দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ১১

0
474

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে-স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব-১১

– আম্মু!

আদিবা দীপ্তকে আনতে যাচ্ছিল।কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয় নি।আদিবা যাওয়ার আগে দীপ্ত নিজেই চলে এসেছে।অনেকক্ষণ গাড়িতে বসে থাকার পরেও যখন কেউ যাচ্ছে না তখন দীপ্ত গাড়ি থেকে বের হয়ে দেখছিল কেউ আসছে কিনা।কিন্তু হঠাৎ করেই কোথা থেকে একজন ভিক্ষুক চলে আসে।ওনার সাথে একটা ছোট বাচ্চাও আছে।জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় অসহায় দৃষ্টিতে দীপ্তের কাছে কিছু টাকা চাইছিলো। কিন্তু ওর কাছে তো টাকা ছিল না।দীপ্তর ওদেরকে দেখে খুব মায়া হচ্ছিল।তাই টাকা নেওয়ার জন্য নিজের মোডকে বিসর্জন দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে।দীপ্তকে দেখে দীপ্তি বেগম মুখ টিপে হেসে বললো,

– তোর মোড আর ধরে রাখতে পারলি না?

দীপ্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে থমথমে মুখে বললো……

– নেহাতি বাধ্য হয়েছি আসতে নয়তো আসতাম না!

– তাই বুঝি?

– হুম,আব্বু কিছু টাকা দাও তো।

জামাল সাহেবকে এসে বললো দীপ্ত।জামাল সাহেব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,

– কেন?

– বাহিরে একজন ভিক্ষুক এসেছে তাকে দিবো।

জামাল সাহেব আস্ত ওয়ালেটটাই ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

– যাও,তার যতটা প্রয়োজন দিয়ে আসো।

বাবার হাত থেকে ওয়ালেটটা নিয়ে দীপ্ত ওর মাকে দেখিয়ে বলে,

– আম্মু এইটা নিতেই আমি বাড়ির এসেছিলাম!

দীপ্তি বেগম ছেলের এমন মহৎকর্মে খুশি হয়ে তৃপ্তির হাসি দিয়ে ছেলেকে চোখে ইশারা করেন টাকাটা দিয়ে আসার জন্য।দীপ্ত ভিক্ষুককে টাকা দিয়ে ফিরে এসে ওর আব্বুকে ওয়ালেটটা ফেরত দেয়।সোফায় দৃষ্টি পড়তেই দেখলো রাবিয়া বেগম বসে আছে।দীপ্ত দৌড়ে গিয়ে রাবিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।রাবিয়া বেগমও অনেক দিন পর নাতিকে কাছে পেয়ে আবেশে জড়িয়ে ধরলেন।দীপ্ত বললো,

– কেমন আছো নানুজান?
– ভালো আছি।তুই কেমন আছিস?
– আমিও খুব ভালো আছি।
– এতো দিনে বুঝি এই বুড়ী নানুর কথা মনে পরলো?

অভিমানী স্বরে বললো রাবিয়া বেগম।দীপ্ত ওর নানুকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে করুণ স্বরে বললো,

– কি করতাম বলো?পড়াশোনার প্রচুর চাপ ছিল যে।তোমাদের সবার কথা প্রতিমুহূর্তে মনে পড়তো।মন চাইলেও তো আসা যেতো না।এত দূর থেকে তো বললেই চলে আসা যায় না বলো।

– তা ইয়াং ম্যান এখন তোমার কি ইচ্ছে?এখানেই থেকে যাবে নাকি আবার উড়াল দিবে?

দীপ্তকে উদ্দেশ্য করে গলার স্বর উঁচু করে বললেন আনোয়ার সাহেব।নানাজানের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েই বেশ উল্লাসে দৌঁড়ে গিয়ে আনোয়ার সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো দীপ্ত।খুশিতে গদোগদো হয়ে হেসে বললো,

– আপাতত লন্ডনে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।ভার্সিটি লেভেলটা এইখানেই কমপ্লিট করার ইচ্ছা আছে।তাই তো চলে এসলাম তোমাদের কাছে।

– খুব ভালো করেছো।

দীপ্তের পিঠ চাপড়ে বললেন আনোয়ার সাহেব।দীপ্ত ফের বললো,

– আর তুমি ইয়াং ম্যান কাকে বলছো?আমি সেই দশ বছর আগে তোমাকে যেমন দেখে গিয়েছিলাম তুমি তো দেখছি এখনো তেমনি আছো!কি ব্যাপার নানাজান?তোমার এই যৌবন ধরে রাখার রহস্যটা কি বলো তো?

শেষ কথাটা আনোয়ার সাহেবের কানে কানে ফিসফিস করে বলল দীপ্ত।বিষম খেয়ে যান আনোয়ার সাহেব।পরিস্থিতি সামাল দিতে আনোয়ার সাহেব গলা ঝেড়ে দীপ্তের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলেন,

– এটা টপ সিক্রেট!তোমায় পরে বলবো।
– পাক্কা?প্রমিজ!
– হুম হুম পাক্কা!
– ঠিক আছে তাহলে।

– নানা-নাতি মিলে সেই কখন থেকে কি এতো গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করা হচ্ছে শুনি?

