#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#পর্বঃ14
মাঝখানে কেটে গেছে আরো এক সপ্তাহ। এর মধ্যে দিশা বা মেঘ কেউই ভার্সিটিতে আসেনি। কারন ওরা এতোদিন নিজেদের বাসা গোছানো নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো। সেই ঘটনার পরের দিনই ওরা সবাই হোটেল থেকে চেক আউট করে অভিদের ফার্ম হাউজে উঠেছে। এখন থেকে ওরা সবাই সেখানেই থাকবে। বিকজ মেঘ আর দিশার সেমিস্টার ফাইনাল এক্সামের ডেট কাছাকাছি চলে এসেছে। এইজন্যে আপাততো ভার্সিটি থেকে ওদের ট্রান্সফার নেওয়া সম্ভব না। তাই আজম রহমান ডিসিশন নিয়েছেন ওদের এক্সাম শেষ না হওয়া অবদি ওনারা বাংলাদেশেই থাকবেন। এক্সাম শেষ হওয়ার পর ওদের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে ওনারা আবার ইউরোপে ফিরে যাবেন।
সন্ধ্যা 7:00……….
মেঘের মন খারাপ দেখে আজম রহমান ওকে নিয়ে বাইরে ঘুড়তে আসলেন। আজম রহমান বেশ ভালো ভাবেই খেয়াল করেছেন এখানে আসার পর থেকে মেঘ কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এতোদিন ওর উপর দিয়ে যা গেছে তাতে এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়ের এমন চুপচাপ থাকাটা উনি একদমই মেনে নিতে পারছেন না। তাই যথা সম্ভব নিজের সাধ্যমতো মেঘকে আবার আগের মতো স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন।
ফার্ম হাউজ থেকে বের হয়ে বেশ কিছুক্ষন ড্রাইভ করার পর আজম রহমানদের গাড়ি এসে থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। মেঘ জানালা দিয়ে এক পলক বাইরে তাকিয়ে আজম রহমানকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“বাবাই আমার এখন ভালো লাগছে না। আমি কিছুই খাবো না। তুমি ভিতরে যাও, আমি এখানেই বসে থাকি প্লিজ?”
ওর কথার শেষ হতেই পিছনের গাড়ি থেকে একজন গার্ড এসে আজম রহমানের সাইডের দরজা খুলে দিলো। উনি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন
“একদমই না। তুমিও আমার সাথে ভিতরে যাবে। আর খেতে ইচ্ছে না করলে বসে বসে আমার খাওয়া দেখবে। আসো গাড়ি থেকে বের হও।”
_______________________
রেস্টুরেন্টে এসে আজম রহমান কফি আর স্নাক্সের অর্ডার দিলেন। মেঘ কিছু না বলে চুপটি করে ওনার পাশে বসে রইলো। আজম রহমান মেঘকে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ওনার ফোনে একটা কল আসলো। উনি পকেট থেকে ফোনটা বের করে রেস্টুরেন্টের এক সাইডে চলে গেলেন। তারপর কথা বলা শেষ করে মেঘের কাছে এসে ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন
“মামনি আমাকে এখনি যেতে হবে। আমাদের কম্পানির যেই ব্রাঞ্চটা এখানে আছে সেখানে ডিলের একটা পেপার নিয়ে কিছু প্রভলেম হয়েছে। আমি ওখানে এখন না গেলে বড় কোনো গন্ডোগোল হয়ে যাবে। তাই আমি এখন অফিসের দিকে যাচ্ছি, আর গার্ডদের বলে যাচ্ছি ওরা তোমাকে সেইফলি বাসায় পৌছে দিবে।”
