মন নিয়ে কাছাকাছি – পর্ব ৭

0
369

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_৭
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

ঘটনার পটভূমি………..

গ্রামটির পূর্বদিকে ছোটোখাটো বয়ে চলা একটা নদী। দূরেই হাতছানি দেওয়া অনাবিল ধানক্ষেত, ফসল ক্ষেত। স্কুল,মাদ্রাসা,মসজিদ আর চল্লিশ পঞ্চাশটা নিম্নবিত্ত,মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে সাজানো গোছানো ছোট্ট গ্রামটি জয়পুর। দেখলেই মনে হয় বেশ উন্নত ও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে।

ষোল সতের বছরে সমীপে এই গ্রামটি এমন ছিল না। মারামারি খুনাখুনি, হাতাহাতি, লাঠালাঠিতে গ্রামটির বেশ অপযশ ছিল। গ্রামের সমাজপতি, প্রতাপশালী ব্যাক্তি ছিল বর্বর, উগ্র। দুর্নীতি, অপরাজনীতি, উগ্রবাদীদের সংযোজনে গ্রামটি তখন কুখ্যাত কলুষিত।
নাম শুনলেই মানুষ ঘৃণার কার্তুজ ছুঁড়ে এমন।

ডাকাতি, খুনখারাপি, মেয়েদের ধর্ষণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সমাজপতিদের ও কোনো হেলদোল ছিল না তাতে। না ছিল কোনো বিচার। অবিচার, শোষন, জুলুম, অত্যাচার, পাশবিক নির্যাতনে যতই দিন যাচ্ছিল ততই উচ্ছন্নে হচ্ছিল গ্রামটা। এ নিয়ে কয়েকটা ব্যাপারে গ্রামে থেকে অন্যত্র হয়েছে অনেক পরিবার। এতে প্রশাসনের গাঢ় নজর পড়ে।

গ্রাম্য থানায় ওসি হিসেবে নিয়োগ দেন একজন বলিষ্ঠ তাগড়া পুরুষ। এ গ্রাম থেকে সমস্ত দুর্নীতি,পাপ,পচন, অপরাজনীতি এবং কূটনীতি ধূলিসাৎ করার শপথ নেন তিনি। নিজের স্ত্রী আর দু সন্তান নিয়ে পাড়ি জমান তিনি জমিদার বাড়ির পাশের একটি দোতলা বাড়িতে।

তৎকালীন জমিদার বাড়িটাতে তখন আবাল বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ছেলে, বউ, নাতি নাতনিতে ভরা একটা পরিবার ছিল।

পুলিশ অফিসারের স্ত্রী তানজিনা মুফলেহার সাথে অল্পদিনের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে থাকা রাজিয়া ও মাহফুজা নামক বউদুটোর সাথে। বাচ্চাকাচ্চাগুলোর সাথে।
তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক,অনুষঙ্গ বেশ প্রগাঢ়, প্রবল হলে ও উপরকার পুরুষদের মধ্যে কদাচিত ছদ্মবেশী প্রচ্ছন্ন ভেকধারী একটা সম্পর্ক ছিল। কেউ কারো কাজে সন্তুষ্ট না।
হুট করে গ্রামে ঢুকে পড়া ওসিসাহেব যখন একের পর এক দুর্নীতি রুখে দিচ্ছিল, অপরাধীদের ধরে ধরে হাজতে ঢুকাচ্ছিলেন, গোড়া থেকে অপরাধ নির্মূল করার দরুণ জয়জয়কার লাভ সাধন করছিলেন তখন বিপুল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া গ্রামের অসাধু ব্যবসায়ী, আর সমাজপতিদের কাছে ওসিসাহেব হয়ে উঠেন সবার চক্ষুশূল, পথের কাঁটা। উপড়ে ফেলতে পারলেই যেন শান্তি। হিংস্র শ্বাপদের মতো সুযোগের জন্য ওঁৎ পাতা শুরু করে সকলে।

জমিদার বংশে দুুইপুত্র ছিলেন। মান্নান কবির ও হান্নান কবির। গ্রামটি শাসন করতেন ওনারা। সন্ত্রাস হামলায় হান্নান কবিরের মৃত্যু ঘটে দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের আটাশ দিনে।
তিন মাসের মাথায় স্বামীর শোকে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন হান্নান কবিরের স্ত্রী।

