দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ৩৪

0
318

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব-৩৪

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই পুরো রিসোর্টটা জমকালো সাজে সেজে উঠেছে।যে রকম নাম এই রিসোর্টের ঠিক তেমনই বিস্ময়কর সাজ।মুন লাইট রিসোর্ট,আহ!নামেই যার চাঁদের আলো তার সাজসজ্জাও তো তেমনই হওয়া চাই।হোটেলের রুমগুলো সব দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আর নিচ তলাটায় রেস্টুরেন্ট।দক্ষিণমুখী হোটেলের ঠিক মাঝখানে বড় সিঁড়ি রয়েছে যেটা সোজা দ্বিতীয় তলায় গিয়ে শেষ হয়েছে।এই সিঁড়িটাই হোটেলের প্রবেশদ্বার।হোটেলের পূর্ব পাশে বিশাল বড় সুইমিংপুল।হোটেলের ঠিক সামনে বিস্তৃত খোলা মাঠ।তবে এই মুহূর্তে দেখে বুঝার জো নেই যে এটা কোনো খোলা মাঠ।চারপাশে ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো।মাথার উপর খোলা সীমাহীন আকাশ।ক্ষনে ক্ষনেই আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে।আতশবাজির আলোয় পুরো শহর আলোকিত হয়ে যাচ্ছে বার বার।মাঠের ঠিক মাঝখানে অনেক বড় করে স্টেজ করা হয়েছে এনগেজমেন্টের জন্য।আর স্টেজের সামনে ডেকোরেশন করা হয়েছে অতিথিদের বসার জন্য।পুরো রিসোর্ট ভর্তি শহরের গণ্যমান্য বিজনেসম্যান আর রাজনৈতিকবিদ।তাছাড়া আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব তো আছেই।

আদিবাকে পার্লারের মেয়েরা এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে।অপরূপ সুন্দরী লাগছে আদিবাকে। লাজুক,
সোনিয়া,রুহি,মুক্তি পরেছে পিউর মেরুন কালারের লেহেঙ্গা।প্রত্যেক জনকে দেখতে একই রকম লাগছে।সবার সাজটাও একটু ভারীই হয়েছে।অবশ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক।বেস্টফ্রেন্ডের এনগেজমেন্ট বলে কথা।তবে লাজুক তো নামের মতো বরাবরই একটু লাজুক!সেও সবার জোড়াজুড়িতে সেজেছে তবে অল্প!এত গর্জিয়াসভাবে না।মেয়েদের মোটামুটি সাজ কমপ্লিট।কিন্তু গোধূলিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মানে এইখানে অন্যদের সাথে নেই আরকি।ও ওর রুমে একা একাই সাজছে।লাজুক অবশ্য বলেছিল ওর সাথে যেতে কিন্তু গোধূলি ওকে সাফ সাফ মানা করে দিয়ে বলেছে,

– আমাকে সাজাতে হবে না। আজকে আমার বুবুর এনগেজমেন্ট।আমার বুবুকে যেন সবার থেকে স্পেশাল আর সুন্দর লাগে ওকে।সো,এটা দেখার দায়িত্বটা আমি তোমাকে দিচ্ছি লাজুবু।নেহাতি আমার শরীরটা বেশি ভালো না।নয়তো বুবুকে আমিই সাজাতাম।এখন তুমি যাও তো, আমি একাই সাজতে পারি হু!

– আচ্ছা আমি যাচ্ছি।তুই একটু সাবধানে চলাফেরা করিস বোন।

– ঠিক আছে।

লাজুক গোধূলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায়।

দীপ্ত ওর রুমে রেডি হচ্ছিলো।ইহান দীপ্তকে ডাকতে এসে দীপ্তের পড়নে ডার্ক মেরুন কালারের সুট দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে,

– দীপ্ত ভাইয়া সবার না ম্যাচিং ড্রেস পড়ার কথা!
তাহলে তুমি কেন অন্য কালার সুট পড়েছো?

– একটু পড়েই বুঝতে পারবি!

– মানে?

– মানে তুই আমাকে ডাকতে এসেছিলি রাইট?আমিও রেড়ি তো এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন চল!