কথাটা বলে আজম রহমান আর এক মিনিটও দাড়ালেন না। দ্রুত পায়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলেন। মেঘ আজম রহমানের যাওয়ার দিকে ভাবলেসহীন ভাবে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর কাছে এই জিনিস গুলো খুবই নরমাল। কারন আজম রহমান সব সময় এরকমই করে। প্রথমে ওকে নিয়ে বাইরে ঘুড়তে আসে তারপর কাজের জন্যে জরুরি ফোন পেলে সবকিছু ভুলে গিয়ে সেই কাজের জায়গায় চলে যায়। আর ‘ও’ গার্ডদের সাথে বাড়ি ফিরে যায়। মেঘের এসব ভাবনার মধ্যেই কেউ এসে ওর সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লো। ‘ও’ চোখ তুলে ভালো করে সামনে বসে থাকা ব্যাক্তিটার চেহারার দিকে তাকালো। ব্যাক্তিটার চেহারার দিকে তাকাতেই মেঘ ভ্রু কুচকে ফেললো। কারন ওর সামনে আহান বসে আছে। আহান ব্লাক একটা ট্রাউজার আর হোয়াইট টিশার্ট পড়ে আছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাসায় যেগুলো পড়া ছিলো সেগুলো পড়েই এখানে চলে এসেছে। ওর চুলগুলো একদম উশকো খুশকো হয়ে কপালে পড়ে আছে। চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। আহানের মতো পরিপাটি একটা ছেলের এমন অগোছালো অবস্থা দেখে মেঘ বেশ অবাক হলো। আহান এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বললো
“এতোদিন ধরে ভার্সিটিতে আসোনি কেনো? আর ফোন কোথায় তোমার? বন্ধ করে রেখেছো কেনো?”
কথাটা আহান স্বাভাবিক ভাবে বললেও মেঘ ওর চোখে মুখে চিন্তার ছাপটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। কিন্তু সেসবে মেঘ পাএা না দিয়ে বেশ কাটাকাটা কন্ঠে বললো
“বাসায় কাজ ছিলো তাই ভার্সিটিতে যাইনি। আর ফোনে তেমন কোনো বিশেষ কাজ নেই তাই বন্ধ করে ওয়ারড্রোপে রেখে দিয়েছি।”
মেঘের এমন গা ছাড়া জবাব শুনে আহানের ভিষন রাগ লাগলো। তবে ‘ও’ সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না। কারন আগে থেকে এমনিতেই সবকিছু বিগরে আছে। তাই আপাততো মেঘকে ভয় দেখানোর কোনো ইচ্ছেই ওর নেই। আহান ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো
“বুঝলাম! বাট ফোনটা কি ওয়ারড্রোপে তুলে রাখার জিনিস? ওটা কি তুমি ওয়ারড্রোপ সাজানোর জন্যে কিনেছো নাকি?”
আহানের কথা শুনে মেঘ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
“হ্যা,ওটা ওয়াড্রোপ সাজানোর জন্যেই কিনেছি। আসলে আমার কাছে ওয়ারডোপ সাজানোর মতো কোনো শপীজ নেই তো। তাই ফোনটা অফ করে শপীজের জায়গায় রেখে দিয়েছি।”
মেঘের কথা শুনে আহানের এবার হাসি পেলো। ‘ও’ ঠোট চেপে মুচকি হেসে মেঘকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“ভালোই করেছো। এইবার বলো,কি খাবে? আমার কিন্তু ভিষন খিদে পেয়েছে।”
মেঘ বসা থেকে দাড়িয়ে গিয়ে বললো
“খিদে লাগলে খেয়ে নিন। আমি এখন বাসায় যাবো।বাই।”
কথাটা বলে মেঘ রিসিপশনে এসে আরো কিছু খাবারের অর্ডার দিলো। তারপর বিলটা দিয়ে রিসিভশনে বসে থাকা ছেলেটাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“রেস্টুরেন্টের বাইরে ছোট ছোট কয়েকটা ছেলে মেয়েকে রাস্তার পাশে বসে থাকতে দেখলাম। খাবার গুলো পার্সেল করে আপনাদের কোনো স্টাফকে দিয়ে ওদেরকে দিয়ে আসবেন।”
কথাটা বলে মেঘ ধ্রুত পা ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেলো। রিসিভশনের ছেলেটা মেঘের যাওয়ার দিকে অবাক দৃস্টিতে তাকিয়ে রইলো। আজকাল দুই টাকার উপরে মানুষ যাদের ভিক্ষা দিতে চায় না, তাদের জন্যে এই বাচ্চা মেয়েটা কতো অনায়াসেই এতোগুলো টাকার খাবার অর্ডার করে চলে গেলো? কথাটা ভাবতে ভাবতে ছেলেটা বিরবির করে বললো
