#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_৯
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
একটা ছোট বাচ্চা ছেলের হাতে নিজের বাম পায়ের জুতোটা দেখে ছুটে গেল রাহা। একপ্রকার কেড়ে নিয়ে জুতোটা পায়ে দিতেই পেছন থেকে ভারী গলাটা ভেসে এল।
চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রাহা। শুকনো ঢোক গিললো দ্রুত। আমতাআমতা করে কয়েক পা দূরে গেল আর ও। ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে বলল
আপনি পুলিশের লোক?
কপালের মধ্যিখানে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো তানজীবের। ডান হাতটা ঘাড়ে বুলিয়ে বলল
কি মনে হয়?
রাহা আবার ও কয়েক পা দৌড়ে গেল। আবার থামলো। বলল
পুলিশের লোকের কাছেই তো পিস্তল থাকে। নইলে ডাকাতদের, সরি সন্ত্রাসদের। আপনি তো সন্ত্রাস না তারমানে পুলিশ?
আইনের লোক বলা যায়।
হুহ, এজন্যই তো এমন। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আপনি পুলিশ। সেজন্যই এত বদ..মা.শশ….
হোয়াট?
মৃদু কেঁপে উঠলো রাহা। কয়েক পা দূরে গিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল
আমি পুলিশদের একদম দেখতে পাই না। আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে পুলিশ। আপনার সাথে এতক্ষণ কথা বলেছি এই বেশি।
তানজীবের ভ্রুকুটি আর গাঁঢ় হলো। পুলিশ আবার তাকে কি করলো?
ভাবনার রেশ কাটতেই তানজীব দেখলো মেয়েটা হাওয়া। ফুঁস করে দম ছাড়লো সে।
তারপর অধীরকে খুঁজতে লাগলো।
____________
তোমার হাতের মেহেদী খুবই সুন্দর হয়েছে? কে পড়িয়েছে?
নোরার হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আবেগে জড়িয়ে আসা গলায় মিনা একথা দুবার বলে বসলো।
নোরাহ হেসে বলল
ওই রাহার বান্ধবী দুটো। মিলি আর মেঘনা।
নোরার হাতের তালুতে নিজের হাতের তালু মিশালো মিনা। বারবার চোখ তুলে নোরাকে দেখতে দেখতে বলল
বিয়ের পর আমি তোমাকে ভাবি না ডেকে নাম ধরে ডাকলে ভালো হবে না? আমরা তো একই বয়সী। কি বলো?
নোরা এবার মৃদু হাসলো। হাতদুটো একদম শক্ত করে ধরে সন্দিগ্ধ গলায় বলল
কে তুমি?
সানজু চোখ বড় বড় করে মিনার দিকে চাইলো। রোহিনী হেসে বলল
ও তোমার বরের বন্ধুর বউ। আর এটা ননদিনী। আর আমি তোমার জা।
নোরাহ আশ্চর্য হয়ে বলল
আরেহ যাহ, আমাকে আগে বলবেন না। সবাই লুকোচুরি করছে আমার সাথে।
সানজু বলল
এখন যে মেয়েটার সাথে ধাক্কা লাগলো আমাদের সে ভাবির বোনটা। তাই না ছোট আপা?
মিনা ছোট্ট করে আওয়াজ করলো। তার কথা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে।
নোরাকে বলল
তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরব? একটু।
নোরাহ হেসে বলল
এটা জিজ্ঞেস করতে হয়?
মিনা একদম চেপে জড়িয়ে ধরলো। তার বুকের ভেতর কেমন যেন এক অদ্ভুত শব্দের বাজনা বেজে চলেছে।
নোরাহ নিজে ও বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। মেয়েটাকে কেমন আপন আপন লাগছে সেই প্রথম থেকে।
তোমার নামটা তো বললে না।
মিনা সাথে সাথে ছেড়ে দিল। চোখের কোণা মুছে স্টেজ থেকে নেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে আঁখিজলে হেসে বলল
আমি মিনা।
তারপর আর একমুহূর্ত ও দাঁড়ালো না সে। বুকটা এত ভার হয়ে গিয়েছে তার। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।
যেতে যেতে কিছুক্ষণের আগের মেয়েটির সাথে আবার দেখা।
এমা আপনি কাঁদছেন কেন?