দীপ্তের কথার কিছুই ইহানের মাথায় ঢুকে নি।কিন্তু দীপ্তকে অন্যকিছু জিজ্ঞাস করার সাহস ইহানের নেই!তাই দীপ্তের কথা মেনে নেয়।এইদিকে আলিফ আলবীসহ ছেলেরা সবাই সাদা শার্টের উপর ব্ল্যাক কালার সুট পড়েছে।আহান, ইহান, ইফতি, রোহান, সিফাত সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে কাজ করছে।কেউ গেস্টদের সদর দরজা থেকে স্বাগতম জানাচ্ছে তো কেউবা গেস্টদের সাথে কুশল বিনিময় করছে।রাজনীতিবিদদের বেশির ভাগই দীপ্তের ইনভাইটেশনে এসেছে।তাই দীপ্ত ওনাদের সময় দিচ্ছে।এছাড়াও দীপ্তের বিজনেস পার্টনার আর বন্ধু যারা আছে সবাই এসেছে।গার্ডিয়ান হয়ে ইমরুল সাহেবই সবদিক সামাল দিচ্ছেন।এইদিকে যাদের মেয়ের বিয়ে তাঁদেরই কোনো খবর নেই!আহসান সাহেবকে কোথাও দেখতে না পেয়ে রনিত সাহেব আহানকে জিজ্ঞাস করেন,

– আহান তোমার আব্বু কোথায়?তাকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।

– আসলে আঙ্কেল আব্বুকে অনেকক্ষণ ধরেই এখানে দেখা যাচ্ছে না!

– বাহ!মেয়ের এনগেজমেন্টে মেয়ের বাবাই লাপাত্তা!

– আব্বু মনে হয় আশেপাশেই কোথাও আছে।আঙ্কেল আপনি বসুন আমি আব্বুকে ডেকে দি….

– না থাক বাবা, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।আমি খুঁজে নিচ্ছি।তুমি বরং এখানেই থাকো।

– ঠিক আছে আঙ্কেল।

____________________

রায়ান ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল।এমন সময় ও শুনতে পেলো,আরে দোস্ত তোরা যে কি বলিস না!রিসর্টের এমন জমকালো আয়োজন হওটাই তো স্বাভাবিক।এই শহরের টপ ওয়ানে থাকা বিজনেসম্যান দীপ্ত চৌধুরীর এনগেজ…..বাকি কথা রায়ান শুনতে পারে নি।রায়ান পুরো কথা শুনার আগেই রায়ানকে দেখতে পেয়ে ওরা কথাটা স্টপ করে দেয়।রায়ান অর্ধেক কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারছে না!চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে গোধূলিদের বাড়ির কেউ আছে কিনা।কিন্তু কাউকেই চোখে পড়ছে না।এক সময় একটু দূরে দীপ্তকে কারো সাথে আলাপ করতে দেখে রায়ান।তারপর কাছে গিয়ে দীপ্তকে আস্তে করে ডাক দে রায়ান,

– দীপ্ত!

রায়ানের ডাকে পিছনে ফিরে দীপ্ত।চোখের ইশারায় রায়ানকে বুঝায় ও আসছে।

– এক্সকিউজ মি!আপনারা কথা বলুন আমি একটু আসছি।

দীপ্ত ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রায়ানের কাছে এসে বলে,

– কি ব্যাপার দুলাভাই?

– আরে দীপ্ত এই দিকে আসো তো!তোমার সাথে আমার ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।

রায়ান দীপ্তের হাত ধরে টেনে একটু সুইমিংপুলের দিকের নিয়ে যায়।রায়ানের ব্যবহারে দীপ্ত কিছুটা হকচকিয়ে যায়।দীপ্ত বুঝতে পারছে না রায়ানের কি এমন ইম্পর্ট্যান্ট কথা থাকতে পারে যেটা এইভাবে আড়ালে নিয়ে এসে বলতে হবে!দীপ্ত শীতল কণ্ঠে বললো,

– কি ইম্পর্ট্যান্ট কথা?

– আজকে এনগেজমেন্টটা কার?

রায়ানের এমন প্রশ্নে দীপ্ত ওর অট্টহাসি কোনোমতে দমিয়ে রেখে মনে মনে বলছে,আহারে বেচারা গুগলির মধ্যে পড়ে গেছে।কিন্তু রায়ানকে সিরিয়াসই মনে হচ্ছে দেখে দীপ্ত জিজ্ঞাস করলো,

– মানে?

– এনগেজমেন্টটা কি আমার না তোমার?

– একচুয়েলি আজকে এখানে এনগেজমেন্ট হবে আপনাদের আর আমা….

কিছু একটা ভেবে দীপ্ত পুরো কথা শেষ না করে রায়ানকে ফিরতি প্রশ্ন করে,

– কেন?

রায়ান কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলেরদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে

– ওইদিকে তোমার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল আমাকে দেখেই ওই ছেলেগুলো কথাটা স্টপ করে দেয়।তাই

…….

– দীপ্ত তুমি এইভাবে ব্লাশিং করছো কেন?বাই দ্যা ওয়ে শালাবাবু আমাকে একটা কথা বলো তো!

– কি কথা?

– সবাই মিলে কি খিচুড়ি পাকাচ্ছো যেটা আমি জানি না!

– হা হা হা…..