“এদের মতো কিছু মানুষের জন্যেই হয়তো এখনো মনুষ্যত্ব নামের জিনিসটা বেচে আছে। নাহলে মানুষ আর জানোয়ারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতো না।”
_______________________
মেঘ রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে গাড়িতে উঠার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে যেতেই কেউ পিছন থেকে এসে মেঘের মুখ চেপে ধরে ওকে টেনে হিচড়ে নিয়ে গিয়ে অন্য একটা গাড়িয়ে উঠালো। গাড়িতে উঠানোর সাথে সাথে গাড়িটা শা করে টান দিয়ে চলে গেলো। মেঘ একটা চিৎকার দেওয়ার সুযোগটাও পেলো না।
‘ও’ লোকটার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগলো। ওকে এতোটা ছটফট করতে দেখে লোকটা ওর মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে ফেললো। মেঘ বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে পাশে থাকা ব্যাক্তিটার দিকে তাকালো। তাকাতেই ‘ও’ চারশো চল্লিশ বোল্টের শকড খেলো। কারন ব্যাক্তিটা আর কেউ না, আহান। আহানের ঠোটের কোনে মৃদ্যু বাকা হাসি। মেঘ রাগি কন্ঠে চিল্লিয়ে বললো
“এটা কোন ধরনের অভদ্রতা? আপনি জোড় করে কেনো এভাবে আমাকে নিয়ে আসলেন?”
আহান স্বাভাবিক ভাবেই বললো
“কারন,ভালো ভাবে বললে তুমি কিছুতেই আমার সাথে আসতে না।”
“তাই বলে আপনি কিডন্যাপারদের মতো আমাকে এভাবে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসবেন? বাবাই যদি এসব জানতে পারে তাহলে কতোটা রেগে যাবে একবার ভাবতে পারছেন?”
আহান ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বললো
“তোমার বাবাই রেগে গেলে আমার কি? আমি কি তাকে ভয় পাই নাকি?”
আহানের কথা শুনে মেঘের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু এই মুহূর্তে আহানের সাথে ঝগরা করার ওর বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই। কারন আজম রহমান সবটা জানার আগেই ওকে যতো দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরতে হবে। নাহলে যে খুব বড়সড় একটা গন্ডোগোল হয়ে যাবে সেটা ‘ও’ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। মেঘ ব্যাস্ত কন্ঠে আহানকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“গাড়ি থামান প্লিজ। আমি বাসায় যাবো।”
আহান এতোক্ষন সামনের দিকে তাকিয়ে মেঘের সাথে কথা বলছিলো। এইবার মেঘের কথা শুনে ‘ও’ ঘাড় ঘুড়িয়ে ওর দিকে তাকালো। তারপর বললো
“এতো কাঠ খর পুড়িয়ে তোমাকে এখানে নিয়ে আসলাম কি বাসায় যেতে দেওয়ার জন্যে? চুপচাপ এখানে বসে থাকো সময় হলে আমি নিজেই তোমাকে তোমার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবো। ”
মেঘ বিরক্তির স্বরে বললো
“দেখুন এবার কিন্তু বারাবারি হয়ে যাচ্ছে বলে দিলাম। ভালোয় ভালোয় আমাকে যেতে দিন। নাহলে আমার বাবাই এসব জানতে পারলে ব্যাপারটা আপনার জন্যে মোটেও সুবিধা জনক হবে না।”
মেঘের কথা শেষ হতেই আহান ধমকের স্বরে বললো
“শাটআপ মেঘ! বারাবারি আমি করছি না। বারবারি টা তোমার বাবাই করছে। তোমার কাছে মামনিকে দোষী বানিয়ে দিয়ে নিজে ভালো সাজছে। তোমাকে শুধু এটা বলা হয়েছে যে তোমার মা তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু কেনো ছেড়ে চলে গেছে সেই কারনটা কি তুমি আদৌ জানো?”
