#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_২০
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
সকাল থেকে বাড়ির কারো মুখে একটি দানাপানি ও উঠেনি। লেবার পেইন উঠায় মিনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাথে বাড়িসুদ্ধ মানুষ এখন হাসপাতালের করিডরে।
করিডোরের লোহার বেঞ্চে শত শত জটিল অপারেশন কেস চট করে সলভ করা ডক্টর আজরাহান শেখওয়াতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জটলা পাকিয়েছে। লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে অধীর এসে তার পাশ ঘেঁষে বসলো। বন্ধুর পিঠ চাপড়ে সাহস যুগিয়ে বলল
আরেহ এত চিন্তা করছিস কেন দোস্ত? আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাহান মাথা নিচু অবস্থায় চুপচাপ মাথা দুলালো। মিনার তীক্ষ্ণণ আর্তনাদ কানে বাজছে বারবার। বাড়ির সবাই চুপচাপ বসে আছে। সানজু এসে রাহানের পাশে বসলো। বলল
ভাই বলো না আপার ছেলে বাবু হবে নাকি মেয়ে বাবু?
রাহান ধমক দিল।
একদম চুপ। এখন এসব কথা বলার সময়? বড় হচ্ছিস শুধু আক্কেল আর হবে কখন?
সানজু চুপসে গেল। অধীর বলল
আরেহ ওকে বকছিস কেন? মাথা ঠান্ডা রাখ।
সানজু গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রাহান তার দিকে তাকালো। এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
আরেহ রাগিস না। এখন তো চিন্তায় আছি না।
সেলিম সাহেব পায়চারি করতে করতে অধীরকে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন
শুনেছি ও নাকি ফিরেছে। আজও কি আসবে না? বোনের জন্য হলেও তো আসা উচিত। এ কেমন ছেলে? রাগ তো আমাদের উপর। বোনের উপর তো নেই।
অধীর বলল,
মাত্র কালই তো ফিরলো। ওদিকে ঠিকঠাক করে আসতে সময় লাগছে। মিনির এই অবস্থা শুনলে না এসে থাকবে না।
বাড়ি ফিরবে টিরবে বলেছে তোকে?
অধীর রাহানের দিকে তাকালো। রাহান হাত দিয়ে মুখ মুছে বলল
আমি কোনো কথা বলতে চাইছিনা এখন। আব্বা তুমি যাও এখন। যা করে রেখেছ বাড়ি ফিরবে না ছাই।
সেলিম সাহেব চিন্তিত বদনে আবারও পায়চারি করতে লাগলেন।
সবার অপেক্ষা ফুরোলো এক সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর তীক্ষ্ণণ কান্নার আওয়াজে। জানাজানি হলো ডক্টর শেখাওয়াত পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছেন। সবার মুখে হাসি ফুটলো। রাহান ছুটে গেল একদম অপারেশন রুমে।
ইজ শী ওকে?
সিস্টার জবাব দিল।
ইয়েস স্যার।
ডক্টর রেহানা খানম হেসে বলল
কনগ্রেস ডক্টর শেখওয়াত। নর্মাল ডেলিভারি। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম অপারেশন লাগবে। যাক আলহামদুলিল্লাহ।
রাহান কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল
আলহামদুলিল্লাহ। এখন বেবিকে দেখতে পারি?
ইয়াহ সিউর।
নার্স কোলে করে নিয়ে এল। রাহান দেখলো চোখ বন্ধ সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা বাচ্চাটি কচি কচি হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছে। মুখটা লাল। অতি আবেগে রাহান কি করবে খুঁজে পেল না। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল
আমার কোল থেকে পড়ে যাবে। আমার আম্মাকে দিন।
মনোয়ারা বেগম ছুটে এলেন।
কই দেখি দেখি। ওমা আমার ভাই এসেছে। মাশাল্লাহ মাথা ভর্তি চুল নিয়ে আসছে। আমার রাহানও এমন ছিল। এমা এমন করে কাঁদে কেন?
সানজু মনোয়ারা বেগমের পিছু ছুটে বলল
ও বড়মা আমাকে একটু দাও না। ও আল্লাহ পুরো পাখির ছানার মতো। এত ছোট? বড়মা আমাকে ফুপী ডাকবে নাকি খালামণি ডাকবে?