বড় ভাই মান্নান কবির ও উনার স্ত্রীর কাছে বড় হতে লাগলেন ছোট ভাইয়ের দু ছেলে। মা বাবা হিসেবে সন্তানহীন জেঠা জেঠিকেই তারা চিনে এসেছে ছোটকাল থেকে।

জাহানারা নিজ সন্তানের মতো আগলে বড় করেন তাদের। স্বামী মান্নান কবির তখনকার জমিদার তথা গ্রামের প্রধান মাতব্বর।

ওসি তৌহিদ তাহমিদের আগমন, সাথে উনার কর্মেনিষ্ঠার জয়জয়কার মান্নান কবির কিছুতেই মানতে পারলেন না। ওনার তিলতিল করে গড়ে তোলা সেই জঁজাল সাম্রাজ্র্যতে দুদিনের একজন অফিসার এসে হস্তক্ষেপ করে সবটা ছিনিয়ে নেবেন। ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাবেন। এমনটা হতে দেওয়া যায় না।

সামান্য তুচ্ছতম একজন অফিসারের কাছে হেরে যেতে অভিসন্তাপে, বিবেকদংশন হচ্ছিল উনার। ক্রমাগত ক্ষিপ্তবৎ, উন্মত্ত, উন্মাদে পরিণত হলো মান্নান কবির। ভেবে দেখলেন উনার পালানোর রাস্তাও থাকছেনা।
অস্ত্র পাচার আর নারী পাচারে জড়িতে থাকা মান্নান কবির সিদ্ধান্ত নিলেন এবার সমস্যার মূলকে গোড়া থেকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। তবেই নিষ্কৃতি। নইলে রাজ্য ও যাবে, রাজত্ব ও যাবে।

অতঃপর গুপ্তচরের সাহায্যে খুবই ছতুরতার সাথে মালবাহী ট্রাকের গুজরতে নির্মম নৃশংসভাবে খুন করেন তিনি ওসি তৌহিদ তাহমিদ ও স্ত্রী তানঝিনা মুফলেহাকে। ভাগ্য হয় সহায় ছিল ছেলেমেয়ে দুটো প্রাণে বেঁচে গিয়েছে । তারা তখন স্কুলে ছিল। মা বাবা দু’জনই স্কুল শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে ফিরছিলেন বাড়িতে। সাথে ছিল পুলিশি গাড়িটা। পথিমধ্যে দুরদৃষ্টের মারফত জান্তবের ন্যায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে তথায় প্রাণত্যাগ করেন জম্পতি। অনাথ হয়ে যায় দুটো ছেলে মেয়ে।

মান্নান কবির পরে অবশ্য খুবই বাজেভাবে ধরা পড়েছেন প্রশাসনের কাছে। ড্রাইভারটিকে হাজতে নিয়ে ঠেঙ্গানি চাবকানি দিতেই গড়গড়িয়ে সব বিস্ময়কর তথ্য এবং কলকাঠি নাড়তে থাকা সমাজপতিদের ভালো মানুষের মুখোশ বের হয়ে আসে।

পুরো গ্রামে শহরে তোলপাড় পড়ে যায়। গ্রামের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে মান্নান কবিরের বিরুদ্ধে। ছোট্ট অনাথ ছেলে মেয়ে দুটোর মুখ চেয়ে হলেও এগিয়ে আসে সর্বস্তরের মানুষ খুনীর ফাঁসির দাবি নিয়ে। তাদের এতদিনের ভেতরে জমে থাকা রোষ ক্ষোভ মিটিয়ে নেয় সুযোগে।

তন্মধ্যে ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সেলিম ও সাজ্জাদ শেখাওয়াত ও লড়ে যান মামাতো ভাইয়ের খুনীর ফাঁসি কার্যকর করার নিমিত্তে।
ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পূর্বেই মান্নান কবির আত্মহত্যা করেন জেলের ভেতর। অবশ্য সে নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়েছে।
যার কারণে এখনো চেয়ারম্যান আমজাদ কবির ও বড় ভাই আজমল কবির বলে বেড়ায় যে ডিএসপি অফিসার খুনের দায়ে নিরাপরাধ তাদের জেঠাকে ফাঁসানো হয়েছে। এবং পরবর্তীতে জেলে খুন করা হয়েছে।
গড়পড়তায় এভাবে পাঁচ ছয়বছর কেটে যাওয়ার পর গ্রামের বেশ উন্নতি, প্রগতি সাধনে অবদান রাখায় বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়ে আবার ও জমিদারি পরিবারের স্বসম্মান ফিরিয়ে আনেন আমজাদ কবির। সমাপ্তি টানেন বাপ দাদার আমলের সেই জমিদারি কারিকা কৃতি। জমিদারি প্রাসাদ ভেঙে গড়ে তুলেন নিজেদের প্রাসাদ।