রায়ানের অবস্থা দেখে দীপ্ত ওর হাসি আর দমিয়ে রাখতে পারলো না।

– তুমি হাসছো কেন?

দীপ্ত ওর হাসি থামিয়ে রায়ানের কাছে এসে কানাকানি ফিসফিস করে বলে,

– জামাইবাবু রিসর্টে ঢুকার সময় গেইটের পাশে যে নেইম-প্লেটটা ঝলঝল করছে সেটা একবার হলেও আপনার দেখা উচিৎ ছিল!

দীপ্তের কথা শুনে রায়ানের মুখ হা হয়ে গেছে আর চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে।কারণ সে দীপ্তের বলা কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। দীপ্ত রায়ানের অবস্থা দেখে মুচকি হেসে রায়ানের থুতনি উপরে ঠেলে বলে,

– এইভাবে হা করে থাকলে মুখের ভিতর মশা-মাছি ঢুকবে!

– দীপ্ত…..

রায়ান কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু দীপ্ত রায়ানকে বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যেতে যেতে বলে,

– সাসপেন্স!

দীপ্তের কথা কিছুই বুঝতে পারলো না রায়ান।রায়ান মনে মনে ভাবছে,
– সাসপেন্স!এই ছেলের এইসব হেয়ালি পনা কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আমার আর আদিবার নাম ছাড়া নেইম-প্লেটে আর কি এমন থাকতে পারে?দীপ্ত কথাটা এইভাবে বললো কেন?আর ওই ছেলেগুলোই বা কি বলছিল?ধুরু গিয়ে দেখেই আসি না নেইম-প্লেটে কি গাবলা আছে!

রায়ান যেই গেইটের দিকে যাবে বলে পা বাড়ালো ঠিক তখনই পিছন থেকে হাতে টান পেয়ে থেমে যায়।পিছনে তাকিয়ে দেখে রনিত সাহেব।

– তুই আবার ওইদিকে কোথায় চলে যাচ্ছিস?

– আব্বু আমি একটু বাহিরে……

রায়ান ওর পুরো কথা না বলেই আবার রনিত সাহেবকে প্রশ্ন করে,
– আচ্ছা আব্বু তুমি কি কিছু জানো?

রনিত সাহেব ছেলের হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলেন,

– কি জানবো?

– নেইম-প্লেট সম্পর্কে?আজকে কি এখানে শুধু আমার এনগে…..
আরে আব্বু আমার কথাটা তো শুনো।

– তোর কথা শুনার সময় নেই তুই চল আমার সাথে।এনগেজমেন্টের সময় হয়ে গেছে!

“আজকে কি এখানে শুধু আমার এনগেজমেন্ট হবে নাকি দীপ্তেরো” – এই কথাটা রায়ান বলতে পারে নি। তার আগেই ওর হাত ধরে রনিত সাহেব হাটা শুরু করেন।গন্তব্য আদিবার রুম।

মোটামুটি সবাই নিচে এসে উপস্থিত হয়েছে।শুধু বর-কনে ছাড়া।গোধূলি সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই পুরো রিসর্টের লাইট অফ হয়ে যায়।অন্ধকারে আসতে পারবে না বলে ওইখানেই দাঁড়িয়ে যায়।

– এটেনশন প্লিজ!

কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই স্টেজ থাকা লাইটগুলো মুহূর্তেই জ্বলে উঠে।স্টেজের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মিহিরের উপর সবার দৃষ্টি স্থির।সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে মিহির কি বলবে তা শুনবে বলে।গোধূলি এখনো উপরেই দাঁড়িয়ে আছে।তাঁরও উদ্দেশ্য মিহির কি এনাউন্স করে সেটা শুনা।

– গুড ইভিনিং লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান!অনেকক্ষণ আপনাদের অপেক্ষায় রাখা হয়েছে!যাদের উদ্দেশ্য আজকের এই আয়োজন আর কিছুক্ষনের মধ্যেই তাঁরা আমাদের মাঝে উপস্থিত হতে চলেছে।
প্লিজ ওয়েলকাম!

মিহিরের এনাউন্সমেন্টের সাথে সাথে আবারো পুরো রিসর্ট অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।হঠাৎ করেই বড় লাইটের আলো পড়তেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা একজোড়া সবুজ কাপল!আদিবার পড়নে সবুজ লেহেঙ্গা আর রায়ানের পড়নে সবুজ সুট।দুজনকেই খুব সুন্দর লাগছে।আদিবাকে হাত ধরে খুব সাবধানতার সহিত নিচে নামে রায়ান।আদিবারা নিচে এসে দাঁড়াতেই আবারো সব লাইট অফ হয়ে যায়।মিহির আবারও এনাউন্স করে,

– প্লিজ ওয়েলকাম,আওয়ার এনাদার স্পেশাল কাপল!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here