তুই চুপ কর তো। রাহানকে বল মিষ্টি নিয়ে আসতে। সবাই আগে মিষ্টি মুখ করুক।
অধীর ভাই গিয়েছে। আমাকে কোলে দাও।
বাচ্চাটাকে পেয়ে সবার আনন্দের শেষ নেই। মিনার জ্ঞান ফিরলো প্রায় দু ঘন্টা পর। রাহান মা চাচীর জন্য মিনার কাছে যেতে না পেরে বাইরে দাঁড়িয়ে উশখুশ করতে করতে বলল
আম্মা একটু বেরোও। মিনির সাথে কথা ছিল একটু।
সবাই হেসে উঠলো একসাথে। সানজু বলল
আপা দেখ ভাইয়ের ছটফটানি।
মিনার ঠোঁট নড়লো একটুখানি। মনোয়ারা বেগম মাথায় হাত রাখলেন। বললেন
কোনো অসুবিধা হলে বলিস কেমন?
চোখের কোণায় অনেকক্ষণ ধরে জমে থাকা জলফোঁটা কান বেয়ে গড়িয়ে পড়লো মিনার। এই প্রথম বড়মা তার মাথায় হাত রাখলেন। বাচ্চাটাকে মিনার পাশে রেখে সবাই বেরিয়ে গেল। রাহান হন্তদন্ত পায়ে ঢুকে এল। পাখির ছানার মতো বাচ্চাটিকে দেখে বলল
মিনির বাচ্চা ম্যাও।
মিনা হেসে উঠলো। রাহান টুল টেনে নিয়ে একদম পাশ ঘেঁষে বসে মুখে হাত বুলিয়ে বলল
তোর খুব কষ্ট হলো না?
মিনা হাসলো শুধু। রাহান তার চোখের কোণা বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা চেপে মুছে দিল। ডান গালে চেপে চুমু খেয়ে বলল
তোর বাচ্চাকেও আদর দিতে হবে?
মিনা আবারও হাসলো। ছোট্ট করে বলল
হ্যা।
করেছি হুহ।
মিনা আরও একবার হাসলো। বলল
আপনি ওকে কোলে নেননি কেন এখনো?
না না ওসব আমার দ্বারা হবেনা। হাত ফসকে পড়ে যাবে। এত নরম বাবারে।
মিনা হেসে উঠলো শব্দ করে।
ডাক্তার মানুষ এত ভীতু?
একদম না মিনি। এটা তো আমার বাচ্চা তাই কেন জানি ভয় করছে। কাল পরশু নেব। একটু শক্ত হোক। বুঝলি? তোকে আজই নিয়ে যাব।
সাথে সাথে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটি। দুজনেই তাকালো সাথে সাথে। মিনি বলল
কি হলো? কে মেরেছে?
মিনি তোর ছেলে মহাবজ্জাত হবে। একদম তার মামার মতো।
মিনি চমকে তাকালো।
মামা?
____________
মিনিকে নিয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি চলছিল সবার। কাছের আত্মীয় স্বজন যারা ছিল তারা এল। মিনার মামার বাড়ি থেকে কয়েকজন এল। বড় মামা ছোট মামা আর বৃদ্ধা নানী। তারা ভীষণ খুশি। মিষ্টিমুখ চললো সবার মাঝে। হাসপাতালেও মিষ্টি বিতরণ হলো। হাসপাতালের ডাক্তাররা দলে দলে এসে রাহানকে অভিনন্দন জানালো।
হসপিটাল থেকে বেরোনোর ঠিক আগমুহূর্তে সবাই দেখলো একটি নার্সের সাথে কথা বলতে বলতে একদম অফিশিয়াল পোশাকে এগিয়ে আসতে লাগলো তানজীব। চেহারায় উৎকন্ঠা, ব্যগ্রতা। বাড়ির সবাইকে ভীষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাতে সে নিজেও থমকে গেল। মাথার ক্যাপ খুলে নিয়ে এগিয়ে এল ত্রস্ত পায়ে।
মিনি ঠিক আছে? কোথায় এখন?
কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুলো না।
সব ঠিকঠাক? কারো মুখে কথা নেই কেন? বড়মা কেমনে আছ? মণি সবাই ভালো আছে?
খানসা বেগম আর মনোয়ারা বেগমের সাথে কলাকুশলী বিনিময় করে রাহানের কাছে গেল সে। সানজুর মাথা চাপড়ে দিতেই সে খুশিতে গদগদকন্ঠে বলল
আপার ছেলেবাবু হয়ছে তো। তুমি জানো না?