পাঠক গত পনের ষোল বছর আগের ঘটনা এসব।
তারপর আর কারো মুখ দেখাদেখিও হয়নি। প্রাণ দিয়ে যে গ্রামটি শাপমুক্ত করে যে গ্রামের নাম জয়পুর দিয়ে গিয়েছিলেন ওসি তাহমিদ সেই গ্রামের ছায়াও উনার ছেলেমেয়েদের দেখাবেন না বলে শপথ নিয়েছিলেন শেখাওয়াত পরিবার।
সন্তানস্নেহে দু ভাইবোনকে আগলে রাখেন উনারা মমতার চাদর মুড়িয়ে। আজ তারা প্রতিষ্ঠিত। একজন সেনা অফিসার অন্যজন মার্কেটিং বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের স্টুডেন্ট। ভাইয়ের নয়নমণি। শেখাওয়াত বাড়ির পুত্রবধূ। ডাক্তারের ঘরকন্যা।

মা বাবার অবিদ্যমানতা, শূন্যতা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে, সেই মর্মান্তিক ঘটনার রেশ ভুলে ট্রমা থেকে বেরোতে ছোট্ট তাহমিনার বেশ সময় লেগেছিল।
অপরদিকে ছেলেটা আকাশছোঁয়া বুকের কষ্টগুলো জমিয়ে পরিণত হলো কষ্টিপাথরে। ঘুরে দাঁড়ালো এই কঠিন নির্মম দুনিয়ার বুকে মা বাবার রেখে যাওয়া ছোট্ট প্রাণটির জন্য। তাকে যে বাঁচতে হবে, লড়তে হবে সকল অন্যায় অবিধেয় অনুচিতের বিরুদ্ধে। জীবনের শেষ পর্যায়ে নিজের প্রাণ দিয়ে শিক্ষা দিয়ে যাওয়া তৌহিদ তাহমিদ তার আদর্শ, শিক্ষাগুরু। যিনি চৌদ্দ পনের বছরের কিশোর তানজীবের কাঁধ চাপড়ে বলতো

শেয়ালের মতো একশবছর নয়, সিংহ হয়ে একদিন বাঁচতে শেখো পুত্র । প্রাণ যাক তবু মান নয়। মিথ্যের সাথে আপোষ নয়। সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

এই নীতিবচন, সাহস, জিদ, অটলতা, অবিচলতা, চারিত্রিক দৃঢ়তায় তাকে এনে দিয়ে এক একটা দুর্ধর্ষ, পরাক্রান্ত অর্জন। সোনার মেডেল। সম্মান, বিজয় গৌরব।

তবে ধরাছোঁয়া, হিসেবনিকেশের বাইরে ও যে কিছু একটা থাকে। আত্মিক বন্ধন। মায়া, মমতা, অনুরক্তি, আসঙ্গ, ভালোবাসা। সেসব ধূলিসাৎ হওয়ার নয়।

সেই ষোল বছর আগে জমিদার বাড়ির একটা কোণে যে ছেলেমেয়েগুলো বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল দুটো বছরে । একে অপরের সাথে গেঁথে গিয়েছিল ধোঁয়াশা এক মিতালি সুতোয়। সে সুতো এতটাই মজবুত যে বড়দের এত দ্বেষ শত্রুতা তাদের কচিমনে আঘাত ফেলতে পারেনি।
বরঞ্চ তাদের বন্ধুত্বের বিচ্ছেদের জর্জরিত কান্না আর বেদনার চিৎকারে আকাশটাও সেদিন মেঘলা ছিল। প্রকৃতি ও নির্জীব ছিল। চারপাশটা থমকে গিয়েছিল।

মাতৃমমতা দেওয়া একটা মা, পিতৃতুল্য একটা বাবার মতো মানুষ হুট করে দুনিয়া ছেড়ে পগারপার সেটা মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন ছিল জমিদার বাড়ির মেয়ে ছেলেগুলোর জন্য। সাথে বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ। বন্ধুদের চোখের সামনে আর কভু দেখতে না পাওয়ার কষ্ট মর্মপীড়া ছিল অসহনীয়।

তানঝিনা মুফলেহার মুখনিঃসৃত গুঞ্জন জমিদার বাড়ির ছোট কন্যাটি সাবালিকা হলেই তিনি পুত্রবধূ করে নেবেন সেকথা সেসময় বুঝতে না পারলেও সাবালিকা হওয়ার পর মনে হলেই আজও বাড়ির ছোট কন্যাটির মনের নীল আকাশ কালো মেঘে এসে দীর্ণ করে দিয়ে যায়। না হওয়া শ্বাশুড়ি মা তার নাম ও দিয়েছিল।

প্রাণো…..

