা গামছা দিয়ে মারতে গেলে সারাহ দৌড়ে পালালো। দু বোনের ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইলো মেঝেতে বসে টিংটিংয়ের সাথে খেলা করা বাড়ির ছোট সদস্যটি।
নোরাহর ফোন কেটে দেওয়ার বিষয়টা অধীরের বুদ্ধিভর্তি মাথায় কিছুই ঢুকলো না।
বাড়িতে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই বাড়ির সবাই হামলে পড়লো যেন তার উপর।
মা এসে বললেন
কিরে অধীর? তুই নাকি তোর আব্বাকে বিয়ের দিনতারিখ নিয়ে কিছু বলিসনি? কেন? বিয়েটা কি তুই করবি না? ওই মেয়েকে বিয়ে করবি বলে তো অনেক লাফিয়েছিস এখন চুপ কেন?
অধীর সোফায় গিয়ে বসলো গা এলিয়ে। বলল,
আমার কোনো দোষ নেই আম্মা। সব দোষ আর্মি ম্যানের। রাহান আর ওকে ছাড়া আমি কোনো অকেশন নামাতে পারব না। সেটা তুমি ও জানো, আব্বা ও জানে। ও আসুক
বন্ধু সহোদরা অতঃপর বড় ভাইয়ের স্ত্রী রোহিনী এগিয়ে এল। বলল
অধীর ভাই, ভাইয়া তো আমাকে ফোন করেছিল সকালবেলা।
তানজীব ভাই নাকি কোন একটা অপারেশন শেষ হলেই চলে আসবে। আর কয়েকটা দিন বাকি। মিনা ও একই কথা বললো।
শালা বহুত জ্বালা জ্বালাচ্ছে। বিয়ে বিলম্ব করার অপরাধে আর্মি ম্যানকে কি শাস্তি দেওয়া যেতে পারে বলোতো ভাবি? চাচ্চু তুমি বলো।
রোহিনীর কোল থেকে চাচার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো চার বছরের বাচ্চাটি।
বলল
মারি মারি।
সবাই হেসে উঠলো তার কথায়। মা আনতারা হৈচৈ করে উঠে বললেন
আরেহ আরেহ গোসলে যাহ। আজান পড়ছে শুনছিস না?
_________________
গোসলটা সেড়ে ভেঁজা তোয়ালেটা বারান্দার রেলিঙে মেলে দিতেই খটখট পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিনা। সাদা এপ্রোণ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা চিকন ফ্রেমের চশমা পরিহিত সৌম্যদর্শন ডাক্তারকে দেখে চমকালে ও চেহারা তা না ফুটিয়ে মৃদুহেসে হাত বাড়িয়ে এপ্রোনটা আর ব্যাগটা নিয়ে বলল
এত তাড়াতাড়ি আজকে? কোনো সমস্যা?
কোনো সমস্যা না মিনি। বিয়ের পর তোকে তো বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর যাওয়া হয়নি। আজকে তোকে নিয়ে ঘুরতে যাব। যাবি?
নাহ।
বলেই ঘরের দিকে পা বাড়ালো মিনা।
কেন কেন?
মিনার পেছন পেছন ছুটলো রাহান।
যাবিনা কেন?
এপ্রোণটা সাদা দেয়ালের এপাশ থেকে ওপাশ দিয়ে টানা রশির উপর ঝুলিয়ে দিয়ে বলল
জেম্মা বকাবকি করবে। শুধু শুধু অশান্তি।
আরেহ আম্মার বয়স হচ্ছে তাই এরকম বকাবকি করে। তুই ওসব ধরে বসে থাকিস কেন? আমি যাব। তুই ও যাবি। কেমন?
বাচ্চাদের মতো আবদার! মিনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ঠোঁটের কোণায় হাসি টেনে বলল
নাহ।
কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইলো রাহান। মিনা হেসে উঠলো।
চোখের চশমাটা খুলে নিতে নিতে বলল
অন্য একদিন। ভাইয়া আসুক। তারপর সবাই মিলে বেড়াতে যাব।
সে তো সবাই মিলে। আজ তোকে একা নিয়ে যাব। যাবই যাব।
চশমাটা নিয়ে চলেই যাচ্ছিল মিনা। রাহান আষ্টেপৃষ্টে বাহুডোরে বেঁধে নিল তার কোমর । মিনার পা হালকা মেঝে থেকে একটু উপরে উঠে গেল বটে।
টাল সামলতে না পেরে রাহানের গলা ঝাপটে ধরে মিনমিন করে আতঙ্কিত গলায় বলল
কি করছেন? দরজাটা খোলা।
দু বাহুর চাপ দিল রাহান। গালে নাক ঘষে বলল
যাবি বল। বল বল।
উহু। ছাড়েন। উফফ। আল্লাহ কেউ আসলে কি হবে?
রাহান ছাড়লো না।
আর ও একটু তুলে নিয়ে দু পা হেঁটে গলার পাশে ঘন ভেজা চুলগুলোতে মুখ ডুবিয়ে বলল
যাব কেমন?
যাব বললে ছাড়বেন?
নাহ। যাব না বললে ও ছাড়ব না।
চলবে,
বেশি লিখতে পারিনি। কাল থেকে বড় বড় দেব।