মেঘ কঠিন গলায় বললো
“না জানি না। আর জানতেও চাই না। আমাকে আমার বাবাই যতোটুকু বলেছে,আমার শুধু ততোটুকু জানলেই হবে। এর বেশি কিছু জানার আগ্রহ আমার একদমই নেই।”
“আগ্রহ নেই বললে তো হবে না মেঘ। তুমি নিজের মাকে এভাবে ভুল বুঝে উল্টাপাল্টা ব্লেম করতে পারো না। এক তরফা কথা শুনে কাউকে বিচার করাটা অন্যায়।”
আহানের কথা শেষ হতেই মেঘ ঝাঝালো কন্ঠে বললো
“খবরদার ওই মহিলাকে ভুলেও আমার মা বলবেন না। উনি আমার কেউ হন না। আমি জিবনে কোনোদিন ওনার নামটাও শুনতে চাই না। আর আপনার থেকে এসব ফালতু কথা শোনার ইচ্ছেও আমার নেই। তাই আমাকে এসব বলে একদম আমার ব্রেন ওয়াশ করার চেস্টা করবেন না।”
মেঘের কথা শুনে আহানের রাগ উঠে গেলো। যেখানে ওর মুখের উপরে উল্টে কথা বলার আগেও মানুষ একশো বার ভেবে বলে। সেখানে মেঘ ওকে সরাসরি অপমান করছে? মেঘের জায়গায় এখানে অন্য কেউ থাকলে এতোক্ষনে আহান তাকে চড় মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দিতো। কিন্তু আফসোস এই মুহূর্তে মেঘকে হার্ট করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে ওর নেই। মেঘ স্পষ্ট খেয়াল করলো রাগে আহানের পুরো চেহারা লাল টমেটোর মতো হয়ে গেছে। কিন্তু মেঘ সেদিকে পাএা দিলো না। আহান সোজা হয়ে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ির ফ্রন্ড সিটের পিছনে একটা পাঞ্চ করলো। তারপর সিটের উপর থেকে পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানিটা শেষ করে ফেললো। মেঘ চোখ ছোট ছোট করে আহানের কান্ড দেখছে। আহান পানির বোতলটা সাইডে রেখে আবারও মেঘের দিকে ঘুড়ে বসলো। তারপর নরম স্বরে বললো
“ওকে ফাইন! আমি তোমাকে মামনীর বিষয়ে একদম কোনো কথা বলবো না। কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে এটা বলো যে তুমি যার নামটাও শুনতে চাও না,তার সাথে দেখা করার জন্যে তুমি বাংলাদেশে এসেছো কেনো? তাও আবার নিজের বাবাকে না জানিয়ে।”
মেঘ শক্ত কন্ঠে বললো
“সেটা নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই?”
আহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
“ওকে কোনো ব্যাপার না। তোমাকে কিছু শুনতেও হবে না আর বলতেও হবে না। আমি নিজেই সবটা খুজে বের করতে পারবো। হয়তো একটু সময় লাগবে বাট সবটা জেনে যাবো।”
মেঘ ভেংচি কেটে বললো
“যতোটা সহজ ভাবে বলছেন। সবকিছু বের করা এতোটাও সহজ না। তাই বলছি এসবের পিছনে অযথা মাথা ঘামিয়ে নিজের সময় নষ্ট করবেন না। তারচেয়ে এসবের থেকে দূরে থাকাটাই আপনার জন্যে ভালো হবে।”
মেঘের কথা শেষ হতেই আহান মেঘের দিকে কিছুটা ঝুকে ওর নাক টেনে দিয়ে বললো
“সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না পুচকি। তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো। আমি কোনটাতে মাথা ঘামাবো আর কোনটাতে ঘামাবো না সেটা নাহয় আমি নিজেই বুঝে নেবো। এসব ভেবে তোমার ছোট্ট মাথায় এতো জোড় দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
মেঘ নাক চেপে ধরে আহানের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। একে তো আহান ওর নাক টিপে দিয়েছে তার উপর ওকে পুচকি বলে ডাকছে। আহানের মুখে পুচকি ডাক শুনে মেঘের নিজেকে কেমন বাচ্চা টাইপ মনে হচ্ছে। আহান মেঘের রাগি ফেইসের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। তারপর নিজের হাত দিয়ে আলতো করে মেঘের দু’গাল টিপে দিয়ে বললো
“তুমি জানো, রেগে গেলে তোমাকে একদম কিউট বাচ্চাদের মতো লাগে? ছোট বেলায় যখন তুমি রেগে ঠোট ফুলিয়ে বসে থাকতে তখন আমি জোড়ে তোমার গাল টিপে দিতাম। আর তুমি ব্যাথায় ভ্যা ভ্যা করে কেদে দিতে। আর তারপর যখন তোমার কান্না থামানোর জন্যে তোমাকে কোলে নিতে চাইতাম তখন তুমি দৌড়ে পালাতে।”
কথাটা বলে আহান আবারো ঠোট চেপে হাসলো। আর মেঘ নিজের গালে হাত দিয়ে কাদো কাদো মুখ করে বসে রইলো।
__________________________
রাত 10:30
ফুড ট্রলিতে খাবার এনে মিহিরের রুমের দরজার সামনে দাড়ালো সাঈফা। তারপর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে পা টিপে টিপে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলো। দেখলো রুমের মধ্যে কেউ নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাঈফা বুঝলো মিহির ওয়াশরুমে আছে। ‘ও’ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফুড ট্রলি থেকে খাবারের প্লেটগুলো টি-টেবিলের উপর রেখে বাইরে যাওয়ার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু দু-কদম এগোতেই মিহির পিছন থেকে বলে উঠলো
“তুই আমার রুমে কি করছিস?”
মিহিরের প্রশ্ন শুনে সাঈফার কলিজার মধ্যে ধক করে উঠলো। ‘ও’ যেই ভয়টা পাচ্ছিলো ঠিক সেটাই হলো। সাঈফাকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মিহির এগিয়ে এসে ওর সামনে দাড়ালো। তারপর ভ্রু কুচকে বললো
“কিরে এভাবে স্টাচু হয়ে দাড়িয়ে আছিস কেনো? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো? আমার রুমে কেনো এসেছিস? আর ভিতরে ঢুকলিই বা কি করে?”
মিহিরের প্রশ্ন শুনে সাঈফার গলা শুকিয়ে গেলো। ‘ও’ শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো
“লাস্ট এক সপ্তাহ ধরে তুমি নাকি ফুপি মনির সাথে কথা বলছো না। আর বাসার কোনো খাবারও খাচ্ছো না। সারাক্ষন শুধু বাইরে বাইরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছো। তাই আমি তোমার খাবারটা রুমে নিয়ে আসলাম।”
সাঈফার কথা শেষ হতেই মিহির ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললো
“কেনো এনেছিস? আমি কি তোকে খাবার নিয়ে আসতে বলেছি?”