সে ভাবে আর ভাবে মায়ের কথা শুনে গুরুগম্ভীর হয়ে তার দিকে আঁড়চোখে তাকানো কিশোরটা নিশ্চয়ই এখন টগবগে যুবক। সাহসী বীর। তার গভীর চোখে এখন অসীম সাহস। কিভাবে যেন কানে এসেছিল একদিন সেই পুলিশ অফিসারের ছেলেও এখন সেনা অফিসার। দেশরক্ষী। ভারী ভারী রাইফেল আর পিস্তল নিয়ে ঘুরে শত্রু প্রতিহত করার জন্য । যে রূপকথার নয় সত্যিকারের একজন যোদ্ধা।

মায়ের মনোনীত সেই ছোট্ট প্রাণোর কথা মনে পড়লে যোদ্ধার কঠিন চোখ কি নির্মল হয়? ঠোঁট চওড়া হয়? নাকি চোয়াল শক্ত হয়? চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ঘৃণার আস্ফালিত দুন্দুভি?

প্রাণো নিজের মতো করে কল্পনার একটা মানুষ সে নিজেই গড়ে নিয়েছে। যাকে ভাবতেই তার হৃদয়নদে নীলৎপল ভাসে। ঝাপটাঝাপটি করে রঙিন মীন। উড়াউড়ি করে প্রজাপতির দল। তার না হওয়া বরের কি তাকে মনে পড়ে? জ্যোৎস্নার আলোয় বসে তিনি কি চিঠি লিখেন? ঠোঁট নেড়ে কি প্রাণো বলে ডাকেন? ওনার কঠিন চোখে দেখা পৃথিবীটাতে কি প্রাণোর ঠাঁই মিলবে কভু?

পাঠক নিশ্চয়ই এবার কাহিনীটা বুঝে গিয়েছেন। তবে ফেরা যাক বর্তমানে। যেখানে চেয়ারম্যান কন্যা ও অধীর রায়হানের বিবাহ কার্য চলছে। যেখানে সম্মুখে মিলিত হবে সেই দু’পরিবার। সাপে নেউলের যুদ্ধের অপরপ্রান্তে কি প্রস্ফুটিত হবে কোনো প্রেমপ্রণয়ের অর্ধমুকুলিত সেই অঙ্কুরিত কুঁড়ি? নাকি সমাপ্তি? হৃদয়বেদনার দহন আতশীর সূচনা?

_______________

সার্বিক পরিস্থিতির দিক বিবেচনায় এনে আকদের সময়টা রাত ন’টায় দেওয়া হয়েছে। বরপক্ষ এতে কিছুটা অসন্তোষ হলেও চেয়ারম্যানের কিছুই করার ছিল না। অতএব বিয়ের সমস্ত আয়োজন রাতেই। এতে বরপক্ষের আহামরি কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন না। সকল আত্মীয়স্বজনকে জানানো হয়েছে মেহেদীর আগের দিনই। তাই কোনো সমস্যা হয়নি। হওয়ার কথা নয়। তবে কথা নড়চড় হওয়ায় বরপিতা খানিকটা অসন্তোষ। ওনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুগুলো ভীষণ ব্যস্ত মানুষ, তাই দ্বিতীয় বার সময় পরিবর্তনের কথাটা বলতে গিয়ে উনি খানিকটা লজ্জিত বোধ করেছেন।

রাতে হওয়ায় তাড়াহুড়োর ব্যাপারটা চুকলো তবে। আটটার দিকে বরপক্ষের মানুষের আগমন ঘটলো। সার সার গাড়িতে মুখরিত হলো নিচের বেজমেন্ট। নব্য বেয়াইনদের মিষ্টি বরণে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রাজিয়া বেগম আর মাহফুজা বেগম।