মিনা আবার ও চোখের কোণা মুছলো। রাহার মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলল
তোমাকে কোন নামে ডাকব? সারাহ? রাহা? প্রাণো?
রাহা চমকে উঠলো। দুলে উঠলো তার সারা তনু। স্থির দুটো চোখ মিনার মুখের প্রতিটা পরাবর্তন পড়ে নিচ্ছে। সন্দিগ্ধ গলায় থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলো সে
কে আপনি?
রাজুর বোনের নাম কি জানো?
কিহ? ওহ হ্যা মিনা। মিনা!
মিনা হেসে কয়েকদূর পর্যন্ত গেল। ঘাড় ঘুরালো রাহার কথায়
তুমি মিনা!
মিনা হাস্যজ্জ্বল চেহারায় তাকালো। চোখের কোণা মুছতে মুছতে বলল
আমাকে আপা না ডাকলে জরিমানা হবে। আমি তোর দু’বছরের বড় প্রাণো। কান ধরে ওঠবস করার কথা মনে আছে?
বুকের ভেতরটাতে মোচড়ে উঠলো । গুড়মুড় করে কি যেন ভাঙার আওয়াজ হলো। ঠোঁট ভেঙে এল রাহার।
জড়িত পায়ে হেঁটে সামনে যেতেই মিনা দৌড়ে চলে গেল।
রাহা ডেকে বলল
পালাচ্ছ কেন? আমরা তো অপরাধী নই।
__________________
বেজমেন্টে একটা কোণা দখল করে রয়েছে রায়হানি পরিবার আর শেখাওয়াত পরিবারের পুরুষ সদস্য। সাজ্জাদ শেখাওয়াত ও সেলিম শেখাওয়াত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। রাহান তাদের পেছনে। বাবা চাচাকে পাহাড়া দিয়ে রাখতে হচ্ছে। কখন কি জানি করে বসে ক্রোধের নিমিত্তে।
কিন্তু যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই ঘটে গেল তাদের
অজ্ঞাতে। বাবা চাচারা মুখ খোলার আগেই অধীরের ছোট মামা আর বড় ফুপাকে সেই ভৈরব দোর্দন্ড অতীতের কাহিনী শুনিয়ে কান ঝালাই করিয়ে দিয়েছে কনে পক্ষের দাওয়াত খেতে আসা এক গ্রামের লোক। যদিও সেই ঘটনার পর লোকটাকে আর ক্লাবের আশেপাশে দেখা যায়নি।
বাতাসের চাইতে দ্রুত গতিতে কথাটা রটে গেল পুরো ক্লাবের বরপক্ষের লোকজনের কাছে। মুখে মুখে চুগল করা কিছু মহিলা অধীরের মায়ের কানের কাছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে বলে উঠলো
কেমন পরিবারের মেয়ে ঘরে তুলছ কে জানে বাবা? তাদের পূর্বপুরুষ, আর বাপ জ্যাঠা তো ভালো না। লোকে খুনীর পরিবার বলেই চেনে যতই জমিদার হোক ওরা। খারাপ তো খারাপই। ওসব নবাব জমিদারগুলোই যত নষ্টের মূল ছিল তখন। সাদিকের মা তোমার ছোট ছেলের কপাল পুড়লো তবে। আহারে ছেলেটা কত মানুষের কত ভালো করে। তার বেলায় এমন,,,
আনতারা বেগম চুপ করে থাকলেন। অধীরের বড় ফুপু ধমক দিলেন।
চোপ চোপ । আমরা কেউ আগে জানতাম নাকি? ওনারা তো ভারী অন্যায় করেছেন এসব লুকিয়ে। অবশ্য নিজের অপকীর্তির গান কে করে?