রাবিয়া বেগম সন্দিহান চোখে তাকিয়ে দেখে বললেন।আনোয়ার সাহেব আর দীপ্ত চকিত দৃষ্টিতে তাকায় রাবিয়া বেগমের দিকে।তিনি। ফের ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাস করেন।দীপ্ত ফিচেল হেসে বললো,

– কিছু না নানুজান।ওই নানাজানকে একটু ভালো মন্দ জিজ্ঞাস করলাম আরকি।

দীপ্ত এগিয়ে গিয়ে ফের রাবিয়া বেগমের পাশে বসে।এদিক সেদিন চোখ বুলিয়ে রাবিয়া বেগমের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,

– নানুজান বাড়ির বাকি সবাই কোথায়?ছোট মামুর যমজ পিচ্চি দুইটা নিশ্চয় অনেক বড় হয়ে গেছে?আচ্ছা ওরা দেখতে কি এক রকমই হয়েছে?

– হ্যাঁ,দেখতে এক রকমই হয়েছে।ওরা সবাই একটা বিয়ে বাড়িতে গেছে। সেই সকাল বেলায় গেছে এতক্ষণে তো চলে আসার কথা।

– এসে গেছি এসে গেছি!

ইমরুল সাহেব বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বললেন।রাবিয়া বেগম স্মিত হেসে বললো,

– এই দেখ বলতে না বলতেই চলে এসেছে।

সবাই বাড়িতে চলে আসার সাথে সাথে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।এতো বছর পর তাদের বাড়িতে বোন, বোনজামাই ভাগ্নে এসেছে বলে কথা।গোধূলি আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছে।ফুপা-ফুপির সাথে দেখা হলেও দীপ্তের সাথে ওর আগে কখনো দেখা নি।হয়েছে বলতে সেই ছোট বেলায়!গোধূলির বয়স যখন দুই বছর তখন দীপ্তরা লন্ডনে চলে যায়। দীপ্তি বেগম আর জামাল সাহেব বাংলাদেশে কয়েক বার আসলেও দীপ্ত কখনো আসে নি।আর এই জন্যই দীপ্তকে গোধূলি কখনো দেখে নি।

গোধূলি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে ওর এই “গোধূলি” নামটা নাকি দীপ্তই রেখেছিল।এই নামটা যে রেখেছে তাকে দেখার জন্য সেই ছোট্ট বেলা থেকে গোধূলি কতই না এক্সাইটেড ছিল।যে ওর এই সুন্দর নামটা দিয়েছে না জানি সে দেখতে কত সুন্দর!কিন্তু না!এই ছেলে তো দেখতে আস্ত একটা এলিয়েন!গোধূলির খুব অভিমান হচ্ছে।সাথে অনেক রাগও।সবার সাথেই তো দীপ্ত দেখা করলো কই ওর কথা তো একবারো জিজ্ঞাস করলো না!আর ও কিনা ভেবেছিল সবার আগে হয়তো ওর কথায় জিজ্ঞাস করবে!

দীপ্তরা আজকে আসবে শুনে আদিবাকে নিয়ে আগে-বাগেই বিয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছিল গোধূলি।কিন্তু এখন দেখছে শুধু শুধু এতোটা পথ দৌড়ে এসেছে।এর থেকে তো বিয়ে বাড়িতে থাকলেই ভালো হতো।এটলিষ্ট সবাই মিলে আনন্দ করতে পারতো।এখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বোরিং ফিল করতে হতো না!

গোধূলি কথা গুলো মনে মনে ভেবে ঠোঁট বাঁকিয়ে কড়া গলায় বিড়বিড় করে বললো,

– যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার সাথে এসে দেখা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমিও সামনে যাবো না হু!

গোধূলি মুখ ভেংচি দিয়ে ওইখানে নাক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

– মা,আদিবা আর সাজি তো সেই কখন বিয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছে।তাহলে ওদেরকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

জাকিয়া বেগম রাবিয়া বেগমকে জিজ্ঞাস করলো।তখনই আদিবা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বললো,

– এই তো মা আমি এখানে।

– তুই এখানে তাহলে সাজি কোথায়?

– ও তো এতক্ষণ নিচেই ছিল।ফুপা ফুপির সাথেও তো দেখা করে গেল।মনে হয় ওর রুমে আছে

– বিয়ে বাড়ি থেকে তো ঠিক মতো কিছু খেয়েও আসে নি মেয়েটা।গিয়ে দেখ তো কোথায় আছে?

জাকিয়া বেগম আর আদিবার আলাপচারিতা মাঝে দীপ্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,

– বড় মামী,সাজি কে গো?

দীপ্তের এইরূপ প্রশ্ন শুনে বিষম খায় গোধূলি।হতভম্ব হয়ে দীপ্তের দিকে তাকিয়ে আছে।এই ছেলেকে এবার গোধূলির কাছে সত্যি সত্যিই এলিয়েন!ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে।নয়তো এমন প্রশ্ন করে?গোধূলি তাচ্ছিল্যের সুরে বিড়বিড় করে বললো,

– বাহ্ বাহ্ ভালোই!এই ছেলে দেখছি আমাকে চিনেই না!ওর মেজো মামার যে একটা মেয়ে আছে, যার নাম গোধূলি ইসলাম সাজি সেটা মনে হয় এই দশ বছরে ভুলেই গেছে!ধ্যাৎ আমি আর এখানে থাকবোই না!