সজ্জিত সুশোভনা শাড়ি পরিহিতা লাবণ্যময়ী বাড়ির ছোট কন্যাটি তখন দৌড়ের উপর। তার গায়ে শাড়ির সাথে মিলিয়ে কাঁধের পাশ গলিয়ে ফেলে দেওয়া সোনালী রঙের ভারী কাজের ওড়নাটি। ঘন চুলের মাথার বেণীতে গাঁথা সাদা পাথুরে অলঙ্করণ।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে, আতিথেয়তার পাশাপাশি সে পরিচিত হয়ে নিচ্ছিল বরপক্ষ থেকে আসা লোকজনের সাথে।

অধীরের মা,বাবা,ফুপা,ফুপীরা দেখলেন সাহেবিয়ানার বিরাট আয়োজন। এককালে ইনাদের পূর্বপুরুষরা নাকি জমিদার ছিলেন! এত আয়োজন হবেই না বা কেন?

বর আসছেন উনার ভাইবন্ধুদের সাথে।

পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইলে ক্রিং ক্রিং ফোনের শব্দ বেজে উঠলো। ফোন তুলে কানে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বরের বাবা আজমীর রায়হান নামলেন দোতলার বাহারি ডিজাইনের সিঁড়িটি বেয়ে।
শেখাওয়াত বাড়ির কারো এখনো আসার নামগন্ধ নেই কেন? কতদূর এসেছেন উনারা?তিনি ফোন কানে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে হৈহৈ রব উঠলো চারপাশে।

বরের গাড়িতে সন্ত্রাস হামলা হয়েছে!!!!!

খুবই গুরুতর অবস্থা। গাড়ি ভাঙচুর করেছে সন্ত্রাসরা।

এসব শুনে স্নায়বিক আঘাতে সংজ্ঞা হারিয়ে বসলেন আনতারা বেগম। এজন্যই তিনি বারবার ছেলেকে বলে বেড়ান দরকার পড়লে চাকরি করে খা তারপরও রাজনীতি ছাড়।

শোনামাত্রই ঘটনাস্থলে যাচ্ছিল আশরাফ। রাহা ভাইয়ের পিছু নিল সবার চোখের আড়ালে। সন্ত্রাস কারা হয় তা দেখার খুব ইচ্ছে তার।

আশরাফ ধমক দিল।

তোকে নিয়ে যাব না। তুই ওখানে গিয়ে কি করবি?

ডাকাত দেখব।

বলেই দৌড়ে গিয়ে আশরাফের বলিষ্ঠ আঙুল ধরলো সে। ফিসফিস করে বলল

প্লিজ প্লিজ। এমন করো না। আব্বা শুনলে যেতে দেবে না।

আশরাফ বড় বড় চোখ করে বোনের দিকে তাকালো।

ডাকাত? ওরা সন্ত্রাস। ডাকাত না।

ওই একই হলো । চলো চলো আব্বা আর জেঠুর আগে চলে যাই। গাড়ি ভাঙলে ভাঙুক কিন্তু জিজুর কোনো ক্ষতি টতি হলো না তো।

আশরাফ গভীর ভাবনায় ডুব দিয়ে বলল

কে জানে? যাহ গাড়িতে গিয়ে বোস।

রাহা খুশি হলো তবে মনের ভেতর একটা ভয় ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। মনে মনে প্রার্থনা করলো জিজুর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

তারা বেরোতেই শেখাওয়াত বাড়ির দুটো গাড়ি এসে থামলো বেজমেন্টে।

—–

ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে আশরাফের পনের মিনিটের মতো লেগেছে মাত্র। বাড়ির গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে আশরাফ। চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ দ্বিগুণ। রাহাকে ধমকে বলল

এই বিলাই খবরদার বের হবি না গাড়ি থেকে। আমি দেখছি ওরা কোথায়?