আনতারা বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন। কত কাহিনীর পর তার ছেলেটার মনে একটা মেয়ে ধরলো। আর তাতেই এত খুঁত। তার ছেলের কপালটাই খারাপ।
তিনি ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে উঠলেন।
রাজিয়া বেগম দূর থেকে উনাকে ফুঁপাতে দেখে ছুটে এলেন। অস্থির হয়ে বললেন
বেয়াইন শরীর খারাপ লাগছে? পানি দেব?
অধীরের ছোট ফুপু নাছিমা বেগম ক্রুর হেসে বললেন
ও পানি টানিতে হবে না। যত নষ্টের মূল আপনারা। ছিঃ আমার ভাইপোটা এভাবে ঠকে গেল। আপনাদের ভালো ভেবেছিলাম।
আনতারা বেগম ফুঁপিয়ে বলে উঠলেন,
আমি বারবার বলেছিলাম ভালো করে খোঁজ খবর নাও। আমার সংসারে আগুন না লাগালে তোমার ভাইয়ের হচ্ছিল না।
বড় ফুপু আছিয়া ক্রোধে চেঁচিয়ে বলেন
আমার ভাইয়ের দোষ দিওনা ভাবি। সব এনাদের দোষ।
রাজিয়া বেগম ওড়নার কোণা টেনে মুখে পুড়লেন। কিছু নটখটের অভিশঁকা টের পেতেই উনার হৃদস্পনন্দের গতি কমে গেছে কয়েকগুন। জড়িত পায়ে হেঁটে যেতে যেতে উনার রুক্ষ শুষ্ক ঠোঁট ছিঁড়ে বেরিয়ে এল,
না না ওই অভিশাপের কলঙ্ক আমার নিষ্পাপ মেয়েটার গায়ে লাগতে পারে না।
*******
এসি থাকা স্বত্বে ও কুলকুল করে ঘামছে অধীর। তানজীবের সাথে হেঁটে বেজমেন্টে চলে এল সে জরুরৎ ডাক শুনে। আব্বা তাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছে ? আজ বিপদ যেন পিছু ছাড়ছেনা। একটার পর একটা।
অতঃপর আসামাত্রই সকলের মুখে সমুদয় ঘটনা শুনে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। চোখদুটো উদ্দেশ্যহীন ভাবে নিবদ্ধ দূরে কোথাও। তানজীব চোয়াল শক্ত করে সেলিম শেখওয়াত ও সাজ্জাদ শেখাওয়াতের দিকে তাকালো।
উনারা নিষ্পাপ ভঙ্গিতে তাকালো। রাহান ইশারায় আশ্বস্ত করলো যে তারা মুখ খোলেনি। কিন্তু অধীরের বাবা আজমীর রায়হান এসব শোনার পর সেলিম শেখ ও সাজ্জাদ শেখকে দোষ দিয়ে যাচ্ছেন। তারা কেন আগে থেকে সতর্ক করলো না। বন্ধু পরিবারের সাথে এত এত শত্রুতা থাকা স্বত্বেও কি করে অমন একটা পরিবারের মেয়ে তিনি ঘরে তুলবেন?
গুরুজনদের পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে গলা একটু নামিয়ে তানজীব বলল
এসব ব্যাপারে মেয়েটাকে না জড়ানোটাই ভালো।
হায়হায় আপনি একথা বললে মানাচ্ছেনা মেজর।
অধীরের বড় ফুপা একথা বলে তানজীবের পিঠ চাপড়ালেন। বললেন
খুনী মানেই খুনী। ওই মেয়ের শরীরে ও তো খুনীর রক্ত বইছে। এটা উনারা লুকিয়ে ভালো করেনি।
রাহান আর তানজীব অধীরের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিজোড়া কেমন যেন এলোমেলো হয়ে দূরের মেঝেতে লেপ্টে রয়েছে। সে এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা ।
তানজীব তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। বলল
তুই ওদের কথা কানে নিস না অধীর। আরেহ যা হারানোর আমি আর আমার বোন হারিয়েছি।
তুই নিজে ও তো ওই পরিবারটাকে ঘৃণা করিস। এটা কি মিথ্যে?