হ্যা অধীর বলেছে। মিনিকে দেখব। কোথায় রেখেছে ওকে?
রাহান বলল
একটু ঘুম এসেছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমালো। আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। তুই গাড়ি নিয়ে এসেছিস?
হ্যা ক্যান্টেন্টমেন্ট থেকে সোজা এখানে চলে এলাম। আমার কাল ফেরার কথা ছিল। অধীর জানালো আর বেরিয়ে পড়লাম।
কথা বলতে বলতে দুজন এগিয়ে গেল। কেবিনে ঢুকতেই দুর্বল নিস্তেজ বোনকে ঘুমন্ত দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। নানী মিনার পাশেই বসা ছিলেন। নাতিকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন তিনি। বলল
ভাই এতদিন পর ফিরলি তুই? দেখ কে এসেছে? তোর মতো হবে মনে হইতেছে।
তানজীব হাসলো। সালাম করে দোয়া নিয়ে বলল
বুড়ি এসেছ কখন?
সে খবর কি তুই রাখিস ভাই? এত অসুস্থ ছিলাম এতদিন। তুই তো দেখতেও গেলিনা। খুব রেগেছি। পরে শুনলাম দেশের বাইরে গিয়েছিস।
তানজীব মিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কপালে চুমু খেল। বলল
ওর চেহারাটা শুকিয়েছে কেন এত? কিছু খায়নি এখন অব্দি?
খাবে খাবে। এত অশান্ত হস না।
নে নে এটারে কোলে নে। মামার কোলে উঠুক। ওরে কিন্তু বখশিশ দিবি। ভালা কথা আগুন ধরছিস তো।
হ্যা হ্যা। দাও।
ছোট্ট শিশুটাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। রাহান আর অধীর এগিয়ে এল। তানজীব ছোট্ট গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। রাহান বলল
শালা তোর হাত অত শক্ত। ব্যাথা পাবেনা? আমি তো এজন্যই কোলে নেইনি। আমার হাত থেকে তো তোর হাত আরও শক্ত।
তানজীব হাসলো। অধীর হেসে পিঠ চাপড়ে বলল
শালা ওর কাছ থেকে শিখ। বন্ধু তুমি তো আরও হ্যান্ডসাম হয়ে এসেছ। কোর্স করতে গিয়েছ নাকি ফিট হতে?
নাটক রাখ। একেকটা জার্নি কত কঠিন ছিল দেখলে বুঝতি। রেস্টে ছিলাম পুরো একমাস। তাই এমন দেখতে পাচ্ছিস। কোর্সের পরপর ফিরলে চিনতেই পারতিনা।
ভালোই হলো। নইলে আমাগো আগে তোমার বউ তোমারে চিনতো না।
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো তিনজনই।
মিনা ঘুম থেকে উঠে ভাইকে দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার বহুদিনের কান্না জমে আছে। আজকের দিনে মা বাবা থাকলে কতই না খুশি হতো। যাক শেষমেশ ভাইয়ের মুখটা দেখে শান্তি পেল সে। পরক্ষণে আরেকটা দুশ্চিন্তা গ্রাস করলো তাকে। তাদের বিয়ের খবরটা জানাজানি হলে কি হবে?
সেলিম সাহেব আর সাজ্জাদ সাহেব বহুদিন পর তানজীবকে দেখে আবেগি হয়ে পড়লেন। বললেন
তুই চেয়েছিস আর আমরা দেইনি এরকমটা কখনো হয়েছে বাপ? এবার বাড়ি চল। তোর উপর কোনো জোরাজোরি করব না আর। তুই যেটা চাইবি সেটাই হবে।
তানজীব তাদের কথা চুপচাপ শুনলো। তাদের কথার তালে তালে মাথা দুলালো। সম্মতি জানালো। তারপর শেষে রসিক গলায় বলল
চাঁদ এনে দাও।
তানজীব! মজা করবি না একদম। সম্পর্কে কি হই তোর?