গোধূলি রাগে গজগজ করতে করতে ওখান থেকে চলে যায়।দীপ্তের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে ফিক করে হেসে দেয় জাকিয়া বেগম।বললেন,

– দেখো ছেলের কান্ড!তুমি কি সাজির কথা ভুলে গেছো নাকি দীপ্ত?ও তো তোমার মেজো মামার মেয়ে।

দীপ্ত অবাক হয়ে বললো,

– ওহ্!ওর কথা তো আমার মাথা থেকে বেড়িয়েই গেয়েছিল!কিন্তু আমি তো ওর নাম গোধূলি দিয়েছিলাম।

– হুম,কিন্তু বাড়ির সবাই ওকে সাজি বলেই ডাকি!সাজ্জাদের মেতে সাজি!

– ওহ আচ্ছা!তাহলে এখন সে কোথায়?সেই ছোট্টবেলায় দেখেছিলাম। এখন হয়তো অনেক বড় হয়ে গেছে?

– হ্যাঁ,এখন সেভেন এ পড়ে!

– ব্বাবাহ!অনেক বড়ই হয়ে গেছে তাহলে।কিন্তু আমার সাথে দেখা করতে এলো না যে?

দীপ্তের কথার প্রত্যুত্তরে দীপ্তি বেগম বললেন,

– এসেছিল,তখন তুই গাড়িতে ছিলি।তোকে কি বলে জানিস?

কৌতূহলী হয়ে দীপ্ত বললো,

– কি বলে?

তখন গোধূলির বলা কথাটা দীপ্তি বেগম সবাইকে বলে দেয়।গোধূলির বলা কথা শুনে সবাই ফিক করে হেসে দেয়।দীপ্তের ভীষণ লজ্জা লাগছিল সবাই হাসছিল বলে।সাথে প্রচন্ড রাগও হচ্ছিল।পিচ্চি মেয়ের এতো বড় সাহস?দীপ্ত কোনো মতে ওখান থেকে আহানকে নিয়ে ওর ঘরে চলে আসে।নয়তো সবাই মিলে আরো হাসাহাসি করতো ওকে নিয়ে।

________________

দীপ্ত রাগে গজগজ করতে করতে রুমে ঢুকলো।মেয়ের সাহস দেখেছো ওকে অপমান করে?এই দীপ্ত চৌধুরীকে?এই মেয়েকে ও পরে দেখো নেবে!

– কি ভাবছিস দীপ্ত?

আহানের কথায় ধ্যান ভাঙে দীপ্তের।দীপ্ত স্মিত হেসে বললো,

– কিছু না।

একটু পর ফের বললো,

– আচ্ছা আহান, তুইও তো এই বছর ভার্সিটিতে এডমিশন নিবি?

– আমি ভর্তি হয়ে গেছি।

– ওহ তাই?আচ্ছা কোন ভার্সিটিতে?আমিও তোর ভার্সিটিতেই পড়বো।আমাকে কালকে তোর ভার্সিটিতে নিয়ে যাস।

– ওকে,এখন তুই একটু বিশ্রাম নে।অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছিস।

– হুম আগে একটা লম্বা শাওয়ার নেই তারপর একটা লম্বা ঘুম দেবো।

– ঠিক আছে।

শাওয়ার নিয়ে এসে দীপ্ত ঘুমিয়ে পড়েছিল।যখন দীপ্তের ঘুম ভাঙে তখন সূর্য প্রায় ডুবো ডুবো অবস্থায়।ছোট বেলা থেকেই বিকালের এই সময়টা দীপ্তের খুব পছন্দের।সূর্যাস্তের পরমুহুর্তের সময়টা দীপ্ত খুব উপভোগ করে।আধখোলা চোখে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে দীপ্ত।থাই গ্লাসে ডুবন্ত সূর্যের তীর্যক রশ্মি চোখে পড়তেই এক লাফে বিছানা থেকে উঠে সোজা দৌঁড় লাগায় ছাদের উদ্দেশ্যে।

দীপ্ত ছাদের সিঁড়ির কাছে যেতেই ওর চোখ গিয়ে পড়লো ছাদের পশ্চিম দিকটায় দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মানবীর উপর।থমকে দাঁড়ায় দীপ্ত।কোমড় ডিঙানো খোলা চুল গুলো সন্ধ্যার বাতাসে উড়ছে।সেই দিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো বেখেয়ালি মনে আকাশের পানে তাকিয়ে আকাশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতেই ব্যস্ত!দীপ্ত ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সম্মুখে।সেই তরুণীর ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,

– চুলের জন্য খোঁপা আছে,তেমন করেই না হয় রেখো!
মেঘকালো চুল ছড়িয়ে কেন,সূর্যটাকে ঢাকো?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here