তানজীন মুখ ফিরিয়ে নিল।
বিয়ের পর সারাক্ষণ ওর কানের উপর সবাই যদি ওসব কথা বলতে থাকে তখন? আমি কতক্ষণ ওকে আগলে রাখব?
ওই ওখানে গাড়ি রাখা আছে। দূর হ তাহলে।
______________
বড় ছোট সবার আঙুলি দ্যোতনায়, ফিসিরফিসির গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরে কথাটা হাওয়ার বেগে ছুটে এল নোরার কানে।
রাহা সেই তখন থেকে স্তব্ধ হয়ে বোনের পাশে বসে রয়েছে। আজ সব কেমন যেন আজব আজব লাগছে তার কাছে। তন্মধ্যে এমন দুঃসংবাদ। আপার কাছে থাকাটা খুব জরুরী। নোরাকে স্টেজ থেকে নামিয়ে সাজঘরে নিয়ে এসেছে সে। নোরা সেই তখন থেকে মাথাটা নামিয়ে নিসাড়া নিঃশব্দে
বসে রয়েছে।
তার পুরো পরিবার ততক্ষণে তাকে দেখতে চলে এসেছে। মেয়ের মনের অবস্থা অনুমান করে উনারা হয়ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন। আমজাদ কবির পায়চারি করতে করতে মেয়ের মাথায় হাতটা রাখলেন। বুলিয়ে নম্র গলায় বললেন
ওসব কানে তুলিস না। যদি ওই ছেলে তোর হয়ে কথা না বলে তাহলে বুঝে নেব ওই ছেলে তোর যোগ্য না।
নোরার কোনো শব্দ নেই। তার চেহারাটা ও কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
মেয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে উনার চোখ জোড়া ধিকধিক করে জ্বলে উঠলো। আজই শেখাওয়াত পরিবারের মানুষজনকে দেখেছে। নিশ্চয়ই এসব ওদের কাজ। নিমকহারামগুলো সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। এদের আত্নীয় জানলে কখনোই তিনি মেয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেন না। তাছাড়া এখানে এরা এসেছে কোন সাহসে? এসেছে ভালো কথা। এখনো আছে কেন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা লুটছে হা*রা*মি*র বাচ্চাগুলো?
আশরাফ তখন হন্তদন্ত পায়ে ঢুকে এল সাজঘরটাতে। বলল
আব্বা এসব করিমুল্লাহর কাজ। তুমি ওইদিন ওর রিকশা আটকে রেখেছিলে তাই এমন করলো।
কু**ত্তা**র বাচ্চাকে ধরে উল্টো করে বাজারে মাথায় বড় তেঁতুল গাছটাতে ঝুলিয়ে দিতে বল।
আমি বলেছি।
রাহা অবাক গলায় বলল
এতে সব সমাধান হবে আব্বা ?
মেয়ের কথার জবাব দিলেন না তিনি।
তখনি বাইরে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো
জামাই কথা বলতে চায় বউয়ের সাথে। একটু সুযোগ হবে?