মিহির এতো জোড়ে গাল টিপে ধরায় ব্যাথায় সাঈফার চোখের কোনে পানি চিকচিক করতে লাগলো। ‘ও’ দু-হাত দিয়ে টেনে গাল থেকে মিহিরের হাত সরানোর চেস্টা করলো। কিন্তু মিহিরের শক্তির সাথে পেরে উঠলো না। তাই ‘ও’ অসহায় দৃস্টিতে মিহিরের দিকে তাকিয়ে বললো
“এভাবে প্রত্যেক বেলা বাইরের খাবার খেলে তোমার শরীর খারাপ করবে। তাই ভাবলাম রুমের মধ্যে খাবারটা রেখে গেলে তুমি হয়তো খেয়ে নিবে।তার জন্যে খাবারটা এখানে নিয়ে আসলাম।”
সাঈফার কথা শেষ হতেই মিহির দাতে দাত চেপে বললো
“আমার ব্যাপার নিয়ে তোকে এতো নাক গলাতে কে বলেছে? মনে হচ্ছে অনেক দিন পযর্ন্ত তোকে চড় থাপ্পড় কিছুই দেওয়া হয় না। তাই যতো দিন যাচ্ছে তোর সাহস একটু বেশিই বেড়ে গেছে তাইনা? সমস্যা নেই, কানের নিচে কয়েকটা পড়লেই সব সাহস জানালা দিয়ে ফুশ করে পালিয়ে যাবে।”
কথাটা বলে মিহির ঝটকা মেরে সাঈফার গাল থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে ফেললো। এতে সাঈফা দু-পা পিছিয়ে গেলো। মিহির ওর দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে খপ করে ওর হাতটা ধরলো। তারপর হাত ধরে টানতে টানতে ওকে দরজার কাছে নিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলো। ধাক্কা খেয়ে সাঈফা পড়ে যেতে নিয়েও আবার নিজেকে সামলে নিলো। মিহির হুমকির স্বরে বললো
“ভবিষ্যতে কখনো যদি দেখেছি আমার পারমিশন না নিয়ে তুই আমার রুমে প্রবেশ করেছিস, তাহলে তোর ঠ্যাং দুটো ভেঙে আমি তোর বাবা-মাকে পার্সেল করে দেবো। কথাটা মনে থাকে যেনো।”
কথাটা বলে মিহির ঠাস করে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। সাঈফা হাত দিয়ে চোখের কোনে জমে থাকা পানি টুকু মুছে নিয়ে বিরবির করে বললো
“শালা খারুচ, তোর মতো বজ্জাতের রুমে আমি কেনো আমার জুতাও প্রবেশ করবে না।”
কথাটা বলে সাঈফা হনহন করে নিচে চলে গেলো। আর মিহির গিয়ে ধপ করে বিছানার উপরে শুয়ে পড়লো। চারপাশের সবকিছু প্রচন্ড রকম অসহ্য লাগছে ওর। যেদিন থেকে জেনেছে মায়াই আসলে মেঘ। সেদিন থেকে ওর নিজের প্রতিই নিজের ঘৃনা হচ্ছে। মিহির এটাই ভেবে পাচ্ছে না যে মেঘ ওর এতোটা কাছে থাকা সর্তেও ‘ও’ কিভাবে মেঘকে চিনতে পারলো না? আর ওর মা?সে নিজের মেয়েকে তো চিনতে পারলোই না। উল্টে অন্য একটা মেয়েকে এতোদিন পযর্ন্ত নিজের মেয়ে ভেবে বসে ছিলো। তার উপর সেদিন ওতো গুলো লোকের মধ্যে বসে কিছু না জেনে, না বুঝে মেঘের গায়ে হাত তুললো। আর ওরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে নিরব দর্শকের মতো সবটা দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারলো না। মিহির ওর মাথার চুলগুলো শক্ত করে হাত দিয়ে মুঠো বন্ধি করে নিলো। তারপর শোয়া থেকে উঠে বসে দু-হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলো। কাদতে কাদতে একা একাই বলে উঠলো
“সরি রে! আই অ্যাম ভেরি সরি। সমস্ত বিপদ থেকে তোকে সব সময় আগলে রাখার দ্বায়ীত্বটা তো আমারই ছিলো। কিন্তু উল্টে আমিই তোকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছি। তোকে আমি অনেকটা কস্ট দিয়েছি। এখন আমি কোন মুখে তোর কাছে ক্ষমা চাইতে যাবো? আমি নিজেই তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না বোনু।”
কথাটা বলে মিহির আরো জোড়ে কেদে দিলো।
#চলবে…….