রাহা মুখ ভেঙচিয়ে বলল

তুমি ভাল্লুক।

আশরাফ মৃদু হেসে এগিয়ে গেল ললাট কুঞ্চিত করে।

রাহা দেখলো সামনেই জটলা পাকিয়েছে অনেকগুলো মানুষ। তার ভীষণ কৌতূহল হলো। গাড়ি থেকে নামবে নামবে করতেই দেখলো গাড়ির পাশেই পায়চারি করছে একটা সৌম্যদর্শন লোক। চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। গায়ে কালো জ্যাকেট নিচে সাদা গেঞ্জিটা আর হাতের ঘড়িটা,কানে গুঁজা সাদা ব্লুটুথ ইয়ারফোনটা স্পষ্ট শুধু।

ভরাট গলায় গর্জে গর্জে অবিরত কথা বলতে বলতে উঠে বসলো রাহার গাড়িতেই। চাবি মোঁচড়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল তড়িৎ গতিতে।

রাহা কিছু বলবে, চিৎকার করবে তার আগেই গাড়িটা অনেকদূর চলে এসেছে। সে পেছন থেকে লোকটার কাঁধের কাছের জ্যাকেট ধরে টান দিল সে। মুখ দিয়ে শুধু উহ উহ শব্দ বের হলো। ভয়ে, আতঙ্কে বক্ষঃস্থল কাঁপছে তার। মাথা ঘুরছে।

কাঁধে মেয়েমানুষের হাতের আঁচড় বিচরে মানবটা বুঝলো একটা মেয়ে মানুষ গাড়িতে আছে। ক্ষীপ্ত মেজাজ আর বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।

ওহ শিট বলে পা দিয়ে ধড়াম করে লাতি বসালো ধাতব বস্তুতে। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল আরও দ্বিগুণ। অনবরত ঝাপটাতে থাকা কোমল মেয়েলী হাতটা এক হাতে মোচড়ে ধরে রাশভারী গলায় ধমক দিয়ে বলল

ম্যাডাম একটু চুপ থাকুন। তখন মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন কেন? আগে চিৎকার দিলে তো ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিতাম। ভূতের মতো বসে ছিলেন আর এখন আমার সাথে ঝাপটাঝাপটি শুরু করেছেন। অসহ্য।

রাহা বোকাবনে গেল। লোকটাকে দারুণ উঁচুমানের মনে হচ্ছে। কিন্তু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতাম, ভূতের মতো বসে ছিলেন এসব কেমন কথা?

আমা..কে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? গাড়ি থামান।থামান বলছি। আমি খুব চিৎকার করব। লোকজন জড়ো করব। আপনাকে মার খাওয়াবো। আমার হাতটা ও মোচড়ে দিলেন। আপনি মানুষ ভালো না। নামান বলছি।

মানব গাড়ি থামালো না। ফোনে একনাগাড়ে বলতে থাকা হামলাকারীদের গাড়িটার খোঁজে বারবার চোখ এদিকওদিক বুলাচ্ছে সে।
পেছনে চিকন গলায় মেয়েটা তাকে যা না তা গালি বর্ষণ করেই যাচ্ছে।
সেফটির বিনিময়ে সিভিলিয়ানদের গালি খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আর্মিরা। এ আর নতুন কিছু নয়। গায়ে মাখলেন না মেজর।

তবে বেশকিছুদূর পৌঁছুতেই ফোনের ওপাশ থেকে খবর এল গাড়িটা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর বেশিদূর গিয়ে লাভ নেই।

তাদের গাড়িটা তখন কোনো নির্জন একটা রাস্তায়। বিকট শব্দে ব্রেক কষলো গাড়িটা। গাড়ি থেকে নেমে রাগে, দুদার্মতায় গ্লক সেভেনটিন থেকে খোলা আকাশে দুটো গুলি ছুঁড়ে দম নিলেন মেজর।

ধমকে বললেন,

আপনার জন্য আমি হাতছাড়া করে ফেলেছি। বারণ করেছিলাম চেঁচামেচি করতে। বিরক্তিকর মহিলা। ননসেন্স।

বলেই গাড়ির পেছনের সিটের দরজা খুলে দিতেই বলিষ্ঠ কড়ুয়া বাহুতে এসে পড়লো একঝাঁক চুলভর্তি মেয়েলী মস্তক। প্রকট হলো একটি লাবণ্যময়ী মেয়েলী মুখবিবর। বন্ধ চোখের পাতার নিচে দু’ফোটা আটকে থাকা নোনাজল টুপ করে গড়িয়ে পড়লো মাত্রই । একে অপরের সাথে এঁটে থাকা সুচিক্কন চঞ্চুতে রাজ্যের কুন্ঠা।

মেয়েটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে মহাবিরক্তি নিয়ে মেজর বিড়বিড় করলেন

যাব্বাবা এবার মেয়েদের কেস সামলাতে হবে?

চলবে..……..

নাইচ নাইচ খমেন্ঠ করেন ফাঠখ😐😐😐😐

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here