রুমটি ফাঁকা করে দিল সবাই। ঘোমটার আড়ালে চুপচাপ বসে থাকা নোরার আলগোছে মুছে নিল নিজের ভিজে উঠা গাল। নিঃশব্দে পারফিউমের গন্ধটি একদম কাছ ঘেঁষে এসে বসলো। নোরার দমবন্ধ হয়ে এল প্রায়।
বেঞ্চিটাতে একদম পাশাপাশি বসলো অধীর। বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা কপালের ঘাম মুছে আঙুল ঝেড়ে নিল। বলল
আপনি আমাকে বলুন নোরাহ। এমুহূর্তে আমার কি করা উচিত?আমি এই শেরওয়ানি এই প্রথম এবং এই শেষ পড়েছি। দ্বিতীয় বার পড়ব না কখনো। আপনার এই বিয়ের সাজ যেন এই প্রথম এবং এই শেষবার হয়।
নোরাহ নিরুত্তর।
অধীর তার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো। ঘোমটার আড়ালে মুখটা ঢাকা। দুজনের নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।
বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠলো অধীর। তখনি মিনমিনে গলাটি বলে উঠলো
আমাদের মধ্যে কোনো অগাধ প্রেম প্রণয়ের সম্পর্ক নেই। যার জন্য বিচ্ছেদে কষ্ট হবে। হয়ত সেদিনটা একদিন আসতো। কিন্তু তা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনার যেকোনো সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি। আপনি যা ভাবছেন তাই করুন। নিজেকে সামলে নেওয়ার যথেষ্ট প্রতিরোধশক্তি আমার আছে।
অতন্দ্র নীরবতা ক্ষণ পার হওয়ার পরেও অধীরের কোনো সাঁড়াশব্দ না পেয়ে নোরা এবার ঘোমটা সরিয়ে পাশ ফিরে একবার তাকালো।
কেমন দৌর্মনস্য দৃষ্টিতে মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত কথাগুলো ভীষণ কঠিন ছিল। হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তিক্ত হলেও এটাই সত্যি। মেয়েটাকে যতটা কোমল মনে হয়েছে তার চাইতেও সে হাজারগুণ কঠোর।
নোরাহ চোখ সরিয়ে নিল। বলল
এভাবে কি দেখছেন?
আমাদের মাঝে কিছুই নেই?
নোরা এবার সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো। আহ লোকটার গলায় এত কাকুতি কেন?
এভাবে বলবেন না। হয়ত আছে, কিংবা নেই। বিয়েতে শুধু দুটো মানুষ জড়িত নয়, দুটো পরিবার জড়িত। আপনি আমার কথা ভাববেন না।
আমাকে চলে যেতে বলছেন আপনি?
গর্জনে কেঁপে উঠলো নোরাহ।
লোকটা এমন রেগে গেল কেন? তাহলে তিনি কি নোরাকে ভীষণভাবে চান? এতকিছুর পরও?
অধীর দাঁড়িয়ে পড়লো।
দ্যোতনা ভৎসনাকে যদি আপনি আমার আগে ঠাঁই দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার আসার দরকার নেই।
যদি আমার জায়গাটা তার আগে হয় তাহলে আমি অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। কাজী সাহেবকে বসিয়ে রেখেছি। আসুন নয়ত….