ধমকে হেসে উঠলো সে।
ইয়েস। আমি এরকম কিছুই চাইবো জেঠু। বি রেডি।
বলেই চোখ টিপে সোজা হেঁটে গেল সে।
দেখলে দেখলে? এই তোমরা দেখলে কি বললো এই ছেলে? দেখুন খালাম্মা আপনার নাতির কথা।
বৃদ্ধা আনোয়ারা চশমা ঠিক করতে করতে বললেন
ও যেটা বলবে সেটাই হবে। আমি আমাদের কথা ও শুনেছে কবে? আমাদের এক ঘাড়ত্যাড়া ছেলে দিয়ে গেল আমার মেয়েটা।
মিনির তো একটা কূল হলো। একে নিয়ে কি হবে আল্লাহ জানে?
___________________
সকাল থেকেই আবহাওয়া সুন্দর। ফুরফুরে বাতাসে দুলছে রাস্তার পাশের সুপুরি গাছ। ফকফকা আকাশ। গগনতলে উড়ে যাচ্ছে মুক্ত পাখির দল। রাস্তায় শাঁ শাঁ করে ছুটছে সিএনজি এবং অটোরিকশা। সাথে মোটর।
নীল রঙের শাড়ি পরিহিত রাহা রিকশা থেকে নামলো স্কুল গেইটের কাছাকাছি আসতেই। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ঢুকে পড়লো গেইট ঠেলে।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ। স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম শেষ। আজকেই অরিয়েন্টেশন ক্লাস বাচ্চাদের। ফ্রেব্রুয়ারি থেকেই ক্লাস শুরু। অরিয়েন্টেশন উপলক্ষে স্কুলটা সাজানো হয়েছে। রাহাকে শাড়ি পড়েই আজকে উপস্থিত থাকতে বলেছেন সহকারী শিক্ষিকারা। সব শিক্ষিকাদের গায়ে নীল রঙের শাড়ি।
স্কুল প্রান্তর নব্য ছাত্রছাত্রীদের ছোটাছুটি আর অভিভাবকের পদচারণায় মুখোরিত। রাহা সবার সাথে ধীরেধীরে পরিচিত হলো। ছাত্রছাত্রীদের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠলো।
রাহাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো অতিথি শিক্ষক হিসেবে।
অনুষ্ঠান শুরু হলো সাড়ে এগারোটার দিকে। শেষ হলো প্রায় একটা দেড়টার দিকে। রাহার স্কুল থেকে বেরোতে বেরোতে সময় লাগলো দুুইটার আড়াইটার মতো।
রাস্তার পাশে গাড়ির জন্য দাঁড়াতে দাঁড়াতে হঠাৎ ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচির দরুন কেঁপে উঠলো সে। শোনা গেল কিছুক্ষণ আগেই সামনেই একটি এক্সিডেন্ট ঘটেছে। সবার মতো সেও ছুটে গেল তড়িৎ গতিতে। মুহূর্তের মধ্যে দলে দলে লোকজন ছুটে এল। প্রকান্ড জনসমুদ্রের মাঝখানে কোনোমতে ঠেলেঠুলে রাহা ঢুকে পড়লো ভীড়ের মাঝে। দেখলো কালো একটি প্রাইভেট কার। ততক্ষণে এম্বুল্যান্সে তোলা হয়েছে আহত লোকটাকে । আমজাদ সাহেবের সাথে দেখা হওয়ায় তিনি মেয়েকে তাড়া দিলেন।
এখানে কি করছিস? বাড়ি চল। মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল এরকমই হতো।
রাহার মন খারাপ হয়ে গেল।
বেশি আহত হয়েছে আব্বা?
কে জানে?
কিভাবে হলো?
পাশ থেকে একজন বলল
ট্রাকে মারছে। দোকানদারেরা বলল ইচ্ছে করে মারছে। ট্রাক ড্রাইভারের দোষ।
আমজাদ সাহেব তাড়া দিলেন।
আরেহ চল। এসব শুনে লাভ নেই। চল চল।
মেয়েকে নিয়ে হেঁটে কিছুদূর গেলেন তিনি। বললেন
বেলা তো কম হলো না। আজ এত দেরী হলো কেন? এত বেলা করে পড়াতে হবে না। কতই বা মাইনে দেয় তোকে।
মেয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি ঘাড় ঘুরালেন। দেখলেন রাহা একটি ছিটকে পড়া গোলাপ কুড়িয়ে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে।
আরেহ আয়। ওসব কি নিচ্ছিস?