কিন্তু,,,
আপনার কথাটা আমি মনে রেখে দিলাম নোরাহ। আজকের বিচ্ছেদে আপনার কোনো কষ্ট হবে না। কিন্তু আমার সব উল্টেপাল্টে গিয়েছে। এর নাম কষ্ট কিনা জানিনা, যদি কষ্ট হয় তাহলে বলব সেই কষ্টের কারণ আপনি। আসছি…
বলেই একমুহূর্ত ও দাঁড়ালো না সে।
সে যেতে না যেতেই নোরাহ ভেঙে পড়লো ক্রন্ধনের জোয়ারে। ভেসে গেল তার সমস্ত সংযম।
যান্ত্রিক ফোনটাতে বিদ্যমান থাকা এই একটা মানুষের সাথে অল্প কয়েকমাসে কতটা জড়িয়ে গেছে সেটা সে কাকে বুঝাবে? মানুষটাও তো তার মুখের কথাটা বিশ্বাস করে নিল। তর্জন-গর্জন করে চলে গেল। এই এত এত রোষাবেশ, অভিমান ভাঙানোর জন্য হলেও দ্যোতনা ভৎসনাকে ফেলে মানুষটার কাছে যাওয়া উচিত।
—————-
চোখমুখ ফোলা রাহা অধীরের কথায় নোরার কাছে যাওয়ার সময় দেখলো মিনাকে। সুকুমার লোকটির বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মা বাবা তো তারা হারিয়েছে। কেন সবাই এটাকে লক্ষ্য করে দুটো মানুষের সম্পর্কের জোড়া বাঁধতে দিচ্ছে না? কেন না চাইতেও তারা বন্ধুরা একে অপরের বিরোধী, অভিঘাতী হয়ে পড়ছে? এমনটা তো কথা ছিল না।
বিয়েটা হবে বনু। ওরা হিংসেয়, ক্রোধে, কোপে পাগল হয়ে গেছে। এসব চলতেই থাকবে। এবার থেমে যাহ।
রাহার মেরুদণ্ড বরাবর ইলেকট্রিক শক বয়ে গেল যেন।
মিনা মাথা তুলতেই তানজীব চোখমুখ মুছে দিয়ে বলল
তোর উচিত নোরাকে নিয়ে আসা। যে কয়েকজন চাইবে তারা সাক্ষী থাকবে। বাকিদের দরকার নেই। ঠিক আছে?
মিনা দুপাশে মাথা নাড়ালো। চলে যাওয়ার সময় রাহা লুকিয়ে পড়লো দ্রুত। মিনা যেতেই বের হয়ে এল। তানজীব যাওয়ার সময় পথ আটকে দাঁড়ানো মানবীকে দেখে থমকে গেল।
কেমন অনিমেষনেত্রে চেয়ে আছে মানবী। চোখমুখ স্ফীতি, ফাঁপা, ফোলা। ঈষৎ রক্তিম গালের পাটা। কেঁদেছিল কি?
তানজীব পকেট থেকে দুটো টিস্যু বের করে বাড়িয়ে দিল। বলল
মিস কবির একটা নাকের পানি মুছার জন্য। অপরটি চোখের পানি।
রাহা বিস্ময়ে ঠাঁঙানো ক্রিমরঙা বড় পর্দা গুলোর আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ঢোক গিলে স্খলিত অস্ফুটস্বরে বলল
একটা লালরঙা পোড়ামাটির ঘোড়া। আপনি চেনেন?
একথা শোনার পর মেজরের ঠোঁটের কোণে খেলছে থমথমে গাম্ভীর্য আর মনোহর দুটি চোখে গহন বিষণ্ণতা! শাণিত নিশিত এসির ভোঁতা যান্ত্রিক সমীকরণে কাঁপছে ছোট ছাটের অসিত-বরণ চুল।
ডহর দুটি চোখে তিনি মানবীর বিস্মিত দৃষ্টিতে আটকে গেলেন। বললেন
চিনি। চৌদ্দ বছর আগে সেটি একজনের হাতে আমনত রেখেছিলাম। আমার ঘোড়াটি চাই।
চৌদ্দ বছরে সেটি পুরোপুরি আমার হয়ে গেছে। আমি ওটা আর কাউকেই দিতে পারব না। পুরোনো মনিব তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। না পাবে সেই ঘোড়া, না তার কোনো আধুলি। আমি দেব না। ওটার সাথে আমার আজন্ম অনুষঙ্গ।
হাত ভর্তি রেশমী চুড়ির রিমঝিম আওয়াজ তুলে মানবী চলে গেল মেজরের কঠিন বুকের ভেতরটাতে অনুরক্তির দুন্দুভি বাজিয়ে। কল্লোল তুলে।
বোকা মেয়েটা বড়দের মতো কথা বলে গেল না?
চলবে….