রাহা ফুলটা ব্যাগে নিয়ে নিল।
নাইরাকে দেব আব্বা। ফুলটা তাজা আছে। কেউ ফেলে দিল বোধহয়।
আমজাদ সাহেব রাহাকে সিএনজিতে বসিয়ে দিলেন। নিজেই সিগারেটটা জোরে টানতে টানতে এদিক-ওদিক তাকাতেই কোথাথেকে হুড়মুড়িয়ে রোস্তম শেখ ছুটে এল অনেকগুলো পুলিশের মাঝখান থেকে। এসেই ফিসফিস করে বলল
আঘাত বেশি পায়নি। মরবে না। যদি শিক্ষা হয় আর কি।
আমজাদ কবির খুকখুক করে কেশে উঠলেন। বললেন
বাড়ি যাই আগে।
রাহাকে ভুরু কুঁচকে চাইলো। রোস্তম রাহাকে দেখে হাসলো। বলল
আরেহ আপনি? আমি তো খেয়ালই করিনি।
রাহা গলার আওয়াজ বড় করে বলল
গাড়ি ছাড়ুন।
______________
বাড়ি ফিরতেই বাড়ির সবার চেহারা দেখে কিছুটা বিচলিত হলো রাহা। অন্তরাকে বলল
সমস্যা কি সবার? কি হয়েছে?
কিছু হয়নি। ঘরে যাহ।
রাহা ঘরে গেল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই দেখলো নোরার মিনার অনেকগুলো ফোন। সে শুরুতেই নোরার ফোনে কল দিতেই নোরা সাথে সাথে কল তুললো। রাহা বলল
কি হলো আপা? এত ফোন দিলি। মিনা আপাও ফোন দিল। কোনো সমস্যা? কিছু কি হয়েছে? কার কি হয়েছে?
নোরা কিছু বলার করার আগেই রাহা ধরে আসা ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল
উনি ঠিক আছেন আপা? দেশে ফিরেছে? ঠিকঠাক ফিরেছে?
ছোট শোন….
রাহার গলা ধরে এল।
উনি আসবেন বলেছিলেন আপা।
হ্যা তো। গিয়েছে তো। গিয়েছে। তারপর….
রাহা চুপ করে রইলো।
নোরা কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল
শোন, এই রাহা। তোর জিজু আর রাহান ভাইয়া যাচ্ছে। শোন এই রাহা।
উনার কি এক্সিডেন্ট?
বাকি কথাটা আর মুখ দিয়ে বেরোলো না রাহার।
তুই জানিস?
রাহা ফোন কেটে দিল। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। ঠোঁট ভেঙে বুক ফেঁটে কান্নারা বেরিয়ে এল। আব্বা আর রোস্তম শিকদার ওইসময় ওসব কি বলছিলেন? এসব উনাদের কাজ?
সেই এক কাপড়ে কারো কথা না শুনে, বারণ না শুনে রাহা বেরিয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে পাগলের মতো হন্যি হয়ে। সেখানে পৌঁছুতেই দেখলো পুরো হসপিটালের করিডোর ভর্তি মানুষ। পুলিশের পর পুলিশ। আরও কত ধরণের লোকজন। লোকেমুখে ছড়িয়ে গেল সন্ধ্যায় স্কুলের রাস্তার মোড়ে আহত লোকটি সাধারণ কেউ নন। অসম্ভব সম্ভব করা সেই দুর্ধর্ষ সেনা অফিসার। সামান্য এক্সিডেন্ট নয় এটি। এটির পেছনে ভয়ানক এক রহস্য লুকিয়ে আছে সেটা শতভাগ সত্য। সেখানে রাহার জায়গা হলো না কোথাও। সে শুধু পাগলের মতো সন্ধ্যার আগপর্যন্ত এদিকওদিক ছুটেছে। ঢাকা থেকে ফিরতে এতক্ষণ লাগে জিজুদের? সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা পেরোতে পেরোতে মাগরিবের আজান পড়ে গেল। আমজাদ কবির হাসপাতালে এলেন ঠিকই। অধীর এসেছে শুনে আর বেশি ছুটলেন না। জামাইটা যদি খারাপ কিছু মনে করে? রাহাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখবেন উনি। কত বড় সাহস বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে কাউকে কিছু না বলে? ওই ছেলের সাথে তার এত কিসের দরদ?
রাহার সাথে অধীর আর রাহানের দেখা হলো। সেলিম সাহেব আর সাজ্জাদ সাহেব এলেন বাকিদের সাথে নিয়ে। সবাই রাহাকে অত বিষণ্ণ অবস্থায় দেখে ভীষণ চমকালো। সেলিম সাহেব চেঁচিয়ে বললেন
ওই মেয়ে এখানে কি করে? এখানে কি? কেন তানজীব এই গ্রামে? ও জানেনা এই গ্রাম তাদের জন্য অভিশপ্ত? আমাদের কথা মিলিয়ে নিয়েছিস তো এবার? আরেহ এই মেয়ে এখানে কি করে বলবি তো রাহান। এই অধীর কিছু তো বল। তোরা জানতি ও এখানে আসছে? কেন? এখানে ওর কি কাজ? এখানে পদে পদে ওর শত্রু সেটা কি ও জানেনা? কেন এল সে এই গ্রামে?
অধীর তাদের বসিয়ে শান্ত করলো। রাহাকে দেখিয়ে বলল
ওর সাথে তানজীবের…
না কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা। খানসা বেগম বললেন
ওর সাথে কি?
রাহান তেড়ে এসে গর্জে বলল
ওর আগে এখন ওর সাথে রাহার কি সেটা তোমাদের জানাটা বেশি ইমপোর্টেন্ট? তাহলে শোনো, ওদের বিয়ে হয়েছে। ওরা স্বামী স্ত্রী। আর ও স্বামীর এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই এমন হয়ে আছে।মেয়ে হয়ে মেয়ের মন তো বুঝো। আল্লাহ এদের জ্ঞান দাও।
রাহার পাশে মিনা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে ।
রাহানের কথা শোনার পর সবাই চুপ হয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এতকিছু হয়ে গেল অথচ তারা কিছু জানেনা? এতবছর আগলে রেখেও তারা আপন হতে পারলো না? একবার জানালো না তাদের? শেষমেশ ওই বাড়ির মেয়েকে? ছিঃ ছিঃ!
এমন বিপদ আসবেনা কেন? ওই বাড়ির রক্ত যেদিকে যাবে সেদিকেই বিপদ। নিমকহারামের দল। রাগে হাতের মুঠি শক্ত করে এদিকওদিক হাঁটলেন সেলিম সাহেব।
চারপাশে তখন এশার আজান পড়ছে।
করিডোরে সবাই নিস্তব্ধ, নিস্তেজ। নার্সদের চিল্লাচিল্লি শুনে অধীর আর রাহান ছুটে গেল। সেই হার মানতে না চাওয়া অকতোভয় দুঃসাহসী ছেলেটাকে দেখলো হাতের ক্যানোলা টেনে ছাড়াতে। তারা দুজনেই হতভম্ব।
ভারী গলাটি ঠান্ডা আজ।
এত চেঁচাবেন না সিস্টার। আমাকে যেতে দিন। এসব সামান্য ব্যাপার। এর চাইতে জঘন্য এক্সিডেন্ট আমি হ্যান্ডেল করেছি।
অধীর রাহাকে ডাকলো। বলল
রাহা ওকে একটু বুঝাও।
রাহা গলার আওয়াজটি শুনতে পেয়ে ছুটে গেল। কেবিনে ঢুকে ডাকলো
মেজর!
তানজীব ক্যানোলা টান দিয়ে খুলে হাসলো। তার মাথা কপাল হাত কাঁধে ব্যান্ডেজে মোড়ানো। হাসতে গিয়েও চাপ পড়ছে মাথায়। আহ কি যন্ত্রণা!
নার্স দুটো বেরিয়ে গেল। রাহা বহুকষ্টে কান্না আটকালো মুখে হাত দিয়ে। তানজীব আঙুল দিয়ে ইশারা করে ডাকলো
কাম।
রাহা ছুটে গেল। খুবই সতর্কতা সহিত বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল
কেন এলেন এভাবে?
না এলে দেখা হতো না।
না হতো। আপনি ঠিক থাকতেন।
আমি বেঠিক। ঠিক হতেই তো চাই।
এক হাতে রাহাকে জড়িয়ে ধরলো সে। মাথায় থুঁতনি ঠেকালো। চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
আমার সাথে চলো। আজকেই।
রাহা চমকে মাথা তুললো।
কি করে সম্ভব? এখনো সবাই..
তানজীব তাকে ঠেলে দিল। বলল,
ঠিক আছে যেওনা। আমার কাউকে দরকার নেই।
দূরে যাও।
রাহা পড়লো মহাবিপাকে।
চলবে….
রিচেক করা হয়নি